Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোর্টনি ওয়ালশের মহানুভবতা, কিংবা আব্দুল কাদিরের সাহসী ব্যাটিংয়ের স্মৃতিচারণ

ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৮৭ সালে। বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর আয়োজন করেছিলো ভারত এবং পাকিস্তান। মোট আটটি দল ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলো। গ্রুপ ‘এ’-তে ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড এবং জিম্বাবুয়ে। গ্রুপ ‘বি’তে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শ্রীলঙ্কা লড়াই করেছিলো। গ্রুপ পর্বে প্রতিটি দল প্রতিটি দলের সাথে দুইবার করে মোট ছয় ম্যাচ খেলেছিলো, যার মধ্যে শীর্ষ দুই দল সেমিফাইনালে উঠেছে।

বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচগুলো নিয়ে ধারাবাহিক লেখার মধ্যে আজকে আলোচনা করা হবে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচটিকে নিয়ে।

১.

পাকিস্তান গ্রুপপর্বের প্রথম দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পেয়েছিলো। অন্যদিকে আগের তিন আসরের ফাইনালিস্ট এবং দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের প্রথম ম্যাচ শুরু করেছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয় দিয়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজিত হলেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সহজ জয় পায় উইন্ডিজ। ভিভ রিচার্ডসের ১৮১ রানের বিধ্বংসী ইনিংসের কল্যাণে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯১ রানের জয় পেয়েছিলো উইন্ডিজ।

দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫১ রান করেছিলেন ভিভ রিচার্ডস ; Image Source: Getty Images

গ্রুপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম পাকিস্তান। সেমিফাইনালের জন্য ম্যাচটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। লাহোরে স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুই ওপেনার হেইন্স এবং সিমন্সের ব্যাটে চড়ে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৯১ রান যোগ করেছিলো তারা। হেইন্স ৩৭ রান এবং সিমন্স ৫০ রান দ্রুত ফিরে গেলে দলের হাল ধরেন ভিভ রিচার্ডস। তিনি ৫২ বলে চারটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৫১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।

ভিভ রিচার্ডস সাজঘরে ফিরে যাওয়ার পর দ্রুতই ভেঙে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস। এক পর্যায়ে তাদের রান ছিল চার উইকেটে ১৬৯। সেখান থেকে ইমরান খান এবং ওয়াসিম আকরামের বোলিং তোপের মুখে পড়ে মাত্র ২১৬ রানেই সবক’টি উইকেট হারায় উইন্ডিজ। ইমরান খান চারটি এবং ওয়াসিম আকরাম দু’টি উইকেট শিকার করে পাকিস্তানকে রানের পাহাড়ে চাপায় পড়তে দেননি।

২.

ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ২১৭ রানে লক্ষ্যে ব্যাট করতে পাকিস্তানের শুরুটা হয়েছিলো ভালো-মন্দে। ২৮ রান তুলতেই টপ-অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যান মনসুর আখতার এবং সেলিম মালিকের উইকেট হারিয়েছিলো পাকিস্তান। মনসুরকে ফেরান প্যাট্রিক প্যাটারসন এবং সেলিমকে সাজঘরের পথ দেখিয়েছিলেন ওয়ালশ। এই দুই ব্যাটসম্যানের বিদায়ের পর জুটি বেঁধেছিলেন রমিজ রাজা এবং জাভেদ মিয়াঁদাদ। তারা তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৬৪ রান যোগ করে প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দিয়েছিলেন। রমিজ রাজা ৪২ রান করে এবং জাভেদ মিয়াঁদাদ ৩৩ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে ১১০ রানেই দলের অর্ধেক ব্যাটসম্যানের উইকেট হারায় পাকিস্তান।

ইমরান খান চার উইকেট শিকার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২১৬ রানে মধ্যে আটকে রাখেন ; Image Source: PA Photos

দলীয় ১১০ রানে পাঁচ উইকেট পড়ার ক্রিজে আসেন সেলিম ইউসুফ। সাত নাম্বারে এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, তখনও জয়ের জন্য ১০৭ রান প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের। এই ম্যাচের আগে সেলিম ইউসুফের ওয়ানডেতে কোনো অর্ধশত রানের ইনিংস ছিল না। ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৪.৪৫। ম্যাচের এমন পরিস্থিতিতে হয়তো সেলিম ইউসুফকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা ছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তবে তিনি নিজের সেরাটা তুলে রেখেছিলেন এই ম্যাচের জন্য। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে ইমরান খানের সাথে যোগ করেছিলেন ৭৩ রান, যার মধ্যে ইমরান খানের অবদান মাত্র ১৮ রানের! সেলিমের ৪৯ বলে সাতটি চারের মারে সাজানো ৫৬ রানের ইনিংসের সুবাদে জয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পাকিস্তান।

সেলিম ইউসুফের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কারণে প্রাণ ফিরে পায় লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামের দর্শকেরা। তাদের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনায় যেমন পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের মনোবল বেড়ে গিয়েছিলো, তেমনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপরও চাপ সৃষ্টি করেছিলো পর্বতপ্রতীম।

৩.

সেলিম ইউসুফ এবং ইমরান খানের জুটি যখন ভাঙে, তখন পাকিস্তানের সংগ্রহ ছয় উইকেটে ১৮৩ রান। চার উইকেট হাতে রেখে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৪ রান। সেখান থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ম্যাচে ফেরান কোর্টনি ওয়ালশ। তিনি ইমরান খান এবং সেলিম ইউসুফ দুইজনকেই নিজের শিকারে পরিণত করেন। ওয়াসিম আকরামকে প্যাট্রিক প্যাটারসন ফিরিয়ে দিলে, এবং একই ওভারে তৌসিফ আহমেদ রান আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে গেলে ম্যাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কারণ তখনও জয়ের জন্য এক ওভারে এক উইকেট হাতে রেখে ১৪ রান প্রয়োজন ছিল।

বল হাতে কোনো উইকেট না পেলেও ব্যাট হাতে দলের জয়ে অবদান রাখেন আব্দুল কাদির ; Image Source: Getty Images

ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে শেষ ওভার করতে আসেন নয় ওভারে মাত্র ২৬ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করা ওয়ালশ। উইকেটে তখন ছিলেন আব্দুল কাদির এবং সেলিম জাফর। পাকিস্তানের দুই টেল-এন্ডার যখন ব্যাট হাতে ওয়ালশের সামনে, তখন অনেকেই পাকিস্তানের পরাজয় দেখে ফেলেছিলো। কিন্তু আব্দুল কাদিরের ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। জয়ের ব্যাপারে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, যা তার শরীরী ভাষা দেখেই বোঝা গিয়েছিলো। যেখানে ওয়ালশের সামনে অনেক স্বীকৃত ব্যাটসম্যানরাও হেলমেট ছাড়া খেলতে ভয় পায়, সেখানে তিনি নগ্নমস্তকে ব্যাট করতে নেমে পড়েছিলেন। ব্যাট করতে নামার পর থেকেই তিনি বেশ উজ্জীবিত ছিলেন। হাত দিয়ে ব্যাটে ঘুষি দেওয়া, ব্যাটিং পার্টনারকে উৎসাহ দিয়ে জানান দিয়েছিলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে দেখা গিয়েছিল অন্য এক আব্দুল কাদিরকে। জেল পালানো কয়েদিকে পুলিশ তাড়া করলে যেভাবে দৌড়ায়, কাদিরও ঠিক তেমন আগ্রাসী ছিলেন।

ওয়ালশের করা শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে দুইবারের জন্য প্রান্ত বদল করেছিলেন আব্দুল কাদির এবং সেলিম জাফর, যার ফলে শেষ চার বলে প্রয়োজন পড়ে ১২ রানের। ওভারের তৃতীয় বল থেকে দ্রুত দুই রান তুলে নেন কাদির। যখন তিন বলে দশ রান প্রয়োজন পড়ে, তখন আব্দুল কাদির সবাইকে চমকে দিয়ে ওয়ালশের গুড লেন্থের বলকে ওয়াইড লং-অফের উপর দিয়ে সীমানাছাড়া করেন। ফলে, শেষ দুই বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল চার রানের। ওভারের শুরু থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিল্ডারদের চাপে রেখেছিলেন কাদির। ৫ম বলে আবারও দুই রান তুলে নেন তিনি।

সুযোগ থাকা পরেও সেলিম জাফরকে মানকড় পদ্ধতিতে আউট করেননি ওয়ালশ ; Image Source: Getty Images

জয়ের জন্য শেষ বলে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল দুই রানের, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল একটি উইকেট। কোর্টনি ওয়ালশ যখন শেষ বল করার জন্য দৌড় শুরু করলেন, তখনই ক্রিজ ছেড়ে বের হয়ে যান বোলিং প্রান্তে থাকা সেলিম জাফর। ওয়ালশ বল না করে থেমে যান। ততক্ষণে সেলিম জাফর আশাহত হয়ে উইকেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। ওয়ালশ চাইলে সেলিম জাফরকে ‘ম্যানক্যাড’ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় নিশ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে সেলিম জাফরকে সতর্ক করে পুনরায় বোলিং করতে দৌঁড় শুরু করেন। ওয়ালশের মহানুভবতার পর ম্যাচের ভাগ্য পুরোটাই ছিল কাদিরের হাতে। তিনি পাকিস্তানকে হতাশ না করে শেষ বলে শর্ট থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়ে খেলে দৌঁড়ে দুই রান নিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন। দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় তিনি এমনভাবে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছিলেন, যেন কোনো যোদ্ধা, যুদ্ধশেষে তার তরবারি উঁচিয়ে ধরছেন।

৪.

শেষ ওভারে আব্দুল কাদিরের ছয়, এবং মাত্র নয় বলে তার অপরাজিত ১৬ রানের ইনিংসের চেয়ে এই ম্যাচের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল কোর্টনি ওয়ালশের স্পোর্টসম্যানশিপ। তিনি সেলিম জাফরকে ‘ম্যানক্যাড’ পদ্ধতিতে আউট না করার কারণে তার দল শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিলো। এই পরাজয়ের কারণে প্রথমবারের মতো গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

মাত্র নয় বলে ১৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন আব্দুল কাদির ; Image Source: Getty Images

ওয়ালশ দলকে জয় এনে দিতে না পারলেও পাকিস্তানের মানুষদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ ভক্তরা তাকে ‘বীর’ হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করেছিলো। তারা বিভিন্ন উপহারও দিয়েছিল ওয়ালশকে। পাকিস্তানের সরকারও ওয়ালশের মহানুভবতাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে মেডেল দেয়। লাহোরের এই শ্বাসরূদ্ধকর এই ম্যাচটি শেষপর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে আছে কোর্টনি ওয়ালশের কারণে। পরাজিত হয়েও তিনি পেয়েছিলেন বীরের মর্যাদা।

This article is in Bangla language. It is about 1987 world cup match between Pakistan vs West Indies. Please click on the hyperlinks to check the references. 

Featured Image: Getty Images

Related Articles