ইউরোপে যেরকম প্রতিটি ফুটবল দলে ফিজিওথেরাপিস্ট থাকে, তেমনি একটা সময়ে আফ্রিকার প্রায় প্রতিটা দলেই নিয়োজিত থাকতো একজন তান্ত্রিক! এই রীতি এতটাই মহামারী আকার ধারণ করেছিলো যে, আফ্রিকান ফুটবল এসোসিয়েশান এদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও আড়ালে-আবডালে চলতে থাকে এই জাদুবিদ্যা। আফ্রিকান দেশগুলাতে এই জাদুটোনায় বিশ্বাস ব্যাপক হারে প্রচলিত জনসাধারণের মাঝে। বাদ নেই ফুটবল খেলোয়াড়রাও। খেলোয়াড়রাও নিয়মিত শরণাপন্ন হন এই তান্ত্রিকদের। প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়ই মনে, ফুটবল খেলোয়াড়রা কেন তান্ত্রিকদের শরণাপন্ন হয়?
নাইজেরিয়ার এক স্থানীয় কোচ মারিউ বাফাংগার মতে, ব্যাপারটা আসে হিংসা থেকে। আফ্রিকার দেশগুলো ফুটবল খেলাকে একপ্রকার যুদ্ধ হিসেবেই দেখে। নিজেদের পারফরমেন্সের উন্নতি ঘটানো, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দেরকে ইনজুরিতে ফেলানো থেকে শুরু করে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয় এই জাদুবিদ্যার মাধ্যমে। সাধারণত বিপক্ষ দলের সেরা খেলোয়াড়দের টার্গেট করা হয় সবচেয়ে বেশি। সেজন্য নিজেদের খেলোয়াড়দেরকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য আফ্রিকান দলগুলো মোটা অংকের বেতনে নিয়োজিত করতো এই তান্ত্রিকদের।
আলি ব্যানকেম এবং জুলিয়েন আবদু নামে এরকম দুজন তান্ত্রিকের বাস একলিংগা নামে একটি গ্রামে। গ্রামটির অবস্থান পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের রাজধানী থেকে গাড়িতে ৩ ঘণ্টা দূরে। এরা দুজন তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা একটি ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারবে কিনা, তারা নির্লিপ্ত ভাষায় উত্তর দেন, “এটা তো কিছুই না। আমাদেরকে শুধু কিছু শেল মারতে হবে আর মাঠের আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তারপর আমাদের গোল সব জালে ঢুকবে আর বিপক্ষ দলের বলগুলো বারের বাইরে চলে যাবে!’’ কোনো ম্যাচে জাদু প্রয়োগ করেছে কিনা অথবা পুরো প্রক্রিয়াটি কী- এসব ব্যাপারে আর বিস্তারিত বলতে রাজি হননি এই দুই তান্ত্রিক।
ফুটবলে এই ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে অনেক মজার ঘটনা। ১৯৮০ সালে পশ্চিম আফ্রিকান নেশনস কাপে মুখোমুখি হয় গাম্বিয়া এবং সিয়েরা লিওন। সে সময় গাম্বিয়ার ট্রেইনার ছিলেন ইউরোপ থেকে আগত হোলগার ওবারম্যান। ম্যাচ শুরুর কিছু আগে ঘটে এক আজব ঘটনা। স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে দেখা যায় নীল রঙের পাউডার দিয়ে অনেকগুলো নকশা আঁকা। এটি দেখার পর খেলোয়াড়রা ভয়ে কাঁপতে থাকে আর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের মতে, এই নকশাতে যারা পা ফেলবে তাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে। ওবারম্যান ইউরোপিয়ান হওয়ায় এগুলো তিনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু খেলোয়াড়রা বিদ্রোহ করে বসল আর ফিরে গেল সেখান থেকে। এরপর ওবারম্যানের মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। তিনি সকল খেলোয়াড়কে বাসে উঠিয়ে নিজেই পুরো বাসটিকে সজোরে চালিয়ে দেন প্রবেশপথে। খেলা শুরুর মাত্র দুই মিনিট আগে মাঠে প্রবেশ করে সিয়েরা লিওন, আর ম্যাচটিও জিতে নেয় ২-০ গোলে।
২০০২ সালে আফ্রিকা কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে ক্যামেরুনের ট্রেইনার উইনি স্কার্ফের সহকারী থমাস কানুকে দেখা যায় মাঠের এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে হাড় পুঁতে রাখতে এবং পানি ছিটাতে। জাদুবিদ্যা করার অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করে কানুকে। জেলে যাওয়াই হয়তো মন্দের ভালো ছিল কানুর জন্য। কারণ প্রতিপক্ষ দর্শকদের কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন ক্যামেরুনের সাবেক এই খেলোয়াড়। যদিও কানু জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু তার এক সময়ের সতীর্থ ক্যামেরুনের কিংবদন্তী রজার মিলা এগুলা বিশ্বাস করেন না। ফুটবল ম্যাগাজিন ‘ফ্রান্স ফুটবল’কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রজার মিলা বলেন, “ফুটবলে কোনো জাদু নেই। আর ক্যামেরুনই এটির সাক্ষী। আমাদের দেশ জাদুবিদ্যায় অত পারদর্শী নয়, কিন্তু আমরা ফুটবলে অন্য আফ্রিকান দেশগুলার চেয়ে এগিয়ে। তারা যাদুবিদ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে, যেমন- বেনিন, টোগো অথবা নাইজেরিয়া।”
‘৯০ এর দশকে একটি ম্যাচে মুখোমুখি হয় রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা। খেলার প্রথম থেকেই দুর্বল রুয়ান্ডাকে একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে উগান্ডা। প্রথমার্ধে ৫টি শট গোলবারে নিলেও একটি গোলও হয়নি। এর মাঝে ৩টি শট বারে লাগে আর দুটি শেষ সময়ে বাঁক পরিবর্তন করে। অর্থাৎ অল্পের জন্য বারবার বেঁচে যাচ্ছিলো রুয়ান্ডা। হঠাৎ ক্যামেরায় দেখা যায়, রুয়ান্ডার গোলকিপারের পেছনের জালে এক জোড়া গ্লাভস সুতো দিয়ে বাঁধা। দর্শক আর উগান্ডার খেলোয়াড়দের মতে, এই গ্লাভসই বারবার রুয়ান্ডাকে বাঁচাচ্ছিল গোল খাওয়া থেকে। এ নিয়ে মাঠে দর্শক আর খেলোয়াড়দের মাঝে মারামারি লেগে যায় এবং অনেকে আহত হয়। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে খেলা আবার মাঠে গড়ায় এবং ম্যাচটিতে রুয়ান্ডা ১-০ গোলে জয়লাভ করে।
আফ্রিকান জায়ান্ট আইভরি কোস্ট নিয়ে একটি গল্প বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিলো। ১৯৯২ সালের আফ্রিকা কাপের ফাইনালে ১১-১০ গোলে পেনাল্টি শুটআউটে জিতে আফ্রিকা কাপ জিতে নেয় ‘আফ্রিকান হাতি’ নামে পরিচিত আইভরি কোস্ট। আইভরি কোস্টের অনেক ভক্তই বিশ্বাস করে, এই জয়ের পেছনে অবদান আছে তাদের দলের তান্ত্রিকদের। তান্ত্রিকদের ভাষ্যমতে, কাপের আগে স্বয়ং আইভরি কোস্ট স্পোর্টস মিনিস্ট্রি ফুটবল দলের জন্য তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলো এবং কথা দিয়েছিলো, কাপ জিতলে তাদেরকে টাকা দেয়া হবে। কিন্তু জেতার পর তান্ত্রিকরা অভিযোগ জানায়, তাদের যে টাকা পয়সা দেয়ার কথা ছিলো, সেগুলোর কিছুই দেয়া হয়নি। ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপ দেয়। কাকতালীয়ভাবে এরপর অনেক বছর আইভরি কোস্ট কিছুই জিততে পারেনি। প্রায় এক দশক পর আইভরি কোস্টের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জাতির পক্ষ থেকে তান্ত্রিকদের কাছে ক্ষমা চান এবং প্রায় ১,২০০ ডলার প্রদান করেন তাদের যেটা নাকি কাপ জেতার পর দেয়ার কথা ছিলো। এমনকি তাদেরকে স্পোর্টস মিনিস্ট্রির হয়ে কাজ করার জন্যও অনুরোধ করা হয়!
শুধু আফ্রিকায় খেলে এমন খেলোয়াড়রাই যে ম্যাজিকে বিশ্বাস করেন, তা কিন্তু নয়। টটেনহাম, আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ এবং ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা টোগো সুপারস্টার এমানুয়েল আদেবায়োর এক সাক্ষাৎকারে তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের জন্য তার মাকে দায়ী করেন। তার অভিযোগ, ঝগড়ার জের ধরে তার মা দীর্ঘদিন ধরে তার উপর ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করে আসছেন।
একইভাবে চেলসির সাবেক খেলোয়াড় ঘানাইয়ান সুপারস্টার মাইকেল এসিয়েন দায়ী করেন তার বাবাকে। ২০১৩ সালে আইভরি কোস্ট তারকা গ্র্যাডেল ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ইনজুরির স্বীকার হন। ফলে এক মৌসুম তাকে মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়। ইনজুরির জন্য তিনি দায়ী করে তার বোন ডেবরাহকে। ডেবরাহকে এই অভিযোগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তার উত্তর ছিলো, “আমাদেরকে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য এটা হচ্ছে তার শাস্তি”।” আইভরি কোস্টের একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘Gradels’s family has been working spiritually against him’ এই শিরোনামে সংবাদও ছাপা হয়।
আইভরি কোস্টের আরেক তারকা দিদিয়ের দ্রগবা তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেন, জাতীয় দলে তার সতীর্থ জিয়েন জ্যাকস কালো জাদু থেকে মুক্তি পেতে বিশেষ আচার অনুষ্ঠানাদি পালন করতো। ব্ল্যাক ম্যাজিক আসলেই কাজ করে কিনা সে ব্যাপারে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। কিন্তু একে ঘিরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো সবার মনে প্রশ্ন জাগাতে বাধ্য।
এরকমই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে বেনশাদি নামের কঙ্গোর একটি প্রদেশে। স্থানীয় একটি প্রতিযোগিতায় বেনাশাদি মুখোমুখি হয় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বাসাংগার। খেলা ১-১ সমতা থাকা অবস্থায় ঘটে অবাক করা ঘটনাটি। বজ্রপাতে মাঠেই লুটিয়ে পড়েন একে একে ১১ জন খেলোয়াড়। তাছাড়া ৩০ জন দর্শকও আহত হন। বজ্রপাতে মানুষ মারা যেতেই পারে, কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, যে ১১ জন খেলোয়াড় মারা যান, তাদের সবাই বেনাশাদি টিমের খেলোয়াড়। অন্যদিকে বিপক্ষ দল বাসাংগার খেলোয়াড়দের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষেরা এদের মৃত্যুর জন্য বাসাংগা দলের জাদুবিদ্যাকেই দায়ী করে। এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয় দু’দলের সমর্থকদের মাঝে। সেসময় দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ চলায় এই ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো এই ঘটনাটি নিশ্চিত করে এবং এখনো এই ঘটনাটিকে ফুটবল মাঠে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ভুতুড়ে ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ফিচার ছবিসূত্র: sports.naij.com