দৃশ্য ১:
২৩ মার্চ, ২০২১।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বেঁধে দেওয়া ২৭২ রানের লক্ষ্যে ৩৫তম ওভার শেষে কিউইদের সংগ্রহ চার উইকেটের বিনিময়ে ১৭১ রান। ব্যক্তিগত ৭২ রানে ডেভন কনওয়ে ফিরে গেছেন, অধিনায়ক টম ল্যাথামের সাথে জুটি বেঁধেছেন জিমি নিশাম। মাহেদী-তাসকিনরা বেশ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করছেন, দ্বিপক্ষীয় সিরিজে নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো জয়ের সুঘ্রাণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। ছত্রিশতম ওভারের প্রথম বলে তাসকিনের আউটসুইংটা ব্যক্তিগত ৩ রানে অপরাজিত নিশামের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ছুটে গেল উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমের দিকে। পৃথিবীর যেকোন উইকেটরক্ষকের জন্য সেটা ‘হাতের ক্যাচ’ হওয়ার কথা, কিন্তু মুশফিক সেটা তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হলেন।
ঐ ওভারেরই চতুর্থ বলে কাভারে উঠলো ক্যাচ, এবার ব্যাটসম্যান মাত্রই পঞ্চাশ পেরোনো টম ল্যাথাম। সুযোগটা কঠিন ছিল, আর কাভারে দাঁড়ানো ফিল্ডার মোহাম্মদ মিঠুন শুধু আঙুলই ছোঁয়াতে পারলেন তাতে। মাহেদী হাসানের করা পরের ওভারে আবারও ক্যাচ তুলে দিলেন ল্যাথাম, এবার সহজতম সুযোগটা নিজেই হাতছাড়া করলেন মাহেদী। জীবন পেয়ে নিশাম করলেন ৩৪ বলে ৩০, আর ল্যাথাম অপরাজিত থাকলেন ১১০ রানে। জয়ের সুঘ্রাণ পাওয়াটাই হয়ে থাকল ঐ ম্যাচে বাংলাদেশের অর্জন, জয়টা আর এল না।
দৃশ্য ২:
২৪ অক্টোবর, ২০২১।
টি২০ বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। ১৭২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কা যখন নিজেদের চতুর্থ উইকেট হারায়, তখনও ৬২ বলে দরকার ৯৩ রান। এই ম্যাচের আফিফ ও মোস্তাফিজের করা যথাক্রমে ১৩ ও ১৫তম ওভারে দুটো ক্যাচ ফেললেন লিটন কুমার দাস। প্রথমটা ভানুকা রাজাপক্ষের, দ্বিতীয়টা চারিথ আসালঙ্কার। ১১ বলে ১৪ রানের সময়ে জীবন পাওয়া রাজাপক্ষে শেষ পর্যন্ত করলেন ৩১ বলে ৫৩, আর ৩৭ বলে ৬৩ রানের ইনিংসে আসালঙ্কা টেনে নিয়ে গেলেন ৪৯ বলে ৮০ পর্যন্ত। ফলাফল, জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও বাংলাদেশের হার।
দৃশ্য ৩:
০৫ আগস্ট, ২০২২।
ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩০৩ রান সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ, এরপর ৬১ রানে জিম্বাবুয়ের ৩ উইকেট ফেলে দিয়ে মোটামুটি ম্যাচের চালকের আসনে বসে পড়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। সেখান থেকে ইনোসেন্ট কাইয়া আর সিকান্দার রাজার ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল জিম্বাবুয়ে। ২৭তম ওভারে, যখন প্রতিআক্রমণ করে সিকান্দার রাজা পৌঁছে গেছেন ৪৩ বলে ৪৩ রানে, তাসকিনের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ফুল লেন্থের বলে কাভারে ক্যাচ তুলে দিলেন তিনি। কভারে দাঁড়ানো বদলি ফিল্ডার তাইজুল ইসলাম ডাইভ দিয়েও বলটা হাতে রাখতে পারেননি। এরপর শরীফুল ইসলামের করা ৩৩তম ওভারের প্রথম বলে কাইয়ার ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল শূন্যে ভাসলেও ডিপ থার্ডম্যান থেকে দৌড়ে এসে বলটা ধরতে ব্যর্থ হন তাসকিন। ঐ ওভারেরই শেষ বলে আরেকটা সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু নিজের বলে ঐ সুযোগটা নিতে ব্যর্থ হন শরীফুল। পরে ৪৭তম ওভারে লুক জঙ্গুয়ের ক্যাচও ছেড়েছিলেন তাসকিন, বাংলাদেশের নিশ্চিত পরাজয়টা তাতে আরেকটু ত্বরান্বিত হয়েছে। আর সেই পরাজয়ের ক্ষতস্থানে লবণ লাগিয়েছে কাইয়া-রাজার জোড়া সেঞ্চুরি।
দৃশ্য ৪:
০২ জুলাই, ২০১৯।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০১৯, বাংলাদেশ-ভারতের হাইভোল্টেজ ম্যাচ। বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ খেলা। এই ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিল ভারত, ওপেনিংয়ে নামলেন রোহিত-রাহুল। ম্যাচের পঞ্চম ওভারের চতুর্থ বলে মোস্তাফিজের গুড লেন্থের বলটাকে পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেললেন রোহিত, ডিপ মিড উইকেটে উঠল ক্যাচ। ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে দৌড়ে ডিপ মিড উইকেটে গিয়ে, বলের কাছে দুটো হাত নিয়ে গিয়েও অদ্ভুতভাবে সম্ভাব্য সহজতম ক্যাচটা ফেলে দিলেন তামিম ইকবাল। ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানের জন্য ভাগ্যের ঐটুকু সাহায্যই যথেষ্ট, রোহিত যখন আউট হচ্ছেন তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১০৪ রানের ইনিংস। ভারতের ছুঁড়ে দেওয়া ৩১৫ রানের লক্ষ্যমাত্রাটাও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য অনতিক্রম্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
দৃশ্য ৫:
জুন, ২০১৯।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০১৯, মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি বাংলাদেশ। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের পঞ্চম ওভারের শেষ বলে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। মাশরাফির করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের শর্ট বলে স্কয়ার কাট করতে গিয়ে পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দেন ১০ রানে অপরাজিত ডেভিড ওয়ার্নার, অনুমিতভাবেই ক্যাচটা নিতে পারেননি সাব্বির রহমান। সেই ওয়ার্নার এরপর করেন ১৪৭ বলে ১৬৬ রান, আর পরে ব্যাটিংয়ে নেমে নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৩৩ রান সংগ্রহ করেও বাংলাদেশকে থামতে হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে ৪৮ রান দূরে।
চাইলে এরকম আরো কিছু দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া যায়। ’১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিকের ঐ রান আউট মিস করা, ’২১ সালে দ্বিপক্ষীয় সিরিজের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কুশল পেরেরাকে তিনবার ‘জীবন’ দেওয়া, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিকোলাস পুরানের স্ট্যাম্পিং এবং জেসন হোল্ডারের ক্যাচ মিস, অথবা সর্বশেষ ম্যাচেই মুশফিকুর রহিম কর্তৃক শ্রীলঙ্কার কুশল মেন্ডিসের ক্যাচ মিস, এই তালিকা মোটেই শেষ হওয়ার নয়। ‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’ ক্রিকেটীয় এই প্রবাদের সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব যেন বাংলাদেশ দলের কাঁধে বর্তেছে!
সেই ‘দায়িত্ব’টা খুব ভালোভাবেই পালন করে চলেছেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা, অন্তত পরিসংখ্যানের পাতা তাই বলছে। সাদা চোখে বাংলাদেশের ফিল্ডিংকে ‘খারাপ’ বলা-ই যায়, তবে সেই ‘খারাপ’টা যে আসলে কতটা ‘বাজে’, পরিসংখ্যানের পাতায় চোখ না বুলালে তা বিশ্বাস হওয়ার নয়।
ক্রিকবাজ আর ইএসপিএন ক্রিকইনফোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে যেমনটা পাওয়া গেল, গত দুই বছর, অর্থাৎ ২০২১ এর শুরু থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ দল ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে মোট ২৪টা। এই ২৪টা ম্যাচে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের হাত থেকে ক্যাচ ও স্টাম্পিংয়ের সুযোগ ফসকেছে মোট ৩৬ বার। এর মধ্যে চলতি বছরের ১২ ম্যাচে ক্যাচ পড়েছে মোট ২২টা! এই দুই বছরে ওয়ানডেতে ক্যাচ মিস করার ‘পাপ’-এ পাপীদের মধ্যে সবার উপরের নামটা অবধারিতভাবে মাহমুদউল্লাহ, তিনি ফেলেছেন ৬টি ক্যাচ। আরেক সিনিয়র ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের হাত (পড়ুন গ্লাভস) গলে বল মাটিতে পড়েছে ৫ বার। এর বাইরে মোস্তাফিজ, আফিফ, তাসকিন, শরীফুলরা ছেড়েছেন ৩টা করে ক্যাচ, সাকিব, লিটন, ইয়াসিরের হাত ফসকেছে দুই বার করে। সবচেয়ে হতভাগা বোলার যৌথভাবে তাসকিন-শরীফুল, দু’জনের বলেই ক্যাচ পড়েছে ৯ বার করে। সাকিব দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন ৬ বার, মোস্তাফিজ আর মিরাজ যথাক্রমে ৫ ও ৩ বার।
টি-টোয়েন্টির মৌসুম চলছে যেহেতু, ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণেই চোখ ফেরানো যাক। এই সংস্করণেও বাংলাদেশের রেকর্ড তথৈবচ। ২০২১ এর নববর্ষ উদযাপনের পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি খেলেছে ৩৭টা। ক্যাচ-স্ট্যাম্পিং মিসের সংখ্যাও সমান, ৩৭টা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার ক্যাচ ফেলেছেন যিনি, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তাঁর নাম ‘মাহমুদউল্লাহ’ না। তিনি সৌম্য সরকার। অবশ্য সৌম্য আপত্তি জানাতেই পারেন, ৫টা ক্যাচ ফেললেও এর বেশিরভাগই যে খুব কঠিন সুযোগ ছিল, সৌম্য দৌড়ে শুধু আঙ্গুলের স্পর্শই লাগাতে পেরেছেন তাতে।
ক্যাচের সাথে স্ট্যাম্পিং মিস যোগ করলে সৌম্যের পাশে আরেকটা নাম বসবে, লিটন দাস। ৪টা ক্যাচের সাথে ১টা স্ট্যাম্পিং মিস করেছেন তিনি।, এর মধ্যে মোট দুই ক্ষেত্রে তার হাতে গ্লাভস ছিল। পরের নামটা অবশ্য মাহমুদউল্লাহর, তিনি ছেড়েছেন ৪টা ক্যাচ। এরপর আফিফ আর মোস্তাফিজ ছেড়েছেন তিনটা করে ক্যাচ।
তবে ১০টা ক্যাচ মিস নিয়ে গত দুই বছরে বাংলাদেশের রঙিন পোশাকে ক্যাচ মিসের তালিকায় সবার উপরে আছেন বলে শুধু নয়, মাহমুদউল্লাহর সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাচ ফেলার ধরনও জনমনে ব্যাপক বিরক্তি ছড়িয়েছে। বিশ্বকাপে ওমানের বিপক্ষে, বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে, অথবা আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে, মাহমুদউল্লাহ যে ক্যাচগুলো ছেড়েছেন, ওগুলোকে কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘লোপ্পা ক্যাচ’। হাফ চান্স মিস, মিস ফিল্ডিং, আর ফিটনেসের স্পষ্ট অভাবের কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক!
ভালো ফিল্ডার হিসেবে নাম-যশ থাকলেও ক্যাচ মিসের তালিকায় মাহমুদউল্লাহর পরের দুটো জায়গা যাদের, তাদের নাম লিটন দাস এবং আফিফ হোসেন। যথাক্রমে ৭টি ও ৬টি করে সুযোগ ছেড়ে ‘অপরাধী’দের তালিকার উপরের দিকে নিজেদের নাম তুলেছেন তারা। আফিফ অবশ্য একা নন, তাঁর সমান ৬টি করে সুযোগ হাতছাড়া করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান এবং মুশফিকুর রহিমও। মোস্তাফিজকে অবশ্য ‘পেস বোলার’ কোটায় ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু মুশফিকের ব্যাপারটা রীতিমতো অমার্জনীয়। একই সময়ে দুই ফরম্যাটে কিপিং করে লিটন দাস এবং নুরুল হাসান সোহান ক্যাচ-স্ট্যাম্পিং ছেড়েছেন মোট ৫টা, অপরদিকে মুশফিকুর রহিম একাই ফেলেছেন ৬টা ক্যাচ।
যদি ক্রিকবাজের পরিসংখ্যানকে সত্য বলে মেনে নিই, সেক্ষেত্রে একই সময়ে, অর্থাৎ ২০২১ এর শুরু থেকে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ভারতের খেলোয়াড়রা ৩৯ ম্যাচে ক্যাচ ফেলেছেন ৪৭টা, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা ৩১ ম্যাচে ২৮টা, ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা ২৮ ম্যাচে ১৭টা। তবে ক্যাচ মিসের সংখ্যায় অস্ট্রেলিয়া-ভারতের সাথে বাংলাদেশের মিল থাকলেও আসল অমিলটা পাওয়া যায় ক্রিকবাজের ধারাভাষ্যে। বাংলাদেশের ক্যাচ মিসের ক্ষেত্রে যেখানে ‘ইজি চান্স’ বা ‘সিম্পল ক্যাচ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের ক্ষেত্রে সেটা সাধারণত ‘টাফ চান্স’, ‘অলমোস্ট আ ব্লাইন্ডার’। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের ফিল্ডাররা বাংলাদেশীদের মতো সহজ সুযোগ তো মিস করেনই না, বরং আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ক্যাচটাও তারা নেওয়ার জন্য নিজেদের সর্বস্বটা উজাড় করে দেন।
ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশ দলের স্কিল, খেলা বোঝার ক্ষমতা, পেশাদারিত্ব আর মানসিকতার পার্থক্য ছিল সবসময়েই। সেই কারণেই বাংলাদেশ দলের ফিল্ডিংয়ে রাতারাতি উন্নতির আশা করাটা ঠিক বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে না। বরং ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে দলের অধিনায়কের মুখ থেকে “ক্যাচ মিস করা খেলারই অংশ” শুনতে পারার সম্ভাবনাটাই অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।