ফ্রান্সিস উইমেট: গলফের এক কিংবদন্তী

সেপ্টেম্বর ২০, ১৯১৩। স্যাঁতস্যাঁতে এক দিন। কয়েকদিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই মাটি ভেজা। গাছের পাতা থেকে চুইয়ে পড়ছে পানি।

ম্যাসাচুসেটসের ব্রুকলিন কান্ট্রি ক্লাবে পর্দা নামতে যাচ্ছে সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ইউএস ওপেন গলফ টুর্নামেন্টের। বিখ্যাত ব্রিটিশ পেশাদার গলফার হ্যারি ভার্ডন আর টেড রে প্রত্যাশিতভাবেই শেষ রাউন্ডে উঠেছেন। তাদের প্রতিপক্ষ বিশ বছরের এক স্থানীয় তরুণ অপেশাদার গলফার, ফ্রান্সিস উইমেট (Francis Ouimet)। ভার্ডন আর রে তার নাম টুর্নামেন্টের আগে কোনোদিনও শোনেননি। মূলত স্থানীয় দর্শকদের মাঠে টেনে আনার জন্যই ইউএস গলফ অ্যাসোসিয়েশন তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু এই অপেশাদার উইমেটই সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে গেছে প্লে অফ রাউন্ডে, বিজয়ী হবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সময়ের দুই সেরা গলফারের সাথে। এখনকার দিন হলে মনে করুন টাইগার উডস আর ররি ম্যাকইলরয়ের বিরুদ্ধে খেলছে সবে গলফ শেখা এক স্কুলবালক।

উইমেটের এ পর্যায়ে আসাটা যতটা আশ্চর্যজনক, ঠিক ততটাই চমকাতে হয় তার ক্যাডির (গলফারের সাজসরঞ্জাম বহনকারী সহকারী) দিকে তাকালে। ৪ ফুটের মতো লম্বা দশ বছরের এডি লাউরি (Eddie Lowery) স্কুল পালিয়ে উইমেটের ক্যাডির কাজ করছে। তার কাঁধে ঝুলে থাকা গলফের ক্লাবগুলো (যা দিয়ে বল মারা হয়) তার থেকেও লম্বা। কিন্তু লাউরির মধ্যে উৎসাহের কোনো অভাব নেই। প্রথম দিন থেকেই তার স্থির বিশ্বাস- উইমেটই জিতবে। তার আত্মবিশ্বাস উইমেটের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।   

মাঠের চারদিকে হাজারও দর্শক, সবাই এসেছে ঘরের ছেলের সমর্থনে। তুমুল প্রতিযোগিতায় একপর্যায়ে টেড রে ছিটকে গেলে জয়ের জন্য খেলা কেন্দ্রীভূত হলো ভার্ডন আর উইমেটের মধ্যে। দুই ইস্পাতদৃঢ় স্নায়ুর টক্করে প্রথমে পা হড়কাল ভার্ডনের। ইউএস ওপেনের ইতিহাসে যোগ হলো এক নতুন অধ্যায়, এর আগে কোনো অপেশাদার গলফার এখানে বিজয়ী হয়নি। হর্ষোৎফুল্ল জনতা কাঁধে তুলে নিল উইমেট আর লাউরিকে। লাউরির জন্য চাঁদা তুলতে একটি হ্যাট সবার হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি, কিন্তু উইমেটের বিজয় ছিল গলফের বিজয়, কারণ অবিশ্বাস্য এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই আমেরিকান গলফের জগতে আসে আমূল পরিবর্তন।

হর্ষোৎফুল্ল জনতার সাথে উইমেট আর লাউরি © USGA

জন্ম

জন্ম অভিবাসী বাবা-মায়ের ঘরে, ১৮৯৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখ। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। বাবা আর্থার ফরাসি-কানাডীয়, মা মেরি এলেন আইরিশ। উইমেটের বয়স যখন চার তখন তারা ম্যাসাচুসেটসের ব্রুকলিনে এসে বাসা বাধেন। তাদের বাড়ির ঠিক উল্টোপাশেই ছিল ব্রুকলিন কান্ট্রি ক্লাব, যেখানে নিয়মিত গলফ খেলা হত।

ফ্রান্সিস উইমেট © USGA

উইমেটের বাবা ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী একজন মানুষ। সচ্ছলতার অভাবে তার প্রধান চিন্তা ছিল পরিবারের দানাপানি যোগানো। তিনি চাইতেন তার ছেলেরা দ্রুতই কোনো অর্থকরী কাজে যুক্ত হবে। গলফ খেলার চিন্তা করাও তার কাছে ছিল অপচয়ের শামিল। কারণ তখনকার সময়ে গলফে আজকের মতো কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ছড়ানো ছিল না। মূলত অভিজাত ব্রিটিশদের খেলা হিসেবেই এর পরিচিতি ছিল। আমেরিকাতেও খুব অল্প লোকেই এই খেলা খেলত। পেশাদার গলফাররা খুব বেশি টাকাকড়ি কামাতে পারত না, সমাজেও তাদের খুব একটা উঁচু মর্যাদা দেয়া হত না। ভার্ডন আর রে-এর মতো নামকরা গলফার, যারা নিজেরাও সমাজের নিচু তোলা থেকে সংগ্রাম করে উঠে এসেছিল, তাদেরকে পর্যন্ত ব্রিটেনেও বংশ-পরিচয়ের দোহাই দিয়ে দ্বিতীয় সারির নাগরিক বলেই গণ্য করা হত।

কিন্তু সহজাত প্রতিভার তাগিদে এমন পরিস্থিতিতেও উইমেট গলফের দিকে ঝুঁকে পড়েন। গলফ কোর্সের উল্টোদিকে থাকার কারণে প্রায়ই হারিয়ে যাওয়া বল খুঁজে পেতেন তিনি। তার ভাই উইলফ্রেড ব্রুকলিন কান্ট্রি ক্লাবে ক্যাডির কাজ করতেন, সেই টাকা জমিয়ে পুরনো একটি গলফ ক্লাব কেনেন তারা। এরপর উইমেট আর উইলফ্রেড মিলেমিশে প্র্যাকটিস করতে থাকেন। বাড়ির পেছনের উঠোনে তিনটি গর্ত করে তারা গলফ কোর্সের মতো করে বানান, এরপর সেখানে বাবার চোখ এড়িয়ে চলতে থাকে খেলা।

নয় বছর বয়সে উইমেট নিজেই কান্ট্রি ক্লাবে সদস্যদের ক্যাডির কাজ শুরু করলেন। তারা অনুমতি দিলে উইমেট সেখানে প্র্যাকটিসও করতে পারতেন। প্রায়ই সকাল সকাল স্কুল আরম্ভ হওয়ার আগে তাই উইমেট সেখানে চলে যেতেন, জুতার চাপে মাটি যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য খালি পায়েই নেমে যেতেন কোর্সে। আস্তে আস্তে বাসা থেকে গাড়িতে দুই ঘণ্টার দূরত্বে বোস্টনের ফ্রাঙ্কলিন পার্কেও তিনি খেলা শুরু করেন। এই কোর্স সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৯০০ সালের ইউএস ওপেনে তিনি হ্যারি ভার্ডনের খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হন।

ব্রুকলিন কান্ট্রি ক্লাবের গলফ কোর্স ©Associated Press

দারিদ্র্যের জন্য উইমেট স্কুল শেষ করতে পারলেন না। ষোল বছর বয়সে তাকে স্কুল ছেড়ে কাজের খোঁজে নামতে হলো। সৌভাগ্যক্রমে তিনি চাকরি পেয়ে যান বোস্টনের এক খেলার সামগ্রীর দোকানে, রাইটস-ডিটসন। এর একাংশের মালিক ছিলেন বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় জর্জ রাইট। গলফের প্রতি তার অনুরাগ ছিল সর্বজনবিদিত।

অপেশাদার গলফার

ব্রুকলিন হাই স্কুলে পড়বার সময় সহপাঠীরা যখন বেসবল নিয়ে ব্যস্ত, উইমেটের হাতে তখন গলফ ক্লাব। নিত্য অনুশীলন করে নিজেকে গড়েপিটে নিচ্ছিলেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে। তিনি স্কুলের গলফ দল গঠন করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯০৯ সালে, স্কুল ছাড়ার কিছু সময় আগেই ইন্টারস্কলাস্টিক গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ (Greater Boston Interscholastic Golf Championship) প্রতিযোগিতায় উইমেট বিজয়ী হন।

রাইটস-ডিটসনে চাকরি নিলেও মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উইমেট ছুটি নিতেন। ১৯১০ থেকে শুরু করে পর পর তিন বছর তিনি ইউএস অপেশাদার গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ (U.S. Amateur Championships) খেলতে নেমে খুব বেশি দূর যেতে পারলেন না। কিন্তু ১৯১৩ ছিল তার জন্য পয়া। জুন মাসে তিনি ম্যাসাচুসেটস স্টেট অপেশাদার চ্যাম্পিয়ন হন। পরে আরো পাঁচবার তিনি এখানে জয়ী হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ইউএস অপেশাদার গলফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেকেন্ড রাউন্ডে সামান্য ব্যবধানে তিনি তৎকালীন সেরা অপেশাদারের খেতাবধারী জেরোম ট্র্যাভার্সের কাছে পরাজিত হন। জর্জ রাইটের কাছ থেকে নেয়া ছুটি ততদিনে শেষ, কাজেই উইমেট ফিরে এলেন দোকানের কাজে।

ইউএস অপেশাদার গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ-১৯১৩ © USGA

অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ

যদিও উইমেট দ্বিতীয় রাউন্ডেই ছিটকে গিয়েছিলেন, অপেশাদার গলফার হিসেবে ততদিনে তিনি পরিচিতি পেয়ে গেছেন। তার খেলাও উপস্থিত দর্শকদের প্রশংসা কুড়োতে সক্ষম হয়। নিউ ইয়র্কের প্রতিযোগিতায় উইমেটের খেলা দেখেন রবার্ট ওয়াটসন। এই ভদ্রলোক ছিলেন তৎকালীন ইউএস গলফ অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসজিএ) প্রেসিডেন্ট। উইমেটের প্রতিভা বুঝতে তিনি ভুল করেননি। সেই মাসেই শুরু হতে যাওয়া ইউএস ওপেনে তাদের আরো একজন প্রতিযোগী দরকার ছিল, আর ব্রুকলিনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রতিযোগিতায় স্থানীয় কেউ খেললে দর্শক সমাগম আরো বেশি হবে। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে তিনি উইমেটকে ইউএস ওপেনে আমন্ত্রণ জানালেন। অপেশাদার উইমেটের কাছে এটা ছিল স্বপ্নের মতো, কিন্তু তার হাতে খেলার জন্য কোনো ছুটি বাকি নেই। বছরের সব ছুটি তো শেষ। ওয়াটসন দমলেন না। রাইটের সাথে কথা বলে তিনি উইমেটের খেলার ব্যবস্থা করেন।

ইউএস ওপেন, ১৯১৩

ব্রুকলিন কান্ট্রি ক্লাবে সেই বছরের ইউএস ওপেন হবে ১৮-২০ সেপ্টেম্বর অবধি। সাধারণত ইউএস ওপেন আরো আগে হবার কথা থাকলেও ব্রিটিশ কিংবদন্তী গলফার হ্যারি ভার্ডন আর ব্রিটিশ ওপেন গলফের তৎকালীন বিজয়ী টেড রে-কে খেলার সুযোগ করে দিতে তা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেছানো হয়, কারণ তারা দুজনেই এর আগে অন্যান্য প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকবেন। ভার্ডন তখন অবধি পাঁচবার ব্রিটিশ ওপেন চ্যাম্পিয়ন, জীবদ্দশায় তিনি ছয়বার এই খেতাব অর্জন করেছিলেন। ১৯০০ সালের ইউএস ওপেনেও তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এরপর তিনি আর এই আসরে অংশ নেননি। লর্ড নর্থক্লিফের অনুরোধে ভার্ডন ১৯১২ সালেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু যক্ষ্মার সংক্রমণে তিনি সেই বছর কাবু হয়ে যান। ফলে পরবর্তী বছর তিনি আর রে আসরে নাম লেখান।

হ্যারি ভার্ডন © Library of Congress George Grantham Bain Collection
টেড রে; Image Source: golfwrx.com

১৯১৩ সালের ইউএস ওপেন ছিল সতেরতম আসর। এখানে তখন ছিল ব্রিটিশ গলফারদের জয়জয়কার। বারোবার স্কটিশ আর তিনবার ব্রিটিশ প্রতিযোগী এখানে বিজয়মাল্য পড়েছেন। শুধুমাত্র ১৯১১ এবং ১৯১২ সালে আমেরিকান জনি ম্যাকডার্মট এখানে বিজয়ী হন। ব্রিটিশরা তাই এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে করেই হোক পদক নিয়ে আসতে হবে ইংল্যান্ডে।

১৬০ জন প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নাম লিখিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে খেলতে এলেও উইমেটকে অনেকের সাথে মূল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দুদিন কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলে আসতে হয়। তার সুবিধা ছিল তিনি এই কোর্সের আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। এর প্রতিটি কোণা তার নখদর্পণে।

উইমেটের প্রতিভা নিয়ে সংশয় না থাকলেও ওয়াটসন থেকে শুরু করে আর কেউই আঁচ করতে পারেননি যে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এক ঘটনার সাক্ষী তারা হতে যাচ্ছেন। টুর্নামেন্টে ভার্ডন আর রে-র মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে সবাই ধরে নিয়েছিল, এবং তাদের কেউ একজনই বিজয়ী হতে যাচ্ছে বলে বাজিও ধরা হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকানদের আশা ছিল ম্যাকডার্মট, যদিও তিনি তখন ক্যারিয়ারের গোধুলিলগ্নে। ফরাসি গলফার লুই টেলিয়ার এবং আরেক ব্রিটিশ খেলোয়াড় উইলফ্রিড রিডও ফেভারিটদের তালিকায় ছিলেন।

অপ্রত্যাশিত এক ক্যাডি

আমন্ত্রিত হিসেবে উইমেট খেলতে এলেও কান্ট্রি ক্লাব তার জন্য কোনো ক্যাডির ব্যবস্থা করেনি। অখ্যাত এক অপেশাদার গলফার, যে কোয়ালিফাই করতে পারে কি না সন্দেহ, তার জন্য নিজেদের অভিজ্ঞ ক্যাডি খরচ করতে তারা রাজি ছিল না। এদিকে উইমেটেরও সামর্থ্য ছিল না কোনো অভিজ্ঞ ক্যাডির খরচ বহন করার। কিন্তু একজন ভাল ক্যাডি খুব দরকার। সরঞ্জাম বহন তার কাজের একটি অংশমাত্র, অভিজ্ঞ একজন ক্যাডি প্রতিনিয়ত গলফারকে পরামর্শ দিয়ে তার খেলাকে আরো ধারাল করে তুলতে পারেন। গলফারের সাফল্যের পেছনে একজন ভাল ক্যাডির ভূমিকা অপরিসীম।

সাত-পাঁচ ভেবে উইমেট তাই স্কুলপড়ুয়া জ্যাক লাউরিকে নিজের ক্যাডি হতে অনুরোধ করলেন, কারণ তার মতো স্কুলবালকের কাছে টাকার থেকে বড় হলো ইউএস ওপেনের মতো আসরে বড় বড় তারকা গলফারদের সান্নিধ্য পাওয়া। কাজেই টুর্নামেন্ট শুরুর দিন স্কুল পালিয়ে জ্যাক কান্ট্রি ক্লাবে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু কপাল খারাপ, তাকে ধরে আবার স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু উইমেটের জন্য এই ঘটনা সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এলো। জ্যাকের দশ বছর বয়সি ছোট ভাই, এড ঠিকই মায়ের চোখ এড়িয়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ল কান্ট্রি ক্লাবে। উইমেটের খেলা আরম্ভ হতে মাত্র তখন মিনিট দশেক বাকি। “আমি তোমার ক্যাডি হতে পারি ,” এডির এই কথায় উইমেট হকচকিয়ে গেলেন। পুঁচকে এই ছেলে কীভাবে তার ব্যাগ টানবে। কিন্তু এডির জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন। ভাগ্যিস হয়েছিলেন!

পুরো টুর্নামেন্টে উইমেটের পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ালেন এডি। স্নায়ুর চাপে ভুগতে থাকা উইমেট শুরু করেন ভীষণ এক বাজে শট খেলে। এডি অনেকটা ধমকের সুরে তাকে বলল, “মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে চোখ রেখে মারো “।

ইউএস ওপেনে উইমেট এবং লাউরি; Image Source: petesperspective.com

এডি নিরন্তর উৎসাহ উইমেটকে সাহস যোগায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। আর কেউ একমত না হলেও এডি প্রথম থেকেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত উইমেটই বিজয়ী হবে। প্রতিটি মুহূর্তেই বয়সের তুলনায় পরিণত এই বালক উইমেটকে উদ্দীপনা যুগিয়ে গেছে। উইমেট প্লে অফে উঠে গেলে যখন এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আমেরিকার আশা-আকাঙ্ক্ষা এখন তার উপর নির্ভর করছে, তখন আয়োজকেরা তাকে অনুরোধ করলেন এই বেলা এডিকে বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ একজন ক্যাডিকে নেয়ার। শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে যাবার দুঃখে এডির চোখে পানিতে ভরে করে। নিজের দশ বছরের ক্যাডির দিকে একপলক তাকিয়ে উইমেটের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, “নাহ, আমি এডির সাথেই থাকব।”

বিজয়

প্লে অফ রাউন্ডে টেড রে, ভার্ডন আর উইমেটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে ওঠে। রুদ্ধশ্বাস দর্শকেরা দেখতে থাকেন সর্বোচ্চ মাত্রার লড়াই। মাঝে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেললেও এডির সাহায্যে উইমেট দ্রুতই খেলায় ফিরে আসেন। বাজে শট খেলে রে অন্য দুই প্রতিযোগীর থেকে পিছিয়ে পড়লে তার জেতার আশা কার্যত শেষ হয়ে যায়। ভার্ডন আর উইমেট খেলতে থাকেন পাহাড় সমান চাপ নিয়ে। যে আগে চাপে ভেঙে পড়বে সে-ই হারবে। অবশেষে ভার্ডন ঠিকভাবে একটি শট খেলতে পারলেন না। এই সুযোগে উইমেট ছিনিয়ে নিলেন জয়ের মালা। ভার্ডন পরে নিজেই বলেছিলেন, ঐদিন উইমেটের ভেতর তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তার নিজের তরুণ বয়সের ছায়া।  

বিজয়ী উইমেটের (মাঝে) সাথে ভার্ডন এবং রে © USGA

স্থানীয় দর্শকদের মধ্যে তখন বাঁধভাঙা আনন্দ। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অল্প কিছু লোককে ডিঙিয়ে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ল মাঠে, উইমেট আর এডিকে কাঁধে তুলে নিল। এর মধ্যেই রে আর ভার্ডন উইমেটের বালক ক্যাডির জন্য টাকা সংগ্রহ করতে একটি হ্যাট জনতার মাঝে ছেড়ে দেন। বলা হয়, উইমেটের বাবা, যিনি সন্তানের গলফ খেলা পছন্দ করতেন না, তিনি সেদিন উপস্থিত ছিলেন এবং এডির জন্য প্রথম দান তিনিই করেন। মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে দেড়শ ডলারের মধ্যে একটা পরিমাণ ওঠে, যা তখনকার হিসেবে অনেক। উইমেটের মা-ও মাঠে এসেছিলেন ছেলের কীর্তির সাক্ষী হতে। বহু লোকের ভিড় ঠেলে তিনি কোনোমতে তাকে অভিনন্দন জানাতে সক্ষম হন।

উইমেটের জয়ের প্রভাব

বেশ কয়েকদিন উইমেটের বিজয় পত্রপত্রিকারগুলো ফলাও করে প্রচার করে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মেই বেশিরভাগ মানুষ অন্য খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু গলফের মধ্যে সূচীত হয় বড় পরিবর্তন। ১৯১৩ সালের দিকে আমেরিকার মতো বিশাল দেশে পেশাদার-অপেশাদার মিলিয়ে মাত্র সাড়ে তিন লাখ লোক গলফ খেলত, উইমেটের জয়ের দশ বছরের মধ্যে এক ধাক্কায় সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২১ লক্ষে। ফলে উইমেটকে “ফাদার অফ আমেরিকান গলফ” বললেও অত্যুক্তি হবে না।

ধনী লোকের খেলা বলে গলফের যে দুর্নাম ছিল তা-ও আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে। অনেক কর্মজীবী লোকেই গলফ খেলতে শুরু করে। খেলার মাঠের সংখ্যাও ৭৪২ থেকে ১৯২০ সালের ভেতরে বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮৯-এ। গলফের ব্যাপারে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক ইতিবাচক হয়, যার ঢেউ আছড়ে পড়ে আটলান্টিকের ওপারেও। পেশাদার গলফারদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া হতে থাকে।

পত্রিকাতে উইমেটের বন্দনা; Image Source: readex.com

ধীরে ধীরে হলেও সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ক্যাডিদের মধ্যে। উইমেটের সাফল্য তাদের উদ্বুদ্ধ করে যে তারাও কষ্ট করলে খেলোয়াড় হিসেবে সফল হতে পারবে। গলফের ক্লাবগুলোও বুঝতে পারে ক্যাডিদের মধ্যেই উইমেটের মতো আরো খাঁটি সোনা আছে, প্রয়োজন শুধু জহুরি চোখে তাদের খুঁজে বের করা। ১৯২৭ সালে সেই উদ্দেশ্যে তারা টেক্সাসে আয়োজন করল মার্কিন ইতিহাসের প্রথম ক্যাডি টুর্নামেন্ট। এখান থেকে উঠে আসে পরবর্তীকালের নামকরা গলফার বায়রন নেলসন আর বেন হ্যাগেন। উইমেটের পথ ধরে উঠে আসেন ববি জোন্স, সারাজেন, আর্নল্ড পামার, জ্যাক ফ্লেক, ড্যালির মতো অনেক তারকা।

উইমেটের পর তাকে অনুসরণ করে আরো চারজন অপেশাদার গলফার ইউএস ওপেনে বিজয়ী হন।১৯১৫ সালে উইমেটকে ইউএস অপেশাদার গলফ চ্যাম্পিয়নশিপে হারানো ট্র্যাভার্স চ্যাম্পিয়ন হন। ঠিক পরের বছরই চিক ইভান্স আবারো অপেশাদারদের নাম উজ্জ্বল করেন। কিংবদন্তীর গলফার ববি জোন্স ১৯২৩-৩০ এর মধ্যে চারবার ইউএস ওপেন জেতেন। ১৯৩৩ সালে সর্বশেষ অপেশাদার প্রতিযোগী হিসেব জন গুডম্যান চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো অপেশাদার খেলোয়াড় আর বিজয়ী হতে পারেননি।

ববি জোন্স (বামে), উইমেট (ডানে); Image Source:pbagalleries.com

অপেশাদার ক্যারিয়ার

১৯১৩ সালের ইউএস ওপেন ছিল উইমেটের মাথার মুকুট। এরপরেও তিনি অনেক বছর গলফ খেলেছেন, কিন্তু কখনোই পেশাদারের খাতায় নাম তোলেননি। তিনি দুবার ইউএস অপেশাদার চ্যাম্পিয়নশিপ (১৯১৪ এবং ১৯৩১) জিতে নেন। ১৯১৪-তে ফ্রেঞ্চ অপেশাদার টুর্নামেন্টেও তিনি জয়ী হন। ছয়বার তিনি ম্যাসাচুসেটস অপেশাদার চ্যাম্পিয়নের খেতাব অধিকার করেন। গলফের বিখ্যাত টুর্নামেন্ট ওয়াকার কাপ তিনি খেলেন বারোবার, এর মাঝে তিনি দুবার খেলোয়াড় আর অধিনায়ক হিসেবে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে ষষ্ঠ এবং শেষবারের মতো ইউএস ওপেনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করেন।

পরিবার ও কর্মজীবন

১৯১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সিস উইমেট আর স্টেলা সুলিভান বিয়ে করেন। তাদের ঘরে জ্যানিস আর বারবারা নামে দুই কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এর আগে স্টেলার ভাই জ্যাকের সাথে উইমেট খেলার সরঞ্জামাদির দোকান দিয়েছিলেন। তিনি গলফার হিসেবে নিজের খ্যাতি কাজে লাগিয়ে পয়সা বানাচ্ছেন এই অজুহাতে তৎকালীন এক নিয়মের দোহাই দিয়ে ইউএসজিএ তার অপেশাদার হিসেবে খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে তারা প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে। জনতা আর রাজনীতিবিদদের অব্যাহত চাপে তারা অবশেষে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই সময় উইমেট প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাই মুখ বাঁচানোর খাতিরে ইউএসজিএ যুক্তি দেয় যে তিনি দেশের জন্য কাজ করছেন বলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলো।  

উইমেটের বন্ধুর তালিকা ছিল দীর্ঘ। তাদের একজন, চার্লস ফ্রান্সিস অ্যাডামস তাকে ১৯৩১ সালে জাতীয় হকি লীগের অন্তর্ভুক্ত দল বোস্টন টাইগার্সের প্রেসিডেন্ট করেন। উইমেট প্রেসিডেন্ট হয়েই দলের খেলাতে টিকিটের দাম কমিয়ে দেন। তিনি অ্যাডামসের সাথে অন্য একটি দলের স্বত্বও কেনেন, যদিও পরে তা বিক্রি করে দেন। এসবের মাঝেই তিনি বিনিয়োগকারী বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করতে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সাথেও উইমেটের সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৫০ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার তাকে আমন্ত্রণ জানালেন একদিনের জন্য ক্যালিফোর্নিয়াতে এসে তার সাথে গলফ খেলতে। উইমেট কোম্পানির কাছ থেকে ছুটি প্রার্থনা করলে তার আবেদন না-মঞ্জুর হলো। হোয়াইট হাউজ এবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এবং উইমেটকে নিয়ে আসতে এয়ারফোর্স ওয়ান পাঠিয়ে দেয়। কোম্পানির ছুটি মঞ্জুর করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।

মৃত্যু এবং সম্মাননা

স্ত্রী স্টেলার মৃত্যুর দুই বছর পর, ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সিস উইমেটের মৃত্যু হয়। প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে ব্রুকলিনেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তার মৃতদেহ বহনকারীদের মধ্যে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু, সেই ক্যাডি এডি লাউরি। তিনি ততদিনে হয়ে উঠেছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী এবং নামকরা অপেশাদার গলফার।

উইমেট বেঁচে থাকতেই বন্ধুরা তার নামে ১৯৪৯ সালে বৃত্তি (Francis Ouimet Scholarship Fund) চালু করে, যা দেয়া হত ম্যাসাচুসেটসের বিভিন্ন গলফ কোর্সে কাজ করা ক্যাডি বা অন্যান্য মাঠ পরিচর্যাকারীদের। এছাড়া তার জীবদ্দশাতেই ১৯৫১ সালে তিনি গলফের আইন কানুন তৈরির সংস্থা (ক্রিকেটের এমসিসি-র মতো) রাজকীয় এবং প্রাচীন গলফ ক্লাব-এর (Royal & Ancient Golf Club) প্রথম আমেরিকান ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচিত হন। ইউএস সিনিয়র ওপেনের ট্রফির নামকরণ করা হয়েছে ফ্রান্সিস ডি উইমেট মেমরিয়াল ট্রফি

ইউএসজিএ-র জাদুঘরের একটি কক্ষের নাম ফ্রান্সিস উইমেট কক্ষ। তিনি চারজন গলফারের একজন যার নামে ১৯৮৮ সালে স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। ফ্রান্সিস উইমেট স্কলারশিপ বর্তমানে গলফে দীর্ঘমেয়াদী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি পুরস্কারও চালু করেছে। উইমেটের মৃত্যুর সাত বছর পর ইউএস গলফ হল অফ ফেম-এর উদ্বোধন করা হয়। প্রথমপর্যায়ে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় চারজনকে- ববি জোন্স, সারাজিন, হ্যাগেন আর ফ্রান্সিস উইমেট।

বই এবং চলচ্চিত্র

এ গেইম অফ গলফ; Image Source: lotsearch.net

ফ্রান্সিস উইমেটের নিজের লেখা আত্মজৈবনিক গ্রন্থএ গেইম অফ গলফ” প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এতে তিনি নিজের জীবনের অনেক কথাই তুলে ধরেছেন। ২০০৪ সালে মার্ক ফ্রস্ট উইমেটের বিখ্যাত সেই বিজয় উপজীব্য করে লেখেন “দ্য গ্রেটেস্ট গেইম এভার প্লেইড”, যা ২০০৫ সালে ডিজনি চলচ্চিত্রে রূপ দেয়। এই চলচ্চিত্রে উইমেটের ভূমিকাতে অভিনয় করেছেন পরবর্তীকালে ট্র্যান্সফর্মার ছবি করে খ্যাতি পাওয়া অভিনেতা শিয়া লেবোফ। মার্ক ফ্রস্ট পরবর্তীতে একই ঘটনা নিয়ে “দ্য ম্যাচ” নামে আরেকটি বই লেখেন, যেখানে এড লাউরির কথা বিশদভাবে তুলে ধরা হয়।

This is an article in the Bengali language about Francis Ouimet. The article describes the events leading up to Ouimet's capture of the US open Title in 1913 and subsequent changes in the world of golf. Necessary references are hyperlinked.

References

  1. Frost, M. (2004). The greatest game ever played: Harry Vardon, Francis Ouimet, and the birth of modern golf. New York, NY: Kingswell.
  2. A. (2013). Remembering Ouimet: Winning the1913 Open
  3. Dimond, A (2008). Francis Ouimet: The Father of American Golf
  4. Mosier, B. (2013)Remembering Ouimet: The Eddie Lowery story
  5. Baggs, M. (2013). Remembering Ouimet: Who was Francis?
  6. GOLF’S GREATEST UPSET: FRANCIS OUIMET WINS THE 1913 U.S. OPEN: 
  7. FRANCIS OUIMET
  8. OUIMET, Francis DeSales
  9. Glenn, R (2013). Francis Ouimet, America's First Golf Hero: Part I
  10. Remembering Ouimet: The Eddie Lowery story
  11. Tays, A (2013). Remembering Ouimet: How his win changed U.S. 
  12. Kelley, B (2018). Has an Amateur Ever Won the US Open?
  13. McCabe, J. (2013). Despite U.S. Open victory, Francis Ouimet remained gracious, humble: 
  14. About Francis Ouimet
  15. A Game Of Golf

Featured Image: spokesman.com

Related Articles

Exit mobile version