লিওনেল মেসি।
ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ের পাতা উলটাচ্ছেন ৩১ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন তারকা। ইতিহাস গড়া এই ফুটবলারকে ডাকা হয় নানান নামে, মেসিডোনা, খুদে জাদুকর, ম্যাজিক মেসি, ভিনগ্রহের খেলোয়াড়; প্রাক্তন সতীর্থ স্যামুয়েল ইতোসহ আরো বেশ ক’জন খেলোয়াড় তো তাকে ডেকেছেন ‘ফুটবলের ঈশ্বর’ বলে।
ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী রোনালদিনহো ২০০৬ সালে ব্যালন ডি’অর হাতে নিয়ে বলেছিলেন,
‘এই ট্রফিতে লেখা আছে, আমি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। অথচ আমি খোদ বার্সেলোনারই সেরা নই।’
‘ছেলেটাকে দেখলে আমার ম্যারাডোনার কথা মনে পড়ে। গঠনের দিক দিয়েই দু’জনেই খাটো, এবং খেলেও বাম পা দিয়ে। মেসি, ক্রিস্টিয়ানো, কাকা এরা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। বিশেষ করে, মেসির ব্যাপারটা আমাকে মোটেও অবাক করে না। যখন থেকে সে আমাদের সাথে ট্রেনিং করতে শুরু করেছিল, আমরা জানতাম এমনটাই হবে। কোনো একদিন আমি বলে বেড়াবো যে, আমি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের উত্থান দেখেছি।’
যারাই তার সাথে বা বিপক্ষে খেলেছেন, অধিকাংশই ছিলেন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলবেন না’ই বা কেন? ১৫ বছরের পেশাগত ক্যারিয়ারের অর্জনের ঝুলিটা নেহায়েত কম বড় নয় তার। দলীয় অর্জনের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত অর্জনের সংখ্যাও অনেক ফুটবল ক্লাবের দলীয় অর্জন থেকে বেশি। দলের হয়ে জিতেছেন ৯টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৬টি কোপা ডেল রে, ৭টি স্প্যানিশ কাপসহ আরো ৩টি উয়েফা সুপার কাপ। আর ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যে আছে ৫টি ব্যালন ডি’অর, ৫টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট, একটি ফিফা গোল্ডেন বলসহ প্রায় ৩০টি সম্মাননা।
কিন্তু এত কিছু জেতার পরও প্রতিনিয়ত সমালোচনা সহ্য করতে হয় তাকে। দিনশেষে একটি জিনিসের অভাব খোদ মেসিকেই কুড়ে কুড়ে খায়। সবকিছু থাকার পরও যেন তার ট্রফি কেবিনেট কেমন খালি মনে হয়। জাতীয় দলের হয়ে কিছু অর্জন নেই যে!
এমন না যে, সুযোগ হয়নি কিছু জেতানোর। অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে টানা তিনটি ফাইনালে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু শেষমেশ ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনাল হারার পর অবসরের ঘোষণাই দিয়ে দেন আর্জেন্টাইন এই খুদে জাদকর। কিন্তু ভক্ত এবং জাতীয় দল কমিটির অনুরোধে আবার ফিরে আসেন।
আর সেই সাথে তাড়া করে বেড়ায় সমালোচনার ঝড়। বিশেষ করে, আর্জেন্টিনার স্থানীয় পত্রিকাগুলো প্রতিনিয়ত সমালোচনা করে চলেছে তার। এই ব্যাপারে মেসি কখনো কিছু বলেননি। কিন্তু সম্প্রতি আর্জেন্টিনার এক রেডিও চ্যানেল ক্লাব অক্টুবরে ৯৪.৭ এফএমের সাথে এক সাক্ষাৎকারের সময় এই বিষয়ে মুখ খুলেন লিও। তিনি স্বীকার করেন যে, আর্জেন্টাইন পত্রিকাগুলোতে প্রতিনিয়ত তাকে নিয়ে লেখা মিথ্যাচারগুলো তার মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমনকি তার ছেলেও তাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছে যে, কেন মেসিকে তারা মেরে ফেলতে চায়।
এই সাক্ষাৎকারেই মেসির দেয়া গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকে আর্টিকেলটি। চলুন শুনি, কী বলেছেন তিনি।
‘ব্যাপারটা আসলে মেনে নেয়া খুব কঠিন। আমার ছেলে প্রায়ই ইউটিউবে ভিডিও দেখে। সেদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেছে, আর্জেন্টিনায় কেন তারা আমাকে মেরে ফেলতে চায়?
পত্রিকাওয়ালারা প্রায়ই বলে, আমি নাকি আর্জেন্টিনার ফুটবল কমিটি নিয়ন্ত্রন করি। আর আমার কাছের বন্ধু ডি মারিয়া, হিগুয়াইনদেরকে নিয়েই আমি দল বানাই প্রতিবার। কথাগুলো শুনলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়। স্থানীয় পত্রিকাগুলো নিয়ে আমাদের বরাবরই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কথা বলেই চলেছে। আমাদেরই ভুল হয়েছে তাদেরকে এভাবে কথা বলতে দিয়ে। আর এখন তারা মিথ্যা ছড়িয়েই চলেছে।
কিন্তু আমি থেমে থাকবো না। আমি এখনো জাতীয় দলের হয়ে কিছু একটা জিততে চাই। তা না হলে আন্তর্জাতিক বিরতির সময়গুলোতে আমি বাসায় বসে থাকতাম। আমি সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচই খেলবো। আমরা ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে ফাইনাল খেলেছি, আর সে রাস্তাটা মোটেও সহজ নয়।’
তিনি আর্জেন্টিনা দলের বর্তমান অবস্থা এবং নতুন কোচ লিওনেল স্কালোনির কথাও উল্লেখ করেছেন। আসন্ন কোপা আমেরিকার আগেই একটি পরিপূর্ণ দল গঠনের লক্ষ্যে কোচ তাকে আবার দলে ডেকেছেন। যদিও তিনি মনে করেন, কিছু জেতার আশা করার আগে দলটিকে আরো পরিপক্ক হতে হবে।
‘তিনি খুব শক্ত এবং পরিপূর্ণ একটি দল গঠন করতে চান, যে দলটা সহজ সুযোগ দেবে না, যে দলের রক্ষণভাগে কোনো সমস্যা থাকবে না, বল হারালেও খেলায় নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। তিনি মাঠে কর্তৃত্ব স্থাপন করার আগে আমাকে মাঠের বাইরে সেটা করার দিকে নজর দিতে বলেছেন। বিশেষত তিনি চান, আমরা যেন দারুণ শক্তসমর্থ একটা দলে পরিণত হতে পারি।
আমাদের জাতীয় দল এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় কাটাচ্ছে, আর গোটা বিশ্বেই দলটা খুবই মর্যাদাসম্পন্ন। এই মর্যাদা অর্জিত সাফল্যের মধ্যে দিয়ে এসেছে, তাই এর মাহাত্ম্যও অন্যরকম।
কিন্তু আমাদের অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে। যদি আপনাকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেই হয়, তবে সেই মর্যাদা আপনাকে অর্জন করে নিতে হবে। আর সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে আমাদের ঢের পথ পাড়ি দিতে হবে।
দলের অন্য খেলোয়াড়দের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ভালো। খেলার সময় তাদেরকে মাথা ঠান্ডা রাখা লাগবে, এবং ক্লাবের হয়ে যেভাবে খেলে, ঠিক সেভাবে খেলতে হবে।
এই দলটির প্রায় সবাই মাত্র ৭-৮টি ম্যাচ খেলেছে একসাথে। তাই আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। একটি পরিপূর্ণ দলে পরিণত হওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে।’
কোচদের সাথে তার বিরোধ এবং দল নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার নিয়ে তিনি বারবার বলেছেন, এই অভিযোগগুলো মোটেও সত্যি নয়। ব্রাজিল ও রাশিয়া বিশ্বকাপ নিয়ে নিজের আক্ষেপের কথাও বলেছেন।
‘আমি জাতীয় দলের নির্ধারণ করি না। এসব কথা আসলে শুনতেও খারাপ লাগে। আজ যদি আমরা ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততে পারতাম, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন থাকতো। এমন না যে, আমরা ইচ্ছে করে হেরেছি সেদিন। ছোটখাটো কিছু ভুলের জন্য ম্যাচটি আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু পত্রিকাওয়ালারা এভাবে মিথ্যে না ছড়িয়ে বিষয়গুলো অন্যভাবেও সামাল দিতে পারতো।
সেদিনের ম্যাচটা (রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ১৬) আমাকে অনেক ভাবায়। এভাবে হেরে বিদায় নেয়ার স্মৃতিটা মোটেও সুখকর নয়। তাই আমি কিছুদিন নিজেকে দল থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। নিজেকে সুস্থির করার জন্যে হলেও এই দূরত্বটার দরকার ছিল।’
বেশ কিছুক্ষণ আর্জেন্টিনা দল নিয়ে কথা বলার পর মেসি কথা বলেন আরও বিভিন্ন বিষয়ে। ক্যারিয়ারে তার পছন্দের গোল, তার পছন্দের ম্যাচ এবং এক পর্যায়ে মুখ খোলেন তার রাইভাল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সম্পর্কে।
রিয়াল মাদ্রিদকে চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়নস জেতানোর পর এই মৌসুমের শুরুতেই জুভেন্টাসের পাড়ি জমান এই পর্তুগিজ তারকা। সেখানেও তার দুর্দান্ত ফর্ম বজায় রেখেছেন তিনি। চ্যাম্পিয়নস লিগে এক ম্যাচে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকের মাধ্যমে অ্যাটলেটিকোকে হারিয়ে দলকে তুলেছেন কোয়ার্টার ফাইনালে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ফাইনালের আগে দেখা হবে না বর্তমান সময়ের এই দুই বিশ্বসেরার।
এদিকে বার্সার ১২ পয়েন্ট পেছনে ধুঁকতে থাকা মাদ্রিদের বর্তমান অবস্থা দেখে মেসি বলেছেন, লা লিগায় রোনালদোর অনুপস্থিতি এবং তার বিপক্ষে খেলাটা তিনি বেশ অনুভব করেন।
‘ক্রিস্টিয়ানোর অভাবটা আমি অনেক অনুভব করি। যদিও সে থাকতে লা লিগা জেতা বেশ কষ্টকর ছিল। লা লিগাকে সে অনন্য মহিমান্বিত করেছে।
চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য জুভেন্টাস বেশ যোগ্য একটি দল, আর ক্রিস্টিয়ানো যাওয়ার পর থেকে তারা আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষের ম্যাচটি তাদের আত্মবিশ্বাস শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।’
মেসি এবং রোনালদো নিঃসন্দেহে ফুটবলের ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় থাকবেন। কিন্তু মেসি মনে করেন, তার সতীর্থ সুয়ারেজও সেই তালিকায় থাকার যোগ্য।
‘আমি কাউকে ছোট করছি না। তবে আমি মনে করি, নেইমার, এমবাপ্পে, সুয়ারেজ আর কুন অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।’
তার একটু পরই আবার হেসে বলে উঠেন,
‘এই তালিকায় ক্রিস্টিয়ানোর কথা বললাম না, কারণ আমি তাকে আমার সাথে আলাদা করে রেখেছি।’