এ ফিচারে মূল অংশে প্রবেশ করার পূর্বে লেখার উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করার জরুরি। ‘রোর বাংলা প্লেয়ার্স অফ দ্য মান্থ’ সেগমেন্টটি রোর বাংলার পাঠকদের কথা ভেবে চালু করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ফুটবলে সব থেকে জনপ্রিয় লিগ হচ্ছে পাঁচটি। আর লিগ বাদে অনান্য প্রতিযোগিতা হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগ। মাসিক ধারাবাহিক এ লেখায় ইউরোপে সব থেকে জনপ্রিয় লিগ ও দুই প্রতিযোগিতা থেকে এক মাসের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হবে। যেমন: লা লিগা থেকে এক মাসে যেকোনো পজিশনে সেরা পারফরম্যান্স করা একজন, প্রিমিয়ার লিগ থেকে একজন। এভাবে বুন্দেসলিগা, সিরি ‘আ’ ও লিগ ওয়ান থেকে বাছাই করা হবে মোট ৫ জন খেলোয়াড়কে। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগ থেকে ২ জনকে নিয়ে মোট ৭ জন সেরা খেলোয়াড়কে নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।
প্রত্যেক লিগ থেকে খেলোয়াড় বাছাই করা হবে পুরো মাসজুড়ে তাদের গোল, অ্যাসিস্ট, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে। একজন আক্রমণাত্মক ফুটবলারের ক্ষেত্রে গোল ও অ্যাসিস্ট বেশি প্রাধান্য পাবে। মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের জন্য সেটা পাল্টে যাবে পাসিং অ্যাকুরেসি বা গোল সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে। আর ডিফেন্ডারের জন্য অবশ্যই ক্লিনশিট, ট্যাকল, ক্লিয়ারেন্স, শট ব্লকের মতো বিষয়গুলো উঠে আসবে। যদিও প্রতি মাসের সেরা খেলোয়াড় প্রতিটা লিগও নির্বাচন করে। তবে রোর বাংলা তাদের পরিসংখ্যান ও তথ্য অনুসরণ করবে না। আশা করি পাঠকদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে। এবার লেখার মূল অংশে যাওয়া যাক।
প্রিমিয়ার লিগ – কেভিন ডি ব্রুইন, ম্যানসিটি
বর্তমান ফুটবলের সেরা মিডফিল্ডারের তালিকা তৈরি করলে তালিকার বেশ উপরেই পাওয়া যাবে কেভিন ডি ব্রুইনের নাম। বেলজিয়ান এই সুপারস্টার পেপ গার্দিওলার দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে গত মৌসুমের অধিকাংশ সময়েই ডি ব্রুইন ইনজুরির খড়্গে পড়ে নিয়মিত মাঠে নামতে পারেননি। ম্যানসিটিতে তারার মেলা বলে ডি ব্রুইনের অনুপস্থিতি পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তবে এ মৌসুম থেকে মাঠে নিয়মিত হবার পর ডি ব্রুইন বুঝিয়ে দিয়েছেন, ম্যানচেস্টার সিটিতে সময়ের সেরা মিডফিল্ডাররা থাকলেও কেন তিনি সবার থেকে ব্যতিক্রম।
সেপ্টেম্বর মাসে ম্যানচেস্টার সিটি প্রিমিয়ার লিগে মোট ৩টি ম্যাচ খেলেছে। এবারের প্রিমিয়ার লিগে সিটিজেনদের প্রথম ম্যাচ ছিল ওয়েস্টহ্যামের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচ থেকেই ডি ব্রুইন ছিলেন ছন্দে। গত মাসে বোর্নমাউথের বিপক্ষে পুরো ম্যাচ খেলে ৮৬ বার বল স্পর্শ করার পাশাপাশি ৮০ শতাংশ সঠিক পাস দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ব্রাইটনের বিপক্ষে। সে ম্যাচেও তার পরিসংখ্যান বিগত ম্যাচের মতোই। ব্রাইটনের বিপক্ষে ৬৯ মিনিট খেলে ১ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে ম্যানসিটিকে বড় জয় এনে দিতে সহায়তা করেন ডি ব্রুইন।
ডি ব্রুইন একজন পূর্ণাঙ্গ প্লে-মেকার। গোল করার পাশাপাশি গোল করানোতে তার জুড়ি নেই। আর গার্দিওলার মতো কোচের অধীনে তিনি ম্যানসিটির ‘ইঞ্জিন’-এর দায়িত্ব পালন করেন। মধ্যমাঠ থেকে প্রত্যেকটা আক্রমণের সূচনা হয় তাকে কেন্দ্র করেই। আর এ মৌসুমে তাকে আরও ভিন্ন রোলে দেখা যাচ্ছে। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ভূমিকায় থাকা রদ্রি প্রতিপক্ষের আক্রমণকে একাই সামাল দিচ্ছেন। তাই ডি ব্রুইন অথবা ডেভিস সিলভাকে মধ্যমাঠের রক্ষণ নিয়ে বিশেষ ভাবতে হচ্ছে না। আর বার্নাডো সিলভা, আগুয়েরো ও স্টার্লিংদের উপর গোল করার সম্পূর্ণ ভার। তাই ডি ব্রুইন এ মৌসুম থেকে আক্রমণ গড়ে দেবার কাজেই বেশি মনোযোগী।
গত মাসের মধ্যভাগে নরউইচের মাঠে ডি ব্রুইনকে বিশ্রামে রেখে স্কোয়াড সাজিয়েছিলেন গার্দিওলা। তখনই ফুটে উঠেছে ডি ব্রুইন এর কারুকাজ। মধ্যমাঠ থেকে শৈল্পিক পাসগুলোকে প্রতি মূহূর্তে মিস করছিলেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা। ফলে মৌসুমের প্রথম হারের দেখা মেলে সে ম্যাচে। তবে নতুন মৌসুমে ডি ব্রুইন থাকলে কখনোই ভুগতে হয়নি ম্যানসিটিকে।
সেপ্টেম্বর মাসে লিগে ৩ ম্যাচে কেভিন ডি ব্রুইন করেছেন ১ গোল ও ৩ অ্যাসিস্ট। ওয়াটফোর্ড ও এভারটনের বিপক্ষে ম্যাচে পেপ গার্দিওলার দলের আক্রমণের প্রাণভোমরা ছিলেন তিনি। আর তার নান্দনিক ফুটবল তো আর লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এছাড়াও প্রিমিয়ার লিগে ‘টিম অফ দ্য উইক’-য়ে জায়গা করে নিয়েছে একবার। তাই সাদিও মানে বা বার্নাডো সিলভারা পুরো মাস দারুণ ছন্দে থাকলেও সেপ্টেম্বরের সেরা খেলোয়াড় অবশ্যই কেভিন ডি ব্রুইন।
বুন্দেসলিগা – ফিলিপে কৌতিনহো, বায়ার্ন মিউনিখ
বার্সেলোনাতে কৌতিনহোর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল, কৌতিনহো তার নিজস্ব পজিশনে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কারণ, কৌতিনহো হলেন পুরোদস্তুর অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, বা একজন প্লে-মেকার। কিন্তু বার্সেলোনার প্লে-মেকারের দায়িত্ব সবসময়ই লিওনেল মেসির। তাই কৌতিনহোর বার্সেলোনার প্লে-মেকার হবার আশায় গুড়েবালি। কৌতিনহোকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, তেমনই লেফট-উইঙ্গার পজিশনও তার জন্য নয়। এজন্য বার্সেলোনায় কৌতিনহো তার নিজস্ব ফর্মে ফিরতে পারেননি। বায়ার্ন মিউনিখে নিকো কোভাচ ব্যবহার করেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশন। যেখানে ৩ জনের মিডফিল্ডার লাইনআপে কৌতিনহো খেলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে, এবং নিজের পুরনো পজিশন ফিরে পেয়েই ধীরে ধীরে খোলস থেকে বের হতে শুরু করেছেন এই ব্রাজিলিয়ান।
বুন্দেসলিগায় কৌতিনহোর অভিষেক হয় শালকের বিপক্ষে। তবে তিনি তার নিজস্ব ফর্মে ফিরেছেন গত মাসের ম্যাচগুলো দিয়ে। সেপ্টেম্বরে বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের প্রথম ম্যাচে একাদশে ছিলেন না কৌতিনহো। তবে তিনি ফিরেছিলেন পাডারবর্ন ও কোলনের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। কোলনের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি ১ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে মাঠে সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। সে ম্যাচে তার অ্যাকুরেট পাসিং রেট ছিল ৮৫ শতাংশ। কী পাস ৭টি। পরের ম্যাচে পাডারবর্নের বিপক্ষেও কৌতিনহোর ‘ব্যাক-টু-ব্যাক’ পারফরম্যান্স। স্যার্জি নাবরিকে দিয়ে এক গোল করিয়ে নিজেও বুন্দেসলিগায় দ্বিতীয় গোল করতে সক্ষম হয়েছেন। আর পুরো ম্যাচে তার পাসিং স্কিল ও ড্রিবল ছিল মনঃমুগ্ধকর।
পাডারবর্ন ও কোলনের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলার সৌজন্যে টানা দুইবার বুন্দেসলিগা ‘টিম অফ দ্য উইক’-এ জায়গা হয়েছিল তার। বার্সেলোনার হয়ে ভুলে যাওয়ার মতো একটি মৌসুম পার করার পর নতুন দলে পুরনো কৌতিনহোকে ফিরে পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো বায়ার্ন মিউনিখের বুন্দেসলিগা জয়ের মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছেন এই ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেন।
লা লিগা – করিম বেনজেমা, রিয়াল মাদ্রিদ
রিয়াল মাদ্রিদে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নেই। এডেন হ্যাজার্ড মৌসুমের শুরু থেকে ইনজুরি বাধায় মাঠের বাইরে। গ্যারেথ বেল ফিট থাকলেও ধারাবাহিকতা তার কখনোই ছিল না। তাহলে দলের গোল দেবার দায়িত্ব কে নেবে? এই দায়িত্ব মৌসুমের শুরু থেকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন বর্তমান লা লিগা ও রিয়াল মাদ্রিদের বিতর্কিত স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা।
লা লিগার ৭ ম্যাচে বেনজেমা করেছেন ৭ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট। প্রতি ১০২ মিনিটে বেনজেমা গোল করেছেন। বলা যায়, প্রায় প্রতি ম্যাচেই তার গোল রয়েছে।
এবার গত মাসের ম্যাচগুলো সম্পর্কে বলা যাক। সেপ্টেম্বর মাসে রিয়াল মাদ্রিদের শুরু হয় ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে। পরের ম্যাচে লেভান্তের বিপক্ষে বেনজেমা যদি প্রথমার্ধে দুই গোল করতে সক্ষম না হতেন, মৌসুমে হারের তিক্ত স্বাদ জিদানবাহিনী খুব দ্রুত পেয়ে যেত। এ মাসে ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের সব থেকে কঠিন ম্যাচ ছিল সেভিয়ার বিপক্ষে। কারণ, সিজনের প্রথম থেকেই লোপেতেগির শিষ্যরা দারুণ ফুটবল খেলছিল। সে ম্যাচে একমাত্র গোলে জেতে রিয়াল মাদ্রিদ। ৬৪ মিনিটে দুর্দান্ত হেডে করা সেই একমাত্র গোলটি ছিল করিম বেনজেমার। সে ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে ৮ ম্যাচ খেলার পর লা লিগায় সর্বোচ্চ গোলদাতাও এই ফরাসি স্ট্রাইকার।
৪ ম্যাচে ৩ গোল, সেভিয়ার বিপক্ষে জয়ের নায়ক, টানা দুই সপ্তাহ লা লিগা ‘টিম অফ দ্য উইক’-এ জায়গা করে নেওয়া বেনজেমা অবশ্যই লা লিগায় সেপ্টেম্বর মাসের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পাবার যোগ্য।
লিগ ওয়ান – নেইমার, পিএসজি
কোপা আমেরিকা শুরুর আগে গুরুতর ইনজুরি। তারপর বার্সেলোনায় ফেরত আসা নিয়ে নাটকের পর নেইমারের পিএসজির ক্যারিয়ার ছিল খাদের কিনারায়। এমনকি কোচ টমাস টুখেল চাননি দলবদলের নিয়ে এ বিবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নেইমার মাঠে নামুন। তাই এবারের মৌসুম শুরু থেকে খেলা তার সম্ভব হয়নি। ‘১৯-‘২০ মৌসুমের প্রথম ম্যাচে নেমেও স্বস্তিতে খেলতে পারেননি তিনি। ঘরের মাঠে পুরো গ্যালারি যেন তার বিরুদ্ধে। ঘরের মাঠে নিজের সমর্থকদের ব্যু, অশ্লীল পোস্টারের অপমানে জর্জরিত হবার পর হাতে-কলমে নেইমার বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তিনি।
ঘরের মাঠে স্টার্সবার্গের বিপক্ষে ম্যাচ। নতুন মৌসুমে প্রথমবার নেইমার পিএসজির হয়ে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু একের পর এক অ্যাটাকের পরও গোলের দেখা নেই। অথচ সেই প্রথম মিনিট থেকে নেইমারকে ব্যু দিয়ে যাচ্ছে পিএসজি সমর্থক। কিন্তু সেদিনের কাঙ্ক্ষিত জয় এসেছিল ৯২ মিনিটে নেইমারের দুর্দান্ত এক গোলে। পরের ম্যাচে অলিম্পিক লিঁও’র ম্যাচেও একই দশা। ম্যাচের নাটাই পিএসজির হাতে, কিন্তু গোলের দেখা নেই। সেদিনের জয়ের নায়কও নেইমার। অন্তিম মুহূর্তে তার একমাত্র গোলে অ্যাওয়ে ম্যাচে জয় পেয়েছিল পিএসজি।
স্টেদ দ্য রেইমের বিপক্ষে ম্যাচকে অঘটনই বলা চলে। ঘরের মাঠে সেদিন নেইমারসহ পুরো দলই কোনো সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী ম্যাচে বোর্দোর মাঠে আবারও নেইমারের উপর ভর করে ম্যাচ জিতল তারা। ৭০ মিনিটে এমবাপের অ্যাসিস্টে চলতি মৌসুমের তৃতীয় গোল করেন নেইমার।
গত মাসে ৪ ম্যাচ খেলেছেন নেইমার। তাতে তার গোলসংখ্যা ৩টি। অলিম্পিক লিঁও’র বিপক্ষে ম্যান অফ দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত সাফল্য থেকে দলগত সাফল্য বেশি প্রশংসনীয়। কারণ, নেইমারের করা ৩টি গোলের ফলেই ৩টি ম্যাচ জিতেছে পিএসজি। আর নেইমারের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স? প্রত্যেক ম্যাচ ছিল তার দুর্দান্ত ড্রিবল, ডিফেন্সচেরা পাসের ছড়াছড়ি। তড়িৎগতির কাউন্টার অ্যাটাক গড়ে তুলে নাচিয়ে ছেড়েছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণকে।
সিরি ‘আ’ – স্টেফানো সেনসি, ইন্টার মিলান
আন্তোনিও কন্তের অধীনে নতুন জীবন পেয়েছে ইন্টার মিলান। ৩-৫-২ ফর্মেশনে দুর্দান্ত খেলার পেছনে সব থেকে বড় অবদান মিলানের বর্তমান মধ্যমাঠের। আরও পরিষ্কার করে বললে উঠে আসবে নিকোলা বারেল্লা ও স্টেফানো সেনসির নাম। উভয়েই মিলানের হয়ে খেলছেন এই মৌসুম থেকে। বারেল্লা ও সেনসি দুজনই ‘রেজিস্তা’ ঘরনার খেলোয়াড়। এদেরকে উদাহরণ দেওয়া যায় বার্সেলোনার জাভি, আর্থুর বা রিয়াল মাদ্রিদের ক্রুসের সাথে। তবে সেনসি আরেক কাঠি সরেস। তিনি জাভি বা আর্থুর থেকে একটু বেশি এগিয়ে আছেন তার গোল করার দক্ষতার কারণে। তাই বলা চলে, সেনসি একজন আধুনিক ফুটবলের ‘রেজিস্তা’।
মিলানের হয়ে স্টেফানো সেনসি গত মাসে খেলেছেন পাঁচটি ম্যাচ। গোল ও অ্যাসিস্ট করেছেন যথাক্রমে দু’টি করে। তবে গোল ও অ্যাসিস্ট বিবেচনা করলে তার পারফরম্যান্স বোঝা সম্ভব নয়। ইন্টারের হয়ে অভিষেক ম্যাচে গোল ও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হওয়া সেনসির ভিশন, পাসিং ও ফার্স্ট টাচে বল আয়ত্তে আনার দক্ষতা একদম নিখুঁত। ব্রজোভিচকে নিচে রেখে বারেল্লার সাথে ডাবল পিভটে খেলা সেনসি মাঠের প্রেশার খুব ভালো পড়তে পারেন। এ কারণে ইন্টারের মধ্যমাঠে যেমন কোনো গ্যাপ তৈরি হয় না, তেমনই প্রতিপক্ষে ডি-বক্সে তার চোখ ধাঁধানো পাস মোক্ষম সময় চলে আসে লুকাকু ও লাউতারো মার্টিনেজদের কাছে। গত মাসে প্রত্যেকটা ম্যাচে দেখা গেছে তার ফার্স্ট টাচ খুবই উচ্চ পর্যায়ের। বল খুব দ্রুত আয়ত্তে এনে তিনি গোল সুযোগ তৈরি করতে পারেন।
সাধারণত ‘রেজিস্তা’ ধরনের মিডফিল্ডাররা নিখুঁত পাস ও ড্রিবলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করার প্রতি মনোযোগী থাকে। তবে অ্যাসিস্টও তুলনামূলকভাবে কম হয়। কিন্তু সেনসি মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গোল করতেও বেশ পটু। তাই, ইন্টারের হয়ে টানা তিন ম্যাচে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ নির্বাচিত হওয়া এই মিডফিল্ডার সিরি ‘আ’-তে সব থেকে বেশি নজর কেড়েছেন।
চ্যাম্পিয়নস লিগ – আনহেল ডি মারিয়া, পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগের ‘এ’ গ্রুপের প্রথম ম্যাচ। ঘরের মাঠে খেলা হলেও পিএসজি তেমন স্বস্তিতে ছিল না। রিয়াল মাদ্রিদের একাদশে হ্যাজার্ড, বেনজেমা, ক্রুসরা থাকলেও ইনজুরির কারণে ম্যাচের আগে ছিটকে গিয়েছিলেন এমবাপে, কাভানি। আর নেইমার তো নেই আরও আগে থেকেই। দলের মূল আক্রমণত্রয়ী যদি না থাকে, তবে আক্রমণভাগের দায়িত্ব কে নেবে! সেই দায়িত্ব নিলেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ উইঙ্গার ডি মারিয়া। নিজেদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ব্যবধান গড়ে দিতে তার লেগেছে মাত্র ৩৩ মিনিট।
প্রথমার্ধের ১৪ মিনিটে বার্নেট ক্রস করেছিলেন ডি-বক্সে। সেখানে উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছিলেন ডি মারিয়া। কোনোমতে পা বলে লাগানোর ফলে চোখের পলকে ঘুরে গেছে বলের গতি। ফলাফল, কোর্তোয়াকে বোকা বানিয়ে লস ব্লাঙ্কোসদের জালে প্রথম গোল। দ্বিতীয় গোল আসে ৩৩ মিনিটে। ইদ্রিস গানা মাঠের ডান পাশ থেকে বল নিয়ে দুর্দান্ত পাস দিয়েছিলেন ডি-বক্সে থাকা ডি মারিয়াকে। আর্জেন্টিনা উইঙ্গারের নিখুঁত শট কোর্তোয়াকে পরাস্ত করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচে ফিরলেও ডি মারিয়া ছিলেন দারুণ ছন্দে। একাই নাচিয়েছেন লস ব্লাঙ্কোসদের রক্ষণ। হ্যাটট্রিকও হয়ে যেত, শুধু সে শট নিখুঁত ছিল না বলে রিয়ালের জাল খুঁজে পায়নি। তবে পিএসজি তৃতীয় গোলেও তার পরোক্ষ ভুমিকা আছে। থমাস মুনিয়ের গোলে বার্নাড অ্যাসিস্ট করলেও আক্রমণ গড়ে তুলেছিলেন ডি মারিয়া।
৯০ মিনিটে যেভাবে তিনি খেলেছেন, পিএসজি এক মুহূর্তের জন্যও নেইমারকে মনে করেনি। প্যারিসে রিয়ালকে নাজেহাল করা ম্যাচে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম রাউন্ডের টিম অফ দ্য উইকেও।
ইউরোপা লিগ – বুকায়ো সাকা, আর্সেনাল
১৮ বছর বয়সী বুকায়ো সাকা প্রথমবারের মতো আর্সেনালের মূল দলে জায়গা পেয়েছিলেন লাকাজেটের ইনজুরির জন্য। তবে প্রিমিয়ার লিগে ওয়াটফোর্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে তার অভিষেক হয়নি। কিন্তু ইউরোপা লিগের প্রথম ম্যাচে আইনখ্রানট্ ফ্রাঙ্কফুটের বিপক্ষে সরাসরি তাকে নামিয়ে দেন গানার্স কোচ উনাই এমেরি।
আইনখ্রানট্ ফ্রাঙ্কফুট তেমন বড় কোনো ক্লাব না হলেও, জার্মানিতে তাদের মাঠে খেলা কোনো দলের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। আর এই ম্যাচে এমেরি দ্বিতীয়বার না ভেবেই ক্লাবের তরুণ তুর্কিদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাদের ভেতর সব থেকে ভালো খেলেছেন ১৮ বছর বয়সী বুকায়ো সাকা। গানার্সদের প্রথম গোলটি আসে জোসেপ উইলকের পা থেকে। আর সেই গোলটি তৈরি করে দিয়েছিলেন সাকা-ই। ৮৫ মিনিটে জয় নিশ্চিত করা গোলটি আসেও তার পা থেকে। মিনিট দুয়েক পর সাকার দুর্দান্ত অ্যাসিস্টে কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেন এমরিকে অবামেয়াং।
৯০ মিনিট খেলে ২ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হওয়া সাকা পুরো ম্যাচে ৭২ শতাংশ সঠিক পাস দিয়েছেন, অন টার্গেটে শট ২টি। ডেমবেলে, গ্যানাব্রি বা কিংসলি ক্যোমানের মতো সাকাও চকিতে পাস দেয়া-নেয়া করে দুর্দান্ত গতিতে আক্রমণে যেতে পারেন। কিন্তু ফিনিশিং টাচ ও পাসিং অ্যাকুরেসি ঠিকঠাক হলেও তার নিয়ন্ত্রণ ভালো নয়। তাই পুরো ম্যাচে পজেশন হারিয়েছেন ২২ বার। তবে তার পাস ও দারুণ ফিনিশিং টাচের নিচে পজেশন হারানোর পরিসংখ্যান চাপা পড়ে গেছে।
অভিষেক ম্যাচে স্বস্তির জয় এনে দেওয়া সাকার পারফরম্যান্সে সম্ভবত উনাই এমেরি বিস্মিত। তার বয়সী সকল তরুণ তুর্কির ভেতর এমন দক্ষতা খুঁজে পাওয়া যায় না, যতটা তার আছে। তাই বল হারানোর প্রবণতা এবং ভারসাম্য ঠিক করাতে সাকা যত দ্রুত উন্নতি করতে পারবেন, আর্সেনাল ও তার জন্য ততটাই ভালো। হয়তো গানার্স কোচ সাকাকে ইউরোপার ম্যাচগুলোতে নিয়মিত খেলোনোর পরিকল্পনা করছেন।
এই সাতজন খেলোয়াড় বাদেও বিশেষভাবে বলতে হয় ফ্লোরেন্তিনার হয়ে গত মাসে ফ্রাঙ্ক রিবেরির পারফরম্যান্স। তার বয়স হয়ে গেছে ৩৬ বছর। পুরো ৯০ মিনিট একটানা খেলে যাবার শক্তি আর গতি কোনোটিই নেই। তবে এখনও তার পারফরম্যান্স দেখে বোঝা যায়, ছুরিতে মরচে পড়লেও সেরা সময়ের তীক্ষ্ণতার প্রমাণ এখনও বিদ্যমান। লা লিগায় দারুণ খেলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ থেকে লোনে থাকা মার্টিন ওডেগার্ড ও ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসে নিজেকে ফিরে পাওয়া স্যান্তি ক্যাজোর্লা। চ্যাম্পিয়নস লিগে বিস্মিত করেছেন রেড স্টার সালজবুর্গের ১৯ বছর বয়সী বিস্ময় বালক এরভিং হালান্ড। গেঙ্কের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়েছেন তিনি।