Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সর্বকালের সেরা নির্বাচন করা কি সম্ভব?

১.

প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব বিচার-বিবেচনা আছে এবং প্রতিটি বিষয়েরই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। আপনি যতই আরেকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে এবং নিজের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে। তবে একজন যুক্তিবাদী এবং বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় বিশেষজ্ঞদের মতামতকে মেনে নেওয়ার পক্ষে থাকেন। ফুটবলের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের চেয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে, বিশেষজ্ঞ আসলে কাদের বলে?

কেউ খুব ভালো খেললেই যে বিশেষজ্ঞ হতে পারবেন তা কিন্তু নয়। উদাহরণ হিসেবে পেলে আর ম্যারাডোনাকেই নেয়া যাক। তাদের খেলোয়াড়ি জীবন যতটাই উজ্জ্বল, ঠিক ততটাই বিপরীতে ফুটবল সম্পর্কিত তাদের অনুমান। আবার মোটামুটি খেলতে পারতেন এমন মানুষও খুব ভালো ফুটবল বুঝেন। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কিংবা মরিনহো থাকবেন এই গ্রুপে।

খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার খুব ভালো না হলেও ফুটবলটাকে তার বেশ ভালোই বোঝেন; Image Source: peoplespostmedia

নিজে ভালো খেলতেন, একইসাথে ভালো ফুটবল বুঝতেন, এমন বিশেষজ্ঞও আছেন। বেকেনবাওয়ার, ক্রুয়েফ কিংবা জিনেদিন জিদানরা থাকবেন এই গ্রুপে। এখন প্রশ্ন হলো, ফুটবলে ‘সর্বকালের সেরা’ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞদের মতামতটা কী?

ভালো খেলার সাথে সাথে ফুটবলটাকে বুঝতেনও ভালো ক্রুয়েফ আর বেকেনবাওয়ার; Image Source: Getty Images

আসলে ‘সর্বকালের সেরা’ খুবই জটিল এক বিষয়। সেটা শুধু ফুটবল-ক্রিকেটের ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো বিষয়েই। এর চেয়েও বড় কথা হলো, ‘সর্বকালের সেরা’ কথাটাই কেমন যেন একটু ঘোলাটে। যেহেতু আগামী দিনেও খেলাটা চলবে, তাই বলা উচিত যে ‘এই পর্যন্ত সেরা’। কিন্তু মানুষ কল্পনাবিলাসী। সে তার কল্পনায় বিচার করে নেয় যে সবচেয়ে সেরার সীমাটা আসলে কতদূর? সেই অনুযায়ী সে একটা বিচার করে। তবে কখনো যদি কল্পনা সীমা ছাড়িয়ে যায় তাহলে নতুন কিছুকে মানুষ গ্রহণ করে। একটা সময় পর পর তিনবার ব্যালন ডি’অর জেতাটা অসম্ভব মনে হতো। মিশেল প্লাতিনি প্রথমবারের মতো সেই কীর্তি গড়ে বিশ্বাস এনেছেন, সেটা সম্ভব। পরবর্তীতে লিওনেল মেসি টানা চারবার ব্যালন ডি’অর জিতে সীমাটাকে আরেকটু প্রশস্ত করেছেন। কাজেই ‘সর্বকালের সেরা’ উপাধিটি কিছুটা অযৌক্তিক হলেও সমস্যা নেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দলীয় খেলায় একজনকে সর্বকালের সেরা বলা ঠিক কতটুকু যুক্তিযুক্ত? দৌড় কিংবা সাঁতারের মতো খেলায় বিভিন্ন যুগের মাঝে একজনকে সেরা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কারণ, ১০০ মিটার পথ পার হতে একজন অ্যাথলেটের কতটুকু সময় লেগেছে সেটা সব যুগেই একই হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এরপরেও কিছু কথা থাকে। আগের যুগের চেয়ে এই যুগের দৌড়বিদরা অনেক গতিসম্পন্ন, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব গুণাবলীর জন্য নয়, যুগের ব্যাপার বলেই।

টেনিসের মতো একক খেলায় সেরা নির্বাচনটা তুলনামূলক সহজ দলীয় খেলার তুলনায়; Image Source: Amader Orthoneeti

তবে এভাবে চিন্তা করলে তো আগের যুগের খেলোয়াড়েরা অনেক পিছিয়ে থাকবেন। আবার বর্তমানের খেলোয়াড়দের চেয়ে পরবর্তীতে আসা খেলোয়াড়েরা এগিয়ে যাবেন। তাহলে তুলনাটা কীভাবে করা উচিত? সবদিক ভেবেও হয়তো কিছুটা তুলনা করা সম্ভব। টেনিসের মতো খেলায় সেটি বিবেচনা করাটাও কষ্টের। কারণ, সেখানে দেখা যাবে একই সময়ে হয়তো অনেক গ্রেট খেলোয়াড় এসে পড়েছেন, আবার অন্য একটা সময়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল শূন্যতা। তার মানে আপনার প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিশালী ছিল, সেটাও সেরা নির্বাচনে একটা বিবেচ্য বিষয়। একসময়ের সেরা খেলোয়াড়ের চেয়ে অন্য সময়ের তৃতীয় সেরা খেলোয়াড়ও ভালো হতে পারেন। একই সময়ে অনেক ‘গ্রেট খেলোয়াড়’ এসে পড়লে এই সমস্যাটা হয়।

দলীয় খেলায় তো সেরা নির্বাচন করা আরো কষ্টকর। এই জায়গায় বিবেচ্য বিষয় স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। তাই যেকোনো নির্বাচন নিয়ে মতের অমিল হবার সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে। ফুটবলের মতো দলীয় খেলায় পজিশনভিত্তিক সেরা খেলোয়াড় বাছাই করাটাই অনেক ভালো হতো। একজন গোলকিপারের সাথে কি একজন ফরোয়ার্ডের তুলনা করা যায়? মাঠে দুজনের কাজই তো ভিন্ন। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই ধরনের তুলনা হরহামেশাই হয়। মানুষ সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্বাচন করে, সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার কিংবা স্ট্রাইকার নয় (যদিও সেটাও অনেক সময় করা হয়)। ‘সর্বকালের সেরা’ শুধু একজন মানুষ নির্বাচন করে না, ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা থেকেই করা হয়। এটা করা একেবারে অযৌক্তিকও নয়। কোন খেলোয়াড় কোন পজিশনে খেলে খেলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব তৈরি ও ভূমিকা রাখতে পেরেছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারা যাবে। ২০০২ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় কে ছিলেন? অলিভার কান। দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় কে ছিলেন? রোনালদো। অলিভার কান ছিলেন গোলকিপার আর রোনালদো হচ্ছেন স্ট্রাইকার। তাহলে ফিফা তুলনায় এই দুজনকে আনলো কেন? দুজন তো দুই পজিশনে খেলেন! তার মানে দুই ভিন্ন পজিশনে খেললেও তাদের মাঝে তুলনা করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তুলনাটা হয় কীভাবে?

এই প্রশ্নেই আপনার দূরদর্শীতার বিষয়টি এসে পড়বে। আপনি কতটা বিশ্লেষণ করতে পারেন কিংবা কতটা দূরদর্শী সেটা বিচারের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই ভিন্ন পজিশনে খেলা খেলোয়াড়ের মাঝে তুলনা করা উচিত না হলেও অবাস্তব নয়। ধরুন, কাউকে অপশন দেওয়া হলো ওজিল অথবা নয়্যারের মাঝে একজন খেলোয়াড়কে বেছে নিতে। বাকি দশজন খুব সাধারণ খেলোয়াড়। আপনি হয়তো বলবেন, দুজন দুই পজিশনের খেলোয়াড়। কিন্তু কাউকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় নয়্যার আর বাইচুং ভুটিয়ার মাঝে একজনকে বেছে নিতে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষ (সম্ভবত সবাই) নয়্যারকেই বেছে নেবেন। এখন একটু চিন্তা করুন, কেন সবাই এই বাছাইটা করবেন? কারণ, বেশিরভাগের কাছেই মনে হবে, নয়্যারকে দিয়ে যে আউটপুট পাওয়া যাবে, সেটা বাইচুংকে দিয়ে পাওয়া যাবে না। এটাই মূল বিষয়। আপনার কাছে যে খেলোয়াড়টি বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে মনে হবে, আপনি তাকেই বাছাই করবেন। যখন বিশেষজ্ঞরা বিচার করেন, তখন এভাবেই করেন। তার মানে, দুই পজিশনে খেলা খেলোয়াড়ের মাঝেও ভালোভাবেই তুলনা করা সম্ভব। অতীতে সেটা করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে এটা ঠিক যে, যিনি ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলেন তিনি গোলকিপার কিংবা ডিফেন্ডারের চেয়ে সেরা হবার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক পজিশনে থাকবেন। কারণ ফুটবল মাঠে তার কাজ দেখানোর সুযোগ বেশি থাকবে।

জর্জ বেস্টকে মিস করেছে বিশ্বকাপ; Image Source: Boss Hunting

২.

এখন সেরা বলতে কি বোঝায় সেটা একটু বুঝার চেষ্টা করা যাক।

মনে করুন, ১০০ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে সর্বকালের সেরার একটা তালিকা করতে বলা হলো। এখন এখানে কারো মতে পেলে হবেন, কারো মতে ম্যারাডোনা হবেন, কারো মতে জিদান হবেন, কারো মতে ক্রুয়েফ কিংবা কারো মতে অন্য কেউ। কিন্তু এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে কারো মতেই সেরা খেলোয়াড়টা রজার মিলা হবে না। এখন এই ১০০ জনের মতে যারা সর্বকালের সেরা, তাকেই এই খেতাব দেওয়া হবে। এখানে বিষয়টা এমন হতে পারে যে, এই ১০০ জনের মাঝে ১ জনের চোখে প্লাতিনি সর্বকালের সেরা। তাহলে প্লাতিনিও আপেক্ষিকভাবে সর্বকালের সেরা হিসেবে বিবেচিত হবেন, হয়তো পৃথিবীর খুব ক্ষুদ্র একটা অংশের কাছে। তবে এই ১০০ জনের মাঝে যিনি কি না সবচেয়ে বেশি বিশেষজ্ঞের কাছে সেরা বলে বিবেচিত হবেন, তাকেই সেরা হিসেবে মেনে নিতে হবে। এরপর সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে যিনি সেরা, তিনি দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে কম মানুষের কাছে যিনি সেরা, তিনি তালিকার সবার শেষে থাকবেন। আর যিনি কি না কারো কাছেই সেরা হবেন না, তিনি তালিকাতেই থাকবেন না।

এই বিচার মেনে নেবার অর্থ এটা নয় যে, যিনি প্লাতিনিকে সেরা মনে করেছেন তিনি তার মতামত পরিবর্তন করে ফেলবেন। সেটার প্রয়োজন নেই। তবে তিনি যদি এরপরও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিচার নিরপেক্ষ হয়নি তাহলে সমস্যা। যেকোনো একটা বিচার আপনাকে মেনে নিতেই হবে।
সর্বকালের সেরা বা একই যুগের দুজনের মাঝে সেরা নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সূত্র নেই। কাজেই শেষ পর্যন্ত এই ধরনের যেকোনো নির্বাচনেই বিতর্ক থেকেই যায়। ইদানিং ইন্টারনেটে ঢুকলে সেরা নিয়ে অনেক ভোটিংয়ের ফলাফল পাওয়া সম্ভব। এখন কথা হচ্ছে, আপনি কোন ভোটিংটা গ্রহণ করবেন? আমার বা আপনার করা বিচারও অনেক বিশেষজ্ঞদের চেয়ে ভালো হতে পারে। কিন্তু দিনশেষে সংশ্লিষ্ট খেলার বিশেষজ্ঞদের মতামতকেই গ্রহণ করা উচিত। তবে এই মতামত ব্যক্তিগত হওয়া যাবে না, হতে হবে সম্মিলিত। কারণ অনেকের মতামত ঘাটলে বিচ্ছিন্ন ফলাফল পাওয়া যাবে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দের একটা বিষয় উঠে আসে, সেটা দিয়ে সরাসরি কোনো সমাধান আসবে না। কিন্তু সম্মিলিত ভোটিংয়ে এর সুযোগ অনেক কম থাকে।
আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, সর্বকালের সেরার বিবেচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাটাকারদের নাম আসে, কেন ডিফেন্ডারদের সেভাবে নাম আসে না? অথচ ডিফেন্ডারদের বা গোল কিপারদের কাজের গুরুত্বও কিছু কম নয়। ডিফেন্স সবসময়ই কিছুটা থ্যাঙ্কলেস জব। আপনি সারাদিন ১০টা সেভ করে ১টা গোল খেলেও মানুষ গালি দেবে, আর স্ট্রাইকারদের ১০টা মিসের পর কোনোক্রমে ১টা গোল হলেও মানুষ হাততালি দেবে। তবুও সেরার তালিকায় অ্যাটাকাররা কেন এগিয়ে থাকে, সেটা নিয়ে একটু অনুমান করা যাক।

মনে করুন, আপনার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ডিফেন্ডার আছে। সে সর্বোচ্চ কী করতে পারবে? আপনার দলকে গোল খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু এরপরও আপনি টাইব্রেকারে হেরে যেতে পারেন, জেতার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। কিন্তু একজন অ্যাটাকারের পক্ষে সম্ভব ২ গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়লেও ৩ গোল দিয়ে ম্যাচে ফিরে আসা। আর একটা বিষয় হলো, ডিফেন্ডারের ভুল করলে ফিরে আসার সুযোগ কম, একটা ভুলে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়লে ফিরে আসা খুব কঠিন। কিন্তু স্ট্রাইকারের সুযোগটা তুলনামূলক অনেক বেশি থাকে, আপনি অসংখ্য ভুল করার পরও ম্যাচে ফেরার সম্ভাবনা থাকবে।

‘মোটামুটি মানের একজন স্ট্রাইকার এবং শক্তিশালী ডিফেন্ডার’ কম্বিনেশনের চাইতে সম্ভবত ‘মোটামুটি মানের একজন ডিফেন্ডার এবং শক্তিশালী স্ট্রাইকার’-এর কম্বিনেশনের পক্ষেই বেশিরভাগ মানুষ থাকবেন।

আমরা কেউই সঠিকভাবে জানি না, সর্বকালের সেরার তালিকা যখন করা হয় তখন ঠিক কোন ক্রাইটেরিয়ার উপর ভিত্তি করে কাউকে আগে কিংবা পরে রাখা হয়। এছাড়া সেরার যতগুলো তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তার ক্রমেও কিছুটা রদবদল আছে। তাই ক্রাইটেরিয়াগুলো বের করার জন্য কিছু সম্মানজনক তালিকা লক্ষ্য করা যাক। সেগুলো খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

৩.

এক নজরে গত শতাব্দীর সেরার কয়েকটা তালিকা লক্ষ্য করা যাক। এখানে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সম্মিলিত কয়েকটি ভোটিংয়ের ফলাফল দেওয়া হলো। এগুলো সবই গত শতাব্দীর খেলোয়াড়দের নিয়ে করা। এ ফলাফলগুলো থেকে প্রথমে একটা ক্রাইটেরিয়া বের করার চেষ্টা করা যাক। তারপর এই শতাব্দীর সেরাদের সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যাবে।

ফিফা

যেহেতু ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা, তাই তাদের মূল্যায়নকেই সবচেয়ে মূল্য দেওয়া উচিত। ফিফার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটাই নির্বাচন হয়। সেখানকার সিস্টেমটা ছিল এমন, ম্যাগাজিন রিডারদের ভোট থেকে ৫০% গণনা করা হবে আর জুরিদের ভোট থেকে ৫০% নেওয়া হবে। এরপর দুটো যোগ করে গড় দিয়ে নির্বাচন করা হবে। এখানে সেরা হিসেবে একজনকেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। জুরিদের মাঝে ৮৭.৫% ভোট পান পেলে, আর ডি স্টেফানো পান ১২.৫% ভোট। জুরির সংখ্যাটা পাওয়া যায়নি, তবে ফলাফল দেখে আঁচ করা যায়, কমপক্ষে ৮ জন ভোটার ছিলেন। জুরিতে আটজন থাকলে তাতে পেলের ভোটার ছিলেন সাতজন, বাকি একজন ভোট দিয়েছিলেন ডি স্টেফানোর ব্যালট বাক্সে। (জুরির সংখ্যাটা ১৬ হলে পেলে পেয়েছিলেন ১৪ ভোট, ২৪ হলে পেলে ২১, ৩২ হলে পেলে ২৮)। অন্য আর কেউ ভোট পায়নি।

ম্যাগাজিন রিডারদের ভোটের রেজাল্টটা একটু বলা যাক। পেলে (৫৮%), স্টেফানো (৭%), ম্যারাডোনা (১২%), বেকেনবাওয়ার (৫%), ক্রুয়েফ (৪%), প্লাতিনি (২%), গারিঞ্চা (২%), জিকো (২%), বেস্ট (৪%), গার্ড মুলার (২%) ও ব্যাজিও (২%)।

এখন দুটো মিলিয়ে এই ভোটিংয়ের চূড়ান্ত ক্রমটা একটু লক্ষ্য করা যাক।

IFHHS

IFHHS এর পুরো মানে হচ্ছে International Federation of Football History & Statistics। ফুটবলের পরিসংখ্যান বিচার করার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য একটি সংস্থা। সাবেক খেলোয়াড় এবং সাংবাদিকদের নিয়ে এই ভোটিংটা হয়েছিল। এর ফলাফল নিম্নরূপ :

ব্যালন ডি’অর বিজয়ী কর্তৃক নির্বাচিত

১৯৯৯ সালে ব্যালন কমিটি তাদের ইতিহাসে যত ব্যালন উইনার আছেন, তাদের নিয়ে একটি ভোটের আয়োজন করেন। ভোটের নিয়ম ছিল, প্রত্যেক ভোটার পাঁচটি ভোট দিতে পারবেন। প্রথম পজিশনের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পজিশনের জন্য ৪, তৃতীয় পজিশনের জন্য ৩, চতুর্থ পজিশনের জন্য ২ আর পঞ্চম পজিশনের জন্য ১ পয়েন্ট।

সে সময় পর্যন্ত ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ছিলেন ৩৪ জন। এর মাঝে স্ট্যানলি ম্যাথিউস, বেস্ট আর সিভোরি ভোট দেননি, লেভ ইয়াসিন মারা গিয়েছিলেন। ফলে মোট ভোটার ছিলেন ৩০ জন। এদের মাঝে আবার ডি স্টেফানো শুধুমাত্র প্রথম পজিশনের জন্য ভোট দিয়েছিলেন, প্লাতিনি প্রথম আর দ্বিতীয় পজিশনের জন্য দিয়েছিলেন, আর জর্জ উইয়াহ পঞ্চম পজিশনের জন্য দুজনকে নির্বাচন করেছিলেন। তাদের ক্রমটা একটু লক্ষ্য করি।

এখানে ৩০ জন ভোটারের ২৯ জনই তাদের সেরা পাঁচে পেলেকে রেখেছিলেন। ক্রুয়েফ থাকতে পেরেছিলেন ২৩ জনের সেরা পাঁচে, ম্যারাডোনা ২০ জনের। ১৭ জনের প্রথম পছন্দ ছিলেন পেলে, ৪ জনের প্রথম পছন্দ স্টেফানো, ৩ জনের প্রথম পছন্দে ম্যারাডোনা।

৪.

উপরের ভোটিংগুলো লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, সেখানে ১ম পজিশনটা সব জায়গাতেই পেলে দখল করে বসে আছেন, সেটাও একটু বেশি ব্যবধানেই। অথচ অনেকেরই পেলের বিপক্ষে কিছু অভিযোগ আছে। যেমন: পেলে ভালো দল পেয়েছিলেন, তার সময়ে গোল করা এখনকার চেয়ে সহজ ছিল, এখনকার ট্যাকটিক্সে সফল হওয়া কঠিন, অফসাইড রুলস শক্তিশালী ছিল না প্রভৃতি। অভিযোগগুলো একেবারে মিথ্যা নয়, তবে যারা বিচার করেছিলেন তাদেরও নিশ্চয়ই এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে ধারণা ছিল। কিন্তু তারা বিষয়গুলোকে আমলে নেননি। কাজেই আমাদের মেনে নেওয়া উচিত যে, সেরা নির্বাচনে এই ফ্যাক্টরগুলো আসলে খুব বেশি মূল্য পায়নি। আর সত্যিকার অর্থে, এভাবে বিচার হয়ও না। পেলে এই যুগে ব্যর্থ হতেন বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আগের যুগে বেশি গোল পেতেন, এমন কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। সচরাচর বলা হয়, যিনি গ্রেট তিনি সব যুগেই গ্রেট হবেন। মোহাম্মদ আলীর চেয়ে মাইক টাইসনের যুগের বক্সিং অনেক উন্নত, কিন্তু এই যুক্তি দেখিয়ে এটা কেউ বলেন না যে, আলীর চেয়ে মাইক টাইসন ভালো বক্সার।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের ভোটিংয়ে পেলে’র অবস্থান ১ নম্বরে; Image Source: Pinterest

উপরের তালিকার মাঝে মিলগুলো কী? এদের সবার ক্লাব ক্যারিয়ারই ঝলমলে। কিন্তু এদের সবার মাঝে সাধারণ মিল কোথায়? পুসকাস বাদে এদের সবাই অন্তত একটি ব্যালন ডি’অর পেয়েছেন (ম্যারাডোনা এবং পেলে পরে সম্মানসূচক ব্যালন পেয়েছেন)। এদের সবাই ক্লাব আর জাতীয় দল দুই জায়গাতেই ভালো খেলেছেন।

এদের সবাই কি বিশ্বকাপ জিতেছেন? না, সাতজনের মাঝে চারজনই বিশ্বকাপ জেতেননি। ক্রুয়েফ তো কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টই জেতেননি। পুসকাসেরও কোনো আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা নেই। ডি স্টেফানো কিংবা জর্জ বেস্ট তো বিশ্বকাপ খেলতেই পারেননি। সাতজনের সবাই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়, এমনকি দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সেরা খেলোয়াড়ও হননি। প্লাতিনি কোনো বিশ্বকাপেই সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় আসতে পারেননি। কিন্তু এরা সবাই বিশ্বকাপের অলস্টার দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। এরা সবাই বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দলকে রক্ষা করেছিলেন।

ডি স্টেফানো এবং জর্জ বেস্টকে ব্যতিক্রম ধরা যায়। তারা বিশ্বকাপ মিস করেছেন, নাকি বিশ্বকাপ তাদেরকে মিস করেছে, সেটাই আলোচনার বিষয়। বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়াটা তাদের ব্যর্থতা হিসেবে কখনোই বিবেচিত হয় না। ১৯৫০ এবং ১৯৫৪ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ বর্জন করে, ১৯৫৮-তে যখন ডি স্টেফানো স্পেনের হয়ে খেলা শুরু করেছিলেন, তখন স্পেন বাছাইপর্ব পেরোতে পারেনি। ১৯৬২-তে তিনি অসুস্থ ছিলেন। বেস্টের জন্য বিশ্বকাপ চিরকালীন এক আক্ষেপের নাম, নাকি বিশ্বকাপের জন্য বেস্ট, এটা নিয়ে আলোচনা করলে সারাদিনেও আলোচনা শেষ হবে না।

ডি স্টেফানো ছিলেন বিশ্বকাপ খেলতে না পারা দুর্ভাগা; Image Source: Managing Madrid

সফলতা কিংবা ব্যর্থতার মাঝেও কিছুটা হিসাব আছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা মর্যাদাসম্পন্ন, কিন্তু জার্মানিকে নিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়ে ওয়েলসকে নিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলে সেটার মর্যাদা কিছুটা হলেও বাড়ার কথা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো বিষয়ে ৮০ পেলেই ‘এ প্লাস’ ধরা হয়; কিন্তু ৮৫ পেয়ে এ প্লাস, আর ৯৭ পেয়ে এ প্লাসের মধ্যে স্থূল পার্থক্য আছে। আবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হতে পারাটা ব্যর্থতা, কিন্তু ইউক্রেনকে নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হতে পারা আর ব্রাজিলকে নিয়ে বিশ্ব চ্যম্পিয়ন না হওয়ার মাঝেও কিছুটা তফাৎ আছে। ধরুন, পরীক্ষায় পাস করতে হলে ৪০ মার্ক পাওয়াই যথেষ্ট। একজন ৩৫ পেয়ে ফেল করলো, আরেকজন ৫ পেয়ে। দুজনেই ফেল বটে, কিন্তু এর মধ্যেও কে বেশি খারাপ, তা বের করা সম্ভব।

তালিকায় থাকা খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপে কী করেছিলেন সেটা একটু উল্লেখ করা যাক।

পেলে

৩ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব জিতেছেন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ, ফ্রান্স তখন তুখোড় ফর্মে। সেমিফাইনালের ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে ফ্রান্সকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দেন পেলে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে ফাইনালেও প্রথম গোলটি করেন। ‘৫৮ বিশ্বকাপে পান সিলভার বুট, ‘৭০ বিশ্বকাপে পান গোল্ডেন বল। ‘৫৮ আর ‘৭০ এর বিশ্বকাপে অলস্টার একাদশে সুযোগ পান।

ম্যারাডোনা

‘৮৬ বিশ্বকাপ জেতান একক কৃতিত্বে। আর্জেন্টিনার জন্য সবচেয়ে ক্রুশিয়াল ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল। ‘ফকনার যুদ্ধ’ নিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও ম্যাচের উত্তাপ একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ২-১ গোলে জেতা ম্যাচের দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা, জিতে নেন গোল্ডেন বল আর সিলভার বুট। ‘৯০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে অ্যাসিস্ট করেন, সেই বিশ্বকাপে জেতেন ব্রোঞ্জ বল। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দল থেকে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে অলস্টার দলে জায়গা পান। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনা থাকেন, আর্জেন্টিনা থেকে আর একজনই ছিলেন অলস্টার টিমে, গোয়াকচিয়া।

ক্রুয়েফ

১৯৭৪ বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব শেষে দ্বিতীয় পর্বে এক গ্রুপে ছিল তিনটি দল। এখান থেকে মাত্র একটি দল ফাইনালে যাবে। সেই গ্রুপে নেদারল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর ইস্ট জার্মানি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবুন তো, এই অবস্থায় কে উঠতে পারে? ১৯৭৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড ফাইনালে উঠেছিল। সবচেয়ে ক্রুশিয়াল ম্যাচ ছিল ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৪-০ গোলে জেতা ম্যাচে ২ গোল, আর ব্রাজিলের বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে ১ গোল করেন ক্রুয়েফ। ফাইনালে ক্রুয়েফকে ফাউল করেই পেনাল্টি পায় নেদারল্যান্ড। পেনাল্টি ক্রুয়েফ নেননি, হয়তো ভুলই করেছিলেন। কারণ ইতিহাস বলে, ক্রুয়েফ গোল করেছেন এমন কোনো ম্যাচে নেদারল্যান্ড হারেনি। ফাইনাল হারলেও গোল্ডেন বল জেতেন ক্রুয়েফ। বিশ্বকাপের অলস্টার দলে জায়গাও পান।

বেকেনবাওয়ার

১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেলেন মিডফিল্ডার হিসেবে। কোয়ার্টার আর সেমিফাইনালে একটি করে গোল করেন, টুর্নামেন্টে ৪ গোল করে ব্রোঞ্জ বুটও জেতেন। তবে ফাইনালে দল হেরে যায় স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানি মুখোমুখি হন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের, এই বিশ্বকাপে খেলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। ৪৯ মিনিটেই ২ গোলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ৬৮ মিনিটে গোল করে বেকেনবাওয়ারই ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন জার্মানিকে। শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে জেতে জার্মানি। কিন্তু সেমিতে ইতালির কাছে হেরে যায়। ‘৭৪ বিশ্বকাপেও ডিফেন্ডার হিসেবেই খেলেন এবং জার্মানি বিশ্বকাপ জেতে, সেই টুর্নামেন্টে সিলভার বল জিতে নেন বেকেনবাওয়ার। ‘৬৬, ‘৭০ আর ‘৭৪ বিশ্বকাপের অলস্টার দলে সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি।

প্লাতিনি

১৯৮২ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত ফ্রান্স যেতে পেরেছিল। তবে সেটা করার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি ফ্রান্সকে। মূল পরীক্ষাটা হয় সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে। সেখানে একটা গোল করেন প্লাতিনি, কিন্তু টাইব্রেকারে হেরে যায় ফ্রান্স। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ২য় পর্বে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচে প্রথম গোলটি করেন প্লাতিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে গোল করেন, পরে টাইব্রেকারে ব্রাজিল হেরে যায়। সেমিতে ফ্রান্স হেরে যায় জার্মানির বিপক্ষে। তৎকালীন ফ্রান্সের মতো একটি দলের জন্য পরপর তিন ম্যাচে সাবেক চ্যাম্পিয়নকে হারানো একটু কষ্টকরই। ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপের অলস্টার টিমে জায়গা পান প্লাতিনি।

পুসকাস

১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে পুরোপুরি ফিট না হয়েও মাঠে নেমেছিলেন পুসকাস। মাত্র ৮ মিনিটের মাঝেই এক গোল এবং এক অ্যাসিস্ট করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নিয়ে যান পুসকাস। কিন্তু পরবর্তী ১০ মিনিটের মাঝেই যোদ্ধা জাতি জার্মানি ২ গোল করে ম্যাচে ফেরত আসে। বিরতির পর হাঙ্গেরির দুটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে এবং পুসকাসের একটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত খেলা শেষ হবার ১০ মিনিট আগে জার্মানি গোল করে হাঙ্গেরিকে হতাশায় ভাসায়, আর পুসকাস হয়ে যান ট্র্যাজিক হিরো। স্বদেশী ককসিস ৬ ম্যাচে ১১ গোল করার পরও ২ ম্যাচ মিস করা পুসকাস ১৪ গোল করে জিতে নেন বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল।

৫.

ফুটবলে কার দায়িত্ব আসলে কোনটা? গোলকিপারের দায়িত্ব সেভ করা, ডিফেন্ডারের মূল কাজ গোল কিপার পর্যন্ত যেন বল যেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা কিংবা মাঝেমধ্যে সুযোগ বুঝে উইং থেকে আক্রমণে সহায়তা করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্পটকিক থেকে গোল করার চেষ্টা করা। মিডফিল্ডের কাজ হচ্ছে আক্রমণে সহায়তা করা, সুযোগ তৈরি করা, স্ট্রাইকারকে পর্যাপ্ত বল সরবরাহ করা; মাঝে মাঝে গোল করলে সেটা বোনাস। অন্যদিকে, স্ট্রাইকারের মূল কাজ হচ্ছে গোল করা। 

কিন্তু এই সবই একজন সাধারণ খেলোয়াড়ের জন্য প্রযোজ্য। আপনি অসাধারণ হলে ব্যতিক্রম কিছু করতে হবে। অথবা বলা যায়, যারা অসাধারণ হিসেবে বিবেচিত হন তারা সবাই ব্যতিক্রমী কিছু করেছেন। গ্রেট খেলোয়াড়দের জন্য কাজের সংজ্ঞা আসলে নির্দিষ্ট নয়; তাদের একটাই কাজ, দলকে সর্বোচ্চ সাফল্য এনে দিতে হবে (নিজের সেরাটা দিয়েও যদি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন না করা যায়, তাহলে ভিন্ন কথা। ক্রুয়েফ, পুসকাস, প্লাতিনি সেই কাজটাই করেছেন)। সেটার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, সেটা করতে হবে। যদি চান্স ক্রিয়েশন যথেষ্ট হয় তাহলে ঠিক আছে, যদি সেই সুযোগ স্ট্রাইকাররা নষ্ট করেন তাহলে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেলে, ম্যারাডোনা, ক্রুয়েফ, পুসকাস, প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার – কেউই মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেননি। তবুও বিশ্বকাপের সবচেয়ে ক্রুশিয়াল মুহূর্তে গোল করে দলকে উদ্ধার করেছেন।

১৯৯০ বিশ্বকাপটা একটু লক্ষ্য করুন। সেই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার মাত্র একটি অ্যাসিস্ট, প্রায় পুরো বিশ্বকাপেই নিচে নেমে খেলেছেন। সেনাপতিরা এমন কাজই করে থাকেন। যখন দেখবেন আপনার চেয়ে আপনার প্রতিপক্ষ সবল, তখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় মূল সময়ের জন্য। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, আপনাকে ১০০ মিটার পথ যেতে হবে; আপনার সতীর্থরা যেতে পারলো ২০ মিটার, বাকি ৮০ মিটার আপনি হিসেব করে এগোবেন। আর আপনি যদি প্রথমে ৯০ মিটার গিয়েও শেষ করেন, তাহলে আপনার সতীর্থরা হয়তো বাকি ১০ মিটার পার হতে পারবে না। নিজে পারফর্ম করে বিশ্বকাপ জেতানোর কাজটিও ম্যারাডোনা আমাদের করে দেখিয়েছেন ১৯৮৬ সালে, আবার নিজে পেছনে থেকে সতীর্থদের কাছ থেকে খেলা বের করে ফাইনাল পর্যন্ত নেবার কাজটাও করে দেখিয়েছেন ১৯৯০ বিশ্বকাপে। গ্রেটদের বৈশিষ্ট্যই এমন, দল যেভাবে চাইবে সেই অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলা এবং তার সাথে মানিয়ে নেয়া। পেলে, বেকেনবাওয়ার, ক্রুয়েফ, ম্যারাডোনা, স্টেফানো- এরা সবাই দলের প্রয়োজনে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ২০১০ বিশ্বকাপে গ্রুপের ৩ ম্যাচে খেলে ৩টিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। দ্বিতীয় পর্বে স্পেনের কাছে হেরে যায় পর্তুগাল। হয়তো রোনালদোর কাছে পর্যাপ্ত বল যায়নি, কিন্তু আপনি গ্রেট হলে যখন দেখবেন আপনার কাছে বল আসছে না, তখন আপনাকে নিজেই নিচে নেমে বল যোগাড় করে নেবেন। আগের গ্রেটরা ঠিক এমন কিছুই করেছিলেন। ‘আপনার কাছে বল না আসলে আপনি সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাবেন, কিংবা আপনার তৈরি করা সুযোগ স্ট্রাইকারেরা নষ্ট করলে আপনার কী দোষ’ – এসব অজুহাতের সুযোগ নেই। যদি এই অজুহাতের সুযোগ থাকতো তাহলে ক্যারেকার নাম অনেকের আগে এসে পড়তো। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মোট ৫ গোল করেছিলেন ব্রাজিলের পক্ষে, কোয়ার্টারে ফ্রান্সের বিপক্ষেও ১ গোল করেছিলেন। টাইব্রেকারে বাদ পড়ে ব্রাজিল, কেউ এখানে ক্যারেকাকে দোষারোপ করেন না। ‘৯০ বিশ্বকাপেও তিনি ৩ গোল করেছিলেন, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে অন্তত ২টি অসাধারণ প্রচেষ্টা রুখে দেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক। সেই ম্যাচে ব্রাজিল ৮-০ গোলে জিতলেও বিচিত্র হতো না, অন্তত ৩টি বল গোলবারে লেগে ফেরত এসেছে। কিন্তু এরপরও কি ক্যারেকাকে কেউ ম্যারাডোনার পাশে দূরে থাক, বাতিস্তুতার পাশেও রাখে? অথচ নাপোলির স্বর্ণালী সময়ে ম্যারাডোনার অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন ব্রাজিলের এই স্ট্রাইকার। সেরা নির্বাচনে ‘কী হতে পারতো’ সেটার মূল্য নেই, ‘কী হয়েছে’ সেটাই বিবেচ্য। কী হতে পারতো বিবেচনা করলে আগের অনেক খেলোয়াড়কে নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে।

৬.

‘সর্বকালের সেরা’ নির্বাচনে বিশ্বকাপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? স্রেফ একটি টুর্নামেন্ট মাত্র, তবুও কেন যেন সেরা নির্বাচনে বিশ্বকাপটা মোটামুটি বেশ প্রাধান্য পায়। ফ্রান্সের হয়ে ৭২ ম্যাচে ৪১ গোল করার পাশাপাশি ফ্রান্সের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতানো প্লাতিনিও পেছনে পড়ে যান ১০৮ ম্যাচে ৩১ গোল করা জিদানের চেয়ে, কারণ জিদান যে বিশ্বকাপ জিতেছেন! 

বিশ্বকাপে ভালো করা মানেই যে সেরা, বিষয়টা এমনও নয়। থমাস মুলার দুই বিশ্বকাপে করেছেন ১০ গোল, ৩ বিশ্বকাপ খেলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল মাত্র ৩টি। এর মানে কি রোনালদো মুলারের চেয়ে খারাপ স্ট্রাইকার? ক্লোসা ভেঙেছেন রোনালদো লিমার বিশ্বকাপ রেকর্ড। তার মানে কি তিনি রোনালদো লিমার চেয়ে ভালো খেলোয়াড় হয়ে যাবেন?

শিলাচীর কথাও খুব বেশি আগের নয়। ১৯৯০ বিশ্বকাপের কথা। ইতালির নিজ দেশে বিশ্বকাপ, জিয়ানলুকা ভিয়েলির মতো স্ট্রাইকার দলে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই শিলাচী বেঞ্চে। কিন্তু বদলি হিসেবে নেমে এক ম্যাচে গোল করে উদ্ধার করলেন ইতালিকে। এরপর থেকে ইতালির গোল মানেই শিলাচী। ‘বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সাথে সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার’ – শিলাচীই সর্বশেষ উদাহরণ। কিন্তু শিলাচী সেরাদের তালিকায় নিশ্চিতভাবেই পেছনে পড়ে যাবেন বিশ্বকাপ না জেতা রবার্তো ব্যজিওর চেয়ে। বিশ্বকাপে ভালো খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অন্যান্য সময়ে খারাপ খেললে সেটার কোনো মূল্য থাকবে না। দুই জায়গাতেই আপনাকে একটু ব্যলেন্স করে চলতে হবে।
তবে পুরো ক্যারিয়ারে আপনি কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এক বিশ্বকাপে অসাধারণ কিছু করলেও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আসা সম্ভব। সব কয়টা তালিকাতেই প্লাতিনি কেন ক্রুয়েফ আর ম্যারাডোনার পেছনে? এটা একটু বিশ্লেষণ করলে কিছুটা বোঝা যেতে পারে।

১৯৮৪ ইউরোতে প্লাতিনি যা করেছেন, তা ফুটবল ইতিহাসে আর কেউ করতে পেরেছেন কি না সন্দেহ আছে। ফ্রান্স বরাবরই একটা মাঝারি গোছের দল ছিল। বিশ্ব ফুটবলে দল ভালো হওয়ার সাথে সাথে একজন তারকা খেলোয়াড়েরও প্রয়োজন হয়। প্লাতিনি আসার আগে ফ্রান্স ফুটবল দলে সেই মানের কোনো তারকা ফুটবলার ছিলেন না। এক জাঁ ফন্টেইন ছিলেন, যিনি এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড করেছিলেন (১৩ গোলের সেই রেকর্ডকে মোটামুটি অবিনশ্বরই ধরে নেওয়া যায়)। তবে তিনিও ক্লাব বা জাতীয় দলের হয়ে খুব বেশি কিছু জিততে পারেননি।
আগের বছরের ব্যালন ডি’অর জিতে ইউরো ১৯৮৪-তে প্লাতিনি তারকা হিসেবেই শুরু করেছিলেন। তবে সব তারকা নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন না, প্লাতিনি যেভাবে সুবিচার করলেন তা গোটা ফুটবল ইতিহাসেই বিরল।

গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্স ডেনমার্ককে হারায় প্লাতিনি’র দেয়া একমাত্র গোলে। এর পরের ম্যাচে বেলজিয়ামকে ৫-০ গোলে হারানো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন। তৃতীয় ম্যাচে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচে আরেকটি হ্যাটট্রিক করেন। সেমিতে পর্তুগালকে অতিরিক্ত সময়ে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচে গোল করেন ১১৯ মিনিটে। ফাইনালে স্পেনকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন।

ইউরো টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ থেকে শেষ ম্যাচের প্রতিটিতেই গোল করে ফ্রান্সকে এনে দেন প্রথম বড় কোনো শিরোপা। ৯ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ গোল করে ডেনমার্কের আর্নেসেন। সেই টুর্নামেন্টে প্লাতিনি কিন্তু অ্যাটাকিং মিডেই খেলেছিলেন, স্ট্রাইকার হিসেবে নয়।

১৯৮৪ সালের ফ্রান্সের ইউরো জয় আসলে কেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা আসলে এই মুহূর্তে বোঝা যাবে না। একটা তথ্য দেই, তাতে যদি কিছুটা বোঝা যায়। ১৯৬০ সালের ইউরোর প্রথম টুর্নামেন্টে ফ্রান্স চতুর্থ হয়, এরপর পাঁচটি টুর্নামেন্টে ফ্রান্স ইউরোতে কোয়ালিফাই করতেই পারেনি!

প্লাতিনিকে পিছিয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপ; Image Source: YouTube

ক্লাব পর্যায়েও অসাধারণ ছিলেন প্লাতিনি। তিনবার ব্যালনও জেতেন, সেটাও প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পর পর তিনবার। ম্যারাডোনার সময় নন-ইউরোপিয়ানরা ব্যালন পেতেন না, পরবর্তীতে সম্মানসূচক ব্যালন পান ২ বার। দুজনেই খেলতেন অ্যাটাকিং মিডে। ক্লাবের হয়ে গোলগড়ে দুজনেই খুব কাছাকাছি, প্লাতিনির ২২৪ গোল ( ০.৫১ গড়ে ৪৩২ ম্যাচে), ম্যারাডোনার ২৫৯ গোল (০.৫২ গড়ে ৪৯১ ম্যাচে)। জাতীয় দলের হয়ে প্লাতিনি একটু এগিয়ে, প্লাতিনির ৭২ ম্যাচে ৪১ গোল (০.৫৬ গড়) আর ম্যারাডোনার ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল (০.৩৭ গড়)।

জুভেন্টাসকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতান। ফাইনালে তার একমাত্র গোলেই জেতে জুভেন্টাস, হন টুর্নামেন্টের টপ স্কোরার। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জেতেন একবার, তাতেও গোল করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ প্লাতিনি।

ম্যারাডোনাকে অমরত্ব দিয়েছে বিশ্বকাপ; Image Source: Chimu Adventures

ম্যারাডোনা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেননি, নাপোলিকে নিয়ে লিগ জেতেন দুইবার। দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত অর্জনে প্লাতিনি খুব পিছিয়ে নেই ম্যারাডোনার তুলনায়, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েই আছেন। এরপরও প্লাতিনিকে পিছিয়ে দিয়েছে সেই বিশ্বকাপ। এখানে এসেই ম্যারাডোনার চেয়ে পেছনে পড়ে গিয়েছেন। সেমিতে প্রতিপক্ষ জার্মানি না হয়ে বেলজিয়াম হলে হয়তো আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্সই ফাইনাল হতো। বিশ্বকাপ জিতলে এখন যেভাবে ম্যারাডোনাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তেমনটাই হয়তো প্লাতিনিকে নিয়েও হতো। কিন্তু ওই যে, ‘যা হয়েছে’ সেটা নিয়েই বিচার হয়, ‘যা হতে পারতো’ সেটা নিয়ে নয়।
আজকের পর্বে আলোচনা করা হলো গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় এবং তাদের পারফরম্যান্স নিয়ে। আগামী পর্বে নতুন শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স এবং কারা কারা সেরার তালিকায় প্রথম দিকে আসতে পারেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

 

This article is in Bangla language. It is an analysis on how the greatest of all time should be judged. It's the first part on this article, more will be coming in future days. Please click on the hyperlinks to check references. 

Featured Image: Wallpapers-Football.Net

Related Articles