Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গৌতম গম্ভীর: ভারতীয় ক্রিকেটের হিরো নাকি ব্যাড বয়?

একটি সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে থাকা লোকটি যতই ভাল অভিনয় করুক না কেন সিনেমা শেষে নায়িকাকে জয় করে দর্শকদের চোখের মধ্যমণি কিন্তু সেই নায়কটিই। খেলার মাঠও এর ব্যতিক্রম নয়। খেলা শেষে দর্শকদের বাহবা পাওয়ার যোগ্য তিনিই হন যিনি ব্যাট হাতে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে দলকে নিয়ে যান জয়ের প্রান্তে। আড়ালে থেকে যায় ওপারে থাকা ব্যক্তিটির অবদান। খেলার মাঠে তার আগ্রাসী মনোভাব কিংবা প্রতিপক্ষ কোনো খেলোয়াড়ের দিকে ধেয়ে যাওয়া। এ কারণে আপনি হয়তো গৌতম গম্ভীরকে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’ বলতেই পারেন, তবে ভারতকে ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা জেতাতে তার অবদান নেহায়েত কম নয়। কিন্তু নায়ক হতে পারলেন কই। দুর্ভাগ্য তাকে পার্শ্বঅভিনেতাই বানিয়ে রেখেছে।

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল

ফিরে দেখা যাক, ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি স্বাগতিক ভারত। ২৭৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে ভারত। ব্যক্তিগত ৪৭ রানের সময় নিশ্চিত রান আউট হতে পারতেন। ১৯ তম ওভারে মুরালির করা এক বলে দুই রান নিতে যান, তবে সৃষ্টিকর্তা তাকে এভাবে আউট হতে দেননি। অবিশ্বাস্য এক ডাইভে নিশ্চিত রান আউট থেকে বেঁচে যান। সেঞ্চুরি থেকে তখন মাত্র ৩ রান দূরে, বোল্ড হন থিসারা পেরেরার বলে। যুবরাজকে সাথে নিয়ে ম্যাচ শেষ করেন অধিনায়ক ধোনী। ভারত জয় পায় ৬ উইকেটে। বিশ্বজুড়ে হতে থাকে ধোনির জয়জয়কার। আড়ালে থেকে যায় দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করা গম্ভীরের ১২২ বলে ৯৭ রানের ইনিংসটি।

গৌতমের অবিশ্বাস্য সেই ডাইভ; Source: AFP

শৈশব

১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে গৌতমের জন্ম। বাবা দীপক গম্ভীর ছিলেন টেক্সটাইল ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। একমাত্র ছোটবোন একতাকে নিয়েই তাদের ছোট্ট সংসার। তবে গৌতমের শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে নানা-নানীর কাছে। মাঝখানে কিছুদিন ছিলেন মামা পবন গুলাটির কাছে। তার মামাই ছিল তার মূল প্রেরণা, ক্রিকেটে তার প্রথম মেন্টর। দিল্লির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্রিকেট একাডেমিতে সঞ্জয় ভরদ্বাজের হাতে হয় তার ক্রিকেটে হাতেখড়ি।

ক্রিকেটে আনুষ্ঠানিক যাত্রা

১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে দিল্লি টিমের হয়ে অভিষেক হয় গৌতমের। ২০০০ সালে সুযোগ পান ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমিতে।২০০২ সালে ভারত সফররত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩ দিনের প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে মাঠে নামেন গৌতম। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ২১৮ রান করেন তিনি। তার ব্যাটিং প্রতিভায় মুগ্ধ হন দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়। কিছুদিন পর রঞ্জি ট্রফিতে রেলওয়ে একাদশের বিপক্ষে করেন এক ডাবল সেঞ্চুরি, যা ছিল ভারতীয় জাতীয় দলে তার সুযোগ পাওয়ার পূর্বাভাস।

২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু। পরের বছর বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের বিপক্ষে আসে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পান একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম শতক। মাঝখানে টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, তবে বীরেন্দ্র সেহওয়াগকে নিয়ে একদিনের ক্রিকেটে ওপেনিং জুটিতে ছিলেন নিয়মিত।

গৌতম গম্ভীর; Source: AFP

২০০৭ এর বিশ্বকাপে দলে সুযোগ পাননি। সেই টুর্নামেন্টে ভারত প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে। দলে জায়গা না পাওয়া প্রসঙ্গে গৌতম জানান-

যখন দল থেকে বাদ পড়ি তখন সময়টা এমন ছিল যে, আমি খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি অনুশীলন যোগ দিতে পারছিলাম না। নিজেকে কোনভাবেই সমর্থন দিতে পারিনি।

প্রথম রাউন্ডে ভারত বাদ পড়লে ভারতীয় দলকে কম তোপের মুখে পড়তে হয়নি। বিশ্বকাপ শেষে বাংলাদেশের বিপক্ষে দলে ডাক পান গৌতম। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি দলে তার অবস্থা শক্ত করতে সাহায্য করে।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসর। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সঙ্গী হয় ভারত। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গম্ভীরের ৫৪ বলে ৭৫ রানের সুবাদে ৫ উইকেটে ১৫৭ রান করে ভারত। ১৫৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে তিন বল হাতে রেখেই ১৫২ রানে অল আউট হয় পাকিস্তান। ৫ রানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ভারত। ১৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেওয়া ইরফান পাঠানের হাতে ওঠে ম্যান অব দ্য ম্যাচ এর পুরস্কার। ইরফানের ৩ উইকেটের কাছে চাপা পড়ে যায় গম্ভীরের ৭৫ রানের ইনিংসটি। পুরো টুর্নামেন্টে ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ ২২৭ রান করেন গৌতম গম্ভীর, যার মধ্যে তিনটি ছিল অর্ধশতক।

জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব লাভ

২০১০ সালে নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে গম্ভীরকে অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। গম্ভীরের নেতৃত্বে সেই সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে ভারত। ২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বিপক্ষে ভারতের জার্সি গায়ে শেষবারের মতো নেতৃত্ব দেন গম্ভীর। সে ম্যাচেও জয় পায় ভারত। বলা বাহুল্য, গম্ভীরের অধীনে ৬ ম্যাচ খেলে ৬টিতেই জয় পেয়েছে ভারত।

গম্ভীর বনাম আফ্রিদি

২০০৭ সালে কানপুরে এক ম্যাচে ক্রিকেট বিশ্ব সাক্ষী হয়ে থাকে মাঠের ভেতরের আরেক লড়াইয়ের। আফ্রিদির করা এক বলে সিঙ্গেল নিতে যান গম্ভীর। পথিমধ্যে আফ্রিদি থাকায় তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেন গম্ভীর। বিষয়টি হালকাভাবে নেননি আফ্রিদি। কিছু একটা বলতে শোনা যায়। অপরপক্ষ থেকে তেড়ে আসেন গম্ভীর। পরে আম্পায়ার বিষয়টির সমাধা করে উভয়কে শান্ত করেন।

গম্ভীর ও আফ্রিদি; Source: blogspot.com

গম্ভীর বনাম কামরান আকমল

২০১০ সালের এশিয়া কাপের ঘটনা। ডাম্বুলাতে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। ২৬৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করছিল ভারত। ব্যাটিংয়ে তখন ধোনী ও গম্ভীর। ড্রিংকস ব্রেকের ঠিক একটু আগে কট বিহাইন্ডের আবেদন জানান পাকিস্তানের উইকেটরক্ষক কামরান আকমল। তবে ভিলেন কিন্তু এখানে কামরানও। বার বার আম্পায়ারকে বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, ওটা আউট ছিল। ড্রিংকস ব্রেকের সময় আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি গম্ভীর। পাল্টা জবাব দিতে ধেয়ে যান কামরানের দিকে। পরে ধোনি এবং আম্পায়ার বিলি বাউডেনের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়।

কামরান আকমলের সাথে আগ্রাসী গৌতম গম্ভীর; Source: rediff.com

আইপিএল ক্যারিয়ার

২০০৮-১০ সাল পর্যন্ত আইপিএলে খেলেছেন নিজ শহরের দল দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে। ২০১১-তে পাড়ি জমান কলকাতা নাইট রাইডার্সে। টেবিলের তলানিতে থাকা কেকেআর যেন গম্ভীরের অধিনায়কত্বের ছোঁয়ায় বদলে যেতে থাকে। পরের বছর চেন্নাই সুপার কিংসকে হারিয়ে শিরোপা জেতে কেকেআর। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তোলে কেকেআর। তবে কেকেআর ম্যানেজমেন্ট তার প্রতি নেহায়েত সুবিচারও করেনি। তাকে দলে ধরে রাখেনি কেকেআর। ২০১৮ এর আইপিএল নিলামে ফিরে যান নিজ শহরের দল দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে। আইপিএলের দশ আসর মিলিয়ে তার রান সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের ওপরে।

গম্ভীর বনাম কোহলি

খেলার মাঠে তার আগ্রাসনে বাদ যায়নি তার স্বদেশী খেলোয়াড়রাও। তবে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে না, বরং আইপিলে। ২০১৩ সালে আইপিএলে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে বিরাটের সাথে তার আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা যায়। বালাজীর করা ১০ম ওভারের ১ম বলে আউট হয় কোহলি। সতীর্থদের নিয়ে উদযাপন করেন গম্ভীর। রাগে গম্ভীরের দিকে এগিয়ে যায় কোহলি। কোহলির দিকে তেড়ে যান গম্ভীর নিজেও। পরে বিষয়টি মীমাংসা করেন গম্ভীরের আরেক সতীর্থ রজত ভাটিয়া।

পুরো বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করছেন রজত ভাটিয়া; Source: Zee news

ব্যক্তিগত জীবন

২০১১ সালে বিয়ে করেন ছোটবেলার বান্ধবী নাতাশা জৈনকে। ২০১৪ সালে তাদের ঘরে আসে আজিন নামের কন্যাসন্তান। গত বছর দ্বিতীয়বারের মতো কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন গম্ভীর।

স্ত্রী নাতাশা জৈনের সাথে গৌতম গম্ভীর; Source: celebritykick.com

গম্ভীর পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে সালমান খানের পরিবারের সাথে। সালমানের বোন অর্পিতা খানের দেবর অক্ষয় শার্মার সাথে বিয়ে হয়েছে গম্ভীরের চাচাত বোন রাধিকা গম্ভীরের।

শহীদ কন্যা জোহরার পাশে গম্ভীর

আট বছরের ছোট্ট মেয়ে জোহরা। মেহেদিরাঙা হাত নিয়ে গিয়েছিল স্কুলে। ফিরে এসে শোনে বাবা আব্দুল রশিদ আর নেই। জম্মু ও কাশ্মীরের মিলিটারি ক্যাম্পে এক সন্ত্রাসী আগ্রাসনে প্রাণ হারায় এএসআই আব্দুল রশিদ। ছোট্ট জোহরার কান্না নাড়া দেয় গম্ভীরকে। তার পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। টুইট বার্তায় গম্ভীর জানান,

আমি হয়তো তোমাকে তোমার বাবাকে এনে দিতে পারবো না। তবে আমি তোমাকে তোমার স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে পারি। তোমার শিক্ষার দায়িত্ব আমি নিলাম।জোহরা তোমার চোখের পানি মাটিতে পড়তে দিও না। তোমার মা এত কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না। তোমার শহীদ পিতার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

শহীদ আব্দুল রশীদের কন্যা জোহরা; Source: Twitter

ভারতীয় দলে তার অবদান নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। দল থেকে তার বাদ পড়ার পেছনে অনেকেই ধোনিকে দায়ী করেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার রান সংখা ৫,২৩৪। ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এখন দেখার বিষয় একটিই, দেশের জার্সি গায়ে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেন তো গম্ভীর?

ফিচার ইমেজ:espncricinfo

Related Articles