Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘অর্বাচীন’ জিম্বাবুয়ের বলিষ্ঠ ক্রিকেট ইতিহাস

জিম্বাবুয়ে, নামটা শুনলে আমাদের চোখে ভাসতে শুরু করে ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির চাপে জীর্ণশীর্ণ একটি দেশ, দারিদ্র্য যার পিছু ছাড়েনি এখনো। আর জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেট কথাটা মনে পড়লেই চোখে ভাসতে শুরু করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করা এক টেস্টখেলুড়ে দেশ, যারা টেস্ট অঙ্গনে ২৭ বছর কাটিয়ে ফেলার পরও হামাগুড়ি দিতে শেখেনি। বাস্তবতা অস্বীকার করার জো নেই, তবে বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে জিম্বাবুয়ে নিতান্তই অর্বাচীন কোনো জাতি নয় বৈকি! শুধু তা-ই নয়, তাঁদের রয়েছে বর্ণাঢ্য এক ক্রিকেট ইতিহাস। চলুন, আজ তাঁদের ইতিহাসের পাতায় একবার হানা দিই!

ইতিহাসের সূচনালগ্ন

রুড কনসেশন; Image Credit: Wikimedia Commons

১৮১০ সাল নাগাদ আফ্রিকার দক্ষিণাংশে প্রখ্যাত যোদ্ধা শাকা প্রতিষ্ঠা করেন ‘জুলু’ সাম্রাজ্য, যার অধীনে বহু বছর ধরে চলমান দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটিয়ে একাধিক শত্রুভাবাপন্ন রাজ্য অবশেষে একই ছাদের তলায় এসে দাঁড়ায়। জুলু সাম্রাজ্যের প্রধান নেতা এবং কমান্ডারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিলিকাজি (Mzilikazi), তবে বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে সম্রাট শাকাকে ক্ষুব্ধ করে তোলাতে জিলিকাজি এবং তাঁর অনুসারিদেরকে বিতাড়িত করা হয় জুলু সাম্রাজ্য থেকে। ১৮২৩ সালে জুলু সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর জিলিকাজি এসে বসতি গড়েন ট্রান্সভাল (বর্তমান ক্যালিফোর্নিয়া) থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বাংশে। সেখানে তাঁদেরকে ‘ডিবেল’ (Ndebele), মতান্তরে ‘মাতাবেলে’ ডাকা হয়; স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ দাঁড়াতো ‘ম্যান উইথ দ্য লং শিল্ডস’। ১৮৩৮ সালেই কালক্রমে সেই অঞ্চলটির নাম হয়ে ওঠে ‘মাতাবেলেল্যান্ড’।

১৮৮৮ সাল, মাতাবেলেল্যান্ড তখন জিলিকাজির পুত্র লবেঙ্গুলা খুমালোর অধীনস্থ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখনও বর্ধনশীল, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। এরই ধারাবাহিকতায় সে তালিকায় নাম উঠলো দক্ষিন আফ্রিকার এই অংশেরও, ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘রুড কনকাশন’ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন লবেঙ্গুলা। এই চুক্তির ফলে গোটা মাতাবেলেল্যান্ড চলে যায় তিনজন ব্রিটিশ এজেন্টের হাতে, যাদের নাম যথাক্রমে চার্লস রুড, জেমস ম্যাগুয়ের এবং ফ্রান্সিস থম্পসন। তবে এদের পিছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন একজন ব্যবসায়ী, সিসিল রোডস। ১৮৯৩ সালে এই রোডসের নামেই এই উপনিবেশের নাম কাগজে-কলমে হলো ‘রোডেশিয়া’।

জিলিকাজি’র জুলুল্যান্ড থেকে মাতাবেলেল্যান্ড যাত্রা; Image Credit: Wikimedia Commons

উপনিবেশ স্থাপনের পর তৎকালীন ফোর্ট ভিক্টোরিয়াতে (বর্তমান মাসভিঙ্গো) প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়, যাতে অংশগ্রহণ করে তৎকালীন সালিসবুরি এবং বুলাওয়ে। নাম দুটো চেনা লাগছে নিশ্চয়ই? ঠিক ধরেছেন, জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়ে যায় সেদিনই। তৎকালীন রোডেশিয়ারই রাজধানী ছিলো সালিসবুরি, যে শহরটিকে আমরা এখন ‘হারারে’ নামে চিনি।

রোডেশীয় ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলো

রোডেশিয়ার পতাকা; Image Credit: Wikimedia Commons

১৮৯০ সালের ১৬ আগস্টে (মতান্তরে ১২ আগস্ট) ফোর্ট ভিক্টোরিয়াতে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচেই প্রথমবারের মতো গঠিত হয় রোডেশীয় ক্রিকেট দল। সেই ম্যাচের পর ১৮৯১ সালে সালিসবুরিতে গঠিত হয় প্রথম ক্রিকেট ক্লাব, একইসাথে প্রথমবারের মতো শুরু হয় প্রথম শ্রেণীর লীগও। তিন বছর পর বুলাওয়েও একই পথ অনুসরণ করে এবং তিনটি দল গঠন করা হয়। ১৮৯৫ সালে বুলাওয়ে সফরে যায় সালিসবুরি ক্রিকেট দল, যেখানে রোডেশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আন্তঃপ্রাদেশিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। বহু বছর ধরে রোডেশিয়ানরা এই দিনকে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন পর্যন্ত করেছে!

১৮৯৭ সালে সালিসবুরির ক্রিকেট দলকে অফিসিয়াল রূপ দেওয়া হলো, এবার নাম দেওয়া হলো ‘সালিসবুরি স্পোর্টস ক্লাব’। এই ক্লাবটি এখন পর্যন্ত রয়েছে, যদিও কালের পরিক্রমায় ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে তা এখন অনেকটাই বিবর্ণ। ক্লাবটিকে এখন ‘হারারে স্পোর্টস ক্লাব’ বলা হয়ে থাকে, যার স্টেডিয়ামটি সুবিখ্যাত।

১৮৯৮-৯৯ সালে লর্ড মার্টিন ব্লেডেন হকের নেতৃত্বাধীন একটি ক্রিকেট দল বুলাওয়েতে দুই ম্যাচের সিরিজ খেলতে আসে, যা ছিলো যেকোনো ব্রিটিশ ক্রিকেট দলের জন্য প্রথম রোডেশিয়া সফর। লর্ড হক ছিলেন অভিজ্ঞ ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার, যিনি ব্রিটিশ ক্রিকেট দলকে বেশ কিছু প্রীতি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকান উপনিবেশের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন জেমস লোগান, তিনি একজন উৎসাহী ক্রিকেট ভক্ত ছিলেন। তিনিই লর্ড হককে অনুরোধ করেন, যেন রোডেশিয়াতে একটি ট্রফি নিয়ে যেতে পারেন। লর্ড হক সম্মত হন এবং এরপর ১৯০৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতে থাকে ‘লোগান কাপ’। এখনও জিম্বাবুয়ের প্রাদেশিক দলগুলো এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে থাকে।

জেমস ডগলাস লোগান; Image Credit: Wikimedia Commons

১৯০৪-০৫ সালে রোডেশিয়া প্রথমবারের মতো জোহানেসবার্গে একটি ক্রিকেট দল পাঠায়, যাতে কুরি কাপে তারা মুখোমুখি হয় ট্রান্সভালের। লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি থেকেই হোক কিংবা সামর্থ্যের অভাব, ট্রান্সভালের কাছে রোডেশিয়া ইনিংস এবং ১৭০ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। এরপর বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু ক্রিকেট ম্যাচে অংশগ্রহণ করে বটে, তবে ১৯৩০ সালের আগপর্যন্ত সেটার প্রতি খুব একটা যত্নবান হয়ে উঠতে পারেনি রোডেশিয়া। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে রোডেশীয় ক্রিকেট দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে বটে, তবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফলাফল আনতে সক্ষম হয়নি। তবে বেশ কিছু খেলোয়াড় বেরিয়ে আসেন, যার ফলাফল পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁদেরকে।

দ্বিতীয় পর্যায়: লক্ষ্য এবার প্রতিষ্ঠালাভ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বকাল থেকে রোডেশিয়া ক্রিকেট নিয়ে কিছুটা সচেতন হয় এবং তারই প্রমাণস্বরূপ বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। এমনকি ১৯৩১-৩২ মৌসুমে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত কুরি কাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবও অর্জন করে, যদিও প্রতিপক্ষ দল ট্রান্সভাল সামান্য কূটকৌশল অবলম্বন করে সে যাত্রায় রোডেশিয়াকে চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পেতে দেয়নি। এই ম্যাচটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অব্দি কুরি কাপে খেলা রোডেশিয়ার শেষ ম্যাচ। তবে থেমে থাকেনি রোডেশিয়ান ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা। তখন পর্যন্ত রোডেশিয়াতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট শুরু না হলেও প্রথম রোডেশিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে আফ্রিকার হয়ে টেস্ট খেলে ফেলেন ডেনিস টমলিনসন।

ডেনিস টমলিনসন; Image Credit: Cricket Monthly

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের ‘রয়েল এয়ারফোর্স ট্রেনিং বেস’ রোডেশিয়াতে তৈরি করার সৌজন্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেশ কিছু প্রীতি ম্যাচ খেলা হয়। কোনোটাই ঠিক ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হিসেবে স্বীকৃত না হলেও কূটনৈতিকভাবে ক্রিকেট একটা বেশ শক্ত ভিত পেয়ে যায়। এরই বদৌলতে ১৯৪৬ সালের পর থেকে আবারও নিয়মিতভাবে কুরি কাপে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে রোডেশিয়া, ততদিনে তা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আফ্রিকার অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কুরি কাপে নিয়মিত ভালো খেলতে শুরু করায় আফ্রিকার অন্যান্য অঙ্গরাজ্যগুলো রোডেশিয়া সফরে আগ্রহী হয়।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কুরি কাপকে দ্বিস্তরীকরণ করা হয়; যেখানে রোডেশিয়া হঠাৎই নিজেদেরকে আবিষ্কার করে, কোনো স্তরেই জায়গা মিলছে না তাঁদের! বরং তাঁদেরকে বলা হয় ‘বি সেকশন’-এর দলগুলোকে হারিয়ে ‘এ সেকশন’-এ উত্তীর্ণ হতে; যথাযোগ্য প্রতিভা হোক কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাব, রোডেশিয়া সে যাত্রায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়নি। বি সেকশনে নেমে গেলো রোডেশিয়া, ধাক্কা খেলো তাদের ক্রিকেট ভবিষ্যৎটাও।

রোডেশিয়া এবং কুরি কাপ রহস্য

প্রথমবারের মতো কুরি কাপে প্রতিনিধিত্ব করা রোডেশিয়া ক্রিকেট দল; Image Credit: Wikivisually

১৯৫৩-৬৪ সাল পর্যন্ত রোডেশিয়ার অধিনায়ক ছিলেন ডেভিড লুইস, যাকে এখন পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন বলে মানা হয়। তাঁর অধীনে দলে খেলেছেন পার্সি ম্যানসেল, গডফ্রি লরেন্স, জো প্যাট্রিজের মতো আফ্রিকান লিজেন্ডরা। তবে সত্যিকার অর্থে রোডেশিয়ান ক্রিকেটকে বিশ্বের নজরে এনেছিলেন কলিন ব্ল্যান্ড, যার দুর্ধর্ষ ফিল্ডিং রীতিমতো কাঁপিয়ে দিতো প্রতিপক্ষদেরকে। ব্যাটিং অ্যাভারেজের দিক থেকেও খুব একটা পিছিয়ে ছিলেন না (২১ টেস্টে ৪৯.০৮ গড়ে রান করেছেন), তবে ফিল্ডিং প্রতিভাটাই যেন ছাপিয়ে গেছে সবকিছু। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফিল্ডার ছিলেন বলেই মনে করা হয়। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিং লিগ্যাসি, যে পতাকা জন্টি রোডস, ল্যান্স ক্লুজনার, হার্শেল গিবস হয়ে এখন পর্যন্ত বহন করছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স, জেপি ডুমিনিরা।

তবে নিজেদের সর্বকালের সেরা দলটা রোডেশিয়া সম্ভবত পায় সত্তরের দশকে। সে দলে ছিলেন মাইক প্রোক্টরের মতো চ্যাম্পিয়ন অলরাউন্ডার; যোগ্য সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন জ্যাকি দু প্রিজ, ডানকান ফ্লেচার, ব্রায়ান ডেভিসন, জন ট্রাইকোস, প্যাডি ক্লিফট এবং রবিন জ্যাকম্যানের মতো খেলোয়াড়দেরও। বলা হতো, শুধু আফ্রিকা নয়, বরং গোটা বিশ্বেই সেই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী দলটা ছিলো রোডেশিয়ার। রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলো তাঁরা; এখন পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না, এত শক্তিশালী একটি দল নিয়েও গোটা সত্তরের দশকে একবারের জন্যও কুরি কাপ হাতে তুলতে পারেনি রোডেশিয়া! ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে অনেকটা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলো বটে, সেই কুখ্যাত ‘উইলমট ওয়াক-অফ’ ম্যাচে। তবে আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্বমূলক সব সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। পরবর্তী দুই ম্যাচে ব্যাটিং ধ্বসের নিয়মিত প্রদর্শনীর জন্য সৃষ্ট হতাশা থেকেই হোক বা অন্য কোনো কারণ, ওই শতকে আর কোনো মৌসুমেই কুরি কাপটা ছুঁয়ে দেখা হয়ে ওঠেনি মাইক প্রোক্টরদের, যদিও কাগজে-কলমে তৎকালীন ক্রিকেট দুনিয়ায় ঐ দলটিই ছিল অবিসংবাদিত সেরা।

রোডেশিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে: স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ

রোডেশিয়ার অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার মাইক প্রোক্টর; Image Credit: Patrick Eagar/Popperfoto/Getty Images

১৯৭৯-৮০ মৌসুমে ইয়ান স্মিথের থেকে প্রেসিডেন্ট পদটি অলংকৃত করেন অ্যাবেল মুজোরেওয়া, আর শুরু হয় রোডেশিয়ার স্বাধীনতা প্রক্রিয়া। নাহ, আসলে রোডেশিয়া নয়, বরং ‘দক্ষিণ রোডেশিয়া’ শব্দটা ব্যবহারই সমীচীন। সে মৌসুমেই শেষবারের মতো কুরি কাপে অংশগ্রহণ করে রোডেশিয়া, যাতে তাঁদের কেতাবি নাম দেওয়া হয় জিম্বাবুয়ে-রোডেশিয়া। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা লাভের ফলে রোডেশিয়া পরিণত হয় ‘জিম্বাবুয়ে’তে, যার ফলে আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত অবস্থায় ভোগ করা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্বাসন থেকে মুক্তি পায় তাঁরা।

জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের নতুন যুগের গোড়াপত্তন হয় সে বছরই। ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করার বদৌলতে লিস্টারশায়ার এবং মিডলসেক্স দুইটি পূর্ণশক্তির দলকে জিম্বাবুয়েতে পাঠায় প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলার জন্য। এরপর ১৯৮১ সালের ২১ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল’ তথা আইসিসি-র সহযোগী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলস্বরূপ প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় ১৯৮৩ সালে। আর প্রথম দর্শনেই দেখায় চমক, বিশ্বকাপে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে বিধ্বস্ত করে জয় ছিনিয়ে নেয় জিম্বাবুয়ে। বিশ্বকে হতবাক করে দেওয়া এক জয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিলেও এরপর দেশে শ্বেতাঙ্গদের অনুপ্রবেশ এবং বর্ণবাদী কিছু সমস্যার কারণে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে তাদের অগ্রযাত্রা।

আকস্মিক পারফরম্যান্সে ভড়কে দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে বিধ্বস্ত করে বিশ্বকে চমকে দেয় জিম্বাবুয়ে ; Image Credit: Getty Images

১৯৮৩ থেকে শুরু করে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে একে একে তিনটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য খুব একটা ছিল না। ফলে তাঁদেরকে সহকারী দেশগুলোর মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘আইসিসি ট্রফি’ খেলতে বাধ্য করা হয় এবং সবগুলো ম্যাচই জিতে পুনরায় মূল স্রোতে ফিরে আসে তাঁরা। এক্ষেত্রে মূল পুরোধা হিসেবে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করেন অ্যান্ডি পাইক্রফট, ডেভ হটন, পিটার রসন এবং জন ট্রাইকোস। ঠিক ধরেছেন, সেই ট্রাইকোস, যিনি প্রোক্টরের দলেও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ট্রাইকোস সত্তরের দশকে খেলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে চড়িয়ে, এরপর নব্বইয়ের দশকেও বিপুল পরাক্রমে মাঠ মাতিয়েছেন জিম্বাবুয়ের হয়েও।

টেস্ট জগতে পদার্পণ

অভিষেক টেস্টে জিম্বাবুয়ে দল; Image Credit: David Munden/ Popperfoto

নব্বইয়ের দশকটা জিম্বাবুয়ের শুরুটা হলো দারুণভাবে। একদিকে পাইক্রফট, হটনরা ছিলেন ফর্মের চূড়ান্ত শিখরে, অন্যদিকে অভিষিক্ত হলেন ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়। দারুণ একটা দল পেলো জিম্বাবুয়ে, তবে সাথে মাথার উপর ঘুরছিলো আরেকটা হুমকি। নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা, খুব দ্রুতই টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে সেই খেলোয়াড়দেরকে হারিয়ে ফেলার বিশাল এক সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিলো। তৎকালীন জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট অলউইন পিচানিক এবং ডেভ এলমান-ব্রাউন বেশ কয়েক বছর ধরেই সকল টেস্টখেলুড়ে দেশগুলোর কাছে তদবির করছিলেন জিম্বাবুয়ের টেস্ট স্বীকৃতির জন্য। অবশেষে সুফল আসে ১৯৯২ সালে, আইসিসি থেকে টেস্ট স্বীকৃতি লাভ করে জিম্বাবুয়ে।

১৯৯২ সালের ১৮ অক্টোবর হারারে স্পোর্টস গ্রাউন্ডে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে জিম্বাবুয়ে, প্রতিপক্ষ ভারত। প্রথম ম্যাচেই সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়ে ৪৫৬ রানের বিশাল রানপাহাড় দাঁড় করায় ভারতের সামনে এবং ভারত ফলো-অনে বাধ্য হয়। তবে ম্যাচটিতে জয় পাওয়া হয়নি তাঁদের, ড্র-তেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পর এখন পর্যন্ত তাঁরাই প্রথম এবং একমাত্র টেস্ট-খেলুড়ে দল, যারা প্রথম টেস্ট ম্যাচে পরাজয় এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

পাকিস্তানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে প্রথম টেস্ট জিতে নেয় জিম্বাবুয়ে; Image credit: Cricinfo

তাঁদের প্রথম টেস্ট জয় আসতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে তাঁদের একাদশতম ম্যাচে প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের বিপক্ষে হারারে ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউন্ডে টসে জিতে ব্যাটিং-এ নেমে গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের ‘মহাকাব্যিক’ ২০১*, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ১৫৬ এবং গাই হুইটালের ১১৩* রানের সৌজন্যে ৪ উইকেটে ৫৪৪ রানের এক বিশাল রানপাহাড় দাঁড় করায় জিম্বাবুয়ে। জবাব দিতে নেমে হিথ স্ট্রিকের বোলিংতোপে ফলোঅনে বাধ্য হয় পাকিস্তান। মাত্র ৯০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধ্বসিয়ে দেন হিথ স্ট্রিক। এরপর ফলোঅনে খেলতে নেমে আবারও ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে পাকিস্তান, এবার মাত্র ৩৫ রানেই ৫টি উইকেট হারিয়ে বসে তাঁরা। দুই ইনিংসেই ইনজামাম-উল-হক লড়াকু দুটো ফিফটি করলেও শেষ রক্ষা হয়নি।

এই ম্যাচের পরই যেন খোলনলচে বদলে যায় জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেট, জিম্বাবুয়ে দেখা পায় তাঁদের স্বর্ণালী প্রজন্মের। ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, মারে গুডউইন, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, পল স্ট্র্যাং, নীল জনসন, অ্যান্ডি ব্লিগনট, হিথ স্ট্রিক, সঙ্গে হেনরি ওলোঙ্গা – উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখতে শুরু করেছিলো জিম্বাবুয়ে।

উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখতে শুরু করেছিলো জিম্বাবুয়ে; Image Credit : Cricinfo

তাহলে এখন জিম্বাবুয়ের কেন এমন দৈন্যদশা? যেখানে উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ পাওয়ার কথা ছিলো তাদের, সেখানে কেন এই ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলা? সে কথা আজ থাক, নাহয় আরেকদিন সেই কলঙ্কিত অধ্যায়টুকুতে ঘুরে আসা যাবে!

(চলবে)

ফিচার ইমেজ: Cricinfo

Related Articles