২০০৭ সাল। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। মাশরাফি বিন মুর্তজা তখন বল হাতে গনগনে আগুন।
চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংস। মাশরাফির করা বলটি অফ স্ট্যাম্পের বেশ খানিকটা বাইরে পিচ করেছিল। ভারতীয় ওপেনার ওয়াসিম জাফর ছেড়ে দিলেন। ব্যস! বল কাট করে ভিতরে ঢুকে সরাসরি অফস্ট্যাম্পেই ধাক্কা। বোল্ড! জাফর একই ম্যাচের পরের ইনিংসেও বড় একটা শূন্য হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে ফিরেছিলেন সেঞ্চুরি নিয়ে।
এই ২০১৯ সালে এসে মাশরাফি আর ওয়াসিম জাফর, দু’জনেই আছেন ক্রিকেটের ময়দানে। কিন্তু ভাগ্যটা নড়ে গেছে অন্যখানে। ক’দিন পর জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন বিশ্বকাপে, অন্যদিকে জাফর নিজের শেষটুকু দিয়ে আঁকড়ে ধরেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। আছেন বিদায়বেলায়। যদিও দু’জনই সফল দুই জায়গাতে।
এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফর বাংলাদেশেই অবস্থান করছেন। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটে লিগে খেলছেন আবাহনী লিমিটেডের হয়ে। সেখানেও তার শুরুটা সেই ২০০৭ সালের চট্টগ্রাম টেস্টের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথম ম্যাচে ৮ রানেই আউট। এরপর যথাক্রমে ৭৬ ও ৯৪ রানের বড় ইনিংস খেলে দারুণ ফেরা। শেষ দুই ম্যাচে তার ব্যাটে এসেছে যথাক্রমে ৩৮ ও ১৯ রান।
ওয়াসিম জাফরের বয়স ৪১ ছাড়িয়েছে । ভারতের হয়ে ৩১ টেস্ট আর দু’টি ওয়ানডে খেলা এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান সর্বশেষ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন ২০০৮ সালে। তারপর থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে হয়ে উঠেছেন ‘অটোমেটিক চয়েস’।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়াসিম জাফরের প্রাপ্তির ঝুলি অনেক বড়। রঞ্জি ট্রফিতে এবারও সহস্রাধিক রান করেছেন, ম্যাচ আর রানের রেকর্ড তো রয়েছেই। রঞ্জিতে মুম্বাইয়ের অধিনায়ক ছিলেন। কিংবদন্তি শচিন টেন্ডুলকার তারই অধিনায়কত্বে খেলেছেন।
সর্বশেষ, সবাই যখন ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে জাফরকে, তখনই বিদর্ভের মতো আড়ালে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি দলে বিনা পারিশ্রমিকে খেলতে নেমে ট্রফি জেতাচ্ছেন।
১.
ওয়াসিম জাফরের অতি ব্যবহৃত বুটজোড়া সম্ভবত এখনও তুলে রাখার সময় হয়নি। বিশেষত, ৪১ বছর বয়সেও রঞ্জি ট্রফি মাতাচ্ছেন, বিদর্ভের হয়ে দ্বিতীয় সিজনেই ট্রফি জেতাচ্ছেন। তবে এটাও সত্যি যে, তিনি তার ক্যারিয়ারের অন্তিম অবস্থায় আছেন। নিজে সেটা বুঝলেও বলছেন, তিনি এখনও ক্রিকেট ‘উপভোগ’ করছেন।
তিনি যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আসলেই কোনো সন্দেহ নেই যে, এত কিছুর পরও ওয়াসিম জাফর ক্রিকেট খেলছেন কেবলই উপভোগের কারণে, ক্রিকেটের প্রতি তার প্যাশনের কারণে। রঞ্জিতে শেষ দুই আসরে… বলা যায় শেষ আসরে বিদর্ভের সঙ্গে দারুণ সময় কেটেছে এই ক্রিকেটারের। নিজেকে তিনি যেন আবারও ফিরে পেয়েছেন নতুন করে। অবশ্য এই ফেরাটা খুব সহজ ছিল না। কারণ, ঠিক দুই বছর আগেই জাফরকে মুম্বাই দল ছাড়ার মতো বিশাল একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে জাফর বলেন,
‘২০১৪-১৫ মৌসুমে যখন আমি পদত্যাগ করার (অধিনায়কত্ব থেকে) সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন মুম্বাইয়ের নির্বাচকরা আমাকে ফেরানোর কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তারপরও আমি বিজয় হাজারে ট্রফিতে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ তুলে দেখিয়েছিলাম। এরপর জম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে আঙ্গুলের চোটের কারণে আমাকে পুরো মৌসুম বসিয়ে রাখা হয়। তখনই আমার মনে হলো, তরুণদের সামনে নিজেকে প্রতিকূলতা হিসেবে তৈরি করা উচিত হবে না। তারপরই আমি নিজেকে দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান করার পরও ওয়াসিম জাফর বিভিন্ন দলে খেলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এমনকি ফ্রি’তে। তারপরও কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত বিদর্ভের দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দল তার সাথে চুক্তি করার আগ্রহ দেখায়নি।
জাফর বলেন,
‘আমি বিদর্ভের হয়ে দুই মৌসুম খেলেছি। কিন্তু তারাও আমার সাথে চুক্তি নবায়নে আগ্রহী হয়নি। আমি তাদের হয়ে ফ্রি’তে খেলতে আগ্রহী ছিলাম। আমি কেরালাসহ বিভিন্ন রাজ্য দলের সাথে কথা বলেছি। সবাই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পণ্ডিতকে (কোচ) যখন মুম্বাই সরিয়ে দিল, একই সঙ্গে তিনি যখন বিদর্ভের সঙ্গে চুক্তি করলেন, আমি আশা দেখা শুরু করলাম। আমি বিদর্ভের হয়ে বিনামূল্যে খেলার ব্যাপারে তার কাছে নিজের আগ্রহের কথা জানাই। তারপর কোচই কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করেন, তারাও রাজি হন।’
২.
ওয়াসিম জাফর যখন ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ার ফেরানোর লড়াই করছেন, ঠিক তখনই চাপে পড়েন নিজের চাকরি নিয়ে। সব মিলিয়ে একরকম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ৪১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। তার কর্মক্ষেত্র ইন্ডিয়ান অয়েলের পক্ষ থেকে তাকে ক্রিকেট ছাড়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। অথচ, এই ক্রিকেটের জন্যই চাকরিটা পেয়েছিলেন তিনি।
জাফর বলেন,
‘তামি তাদের (ইন্ডিয়ান অয়েল) কাছে ঋণী। আমি যখন ২০ বছর বয়সী, তখন তারা আমাকে চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে যখন আমি ইনজুরিতে পড়ে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তখনই আমাকে বলা হলো ক্রিকেট ছেড়ে সেখানে কর্মরত অন্যান্য ক্রিকেটারদের মতো ৯টা-৫টা অফিস করতে। এতে আমি আরও হতাশ হয়ে পড়ি, একরকম মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। আমি তাদেরকে বারবার অনুরোধ করতে থাকি, যেন তারা আমাকে খেলার সুযোগ দেয়। কারণ আমার মধ্যে এখনও ক্রিকেট রয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। যারা এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়, আমি তাদেরকে স্পোর্টসম্যানদের জন্য খানিকটা ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করি। তারা যতদিন চায়, ততদিন খেলতে দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি।’
এত কিছুর পরও জাফর ভেঙ্গে পড়েননি। তিনি নিজের ফিটনেস ঠিক রাখতে আরও বেশি পরিশ্রম করতে থাকেন, যেটা তার বয়স অনুপাতে তার ব্যাটিংয়ে আরও সুবিধা দেয়।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের এই কিংবদন্তি দিনশেষে মুম্বাই ক্রিকেটকে ভোলেননি, যদিও মুম্বাই তাকে একরকম ছুঁড়েই ফেলেছে বলা যায়। নিজের পুরনো দলের ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন প্রথম শ্রেণীতে ২৫৩ ম্যাচে ১৯ হাজার ১৪৭ রান ও ১০৭ লিস্ট-এ ম্যাচে ৪,৫৪৫ রান করা এই ক্রিকেটার।
নিজের সঙ্গে যা হয়েছে, সেসব কথা মাথায় রেখেই বোধহয় জাফর বললেন,
‘কোচকে অন্ততপক্ষে দুই বছর সময় দিতে হবে। একই সঙ্গে তাকে তার মতো কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। সেটা দিতে না পারলে ব্যর্থতার গ্লানি শুধুমাত্র তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো মানে নেই। একই সঙ্গে শুধুমাত্র নির্বাচকদের দোষারোপ করা যাবে না। এটা কেবল জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের দায় নয়, এবারের মৌসুমে মুম্বাই দলের সবাই খারাপ খেলেছে। অন্যভাবে বলা যায়, ক্লাব ক্রিকেটে মুম্বাই দলের উচিত নিজেদের ঢেলে সাজানো।’
সবশেষে সারমর্ম কি এটাই যে, ওয়াসিম জাফরের ক্রিকেট যাত্রা এখানেই থেমে যাচ্ছে?
উত্তরটা হলো, ‘না’। তিনি খেলবেন আরও একটা মৌসুম।
‘আমি আমার শেষ দেখে ফেলেছি, কিন্তু আমার ক্রিকেটটা এখনও উপভোগ করছি। কোচ পণ্ডিত যদি আমাকে বিদর্ভেই থেকে যেতে বলেন, আমি ভালোবেসেই তাদের জন্য আরও একটা মৌসুম খেলে যাবো।’