Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাফল্যের ক্যানভাসে লাল-সবুজ কাব্য : এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

ম্যাচটা হতে পারতো হারমানপ্রীত কৌরের। ব্যাটিংয়ে ৫৬ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস খেলেছেন, বাংলাদেশী বোলারদের নেওয়া কঠিন পরীক্ষাতে লেটার মার্কস নিয়ে উতরে গিয়েছেন। বোলিংয়েও নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসেছিলেন ডেথ ওভারে বোলিং করতে, সঙ্গী ছিলো ২০১৬ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে শেষ ওভারের তৃপ্ত ইতিহাস। সেবার ঠিকই জিতিয়েছিলেন দলকে অসাধারণ নৈপুণ্যে, সম্পূর্ণ চাপকে নিজের ছোট্ট দুটো কাঁধে বয়ে নিয়ে ওভারটা সফলভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন এবারও।

ম্যাচটা হতে পারতো পুনম যাদবেরও। আগ্রার এই ট্র্যাডিশনাল লেগব্রেক বোলারের জন্য সেই মঞ্চও ছিলো প্রস্তুত, বাংলাদেশের টপঅর্ডারের সঙ্গে ছেলেখেলা করে হিসেবী বোলিংয়ে তুলে নিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। যখনই কোনো জুটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, প্রথাগত লেগ স্পিনারদের মতোই এসে ব্রেকথ্রু এনে দিয়েছেন। মাত্র ১১২ রানের স্বল্প পুঁজিতেও তাই ভারতের স্বপ্ন একটি মুহূর্তের জন্যও ফিকে হয়ে আসেনি।

ম্যাচটা হতে পারতো হারমানপ্রীত কৌরের ; Image Source : PTI
ম্যাচটা হতে পারতো হারমানপ্রীত কৌরের ; Image Source : PTI

টুর্নামেন্টের শেষ তিন বল থেকে তুলতে হবে তিনটি রান, সমীকরণটা খুব একটা কঠিন নয়। তবু ‘পাগলাটে’ এক শটে সানজিদা হঠাৎই তুলে খেলতে গিয়ে ধরা পড়লেন লং-অনে, ক্যামেরা ফ্রেমে ধরা পড়লেন অধিনায়ক সালমা খাতুন। হতাশায় মুখ ঢেকে ফেলেছেন, হয়তো মনের কোনো এক কোণে সামান্য সংশয়ের দোলাচল বুঝতে পেরেছিলেন। সানজিদার সেই শটটি আদৌ পাগলামি ছিলো কিনা, সেটা নিয়ে অবশ্য তর্ক চলতে পারে। নিজের জোনে বলটা পেয়ে গিয়েছিলেন, সুবিধামতো তুলেও মেরেছিলেন। আর একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়তো বলটা বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে পড়তে পারতো, হতে পারতো তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কোনো মুহূর্ত! সানজিদার এই আউটের পর সমীকরণটা হঠাৎ করেই মনে হলো বাংলাদেশের খুব চেনা। ম্যাচ জিততে দুই বলে প্রয়োজন আর তিনটি রান, এমন পরিস্থিতিতে কি আর কম পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে!

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকবারই ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ, তবে ভাগ্যের সুপ্রসন্ন দৃষ্টি থেকে কোনো এক অজানা কারণে বারবারই বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপ ফাইনালে শেষ মুহূর্তের পরাজয়ে যে দুর্ভাগ্যের সূচনা, এরপর সেই এক রানের গেরো যেন কোনোমতেই কাটতে চাইছে না!

বারবারই এমন উল্লাসে মেতে উঠেছে বাঘিনীরা ; Image Source : ACC
বারবারই এমন উল্লাসে মেতে উঠেছে বাঘিনীরা ; Image Source : ACC

তবে সেই রেকর্ডের পুরোটাই বাংলাদেশের পুরুষ দলটির খাতায়, প্রমীলা দলটার জন্য আজই ছিলো প্রথম কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল। সেটাও এমন এক দলের বিপক্ষে, যারা গত ছয় আসরের প্রত্যেক আসরেই ছিলো চ্যাম্পিয়ন। প্রতিপক্ষ দলে ছিলেন মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী, হারমানপ্রীত কৌরদের মতো বিশ্ব ক্রিকেটের রথী-মহারথীরা, অদৃশ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলো এত বড় মঞ্চে অনভিজ্ঞতার অনিশ্চয়তা। দুই দলের র‍্যাঙ্কিংয়ে পার্থক্য বিস্তর, ভারত চারে আর বাংলাদেশ নয়ে। কিন্তু শারীরিক সামর্থ্য, স্কিল, টেম্পারামেন্ট কিংবা অভিজ্ঞতার মতো বাস্তবতা বিবেচনায় সেই পার্থক্য রীতিমতো পর্বতসমান হয়ে ওঠে। টানা চার ম্যাচ জয়ের গৌরবটুকু তাই মাথায় চড়ে বসতে দেওয়া যাচ্ছিলো না। যদি সব হিসেব এলোমেলো হয়ে যায় এই ম্যাচে?

১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়াতে প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি জিতে নতুন যুগে প্রবেশ করেছিলো বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দল। এরপর হঠাৎ করেই বাংলাদেশে ক্রিকেটের অলিগলি বদলে গেলো, আইসিসি ট্রফি জিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশ মাত্র চার বছরের মাথায় খেলে ফেললো প্রথম টেস্ট! সেই থেকে শুরু, এরপর বাংলাদেশে ক্রিকেট-উন্মাদনা ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁয়েছে।

এবারও সেই মালয়েশিয়াতেই প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে ফাইনালে উঠলো বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ প্রবল প্রতাপশালী ভারত। সব মিলিয়ে ছয়বার আয়োজিত এশিয়া কাপের প্রতি আসরেই হয়েছে চ্যাম্পিয়ন, এশিয়াতে দলটির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও বিশেষ সংশয় ছিলো না। সেখানে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বাংলাদেশের গায়ে ছিলো ‘আন্ডারডগ’ তকমা, প্রত্যাশাও ছিলো না তেমন। থাকবে কি করে, প্রমীলা ক্রিকেট নিয়ে কেউ কপাল কুঁচকায় নাকি?

লীগ ম্যাচে বাংলাদেশকে একাই জিতিয়ে ফিরেছিলেন রুমানা ; Image Source : ICC
লীগ ম্যাচে বাংলাদেশকে একাই জিতিয়ে ফিরেছিলেন রুমানা ; Image Source : ICC

পুরো পরিস্থিতি বদলে গেলো, ভারতের বিপক্ষে ‘হুট করেই’ যখন জিতে বসলো বাংলাদেশ। নড়েচড়ে বসলো গোটা বিশ্ব, অপার বিস্ময়ে সবাই লক্ষ্য করলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করা দলটিই এরপর পুরো টুর্নামেন্টে দাপটের সঙ্গে প্রতিটি দলকে পরাজিত করে ফাইনালে উঠে এসেছে। এবার স্বপ্নজাল বুনতে শুরু করলো বাংলাদেশ, প্রমীলা দলটার হাত ধরে এবার নিশ্চয়ই আসবে অতিকাঙ্খিত ফাইনাল জয়!

খেলা শুরু হওয়ার আগে সদাহাস্যময়ী সালমা খাতুনকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো নার্ভাসনেস কাজ করছে কিনা, হঠাৎই যেন সালমার মুখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি ছড়ানো এক হাসিতে সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “দারুণ উত্তেজিত, নার্ভাস লাগছে না মোটেই।” প্রতিপক্ষ দলের বিশাল সব নামের পাশে সালমা-জাহানারাদের বাংলাদেশ যে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকতে চায়নি, সে কৃতিত্ব গোটা দলের। আক্রমণাত্মক মানসিকতার ঐকতানে একসুরে বাঁধা দলটির আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া গেলো ম্যাচ শুরু হতে না হতেই। 

টুর্নামেন্টের প্রতি ম্যাচেই পেসার জাহানারা আলমকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানো হলেও ফাইনালে একপ্রান্ত থেকে বোলিং শুরু করলেন বাঁহাতি স্পিনার নাহিদা আক্তার। আর এ সিদ্ধান্তে যে ভারতীয় ওপেনাররা মোটেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না, সেটা প্রমাণ করতেই সম্ভবত চতুর্থ ওভারের দ্বিতীয় বলেই পাগলাটে এক দৌড়ে স্মৃতি মান্ধানা বিলিয়ে দিলেন নিজের গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি। স্কোরবোর্ডে তখন রান উঠেছে মাত্রই নয়। নাহিদার প্রতি আস্থা রেখে অধিনায়ক এবং কোচ যে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি, সেটা নাহিদা প্রমাণ করেছেন পাওয়ার প্লে-তে তিন ওভারে মাত্র ছয় রান দিয়ে। প্রথমেই পড়ে যাওয়া রানের চাপে এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে ভারত; ভেদা কৃষ্ণমূর্তি এবং ঝুলন গোস্বামীকে সঙ্গে নিয়ে অধিনায়ক হারমানপ্রীত সাময়িকভাবে সে বিপর্যয় সামলাতে চেষ্টা করলেও রুমানা-কুবরাদের সম্মিলীত আক্রমণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। ভারত আটকে গেলো ১১২ রানেই, বাংলাদেশ তখন উড়ছে।

লক্ষ্যটা খুব বড় ছিলো না, শুধু স্থিতধী একটা সূচনার প্রয়োজন ছিলো। সেটা এনে দিলেন শামীমা সুলতানা-আয়শা রহমান, গড়লেন ৩৫ রানের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর একটি জুটি। কিন্তু উড়তে থাকা বাংলাদেশ হঠাৎ বাস্তবতার জমিনে ফিরে আসতে খুব বেশি সময় নেয় না। সপ্তম ওভারে টানা দুই বলে জোড়া আঘাত হানলেন পুনম যাদব, দুই ওপেনারকে বিভ্রান্ত করে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দেন এই লেগ স্পিনার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে যান ফারজানা হকও, দ্বাদশ ওভার চলাকালীন সে সময় বাংলাদেশের স্কোর শিটে রান উঠেছে মাত্র ৫৫। সমীকরণ তখন হঠাৎই কিছুটা কঠিন হতে শুরু করেছে।

এবার ক্রিজে এলেন রুমানা আহমেদ। সেই রুমানা, যিনি এই টুর্নামেন্টের আগে একটি ব্যাট জোগাড় করতে পারছিলেন না। সেই রুমানা, যিনি এ টুর্নামেন্টেই লিগ পর্যায়ে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন ভারতকে। ক্রিজে এসে স্থিতধী ব্যাটিংয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এ ম্যাচটাও তিনি শেষ করেই ফিরতে চান। নিগার সুলতানাকে সঙ্গে নিয়ে শক্ত করলেন বাংলাদেশের ইনিংসের মেরুদণ্ড, পরের তিন ওভারের মধ্যেই ২৮ রান সংগ্রহের পর সে জুটি ভাঙলেন পুনম। টপ অর্ডারে প্রথম চার বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানকে শিকার করে যখন নিজের বরাদ্দকৃত চার ওভার শেষ করলেন পুনম, বোলিং বিশ্লেষণটা ছিলো ঈর্ষণীয়। ৪-০-৯-৪!

দারুণ ব্যাটিং করেছেন নিগার সুলতানাও, ইনিংসের মেরুদণ্ড হয়ে ছিলেন তিনিই ; Image Source : AFP photos
দারুণ ব্যাটিং করেছেন নিগার সুলতানাও, ইনিংসের মেরুদণ্ড হয়ে ছিলেন তিনিই ; Image Source : AFP photos

নিগারের বিদায়ের পর অষ্টাদশ ওভারে নিজেকে নিয়েই একটা ফাটকা খেললেন ভারতের অধিনায়ক হারমানপ্রীত। ভারতের তিন ফ্রন্টলাইন বোলারের ততক্ষণে বরাদ্দকৃত ওভার শেষ, শিখা পাণ্ডে ইনজুরিতে পড়ে চলে গিয়েছেন মাঠের বাইরে। দলের অভিজ্ঞতম এবং এশিয়ার সফলতম বোলার ঝুলন গোস্বামী নিজের করা দুই ওভারে ২০ রান খরচ করে ফেলেছেন বলে সেখানেও আর ভরসা করা চলছে না। আগের দুই ম্যাচে বোলিং না করা হারমানপ্রীত সিদ্ধান্ত নিলেন, এবারও ম্যাচ শেষ করার গুরুদায়িত্বটা তিনিই কাঁধে তুলে নেবেন। ফাটকাটা কাজে লাগলো বেশ, এসেই ফাহিমা খাতুনকে আউটসাইড অফে প্রলুব্ধ করে ডাউন দ্য ট্র্যাকে খেলালেন। ফাঁদে পা দিয়ে স্ট্যাম্পড হয়ে ফিরে গেলেন ফাহিমা, ম্যাচে আবারও ফিরে এলো ভারত। সেই ওভারেরই শেষ বলে নতুন ব্যাটসম্যান সানজিদা ইসলামকে রানআউটের একটি সুবর্ণ সুযোগ মিস করেন স্মৃতি মান্ধানা, ফলশ্রুতিতে আরেকটি মূল্যবান রান যোগ হয় বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে।

ঊনবিংশ ওভারে বোলিংয়ে আসেন দীপ্তি শর্মা। শিখা পাণ্ডের যন্ত্রণাদায়ক ইনজুরিজনিত কারণে মাঠ ছাড়লে সেই ওভারটি শেষ করার গুরুদায়িত্ব নেওয়া দীপ্তি এই ওভারে মাত্র চারটি রান খরচ করেন। তৃতীয় বলে নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে রানআউটের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও থ্রো করেননি দীপ্তি, হয়তো মূল কারণ ছিলো ব্যাকআপ ফিল্ডার না থাকাটাই। জীবন পেলেন রুমানা। শেষ বলে রুমানা আরেকবার ক্যাচ তুললেন শর্ট ফাইন লেগে, প্রাণপন দৌড়েও নাগাল পেলেন না ঝুলন। যতক্ষণে ফিরালেন বলটা, দু’বার প্রান্তবদল করে নিয়েছেন দুই ব্যাটসম্যান।

শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিলো মাত্র ৯ রান। কুয়ালা লামপুরে তখন রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, খেলাটা তখন গড়াতে পারে যেকোনো দিকে। ভারত মেয়েদের ক্রিকেটে বিশাল এক নাম, বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতাও রয়েছে এই দলটির। লন্ডনে সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের পর পুনরুজ্জীবিত ভারতীয় প্রমীলা ক্রিকেট দলটির সামনে এবার পুরোনো বৈভব ধরে রাখা তাগিদ, আবার পিছুটান হিসেবে তিক্ত স্বাদ দিচ্ছে তাদের বিপক্ষে এই টুর্নামেন্টেই অবিস্মরণীয় এক জয় তুলে নেওয়া বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, এই প্রথমবারের মতো কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলতে নেমেছে রুমানা-সানজিদার বাংলাদেশ। হারলে যেখানে হারানোর কিছুই নেই, জিতলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। এর আগে যে পুরুষ কিংবা প্রমীলা কোনোপ্রকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই ফাইনালের গেরোটা কাটানো সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের!

বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট ভারত তাই এদিন তুলনামূলক নবীন এক বাংলাদেশের বিপক্ষেই পড়ে গেলো চাপে। অন্যদিকে ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে হারমানপ্রীতের করা বিংশ ওভারের প্রথম তিনটি বল থেকেই তুলে নিলেন ছয়টি রান! এরপর হঠাৎই কী যেন হয়ে গেলো বাংলাদেশের, সঙ্গী হওয়া মোমেন্টাম ঘুরে গেলো ভারতের দিকে।

সানজিদার ফিরে যাওয়ার পর ক্রিজে এলেন জাহানারা। ওভারের চতুর্থ বলটি যখন করতে এলেন হারমানপ্রীত, বাংলাদেশের প্রয়োজন আর দুই বলে তিন রান। সেই চিরচেনা পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষ সেই ভারত। এবার শুধু মুশফিক-রিয়াদের জায়গাতে ক্রিজে রুমানা-জাহানারা, বাংলাদেশের দুই পোস্টারগার্ল। ঐ বলটিতে সফলভাবেই আরেকবার প্রান্তবদল করার পর হঠাৎ করেই যেন ‘আত্মহত্যা’র সাধ জাগলো রুমানার। দীপ্তির করা থ্রো যখন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে স্ট্যাম্প ভাঙলো, রুমানা তখন আনমনেই যেন ক্রিজের অনেকখানি বাইরে! তিন বলে তিন রান প্রয়োজন এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে পরপর দুই বলে এমন জোড়া আঘাত!

অদ্ভুতুড়ে রান আউটের আগে দারুণ খেলছিলেন রুমানা ; Image Source : ICC
অদ্ভুতুড়ে রান আউটের আগে দারুণ খেলছিলেন রুমানা; Image Source : ICC

উদ্বেগভরা মুখে, দুরুদুরু বুকে সালমা এসে দাঁড়ালেন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে। ঠিক আগের বলেই সানজিদার উইকেট পড়তে দেখে হতাশা-খেদে বাকরুদ্ধ অবস্থায় বসে ছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক, বাংলাদেশের প্রমীলা ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার। গোটা টুর্নামেন্টেই দারুণ পারফর্ম করে আসা রুমানা এ ম্যাচেও দারুণ একটি ইনিংস খেলার পর হঠাৎ ‘ব্রেইন-ফেড’ কাণ্ডে রানআউট হওয়ার পর সালমাকেই তাই নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে এসে দাঁড়াতে হলো শেষ বলে। ইতিহাস থেকে আরেকটি বল দূরে থাকা বাংলাদেশের মুখে হাসি ফোটানোর গুরুদায়িত্ব তখন জাহানারা-সালমাদের কাঁধে।

ক্যাপ্টেন সালমা যখন উদ্বেগভরা হৃদয় নিয়ে নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে, স্ট্রাইকে থাকা জাহানারা তখন আশ্চর্যরকম শান্ত। কোনোকিছুই যেন স্পর্শ করছিলো না তাকে, তিনি জানতেন তাকে কী করতে হবে। ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হয়তো রোমন্থন করছিলেন এমন পরিস্থিতিতে বারবার আটকে পড়া বাংলাদেশের অতীতস্মৃতি, খুঁজে ফিরছিলেন অনুপ্রেরণার রসদ। বাইশ গজের এই পিচটুকু যে কতবার দুঃসহ সব স্মৃতি ‘উপহার’ দিয়েছে বাংলাদেশকে! আজ সব হিসেব চুকিয়ে দেওয়ার পালা, আজ বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার পালা।

মিডল স্ট্যাম্পের একটু সামনে হারমানপ্রীতের ফুললেংথে করা ডেলিভারিটাকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ডিপ মিড বরাবর খেললেন জাহানারা। প্রাণপণে দৌড় শুরু করলেন সালমা, যে করেই হোক দুই রান নিতেই হবে! ডিপ মিডে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার স্মৃতির ডান হাতে হঠাৎই এসে জমলো সারা ভারতের চাপটুকু, গোটা ভারত তখন তার হাতের দিকে তাকিয়ে। সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই জাহানারার, চোখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে রূদ্ধশ্বাসে ছুটলেন জয়সূচক রানটা নেওয়ার জন্য, তাকে যে পৌঁছাতেই হবে অপর প্রান্তে – নিজের জন্য, দেশের জন্য, নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের জন্য তাকে যে পারতেই হবে!

হারমানপ্রীত পারেননি একা ভারতকে জয় এনে দিতে, উল্লাসে উন্মত্ত বাংলাদেশ ; Image Source : Indian Express
হারমানপ্রীত পারেননি একা ভারতকে জয় এনে দিতে, উল্লাসে উন্মত্ত বাংলাদেশ; Image Source : Indian Express

সেই চাপেই বোধহয় হার মানলেন স্মৃতি, একেবারেই নির্বিষ এক থ্রো যখন উইকেটরক্ষক তানিয়া ভাটিয়ার কাছে পৌঁছালো, জাহানারা জীবনবাজি রাখা এক ডাইভ দিয়ে ফেলেছেন। জাহানারা পেরেছেন, দুই রান নিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ! এক ডাইভে ইতিহাসে ঢুকে গেলেন জাহানারা, উল্লাসে ফেটে পড়া গোটা বাংলাদেশ দলটা ঢুকে পড়লো মাঠে। কুয়ালা লামপুরের সবুজ গালিচার মতো ঘাস বিছানো মাঠে মধ্যমণি হয়ে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা, আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন অধিনায়ক সালমা খাতুন। ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়লেন হারমানপ্রীত; চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া, মুহুর্তের আকস্মিকতায় বিহ্বল এক শূন্য দৃষ্টি।

বাংলাদেশের আজ আর সেসব ভাবার সময় নেই। আজ বাংলাদেশের উৎসবের দিন, আজ গর্ব করার দিন। আজ যে বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব!

Featured Image Source: espncricinfo

Related Articles