মেসি ফুটবল বিশ্বের এক বিস্ময়। বার্সেলোনা এবং আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে তিনি ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেন। তার ঝুলিতে আছে পাঁচবার ব্যালন ডি’অর এর খেতাব। তাকে তুলনা করা হয় পেলে কিংবা ম্যারাডোনার মতো কিংবদন্তিদের সাথে। গত ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের আগে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড সকার’-কে একটি ইন্টারভিউ দেন। সেই ইন্টারভিউতে তিনি নিজের খেলার ধরন, নিজের খ্যাতি এবং খেলোয়াড় হিসেবে তার বেড়ে ওঠার কাহিনী নিয়ে বলেন। আজ সেই ইন্টারভিউয়ের দিকেই চলুন ফিরে দেখি।
ফুটবল নিয়ে আপনার প্রথম স্মৃতি কী?
মেসি: আমার প্রথম স্মৃতি হলো আমি যখন একদম ছোট ছিলাম, হয়তো তিন বা চার বছর বয়স ছিলো। তখন আমি আমার পাড়ায় খেলছিলাম। বল পায়ে ছোটবেলার ঐ দৃশ্য আমার চোখে ভাসে।
আপনি তখন থেকেই ফাউল থেকে বাঁচার উপায় শিখেছিলেন?
মেসি: আমি সবসময় একইভাবে খেলতাম। আমি মানুষের লাথি মারা নিয়ে চিন্তা করতাম না।
বার্সেলোনাতে আপনার প্রথম সপ্তাহ এবং মাস কি সুখের দিন ছিলো নাকি কষ্টের?
মেসি: দুটোই ছিলো। বার্সেলোনাতে থাকতে পেরে আর নতুন সব অভিজ্ঞতার জন্য আমি খুশি ছিলাম। কিন্তু অন্যদিকে কাছের মানুষগুলো থেকে এত দূরে থাকাটা কষ্টের ছিলো। নতুন করে সব কিছু শুরু হচ্ছিলো, নতুন টিমমেট, নতুন বন্ধু। প্রথমদিকে ইনজুরি এবং কাগজপত্রের ঝামেলার জন্য খেলতে পারিনি। শুরুটা কঠিন ছিলো।
আপনার হিরো কারা ছিলো?
মেসি: আমার সবসময় পাবলো আইমারকে ভালো লাগতো। তিনি রিভারপ্লেট থেকে এসেছিলেন এবং আমি ওকে অনুসরণ করতাম।
আপনি খাটো ছিলেন বলে কি মানুষের সাথে আপনার সমস্যা হতো?
মেসি: না। উচ্চতা নিয়ে আমার কখনো সমস্যা হয়নি। আমার স্কুল এবং টিমে আমি সবচেয়ে খাটো ছেলে ছিলাম।
আপনার ১৩ বা ১৪ বছর বয়স হওয়ার আগপর্যন্ত অর্থাৎ আপনার বার্সেলোনার বর্তমান কোচ টিটো ভিলানোভা আসার আগ পর্যন্ত আপনাকে খেলার প্রথমে নেয়া হতো না। আপনি কি কখনো খেলা ছেড়ে দেবার কথা চিন্তা করেছেন?
মেসি: না, কখনোই নয়। আমি সব সময় আমার অনুশীলন, কাজ এবং আমার স্বপ্নের কথা ভেবেছি। আমি ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ যখন টিটো এসেছে তখন আমি প্রায় নিয়মিত খেলতে শুরু করেছি এবং এরপর থেকে আমার ক্যারিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়।
টিটো কি আগের মতোই আছেন?
মেসি: তিনি সেই একই মানুষ যিনি আমাদের ক্যাডেট টিমে কোচিং করিয়েছেন। আমি ছোট ছিলাম। ঐ সময়ের কথা খুব একটা মনে নেই। কিন্তু তিনি একই রকম আছেন এবং আমাদের সাথে একই রকম ব্যবহার করেন।
আপনি কি এখনের মতো তখনো ফলস নাম্বার নাইন হিসেবে খেলতেন?
মেসি: না। পদ্ধতিটা আলাদা ছিলো। আমরা একজন স্ট্রাইকার নিয়ে খেলতাম। দুজন উইঙ্গারের সাথে আমি ঠিক তার পেছনে খেলতাম। আমি ছিলাম ‘মিডিয়াপুন্টা’ (অ্যাটাকিং মিড ফিল্ডার)। ঐ দলে এটা ফলস নাইন ছিলো না, কারণ আমরা এই পদ্ধতিতে খেলতাম না।
আপনার খেলার ধরন কি বার্সেলোনাতে খেলার ফলে তৈরি হয়েছে?
মেসি: আমার খেলার ধরন সবসময়ই এক। আমি কোনো বিশেষ স্টাইল তৈরি করতে চাইনি। একদম ছোটবেলা থেকে আমি এভাবেই খেলতাম। কিন্তু এটা সত্যি যে আমি অনেক শিখেছি। আমরা এখানে (বার্সাতে) যেভাবে কাজ করেছি তা আলাদা ছিলো। এখানে বল পাসিং এবং কৌশলগত দিক নিয়ে অনেক কাজ হয়। কিন্তু আর্জেন্টিনাতে আমরা তেমন কিছু করিনি। ওখানে দৌড়ের উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো, আর কিছু নয়।
আপনি সেস্ক ফ্যাব্রেগাসের সাথে আবার খেলতে শুরু করেছেন। আপনাদের মধ্যে কি বিশেষ ধরনের বোঝাপড়া আছে?
মেসি: আমরা একজন আরেকজন ভালোভাবে বুঝি এবং জানি। তার খেলার ধরনের জন্য তার সাথে খেলা সহজ। খেলার মাঠে এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমরা একজন আরেকজনের খেয়াল রাখার চেষ্টা করি।
জোয়ান গাম্পার ট্রফিতে আপনি বার্সেলোনাতে প্রথমবার যখন দলে খেলেছিলেন, তখন ফ্যাবিও ক্যাপেলো আপনাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘ক্ষুদে শয়তান’ হিসেবে।
মেসি: এটা শুনে অসাধারণ লেগেছে। কোচ হিসেবে তিনি অনেক জিতেছেন। তার এ কথাটা বলা আসলেই বদান্যতার পরিচয়।
আপনার প্রথম লিগ খেলা শুরু করার আগে আপনার পাসপোর্টে কিছু সমস্যা হয়েছিলো।
মেসি: ওটা খুব কঠিন সময় ছিল, কিন্তু সৌভাগ্য হলো এ ঝামেলা খুব তাড়াতাড়ি মিটে যায়। আমি খেলতে চেয়েছিলাম। আমি দলে প্রথমবারের মতো খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি না আমি কেন খেলার সুযোগ পাই নি।
ডেকো এবং রোনালদিনহো কেন তাদের ছায়ায় আপনাকে স্থান দিয়েছিলো বলে আপনার মনে হয়?
মেসি: আমি জানি না। আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম কারণ প্রথম থেকেই আমি তাদের পাশে পেয়েছি। আমি তাদের প্রতি এবং তাদের সাথে সাথে মটা এবং সিলভিনহোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন।
ঐ দলটির কী হয়েছিলো? কেন দলটি এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লো?
মেসি: আমি আসলে জানি না কী হয়েছিলো। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে আমরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে হেরেছিলাম এবং রিয়াল মাদ্রিদের কাছে গোলের ব্যবধানে লিগ হেরেছিলাম। আমি জানি না কী হয়েছিলো। অন্তত এটা একটা শিক্ষা হিসেবে কাজ করেছিলো যাতে এটি আবার না হয়।
আপনি আপনার খাবারের ব্যাপারে এখন অনেক সচেতন। আপনি কি কোনো খাবার মিস করেন?
মেসি: আমার খাবারের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হয়েছে। তবে মানুষ যেমন বলে আমার তেমন বড় কোন পরিবর্তন আসেনি। আমি আগের মতোই খাবার খাই। তবে কিছু খাবার আছে যা এখন খাই, কিন্তু আগে খেতাম না, যেমন মাছ। বেশিরভাগটা আগের মতোই আছে।
আপনি গোল দেয়ার পাশাপাশি এখন গোল তৈরিও করে দেন। আপনার খেলা কি পরিবর্তন হয়েছে? আপনি কি আগে শুধু নিজের জন্য খেলতেন?
মেসি: আমি নিজেকে কখনো বলের প্রতি লোভী মনে করিনি। যদিও লোকে তা মনে করতো। খেলোয়াড় হিসেবে আমার উন্নতি হয়েছে এবং আমার উন্নতি করতে যারা সাহায্য করেছে, আমি তাদের কাছ থেকে শিখেছি।
আপনার খ্যাতি এবং প্রশংসার চাপ আপনি কীভাবে সামলান। আপনি কি নিজের আত্মসমালোচনা করেন?
মেসি: আমি আমার নিজের সমালোচনা সবার চেয়ে বেশি করি। আমি জানি আমি কখন ভালো করেছি এবং আমি কখন খারাপ করেছি। অন্য কারও আমাকে বলার দরকার পড়ে না। আমি শুধু আমাদের মাঠের খেলা দেখি এবং আমি বুঝি আমি কী করেছি। এক্ষেত্রে অন্য কারও কোনো কিছু বলার দরকার নেই।
আপনি যখন বল পান তখন কি আপনি আপনার পজিশন নিয়ে চিন্তা করেন নাকি আপনার খেলা স্বতঃস্ফূর্ত?
মেসি: প্রতিপক্ষের গোলের দিকে যাওয়ার জন্য যেটা ভালো হবে আমি সেটা করার চেষ্টা করি এবং আর বাকিটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে।
ফুটবলের পাশাপাশি আপনি কি শারীরিক পরিশ্রম করেন? জিমে অনেক সময় কাটান?
মেসি: আমি আমার দুর্বল দিক নিয়ে কাজ করি। ইনজুরি ঠেকানোর চেষ্টা করি এবং আমার সেরা অবস্থায় থাকতে চাই। আমি আমার নিজের দেখাশোনা করি। এটা এমন নয় যে আমি আমার সারাদিন জিমে কাটাই। আমি জিমের খুব একটা ভক্ত নই।
আপনার সতীর্থ খেলোয়াড়দের থেকে শেখার মতো কী আছে? তাদের কি এমন কোনো দক্ষতা আছে যা আপনাকে ঈর্ষান্বিত করে? উদাহরণ হিসেবে যেমন ধরুন জাভি।
মেসি: সে একজন অসাধারণ খেলোয়াড়। সে কখনও বল হারায় না। তার অসম্ভব দূরদৃষ্টি আছে এবং খেলার অবস্থা বোঝে। আর ছন্দ ও গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা?
মেসি: সেও একই রকম। হয়তো আন্দ্রেসের গোল করার ক্ষমতা বেশি। সে বেশি জায়গা জুড়ে খেলে এবং নিচ থেকে উঠে আসে। কিন্তু তারা একই রকম। আন্দ্রেসেরও প্রখর দূরদৃষ্টি রয়েছে। যখন সে ফর্মে থাকে গোটা টিম তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। জাভি এবং আন্দ্রেস দুজনই যখন একসাথে মাঠে খেলে তখন অপর পক্ষের বল পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আপনি দেখা যাচ্ছে নিচে খেলছেন এবং খেলা তৈরিতে সাহায্য করছেন। শুধু যে পেনাল্টি এরিয়াতে থাকছেন তা নয়। এটা কি সচেতন সিদ্ধান্ত?
মেসি: এটা খেলার উপর নির্ভর করে। আমি নিচে খেলি বলে সংস্পর্শে বেশি থাকার জন্য এবং মিডফিল্ডারদের সাথে মিলে নিচ থেকে খেলা তৈরি করার জন্য। কিন্তু এটা সব সময় খেলার উপর নির্ভর করে। আমি মিডফিল্ডার নই। দলের প্রতিটি মুহূর্তে যা দরকার আমি তা-ই করি।
বলা হয়ে থাকে, কেউ যদি কোনো খেলা হারে, এমনকি ট্রেনিং ম্যাচেও, সবচেয়ে ভালো কাজ হলো কারও সাথে কথা না বলা। এমনকি নিজের সাথেও না। আপনিও কি এতটাই কষ্ট পান?
মেসি: ড্রেসিং রুমে এটা যেকোনো কারও জন্য সত্যি। আপনি যখন হারেন তখন কষ্ট পান। এটা ভালো কারণ আমরা সবাই জিততে চাই। এটার মানে হলো জয়ের জন্য ক্ষুধা আমাদের কমেনি।
পেপ গার্দিওলা যাওয়ার পর কি আপনি নেতা হয়ে উঠেছেন?
মেসি: আমি আগের মতোই আছি। সবাই তাদের দায়িত্ব জানে। ড্রেসিং রুমে এই খেলোয়াড়দের মানসিকতা দেখে বোঝা যায় এই দলের তেমন কোনো নেতার দরকার নেই। আর আমি আগের মতোই খেলি।
মানুষ বলে আপনি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় এবং আপনাকে পেলে, দিয়াগো ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করে।
মেসি: আমি প্রতিদিন উন্নতি করার চেষ্টা করি। ওনারা অবসর নেয়ার পরেও লোকে তাদের নিয়ে কথা বলে। মানুষ যদি তাদের সাথে আমাকে তুলনা করে তাহলে তা অসাধারণ। কিন্তু আমি এটা নিয়ে চিন্তা করি না। আমি সব সময় উন্নতি করার চেষ্টা করি। আমার ক্যারিয়ার শেষে আমি চিন্তা করবো আমি কী করেছি। মানুষ তখন বিচার করবে।
আপনি প্রথমবারের মতো বাবা হয়েছেন। আপনার ছেলে থিয়াগো যদি রিভার প্লেট বা রোজারিও সেন্ট্রালের ফ্যান হয়ে যায়?
মেসি: আমি মনে করি না এমনটা হবে।
আপনি কি চান সে ফুটবলার হোক?
মেসি: সে যেটা হতে চায় আমি তার জন্য সেটাই চাই। সে যখন বড় হবে সে বুঝতে পারবে সে কী হতে চায়। আমি এবং তার মা এটা নিয়ে খুশি থাকবো।
ফিচার ইমেজ: Gipsypixel.com