চলতি মাসেই শেষ হতে যাচ্ছে ক্লাব ফুটবলের দলবদলের সরগরম বাজার। বেশিরভাগ ক্লাবই নিজ নিজ দল প্রায় গুছিয়ে এনেছে। তারপরও বড় বড় কিছু ট্রান্সফারের খবর বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গুঞ্জনমতে ভিদাল, আর্থার, ম্যালকমকে কেনার পরও নাকি বার্সা হাত বাড়াচ্ছে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অসুখী থাকা পল পগবার দিকে। আবার ফ্লোরেন্তিনো পেরেজও নাকি পাখির চোখ করেছেন বেলজিয়ান অধিনায়ক ইডেন হ্যাজার্ডকে। ট্রান্সফার ডেডলাইন যত ঘনিয়ে আসছে, খেলোয়াড় কেনাবেচার গুজব বা ফিসফাসও তত বেড়ে চলছে। তবে এর আগেও দেখা গিয়েছে যে, পুরো ট্রান্সফার মৌসুমে ঝিমিয়ে থাকা কোনো দল শেষ দিনে ঘরে নিয়ে এসেছে অনেক দামী বা চমক জাগানিয়া খেলোয়াড়। চলুন দেখে আসা যাক ট্রান্সফার ডেডলাইনের চমকপ্রদ সাইনিংগুলো।
গ্যারেথ বেল – ১০০ মিলিয়ন ইউরো (টটেনহাম থেকে রিয়াল মাদ্রিদ)
২০১৩ মৌসুম শুরুর আগে থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো রিয়াল মাদ্রিদের প্রধান লক্ষ্য লুইস সুয়ারেজ ও টটেনহাম সেনসেশন গ্যারেথ বেলকে দলে ভেড়ানো। কিন্তু লুইস সুয়ারেজ বার্সেলোনাতে যাওয়ায় গ্যারেথ বেলের জন্য তাই একপ্রকার উঠেপড়েই লাগেন মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। সেই সুযোগ বুঝে টটেনহাম প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল লেভিও বেলের জন্য হাঁকেন চড়া দাম। তাই একটা সময় মনে হচ্ছিলো বেলের বুঝি আর বার্নাব্যুতে পা রাখার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। কিন্তু ট্রান্সফারের শেষ দিনে বিশ্বকে চমকে দিয়ে পেরেজ বেলকে নিয়ে হাজির হন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফারে এই ওয়েলস খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। যার জন্য টটেনহামকে দিতে হয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউরো। আর এতে করেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর রেকর্ড ফি ছাড়িয়ে প্রথম ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি মূল্যমানের খেলোয়াড় বনে যান গ্যারেথ বেল।
সবার কাছেই সেই সময়ে এত চড়া দামে বেলকে কেনা অনেকটা ‘প্যানিক বাই’ মনে হয়েছিলো। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ‘বিগ গেম প্লেয়ার’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন এই গতিময় উইঙ্গার। ২০১৪ কোপা দেল রে ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে রোনালদোবিহীন রিয়ালের জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। একমাস পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে এটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে একটি গোল করে রিয়ালের প্রতীক্ষিত লা ডেসিমা জয়েও রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলতি মৌসুমে রোনালদোর বিদায়ে ভক্তরা আস্থা রাখছেন এই গ্যারেথ বেলেই।
কিলিয়ান এমবাপ্পে – ১৮০ মিলিয়ন ইউরো (মোনাকো থেকে পিএসজি)
গত মৌসুমে রেকর্ড ২০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনা থেকে নেইমারকে কিনে নিয়ে সবাইকে চমকে দেয় পিএসজি। তবে পিএসজি তার চেয়ে বড় কাজটি সারে ট্রান্সফার ডেডলাইনে। মোনাকো থেকে কিনে নেওয়ার বিকল্পে ধারে প্যারিসে নিয়ে আসে হালের তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে। পরবর্তী ছয় মাসে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখান এই ১৯ বছর বয়সী তরুণ। লিগ ওয়ানে ১৫ ম্যাচে ১২ গোল করার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নক আউট স্টেজে ৬ ম্যাচে করেন ৬ গোল।
এই অসাধারণ পারফরম্যান্সের দরুন পরবর্তীতে বিশ্বকাপ জেতার পর স্থায়ীভাবে এই ফরাসিকে নিজেদের করে নেয় নাসের আল খেলাইফির দল। তার জন্য পিএসজিকে গুনতে হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম ১৮০ মিলিয়ন ইউরো। তবে টাকাটা যে ফেলনা যাবে না তা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়াই যায়। পরবর্তী প্রজন্মের তারকা ফুটবলার হতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপে তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জেতা এমবাপ্পে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ক্লাব ক্যারিয়ারে নিজের নামের পাশে জমা করেছেন ৪৮টি গোল। নিঃসন্দেহে তা ঈর্ষণীয়। তাই নেইমার–এমবাপ্পে জুটিতেই স্বপ্ন দেখছেন পিএসজি সমর্থকেরা।
ক্লঁদ ম্যাকলেলে – ১৬ মিলিয়ন ইউরো (রিয়াল মাদ্রিদ থেকে চেলসি)
২০০৩ সালে রোমান আব্রামোভিচ চেলসির মালিক হওয়ার পরপরই বদলে যায় ক্লাবের চেহারা। খেলোয়াড় কেনায় অঢেল টাকাপয়সা ঢেলেছেন তিনি। মালিক হওয়ার পরপরই দলে ভিড়িয়েছেন জো কোল, ভেরন ও ক্রেসপোর মতো তারকাদের। তবে আব্রামোভিচ আসল কাজটি করেন ২০০৩ ট্রান্সফার মৌসুমের শেষ দিনে। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে মাত্র ১৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে নিয়ে আসেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ক্লঁদ ম্যাকলেলেকে।
মরিনহোর আমলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড হিসেবে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করেন এই ফরাসি খেলোয়াড়। ম্যাকলেলে থাকাকালীন সময়ে প্রতি দুই ম্যাচে চেলসি গড়ে ১ এর কম গোল হজম করেছিলো। তাতেই ম্যাকলেলে চেলসিতে জিতে নিয়েছেন দুটি লিগ শিরোপা, দুটি লিগ কাপ এবং একটি এফএ কাপ। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনটিকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন ম্যাকলেলে। যার জন্য পরবর্তীতে একে অনেকে ‘ম্যাকলেলে রোল’ বলেও অভিহিত করতো। পাঁচ বছর চেলসিতে থেকে খেলেছেন ১৪৪টি ম্যাচ। বিদায় নিয়েছেন চেলসি কিংবদন্তী হয়েই।
মেসুত ওজিল – ৪২ মিলিয়ন ইউরো (রিয়াল মাদ্রিদ থেকে আর্সেনাল)
২০১৩ সালে আর্সেনালের লক্ষ্য ছিলো একজন ভালোমানের গোলস্কোরার। লুইস সুয়ারেজ এবং গঞ্জালো হিগুয়াইন ছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গারের প্রধান পছন্দ। তবে দুজনকেই হারানোয় হঠাৎ করেই ফরোয়ার্ড কেনার লক্ষ্য থেকে সরে আসেন তিনি। উল্টো হুট করেই ২০১৩ সালের ট্রান্সফারের শেষ দিনই এমিরেটসে নিয়ে আসেন মেসুত ওজিলকে, যেটিকে বলা হয় আর্সেনালের এযাবৎ করা সবচেয়ে চমকপ্রদ ‘লাস্ট মিনিট সাইনিং’। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১০৫ ম্যাচে ৭৪টি গোলে সহায়তা করা ওজিলকে মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট পেরেজ বিক্রি করে দেবেন তা কেউই ভাবেনি। আর সেই সুযোগ লুফে নিয়ে ওজিলকে ৪২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আর্সেনালে নিয়ে আসেন ওয়েঙ্গার। কোনো খেলোয়াড়ের প্রতি এটিই ওয়েঙ্গারের সবচেয়ে বেশি খরচ।
নিজের ধারাবাহিক ফর্ম ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেও টেনে আনেন ওজিল। প্রতি ১৫০ মিনিটে গড়ে একটি করে গোলে সহায়তা করেন সদ্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া এই জার্মান মিডফিল্ডার। যদিও চার বছরের আর্সেনাল ক্যারিয়ারে তিনটি এফএ কাপ বাদে বড় কোনো শিরোপা জিততে পারেননি তিনি। তবে নতুন কোচ উনাই এমেরির অধীনে ওজিলেই আবর্তিত হবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সফল ক্লাব আর্সেনাল।
ওয়েইন রুনি – ৩০ মিলিয়ন ইউরো (এভারটন থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
২০০৪ ইউরোতে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে বিশ্বকে মুগ্ধ করেন মাত্র ১৮ বছর বয়সী ওয়েইন রুনি। তাতেই ২০০৪ ট্রান্সফার মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোতে রুনিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। ক্লাবগুলোর টানাহেচড়ায় ট্রান্সফার উইন্ডোর প্রায় শেষ দিকে এসেও কোনো গন্তব্যই ঠিক হয়নি রুনির। অবশেষে নিউক্যাসেল ইউনাইটেড ও চেলসিকে টেক্কা দিয়ে স্যার এলেক্স ফার্গুসন এই টিনএজারকে নিয়ে আসেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। তাও আবার ট্রান্সফার উইন্ডো শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে। সেই সময়ে ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য এভারটনকে দিতে হয় ৩০ মিলিয়ন ইউরো। তবে দামটা যে অযৌক্তিক ছিলো না তা রুনি বুঝিয়ে দেন নিজের অভিষেক ম্যাচেই। ফেনারবাচের সাথে করে বসেন এক অনবদ্য হ্যাটট্রিক। পরবর্তী অধ্যায় তো ইতিহাসই।
রুনি আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হয়ে যায় একে অপরের সমার্থক শব্দ। বহু লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে একটানা ১৩ বছর খেলে যান ইউনাইটেডের হয়ে। ১৩ বছরে রুনি জিতেছেন সম্ভাব্য সব ধরনের শিরোপা। ৫টি লিগ শিরোপা, ৪টি এফএ কমিউনিটি শিল্ড কাপের পাশাপাশি ২০০৮ সালে জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগও। রেড ডেভিলদের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ৩৯৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৮৩টি গোল করেন তিনি। ২০০৪ সালের সেই ১৮ বছর বয়সী তরুণ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়েন ক্লাবটির কিংবদন্তী হয়েই।