বাংলাদেশ দলের সময়ের প্রয়োজনে মুশফিকুর রহিম এসেছিলেন। সেই মুশফিক এখন দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। দলের পাঁচ ভিতের একজন তিনি। কঠোর পরিশ্রম আর প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা তার মধ্যে, তা তরুণ ও উদীয়মান ক্রিকেটারদের জন্য উদাহরণস্বরুপ। বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক তারপরও বিতর্কিত হয়েছেন। নিজের অধিনায়কত্ব নিয়ে, কখনও বা নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে। দিন শেষে মুশফিক একজন যোদ্ধা। যিনি নিজের সামর্থ্য বোঝেন, যিনি নিজেকে ফিরে পেতে লড়েন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেট কিংবা লঙ্গার ভার্সন; সবখানেই ‘ফিট’ মুশফিক। তারপরও ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ১ রানের হার নিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। সেটা ছিল শুরু। পরবর্তীতে একাধিকবার জয়ের খুব কাছ থেকে ব্যর্থ হয়েছেন। দলকে জয়ের সুবাতাস টের পেতে দিয়েও সেই বাতাসেই মিলিয়ে দিয়েছেন সবকিছু। মুশফিক চেষ্টা করছেন সেসব ভুলকে শুধরে নিতে। পাশাপাশি আগামীদিনের ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে রপ্ত করে যাচ্ছেন সবধরনের কৌশল।
২০০৫ সালে টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে অভিষেক হওয়া সেই কিশোর ছেলেটি এরই মধ্যে খেলে ফেলেছেন ৬২ টেস্ট, ১৮৭ ওয়ানডে আর ৭৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। সাদা পোশাকের টেস্টে তুলেছেন ৩৬৯৯ রান। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান। রয়েছে পাঁচটি সেঞ্চুরি ও ১৯টি হাফ সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে রান পেয়েছেন ৪৮২৮; টেস্টের সমান পাঁচটি সেঞ্চুরি, ২৯টি হাফ সেঞ্চুরি। টি-টোয়েন্টিতে মুশফিকের মোট রান ১১৩১। আছে চারটি হাফ সেঞ্চুরি।
অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারের নিয়ে ভাবনার কথা। পাশাপাশি নিজের ও দলের দুর্বলতা, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পরিকল্পনার কথা।
আগামী বছর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কি কাউন্টি ক্রিকেট খেলার ইচ্ছা আছে? সেখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে?
অবশ্যই, আমি আমার ক্যারিয়ারের সেই শুরু থেকেই কাউন্টি ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখি। আমাদের বর্তমান কোচ স্টিভ রোডস এর আগে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব ওরস্টারশায়ারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তো আমার মনে হয় তিনি বাংলাদেশ দলের কিছু ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপের আগে সেখানে খেলার সুযোগ করে দিতে চাইবেন। আমরা এরই মধ্যে তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তিনি যদি সত্যিই সীমিত বা লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটে কাউন্টিতে আমাদের কয়েকজনকে সুযোগ করে দিতে পারেন, তাহলে তা দলের জন্যে অনেক ভালো হবে।
উইন্ডিজ সিরিজে যদিও বাংলাদেশ সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দারুণ খেলেছে, তারপরও টেস্ট সিরিজ বাজেভাবে হারের পর থেকে প্রশ্ন উঠছে দলের টেস্ট খেলার সামর্থ্য নিয়ে। আপনি নিজেও দুটি টেস্টেই হতাশাজনকভাবে আউট হয়েছেন। সবমিলিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
যখনই আপনি কোন নতুন সিরিজের জন্য কোথাও সফর করবেন তখন চ্যালেঞ্জ থাকবেই। পাশাপাশি আপনি পেছনে ফিরে সেসব দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতে চাইবেন যেখানে আপনার ঘাটতি আছে। আমরা অনেকদিনের ব্যবধানে উইন্ডিজ সফর করেছি। আপনি যদি খেয়াল করেন, আমরা সেখানে ডিউক বলে খেলা আয়ত্ব করতে খুব ভোগান্তিতে পড়েছি। আমাদের আগে শ্রীলঙ্কাও একই বিপদে পড়েছিল। যদিও তারা একটা টেস্ট জিতেছিল। তারপরও আমি বলবো, এখনও উইন্ডিজে ওই অবস্থায় ব্যাটসম্যানদের জন্য সবকিছু অনেক কঠিন। আমাদের জন্য আরও একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল সেখানকার কন্ডিশন। আমরা পরিচিত কন্ডিশনের বাইরে গিয়ে অনেকদিন পর কোনো টেস্ট ক্রিকেটের কন্ডিশনে খেলেছি।
আমার মনে হয় ব্যাটিংয়ে আমাদের অনেক ঘাটতি ছিল। আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমরা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম যেখানে আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য সবাই টের পেয়েছে। তারপরও আমি বলবো লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটের জন্য আমাদের আরও অনেক কাজ করার বাকি আছে।
বড়রা প্রতিনিয়ত ম্যাচে দলের হাল ধরছে। তরুণ ক্রিকেটাররা কতটা এগোতে পারছে, অবদান রাখতে পারছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আপনি কী মনে করেন?
দেখুন, এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বড়রা উপরের দিকে ব্যাট করছে, রান করার দায়িত্ব তাদেরকে নিতেই হয়। আমরা সবসময় এটা করার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবার টেস্ট সিরিজে সেটা হয়নি। তরুণদের আমি বলবো, তারা যদি মনে করে এটাই পারফর্ম করার জন্য তাদের একমাত্র সুযোগ তাহলে তারা আরও বেশি চাপে পড়বে। তাদের উচিত শান্ত থাকা। আর যেসব জায়গাতে তারা ভালো সেগুলোতে ফোকাস করা। দলে নিজের জায়গা থাকলো কী থাকলো না সেটা না ভেবে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো, খেলাকে উপভোগ করা। দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে ভাবতে গেলে আর পারফর্মই করতে পারবে না ওরা।
সিরিজ শেষে আমি এনামুল হক বিজয়কে বলেছি বাড়তি চাপ না নিতে। তার চেয়ে বরং ভুলগুলো শোধরানোর দিকে মনোযোগী হতে। তারপরও আমার মনে হয় তরুণদের মধ্যেও অনেকে ইতিবাচক পারফরম্যান্স করছে। এর মধ্যে আছে মুস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তো আমি বলবো ভবিষ্যতে তরুণরা আরও অনেক ভালো করবে।
ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে আপনি ব্যাট হাতে আলাদা আলাদা দায়িত্ব পালন করেন। কিভাবে সবকিছু মানিয়ে নেন?
সত্যি কথা বলতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবসময় একটা বাড়তি চাপ থাকে। তবে আমি এটাকে প্রতি সিরিজে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। হ্যাঁ, এটা হয়তো হবে যে আমি আলাদা আলাদা ফরম্যাটে দলকে ভিন্ন রকম কিছু দিচ্ছি। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে একরকম, আবার টেস্টে অন্যরকম। অবশ্যই টেস্ট একেবারেই আলাদা ধরনের খেলা। সেখানে আমার দল সবসময় আমার কাছে বাড়তি কিছু আশা করে। এটা আমি বুঝি, সে কারণে প্রতিনিয়ত নিজের খেলাকে আরও ভালো করার চেষ্টা করি। যে ফরম্যাটেই আমি খেলি না কেন, দলের জন্য ধারাবাহিক থাকার চেষ্টা করি।
কয়েকবার এমন হয়েছে যে আপনি ব্যাট করার সময় দল জয়ের খুব কাছে চলে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। এবারের উইন্ডিজ সফরের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে কি ব্যাট করতে গিয়ে কি সেসব ঘটনা আপনার মনে উঁকি দিচ্ছিলো?
২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালোরে ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টির সেই ম্যাচ ছাড়া আর কখনও ম্যাচ শেষ করে আসতে পারবো না এমনটা মনে হয়নি। একইসঙ্গে বলবো, উইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচে শেষ ওভারে ৮ রান প্রয়োজন ছিল আর আমি ছিলাম উইকেটের একমাত্র সেট ব্যাটসম্যান। আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথম দুই বলে আমরা বড় শট খেলার ঝুঁকি নেবো। তাছাড়া উইকেটে নেমেই নন-স্ট্রাইক ব্যাটসম্যানের জন্য এই কাজটা অনেক কঠিন ছিল। আমি হয়তো সিঙ্গেল নিতাম যদি কি না অপর প্রান্তেও একজন সেট ব্যাটসম্যান থাকতো, যে কি না বড় শট খেলতে পারে। ওই সময়ে সেই অবস্থা ছিল না। অবশ্যই এটা ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে দলকে আমি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারিনি, যেখানে কি না আমি সবসময় দেশের হয়ে ম্যাচ জেতাতে চেয়েছি। আমি শিখে যাচ্ছি। এটুকু নিশ্চিত যে একই ভুল আর হবে না।
টেস্টে ব্যাট করার জন্য আপনার প্রিয় জায়গা কোনটি?
সাধারণত, আমি টপ অর্ডারে ব্যাট করতে পছন্দ করি। তবে এটাও ঠিক যে সবকিছু নির্ভর করে টিম ম্যানেজমেন্টের উপর এবং ম্যাচের পরিস্থিতির উপর। আমি তিন নম্বর পজিশন ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ব্যাট করেছি। যখন আমি উইকেটরক্ষক থাকি, তখন মনে হয় পাঁচ অথবা ছয় নম্বর জায়গাটা ভালো। কারণ অনেকক্ষণ উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে খানিকটা ক্লান্তি এসেই যায়। কিন্তু যখন আমি উইকেটের পেছনে যাই না, তখন আমার পছন্দের ব্যাটিং পজিশন চার নম্বরে। তবে এগুলোর সবকিছু নির্ভর করে কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্টের উপর।
টি-টোয়েন্টিতে ফিনিশারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে কতটা উপভোগ করেন আপনি? নির্দিষ্ট কোনো জায়গা আছে, যেখানে বড় শট নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কাজ করতে চান?
ইদানিং ওয়ানডেতেও রান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। তাই কেবল ধারাবাহিক হলেই চলবে না, নিজের স্ট্রাইক রেট নিয়েও কাজ করতে হবে। তাই আমি চেষ্টা করছি আমার পারুরম্যান্সকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে। এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছি। আশা করি আমি নিজেকে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের জন্যই প্রমাণ করতে পারবো।
ফিচার ইমেজ- Getty Image