নিজের নয় বছর বয়সী স্বত্তাকে অসামান্য আবেগ ভরা এক চিঠি লিখেছেন এডিনসন কাভানি। এই চিঠিতে উঠে এসেছে উরুগুয়ের এই তারকার শৈশব ও জীবন যাপন।
প্রিয় নয় বছর বয়সী এডিসন,
আমি এই চিঠিটা সেই বাচ্চাটিকে লিখছি, যাকে প্রতিদিন বাড়ির আশেপাশের সবাই ‘পেলাডো’ বলে ডাকতো।
টাকলু।
তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমার খুব বেশি চুল ছিলো না। চুল খুব আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলো। কী বাজে একটা ব্যাপার! কিন্তু তোমার তো কিছু করার ছিলো না। ফলে তোমার পরিবারের সৃজনশীলতাকে ধন্যবাদ। তুমি সবসময় ‘পেলাডো’ থাকতে।
যাক, এটা বলতে থাকলো লাগছে যে, পরের ২০ বছরে তোমার জীবন বহু অর্থে বদলে যাবে। ফুটবল দিয়ে এমনকি তুমি ওই ডাক নামটার হাত থেকেও রক্ষা পাবে। তুমি জানো, একটা লোক আছে, তার নাম গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। তুমি এখনও তার নাম জানো না। কারণ, এখন অবধি তুমি ধৈর্য ধরে একটা অনুষ্ঠানই দেখতে পারো- টম অ্যান্ড জেরি। তোমার বড় ভাই নান্দোই প্রথম বাতিস্তুতাকে দেখে অনুপ্রাণিত হলো। সে চুল কাটাতে নাপিতের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাবে। সে তোমার মায়ের কন্ডিশনারও ব্যবহার করতে শুরু করবে। আর শেষ অবধি তাকে অবিকল বাতিগোলের মতো দেখা যাবে। সে যখন মাথায় লম্বা চুল জুতোর ফিতে দিয়ে বেঁধে ফুটবল মাঠে দৌড়াবে, সেটা হবে তোমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।
শেষ অবধি তুমিও সাহসী হয়ে উঠবে এবং মাকে বলবে, ‘আর চুল কাটবো না।’
তুমি তো জীবনটাই কাটাও বাসার বাইরে পায়ে একটা বল নিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় এটাই জীবন। তুমি ভিন্ন কিছু জানতেই না।
বাসার মধ্যে কী ছিলো? কোনো মজা নেই। কোনো আগ্রহের জিনিস নেই। কোনো প্লে স্টেশন নেই। বড় টিভি নেই। এমনকি ঘরে তোমার গরম পানির গোসল করার ব্যবস্থাও ছিলো না। ঘর উত্তপ্ত করার কিছু ছিলো না। শীতে ঠান্ডা ঠেকানোর একমাত্র উপায় চারটে কম্বল। গোসল করতে চাইলে একটা পানির জগ হাতে পাও আর সেটাকে কেরোসিন স্টোভের ওপর গরম করো। তবে ঠান্ডা আর গরম পানির অনুপাত ঠিক রাখাটা খুব জরুরি। বালতির মধ্যে দাঁড়িয়ে তুমি একজন রসায়নবিদ হয়ে উঠতে শেখো।
এটাই তোমার জীবনের বিলাসিতা। প্রথম বাড়ির কথা মনে আছে? যেটাতে কোনো বাথরুম ছিলো না? তোমাকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে ছোট্ট ছাউনির বাইরে কোথাও চলে যেতে হতো।
আমি তোমাকে একটা গোপন কথা বলি? আমার যখন এসব কথা মনে পড়ে, খুব একটা খারাপ লাগে না। কোনো একটা কারণে, এটা আমাকে সাহস দেয়। এটা সুন্দর একটা স্মৃতি।
ভেতরে কী আছে, সে নিয়ে ভেবো না।
রোদের নিচে বাঁচতে থাকো, পেলাডো।
যা-ই হোক, তোমার দেয়ালে ফুটবল পোস্টার থাকার কারণ কী? প্রতি দুই-তিন বছরে যখনই চাকরির বদল হয় বা পরিবার আর বাসা ভাড়া দিতে পারে না, তখনই নতুন একটা জায়গায় চলে যেতে হয়। তুমিও ক’দিন পর নতুন বাসায় চলে যাবে।
তুমি কী জানো, এর মধ্যে সুন্দর কী আছে? প্রতিটা নতুন বাসায়, সে যেখানেই হোক, বাইরে একটা নোংরা খোলা জায়গা থাকবেই। আর বল তো একটা পেয়ে যাবে। দুনিয়ার কোনো বাড়িওয়ালা এটা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।
আমি যদি ঠিক মনে করে থাকি, এখন তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হলো, আইসক্রিম গোল।
আইসক্রিম গোল ব্যাপারটা একটা জাদুকরী ব্যাপার। পিএসজিতে আমার একবার একজনের সাথে আইসক্রিম গোল নিয়ে কথা বলতে হয়েছিলো। এটা অসাধারণ, একটা খাটি আবিষ্কার। এটা ছিলো সাল্টোর তরুণ লিগ আয়োজকদের একটা আইডিয়া। খেলার স্কোর যা-ই হোক, ছয় বছর বয়সী একদল বাচ্চাকে আপনি কিভাবে অনুপ্রাণিত করবেন?
একটা নিয়ম করা হলো, যে বাচ্চাটা খেলার শেষ গোল করবে, সে একটা আইসক্রিম পাবে।
স্কোর ৮-১ হতে পারে; কিচ্ছু যায় আসে না। এটা সময়ের সাথে একটা লড়াই। এখানে শেষ গোলদাতা হতে হবে। আপনি শেষ গোল করেছেন, কোচের কাছ থেকে এই বাঁশি শুনতে পাওয়াটা একটা অবিশ্বাস্য অনুভূতি। একেবারে নিখাদ আনন্দ। তুমি কি চকলেট পাবে? তুমি কি মিকি মাউস আঁকাটা পাবে? যা-ই পাও, সারাটা দিন তুমিই রাজা।
তুমি তো রাজধানী থেকে আসা একটা বাচ্চা নও। মন্টেভিডিওর বাচ্চাদের জীবন একটু আলাদা হয়। সেটা একটা জগত, তুমি জানোই না যে, ওই জগত বলে কিছু আছে। এডিডাস বুট, গাড়িতে চড়া আর সবুজ ঘাসের একটা জগত। সাল্টোতে এর সবকিছুই আলাদা। এখানে কোনো এক কারণে সব বাচ্চা খালি পায়ে ফুটবল খেলে। তারা খেলাটা বুট পরেই শুরু করে। কিন্তু হাফ টাইম যেতে না যেতে বুটগুলো স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে এবং তারা খালি পায়ে দৌড়ায়। আমি চোখ বন্ধ করলে এখনও পায়ের নিচে সেই ধারালো কিছু খোচা টের পাই। আমি এখনও আমার হৃদয়ের ধুকপুকানি শুনতে পাই; আমি বলের জন্য দৌড়াচ্ছি, একটা আইসক্রিম জেতার জন্য।
তুমি সারা জীবন এই অনুভূতি তোমার সাথে নিয়ে ঘুরবে। কারণ, তুমি দক্ষিণ আমেরিকান। তুমি উরুগুয়ে থেকে এসেছ। তুমি সাল্টো থেকে এসেছ। তুমি ভিন্ন পন্থায় ফুটবল যাপন করেছ। উরুগুইয়ানদের ওপর অভিশাপ এবং আশীর্বাদ হলো, আমরা কখনো রিল্যাক্স করতে পারি না। আমাদের ফুটবলের ইতিহাস এবং আমাদের দেশের ইতিহাস; আমাদের বিশ্রাম করতে দেয় না। একজন উরুগুইয়ান যখন তার জার্সিটা পরে, সে তখন ইতিহাসের ওই গর্বটা টের পায়।
আমাদের সবসময় ছুটতে হয়, ছুটতে হয়, ছুটতে হয়। এবং তুমিও একদিন ছুটবে।
আচ্ছা, তোমার স্বপ্ন কী, পেলাদো?
আমি নিজে ঠিক মনে করতে পারি না। সময় কেমন ধোঁয়াশা করে দিয়েছে। তোমার স্বপ্ন কী মন্টেভিডিওতে খেলা? নান্দোর মতো? তুমি একদিন সেটা করবে। মনে হবে, তুমি বুঝি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলছ।
তোমার স্বপ্ন কী ইউরোপে খেলা? সেটাও তুমি একদিন করবে। আর এত টাকা কামাবে যে, তোমার পরিবারের জীবন বদলে যাবে।
তোমার স্বপ্ন কী জাতীয় দলের হয়ে খেলা? সেটাও তুমি পারবে। আর সেখানে তোমার এমন সব অভিজ্ঞতা হবে যে তুমি আনন্দের অশ্রুও ফেলবে এবং দুঃখেও কাঁদবে।
তোমার স্বপ্ন কী বিশ্বকাপ খেলা? (আচ্ছা, এটা বলে দিয়ে তোমার মজাটা নষ্ট করতে চাই না। শুধু বলি, ২০১০ সালটা একটা খ্যাপা বছর হবে।)
তোমার স্বপ্ন কী অনেক টাকা কামানো এবং ভালো গাড়ি চড়া এবং দামি হোটেলে ঘুমানো? ঠিক আছে, পেলাডো, এ সবই তোমার জীবনে পাবে।
তবে আমি তোমাকে বলি, জীবনে সুখী হওয়ার জন্য কিন্তু এসবের দরকার নেই।
তোমার এই ৯ বছর বয়সে যা আছে, আমি এই ৩১ বছর বয়সে এসে সেগুলো মিস করি।
তোমার বাসায় গরম শাওয়ার নেই। তোমার পকেটে ডলার নেই। ভাই, তোমার তো ভালো একটা চুলের ছাটও নেই।
কিন্তু তোমার কাছে একটা ভিন্ন কিছু আছে। এমন একটা কিছু, যা মূল্য দিয়ে পাওয়া যায় না।
তোমার স্বাধীনতা আছে।
একটা বাচ্চা হিসেবে তুমি যে নিবিড়ভাবে ও আবেগ নিয়ে জীবনযাপন করো, তা একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে সম্ভব না। অনেক অনেক দায়দায়িত্ব থাকে। অনেক চাপ থাকে। এক জীবনের ভেতর অনেক জীবন থাকে।
তুমি কী জানো, এখন এই ৩১ বছর বয়সে তোমার জীবনে কী হবে?
হোটেল থেকে বাসে করে ট্রেনিং মাঠে যাওয়া। তারপর ট্রেনিং মাঠ থেকে বাসে করে বিমানে চড়া। তারপর বিমান থেকে নেমে আবার বাসে চড়া। তারপর বাস থেকে স্টেডিয়াম।
বহুবিধ অর্থে এখন তুমি স্বপ্নে জীবনযাপন করো। আর অন্য অনেক অর্থে তুমি এখন স্বপ্নে এক কয়েদীর জীবন যাপন করো। তুমি স্রেফ বাইরে গিয়ে একটু রোদে দাঁড়াতে পারো না। তুমি এখন জুতোটা খুলে নোংরার মধ্যে খেলতে পারো না। এমন অনেক কিছু জীবনে ঘটবে, যা তোমার জীবন জটিল করে তুলবে। এটা অনিবার্য।
তুমি যখন একটা বাচ্চা ছিলে, তখন কল্পনা করতে, সেই সবচেয়ে সুখী, যার অনেক কিছু আছে।
আরেকটু যখন বড় হলে, বুঝতে পারলে যে, সেই সবচেয়ে সফল, যার জীবন সম্পর্কে কিছু জ্ঞান আছে।
তুমি যখন পেশাদার হয়ে উঠবে, তখন তুমি যা যা স্বপ্ন দেখতে, সবই পাবে। আর এ সবকিছুর জন্য অবশ্যই তোমাকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। তবে, আমার তোমার কাছে সত থাকা উচিত, পেলাডো। এই পৃথিবীতে একটা জায়গায় আছে, যেখানে তুমি এখনও স্বাধীনতাটা পাবে। সেই স্বাধীনতাটা ৯০ মিনিট টেকে; যদি তুমি ভাগ্যবান হও।
তুমি যখন বুটটা পরবে, কোথায় খেলছ, সেটা ব্যাপার না। হতে পারে সাল্টোর নোংরা মাঠে, হতে পারে নেপলসের সবুজ ঘাসে, হতে পারে বিশ্বকাপে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের সামনে। আমি তোমাকে তোমার বাবার একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই।
তুমি প্রতিটা খেলা খেলতে যাওয়ার আগে উনি কী বলতেন? আমি জানি, তুমি শব্দগুলো মনে রেখেছ?
উনি বলতেন,
‘তুমি যখন সাদা লাইনটা পার করে ফুটবল মাঠে ঢুকে পড়বে, ওখানে কেবলই ফুটবল আছে। সাদা লাইনের বাইরে কী ঘটছে, তার কিছুই তোমাকে ওই ভেতরে কোনো সহায়তা করবে না। মাঠ ছাড়া আর কিছুই নেই তখন।’
তুমি যদি কথাগুলো শুনে থাকো এবং বিশ্বাস করে থাকো, তাহলে কখনো কখনো, যখন ভয়ানক চাপ থাকবে, যখন তুমি লক্ষ মানুষের সামনে খেলবে, তখনও তোমার মনে হবে, তুমি আদৌ বুটই পরোনি।
তুমি পায়ের নিচে সেই নোংরাটা অনুভব করতে পারবে।
তুমি বুকের মধ্যে হৃদয়ের সেই ধুকপুকানিটা টের পাবে। তুমি বলের জন্য ছুটবে। মনে হবে, তুমি যেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ট্রফিটার জন্য ছুটছো।
তুমি যেন সেই আইসক্রিমের জন্য ছুটছো।
তোমার একান্ত,
এডি