ভারতের মাত্র শেষ হওয়া ইংল্যান্ড সফরে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় দিয়ে শুরু করেছিলেন বিরাট কোহলিরা। সেখান থেকে ওয়ানডেতে সিরিজ ড্র। কিন্তু পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের চারটিতে হেরে লজ্জার সিরিজ শেষ করেছে ভারত। সিরিজ শেষে পুরো টেস্ট সিরিজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন ভারতীয় দলের প্রধান কোচ রবী শাস্ত্রী। ভারতের ফাস্ট বোলারদের সাফল্য, ইংলিশ কন্ডিশনে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কঠিন সংগ্রামসহ অন্যান্য সবকিছু নিয়েই মুখ খুলেছেন সাবেক এই ক্রিকেটার।
ইংল্যান্ড সফরে খুব কষ্টসাধ্য একটা সিরিজ কাটালো ভারত। এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
অনেক কঠিন একটা সফর ছিল। শুধু তা-ই নয়, কঠিন কিছু শিক্ষাও ছিল সেখানে। গভীরভাবে দেখলে, লর্ডস ছাড়া আর সব টেস্ট ম্যাচে আমাদের সুযোগ ছিল। লর্ডসে আমরা হারলাম, নটিংহামে আমরা জিতলাম। বাকি তিন ম্যাচে আমাদের বড় সুযোগ ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর। আমরা কাছাকাছি গিয়েও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারিনি। পরবর্তীতে এই পরিস্থিতিগুলোতে কী করলে ভালো হয় সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমরা যদিও এরই মধ্যে এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এমন শক্ত একটা সিরিজ শেষে আমি মনে করি, আমাদের মাথা উঁচু করে রাখা উচিত। এই কারণে যে আমরা সবগুলো শেষ করতে পেরেছি। আমাদের প্রতিপক্ষ এটা জানতো, ইংলিশ সমর্থক জানতো, আমরাও জানতাম। ভারতীয় সমর্থক ও ভারতের জনগণ; সবাই জানতো। তো সব মিলিয়ে আমি মনে করি ইতিবাচক অনেক কিছু আছে এই সিরিজে। কিন্তু যেটা আগেই বললাম, এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কেন আমরা জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষটা করতে পারছি না।
আপনি জুলাই মাসে বলেছিলেন, ভারত জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে কিছু শিখেছে কি না সেটা টের পাওয়া যাবে ইংল্যান্ড সিরিজের পর। তারা কি কিছু শিখেছে বলে মনে হয়?
হ্যাঁ, তারা শিখেছে। এমনকি, ভারতের বোলিং ইউনিট অনেক ভালো ছিল এবার। আমি সিরিজের মধ্যে একটা ইংলিশ পত্রিকা পড়ছিলাম। তারা বলেছিল, এই মুহূর্তে যদি সেরা চারজন ফাস্ট বোলারের নাম আসে, তার মধ্যে তিনজনই হবে ভারতীয় (ইশান্ত শর্মা, জসপ্রীত বুমরাহ, মোহাম্মদ সামি)। আরেকজন হলেন ইংল্যান্ডের জেমস অ্যান্ডারসন। আমার মনে হয় এটা হলো সেরা প্রশংসাবাণী।
আর ব্যাটিংয়ে যেটা হয়েছে, আমার মনে হয় দুই দলের জন্যই কঠিন ছিল। বলের মুভমেন্ট ছিল অনেক, সিমও করেছে খুব। ব্যাটসম্যান কে, সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম না কারণ সবার জন্যই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আপনার ভাগ্যে থাকলে আপনি ভালো করবেন, নয়তো নয়। আরেকটা ব্যাপার হয়েছে, ভারত প্রতিবার মেঘলা আবহাওয়ায় ব্যাট করেছে। ইংল্যান্ড ব্যাট করেছে রোদের মধ্যে। এটাকে আমি কোনো অজুহাত দিচ্ছি না। আমি শুধু বলছি যে, যারা এখানে জন্মেছে, যাদের এই কন্ডিশন চেনা তারাও বিপদে পড়েছে। এটা সত্যি, আপনাকে এই সত্যিটা মানতেই হবে।
বারবার বলা হচ্ছে প্রস্ততিতে ঘাটতি ছিল। আপনার কি এখনও মনে হয় দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ না খেলে ট্রেনিং (অনুশীলন) করাটাই শ্রেয়? ঠিক একই কথা বিরাট কোহলি স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে মাইকেল হোল্ডিংকে বলেছিলেন ফাইনাল ম্যাচের আগে।
প্রতিপক্ষ যদি দুর্বল হয়, আর তাদের বিপক্ষে যদি পরপর দুই থেকে তিনটি ম্যাচ থাকে, তাহলে আমরা ভাববো না। কারণ এটা একটা খেলা। কিন্তু আপনারা যখন খুব ব্যস্ত সূচীর মধ্যে আছেন, যখন আপনার ক্যালেন্ডার আপনার সবকিছু বলে দিচ্ছে, তখন আসলে প্রস্তুতি ম্যাচের মতো জিনিসগুলো করার সুযোগ খুব কম থাকে। এখন, আমরা অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করবো টেস্ট সিরিজের আগে কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচের আয়োজন করার জন্য।
আপনি কি এরই মধ্যে এই অনুরোধের কথা বিসিসিআইকে জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, এরই মধ্যে জানানো হয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার জন্য জায়গা পাওয়া যাবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
তাহলে বলতে চাইছেন, আপনি প্রস্তুতি ম্যাচের বিপক্ষে নন?
একেবারেই না! কেন বিপক্ষে হবো? আপনি কেবল ফলাফলটাই দেখতে পারবেন। প্রতিবার দ্বিতীয় টেস্টের পর আমরা ভালো করেছি। এর চাইতেও ভালো হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেন আমরা প্রথম টেস্ট থেকেই সেই অবস্থানে আসতে পারছি না?
ভারতের ব্যাটিংয়ে ফেরা যাক। আপনি বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ দলকে হতাশ করেছিল। ইংল্যান্ডেও সেই ব্যাটিংটাই হতাশ করেছে ভারতকে। তো কোচ হিসেবে এই ব্যর্থতার কী ব্যাখ্যা দেবেন?
দেখুন, একটা কথা আমি আগেই বলেছি। যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য হাওয়ায় ভেসে আসা ডিউক বল একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। অ্যালিস্টার কুক একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হয়েও স্বীকার করেছেন যে উইকেটে এত ঘাস আর বলের এত মুভমেন্ট তিনি আগে দেখেননি। আমার এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলার নেই। লোকটি ১৬১ টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, যার অর্ধেকই ইংল্যান্ডের মাটিতে। তার মতো একজন মানুষের এই বিষয়ে এমন মন্তব্য সিরিজের অবস্থা বলে দেয়। এমনকি আমার ক্ষেত্রে, ক্রিকেটার হিসেবে বলেন, ধারাভাষ্যকার হিসেবে বলেন, এমনকি কোচ হিসেবে বলেন, উইকেটে বলের এমন মুভমেন্ট আমি আগে দেখিনি।
টেকনিক ও টেম্পারমেন্ট; এর একটি অথবা দুটিতেই কি ভারতীয় ওপেনারদের ঘাটতি দেখেছেন?
এটা হলো হাওয়ায় গতি বদলানো বল খেলার একটা গুণ, যা আমাদের ওপেনাররা ভালো করে। আপনি যদি সিরিজটা ভালো করে খেয়াল করেন, আমাদের ওপেনাররা অনেক পরে খেলা শুরু করেছে। আগে তারা অনেক বল ছেড়েছে। বিরাট কোহলি এই কাজটা শুরু করেছিল। সে পুরোপুরি সফলও হয়েছে। এটার সঙ্গে আপনার ভাগ্যকেও আপনার সঙ্গে থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলবো, ওভালে দ্বিতীয় ইনিংসে যখন কুক ব্যাট করতে নামলেন তখন তিনি অনেকবার আঘাত পেয়েছেন। আমাদের প্রতিটি ফাস্ট বোলার তাকে আঘাত করেছে। সেটাও অন্তত ১৫-২০ বার। এটা অনেক মজার। কিন্তু আমরা যখন ব্যাট করতে নামলাম, ইংলিশ বোলাররাও একই কাজ করলো, কিন্তু আমরা ব্যর্থ হলাম। প্রথম বলেই আউট হলো কোহলি।
কোহলির প্রথম বলে আউট হওয়া দেখে কি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন?
সত্যি বলতে, প্রথম বলে কোহলির আউট হওয়া আমাকে অবাক করেনি। কারণ এটা ছিল একটা মানসিক অবসাদ। এটা অনেক লম্বা একটা সফর ছিল। সে (কোহলি) পুরোটা সময় মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল, ইনিংস শেষে ১০ মিনিট সময় পেয়েছে ব্যাট-প্যাডের জন্য। ঘটনাটি খুব দ্রুত ঘটে গিয়েছিল।
আপনি নিজেও টেস্টে ওপেন করতেন। কয়েকবার বাজে সময়ে উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস আপনি নিজের ক্যারিয়ারে দেখিয়েছিলেন। এই সময়ে কোচ হিসেবে আপনার ওপেনারদের নিজেদেরকে প্রমাণের জন্য কী করতে বলেন?
তারা চেষ্টা করছে। লোকেশ রাহুল শেষ ইনিংসে কী করলো সেটা দেখলেই টের পাবেন। আপনার সাহস থাকতে হবে, সেটাকে সামনেও আনতে হবে। একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে নোংরা ও কুৎসিত দেখে ভয় পেলে চলবে না। সবসময় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তাহলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪-১ এর সিরিজ হার আপনাকে বিব্রত করেনি? একজন কোচ হিসেবে এটা আপনার উপর প্রভাব ফেলছে না?
না, তেমন কিছু নয়। আমরা এখনও বিশ্বের এক নম্বর দল। তাছাড়া ইংল্যান্ড জানে আমরা কীভাবে লড়াই করেছিলাম। তাদের গণমাধ্যম জানে আমরা কতটা লড়াই করেছিলাম। আমরা নিজেরাও জানি আমরা কিভাবে লড়েছি মাঠে।
তো এই পুরো সফরে পাওয়া সেরা প্রশংসাবাণী কী ছিল?
ওভালে তখন শেষ ইনিংস চলে। এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বললেন, “আমি গেল ২৫ বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেট অনুসরণ করছি। তো আমি এখন গর্বিতভাবে বলতে পারি যে তোমরা এখন একটা দল হিসেবে শেষ পর্যন্ত লড়তে পারো।“
ফিচার ইমেজ- Getty Image