নেইমার আর খবরের শিরোনাম যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। ১৫ বছরের সান্তোস একাডেমির ছেলেটি ব্রাজিল সহ গোটা বিশ্ব মিডিয়ায় সেই যে এসেছিলো, তা আজ এত বছর পরেও চলছে। ব্রাজিলে ‘নতুন পেলে’ খেতাব পাওয়া খেলোয়াড় নেহায়েত কম আসেনি। কোনো তরুণ নজরকাড়া খেললেই তার ভাগ্যে এই তকমা জুটিয়ে দেয় মিডিয়া, নেইমারেরও জুটেছিল। খেলার মাঠের নেইমারকে সবাই ভালোই চেনে, একটু দেখে নেয়া যাক খেলার বাইরের নেইমারের জীবনধারা।
ক্লাবের সাথে চুক্তি
প্রথম যখন নেইমার সান্তোসের সাথে চুক্তি করেন তখন তার বেতন ছিল প্রতি বছরে ১.২ মিলিয়ন ডলার, যেটা ব্রাজিলিয়ান লিগে ১৭ বছরের এক তরুণের জন্য বিশাল অঙ্ক। অনেক বিশেষজ্ঞই তার বেতনকে তার উন্নতির অন্তরায় হতে পারে বললেও, উত্তরোত্তর তার উন্নতি ঘটেছেই। আস্তে আস্তে তার পেছনে যখন গোটা ইউরোপ ছুটেছে, তখন সান্তোস তার বেতন ৩ গুণ করে নতুন চুক্তি করতে বললে, সে তা প্রত্যাখ্যান করে। বলে রাখা ভালো, যে খেলোয়াড়ের চুক্তির মেয়াদ যত বেশি, তাকে কিনতে টাকা তত বেশি লাগে। তাই নেইমারকে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দেয়ার অর্থ ছিল, তাকে বিক্রির সময় অধিক টাকা পাওয়া!
এর কিছুদিন পর চেলসি তাকে পেতে সেই সময়কার বেতনের ৪ গুণ দিতে চাইলো। কিন্তু সে প্রস্তাবও নেইমার ফিরিয়ে দেন, তখন তার ইচ্ছে লা লিগায় যাওয়া। কিন্তু ঘরে-বাইরে বিভিন্ন চাপের মুখে সান্তোসে তিনি নতুন করে ৫ বছরের চুক্তি করেন। সেখানে তার বেতন ছিল ৪ মিলিয়ন ডলার প্রতি বছরে, যেটা সদ্য ১৮ পেরোনো ব্রাজিলিয়ান ঘরোয়া লিগের একজন খেলোয়াড়ের জন্য অচিন্ত্যনীয় পরিমাণ আয়। এরপর যখন প্রথম বার্সায় যোগ দেন তিনি, তখন তার বেতন ছিল বছরে ৯.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। এরপর ২০১৬ সালের দিকে তাকে কিনতে পিএসজি আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে বার্সাও সচেষ্ট হয়ে ওঠে তাকে রেখে দিতে। আবার পাঁচ বছরের চুক্তি হয় তার সাথে। বেতন বাড়িয়ে করা হয় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড। বাইআউট ক্লজ ১৮০ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২২২ মিলিয়ন পাউন্ড। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।
সেই ২২২ মিলিয়ন পাউন্ডেই তাকে কিনে নিল পিএসজি। আর বেতন? বছরে প্রায় ২৮ মিলিয়ন পাউন্ড। সেভাবে হিসেব করলে সেকেন্ডে .৮৮ পাউন্ড, মিনিটে প্রায় ৫৩ পাউন্ড, ঘন্টায় প্রায় ৩,১৯৮ পাউন্ড আর দিনে ৭৬,৮০০ পাউন্ড!
বিজ্ঞাপন জগতে নেইমার
২০১৩ সালেই ইউরোস্পোর্টস তাকে বিশ্বের ‘Most Marketable Athlete’ মনোনীত করে, তার পরেরবারও আবার তিনি একই ক্যাটাগরিতে মনোনীত হন। ২০১১ সালে সান্তোসে থাকাকালীনই নাইকির সাথে তার ১১ বছরের চুক্তি হয় বছরে ১ মিলিয়ন ডলারে, তখন তার বয়স কেবল ১৯ বছর। ইউরোপে আসার পর নাইকি তা বাড়িয়ে ১০ মিলিয়নে উন্নীত করে, যেটা নাদাল বা শারাপোভাদের চেয়েও বেশি। ২০১৬ সালের ৭ তারিখে বিখ্যাত Forbes ম্যাগাজিন এক আর্টিকেল প্রকাশ করে যে, নেইমার সেই সময়টিতে রোনালদোর চেয়েও বেশী বিপননযোগ্য ক্রীড়াবিদ ছিলেন! ২০১৩ সালে সান্তোসের জার্সি গায়েই নেইমার বিখ্যাত গেমস পেস-এর কভারে স্থান পান। এরপর আরো কয়েকবার বিভিন্ন গেমের কভারে তার ছবি ব্যবহৃত হয়।
নেইমারের যন্ত্রযান সংগ্রহ
রেসিং কারের মোহাবিষ্ট লোকের সংখ্যা দুনিয়াজুড়ে অজস্র। তবে সাধ আর সাধ্যের বৈপরীত্যে অনেকের কাছে তা কেবলই স্বপ্ন থেকে যায়। চলুন দেখে নেয়া যাক নেইমারের সংগ্রহে থাকা যানগুলো।
VOLVO XC-60
এই গাড়িটি নেইমার কিনেছিলেন গাড়ি চালানো শেখার জন্য, দাম ৭৫,০০০ ডলার! গাড়ির কাজের তুলনায় দামের পরিমাণটা চোখ ছানাবড়া করারা মতোই।
PORSCHE PANAMERA
নেইমারের এই গাড়িটির দাম প্রায় দেড় মিলিয়নের কাছাকাছি।
AUDI R8 GT
এই গাড়িটির দাম ২.৮ মিলিয়ন ডলার, যেটাকে তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় ভাবতেন একসময়। কে জানে, প্যারিসে গিয়ে আবার কী ভালো লাগে!
Ferrari 458 SPIDER
৪ মিলিয়ন ডলার দাম ছিল এটির।
MASERATI MC-12
১৩ মিলিয়ন ডলার দামে কেনা হয়েছিল এই গাড়িটি।
প্রমোদতরী
এর দাম প্রায় ৯ মিলিয়ন পাউন্ড।
মিডিয়ায় আলোচিত নেইমারের প্রণয়িনীদের একটি ‘ক্ষুদ্র’ তালিকা
১। ব্রাজিলিয়ান অভিনেত্রী ক্যারোলিন দান্তাস, যার সাথে নেইমারের ২০০৯ এ পরিচয় হয়। বছর আড়াই-তিনেকের এই সম্পর্কের সময়ই তাদের সন্তান লুকার জন্ম হয়।
২। এরপর তার জীবনে আসে বারবারা ইভান্স, যদিও এটি বেশ ক্ষণস্থায়ী; আর এ নিয়ে বিস্তারিত শোনাও যায়নি।
৩। ইভান্সের পর ২৭ বছর বয়স্ক নিকোল নামের এক মডেল কাম রিপোর্টারের সাথে তার সাময়িক প্রণয়ের খবর মিডিয়ায় আসে।
৪। এরপর ব্রাজিলীয় মিডিয়ায় আসে দানিয়েলা কারভালোর সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কথা, যদিও এই খবর দানিয়েলা নিজেই প্রত্যাখ্যান করেন।
৫। ক্যারোল নামে এক অভিনেত্রীর সাথে তার বেশ কিছুদিন সম্পর্ক থাকার গুঞ্জন ছিলো, যদিও নেমার নিজেই একে উড়িয়ে দেন।
৬। ২০১৩ সালে আন্দ্রেসা সুইতা নামে আরেক অভিনেত্রীর সাথে তিনি জড়িয়ে যান বলে খবর আসে মিডিয়ায়।
৭। ২০১২ সালে আবার শোরগোল উঠে রবারটা আপারেত্তি নামে এক ব্যালে নাচিয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা নিয়ে।
৮। রবারটার গুঞ্জন না কাটতেই আবার মিডিয়ায় আসে ২২ বছর বয়স্কা আরেক ড্যান্সার ক্যারোল বেল্লির সাথে তার সম্পর্কের কথা।
৯। এরপর জোরালোভাবে আসে ব্রাজিলিয়ান মডেল দানি স্পেরলের সাথে তার সম্পর্কের কথা। প্রথম সম্পর্কের পর এটিই বেশিদিন টিকেছিল।
১০। এরপর দু’বছরের জন্য চুটিয়ে প্রেম করেন ব্রুনা নামে এক ব্রাজিলিয়ান মডেলের সাথে। দুই বছর পর সেই সম্পর্কে আবার বিচ্ছেদ ঘটে।
১১। বর্তমানে ক্যারোলিন কাপুত্তো নামে এক মডেলের সাথে প্রণয়াবদ্ধ আছেন নেইমার- এমনটাই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
ফ্যাশন সচেতনতা
নেইমার ঠিক ইনিয়েস্তা, ক্রুসদের মতো এতটা সাধারণ বেশে থাকেন না। এক জরিপে তাকে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন খেলোয়াড় বলে নির্বাচিত করা হয়। ঝাঁকড়া চুলের সাথে কানের দুল, এই স্টাইলের জন্য একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিন তাকে ফুটবলের ‘রোলিং স্টোন’ আখ্যা দেয়। বিভিন্ন সময়ে হওয়া ফ্যাশন সচেতন ফুটবলারের জরিপে তার নাম সামনের সারিতেই খুঁজে পাওয়া যায় সব সময়।
চ্যারিটি
ব্রাজিলের পরিষ্কার পানি আন্দোলনের পরিচিত মুখ হলেন নেইমার, যেই আন্দোলনটি ব্রাজিলে খুবই সমাদৃত হয়েছে। ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করেছেন তিনি। ‘Instituto Projeto’ নামে একটা প্রকল্পে তিনি নিজেই ২,৪০০ শিশুর ভরণ-পোষণ, শিক্ষার খরচ বহন করেন।
ভক্তদের সাথে সম্পর্ক
এই বিষয়টিতে নেইমারের জুড়ি মেলা ভার। গ্রানাডার মাঠে তাদের হারানোর পর এক প্রতিবন্ধী গ্রানাডা ফ্যানকে তার জার্সি দেয়া, জার্সি পেয়ে ওই ফ্যানের কান্নায় ভেঙে পড়া আর পুরো স্টেডিয়ামের কাছ থেকে অভিবাদন পাওয়া- এসব তো ইতিহাসেরই হল অব ফেম মোমেন্টসে স্থান পাবে। এই ভিডিওতে উঠে এসেছে ভক্তদের সাথে তার রসায়নের কিছু দিক।
মাঠের বাইরের চাপ
যদি বলা হয় নেইমারের সবচেয়ে বড় দিক কী? চিন্তা ছাড়াই বলা যায়, শত চাপের মাঝেও তার একই হারে পারফর্মেন্সের শ্রীবৃদ্ধি করাটা। ১৯ বছর বয়স থেকেই পুরো ব্রাজিলের স্বপ্ন তার কাঁধে। ২০১২ অলিম্পিকের স্বপ্ন-সারথি হয়ে খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন রুপা জিতে। ২০১৩ সালে ঘরের মাঠে কনফেডারেশন কাপে নতুন কোচ, নতুন দল, হাজারো চাপ সব সামলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে উড়িয়ে দিয়ে জিতিয়েছেন ব্রাজিলকে। ২০১৪-তে পুরো দেশের স্বপ্নের ভার নিয়ে ঠিকই এগুচ্ছিলেন, তার কিংবা ব্রাজিল উভয়েরই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় জুনিগার ওই মারাত্মক ট্যাকেলে। তার ট্রান্সফার নিয়ে গোটা বিশ্ব টালমাটাল হয়ে গেলেও মেসি-সুয়ারেজদের নিয়ে ভয়ঙ্কর জুটি গড়ে জিতে নেন দুইটি লিগ আর একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে তাদের একমাত্র অধরা অলিম্পিকের সোনা জেতান। দুই ম্যাচ ড্রয়ের পর যখন মুণ্ডুপাত করা হচ্ছিল তার, তখনো স্থির থেকে দলকে ধীরে ধীরে ঠিকই ফাইনালে নিয়ে যান তিনি। ফাইনালে মারাকানা জুজু, জার্মান জুজু, ইতিহাসের দায় সব একপাশে রেখে ঠিকই ঠাণ্ডা মাথায় জয়সূচক পেনাল্টি নিয়ে দেশকে এনে দেন পরম আকাঙ্ক্ষিত অলিম্পিক স্বর্ণ।
প্রিয় বা আলোচিত তারকাদের জীবনের দিকে এক দুর্নিবার আগ্রহ সবারই থাকে। নেইমার ভক্তদেরও এই নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। তবে ব্যক্তিগত জীবন অনেকেরই খেলায় কোনো প্রভাব ফেলে না। সবচেয়ে উদ্দাম জীবনযাপন করা ম্যারাডোনাই ফুটবল ইতিহাসের সুন্দরতম স্কিলফুল প্লেয়াদের একজন। সেই ১৬ বছর বয়স থেকে নেইমারের জীবন দেখলে দেখা যায়, তার মাঠের বাইরের জীবন তার খেলায় খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। তার ভাষায়,
“আমি সর্বত্রই এঁটে যাই। বস্তিতেও যেমন হাসিখুশি ছিলাম, বিশাল ম্যানশনেও তেমন।”
এমনই থাকুক নেইমার, সদা প্রাণোচ্ছলতাই যে তার ফুটবলকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। খুশি থাকুন ব্যক্তিগত জীবনে আর সেটা প্রতিফলিত হতে থাকুক মাঠে, বারবার।