নিজের আয়ত্তে বল আনার পর সেই বল প্রতিপক্ষের কাছে হারিয়েছেন, এমন দৃশ্য বোধহয় বছরে দুই-একবার ঘটত। পল গাসকোয়েনের মতো শরীরের উপরের অংশের দুর্নিবার শক্তি, জর্জ বেস্টের মতো ড্যান্সিং ফুটে প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে ছিটকে দিয়ে রক্ষণ থেকে আরেকটি আক্রমণের ঢেউয়ের সূচনা করা, এবং সেই সাথে শরীরের উপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রন; এইসবে কেবল হাভিয়ের জানেত্তির মুখচ্ছবিই ভেসে উঠে। ‘এল কাপিতানো’ নামে খ্যাত ইন্টার মিলান কিংবদন্তি জানেত্তি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত।
মহাপরাক্রমশালী জানেত্তিকে ধরা হয় আর্জেন্টিনার ইতিহাসে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভাসম্পন্ন এক ডিফেন্ডার। যিনি একদিকে ছিলেন দুর্ধর্ষ, অন্যদিকে ছিলেন তেমনই নিষ্কলুষ। ক্যারিয়ারে একটিমাত্র লাল কার্ড দেখার প্রাক্কালেও সেই রেফারি থেকে শুনেছিলেন ‘দুঃখিত’ শব্দটি।
ট্যাকটিকাল দিক থেকে জানেত্তি ছিলেন সর্বেসর্বা। একই গতিতে বছরের পর বছর পারফর্ম করে গেছেন। খুব কম সময়ই ইনজুরি তাকে বিচলিত করতে পেরেছিল। ৫টি স্কুদেত্তো, ৪টি কোপা ইতালিয়া, ৪টি ইতালিয়ান সুপার কাপ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি উয়েফা কাপ, একটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ এবং এর পাশাপাশি ১৫ বছর ধরে ‘নেরাজ্জুরি’দের ক্যাপ্টেন থেকে ৮৫৮ ম্যাচে অংশগ্রহণ, কিংবা আলবিসেলেস্তেদের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৩ ম্যাচ – এর কোনোটিই বুঝাতে পারবে না, মাঠের বাইরেও জানেত্তি কতটা ব্যক্তিত্ব বহন করতেন। তারই সম্মানে জানেত্তির পরিহিত চার নাম্বার জার্সিটি চিরতরে অবসরে পাঠিয়েছে ইন্টার মিলান।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে মুখোমুখি হয়েছিল দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা। বেকহ্যাম-ডিয়েগো সিমিওনে কাণ্ডের আগে দুর্দান্ত এক গোলে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন জানেত্তি। ফ্রি-কিক থেকে পাওয়া পাসে বাম পায়ের জোরালো শটে ২-২ করেন এই ডিফেন্ডার। ম্যাচশেষে ইংল্যান্ড কোচ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, দুই পায়েই এত দুর্দান্ত ফিনিশ তিনি কোনো ডিফেন্ডারকে করতে দেখেননি। দুই পায়ের এই সমান দক্ষতার জন্যই নিজের জায়গা নিয়ে কখনো কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। দলের প্রয়োজনে রাইটব্যাক ছেড়ে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডেও খেলেছেন বহু ম্যাচ। জানেত্তি ইন্টারকে সামলেছেন হৃদয়ের ভালবাসা ও আনন্দ থেকে। সেই জন্য ২০১৪ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার সাথে সাথেই ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার মর্যাদায় তাকে ভূষিত করে ক্লাব, যেটি ছিল জানেত্তির স্বপ্ন।
বুয়েন্স আয়ার্সে জন্ম নেওয়া জানেত্তির বেড়ে ওঠা একেবারেই গরীব পরিবারে। ইটভাটায় কাজ করতে করতে ভাই সার্জিও’র সাথে ফুটবলকে আবিষ্কার করেন তিনি। ফুটবলের মাধ্যমে দুর্বিষহ জীবন থেকে এক চিমটি মুক্তি পাওয়ার নিমিত্তেই ফুটবল খেলা শুরু জানেত্তির।
তবে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই নষ্ট হতে পারত তার। আর্জেন্টাইন ক্লাব ইন্দিপেন্দিয়েন্তের হয়ে ট্রায়াল দেওয়ার সময় খুবই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ও দুর্বল হওয়ার জন্য বাদ পড়েন জানেত্তি। সময়টা ১৯৮৯ সাল। জানেত্তির বয়সও সবেমাত্র ১৬। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাচাত ভাইয়ের সাথে দুধ ডেলিভারি দেওয়ার কাজে নামেন জানেত্তি। নিজের কাজ শেষ হওয়ার পর বাবাকেও ইটভাটার কাজে সাহায্য করতেন তিনি।
সেখান থেকেই জানেত্তির জীবনের প্রতি উপলব্ধি শুরু। বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে ইট গেঁথে গেঁথে উপরে ওঠার ব্যাপারটি নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন তিনি। তাই একেবারে নিচ থেকে শুরু করার জন্য ১৯৯১ সালে এইবার জানেত্তি ট্রায়াল দেন আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বিভাগের দল অ্যাটলেটিকো টেলারসে। যেই জানেত্তি দুর্বল হওয়ার জন্য ট্রায়াল থেকে বাদ পড়েছিলেন, সেই জানেত্তিকেই দ্বিতীয় মৌসুমে সমর্থকরা উপাধি দেন ‘ট্রাক্টর’ নামে। কারণ? দুর্দান্ত স্ট্যামিনা, আর পুরো মাঠ জুড়ে দৌড়ে খেলার সামর্থ্য!
আর তাতেই দুই বিখ্যাত ক্লাব বোকা জুনিয়র্স এবং রিভারপ্লেটের চোখে পড়েন তিনি।
তবে জানেত্তির সামনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেন তৎকালীন আর্জেন্টিনার কোচ ড্যানিয়েল প্যাসারেলা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের তিন মাস আগে ২১ বছর বয়সী জানেত্তিকে দলে ডাক দেন তিনি। সেই সময় জানেত্তি খেলছিলেন ব্যানফিল্ডে। ঠিক এর এক বছর পরই ইন্টার মিলান প্রেসিডেন্ট মাসিমো মোরাত্তি জানেত্তিকে ভেড়ান তার নিজের ক্লাবে। রোনালদো লিমা, ইব্রাহিমোভিচ, হার্নান ক্রেসপো, ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি, স্যামুয়েল ইতো, স্নাইডার, ফিগো, রবার্তো কার্লোস – এত সব খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানো মোরাত্তির প্রথম সাইনিং ছিলেন এই হাভিয়ের জানেত্তি।
টানা পারফরম্যান্সে মাত্র ৩ বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে ইন্টার মিলানের অধিনায়ক বনে যান জানেত্তি। নিজের ক্যারিয়ারে মরিনহো, মার্সেলো লিপ্পি, মানচিনি, রাফা বেনিতেজসহ অনেক কোচের অধীনেই খেলেছেন। কিন্তু সবাই একটি দিক দিয়ে একমত ছিলেন। তা হলো, ইন্টার মিলানের ‘এল কাপিতানো’ একজনই – হাভিয়ের জানেত্তি। তাই অবসরের আগ পর্যন্ত ১৫ বছর ধরে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন তিনি।
২০০৯-১০ মৌসুমে ৩৬ বছর বয়সী জানেত্তি ততদিনে ইন্টার মিলানের চোখের মণি। সেই সময়ে কোচ হয়ে আসেন জোসে মরিনহো। মরিনহো এসে দলের খোলনলচে পালটে দিলেও জানেত্তি থেকে যান দলের অধিনায়ক হিসেবে। মরিনহোর অধীনে সেবার জানেত্তির হাতেই উঠল ট্রেবল শিরোপা। ইন্টারের হয়ে অমরত্ব অর্জনের শেষ ধাপটুকুও সম্পন্ন করলেন এই ডিফেন্ডার। ৩৬ বছর বয়সেও সেই মৌসুমে মরিনহোর হয়ে প্রতিটি ম্যাচেই শুরুতে খেলেছিলেন তিনি।
কিন্তু ক্লাবের হয়ে এই সাফল্যেও আর্জেন্টিনার হয়ে জানেত্তির সময়টা ছিল বিষাদে ভরা। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেললেও পরপর দুইটি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে সবগুলো বাছাই ম্যাচ খেললেও অদ্ভুতভাবে তাকে বাদ দিয়েই দল সাজান পেকারম্যান। তার জায়গায় দলে নেন তরুণ লিওনেল স্ক্যালোনিকে। তাতে মিডিয়া সংবাদমাধ্যম প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পরলেও জানেত্তি স্বভাবজাতভাবেই পুরোটা সময় নিশ্চুপ ছিলেন। একটি ‘টু’ শব্দ না করেও বিশ্বকাপের পর দলে ডাক পেয়ে খেলে গিয়েছিলেন নিজেকে উজাড় করে।
অন্যদিকে, ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সময়ে মাচেরানোর কাছে অধিনায়কত্ব হারানোর পর গুতিয়েরেজের কাছে জায়গাও হারান তিনি। বয়সের অজুহাতে ম্যারাডোনা সেবার দলে নেননি তাকে। অথচ, মাত্রই ট্রেবল জিতেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১১ কোপা আমেরিকার পর বিদায় জানান দেশকে।
২০১০ মৌসুমের পরও নিজের ফিটনেস ও শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে ইন্টারের হয়ে প্রতিটি মৌসুমে ত্রিশের উপর ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ৪০ বছর বয়সে ইনজুরি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে ঘোষণা দেন বুটজোড়া তুলে রাখার। নিজের ৪০তম জন্মদিনের তিন মাস আগে ১৮ মে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলেন তিনি। সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় জানান ‘সান সিরো’কে।
নিজের ফিটনেস নিয়ে কোনোদিন আপোষ করেননি জানেত্তি। তার স্ত্রী পলা এক ইন্টারভিউতে বলেন,
‘প্রতিবার জানেত্তি ট্রেনিং কিংবা জিমে গেলে যদি আমার রাগ করেই থাকতে হতো, তাহলে ১৪ বছর বয়স থেকেই আমার মুখ গোমড়া করে রাখতে হতো।’
পলা আরো বলেছেন যে, একবার তুরস্কে পারিবারিক ছুটি কাটতে গিয়ে জানেত্তি ভুল করে জিম ছাড়া এক হোটেল বুক করে ফেলেন। আর তাতেই পুরো ছুটি জুড়ে বিষণ্ন ছিলেন তিনি। এমনকি নিজের বিয়ের দিনও ছাড় দেননি তিনি। বাল্যকালের বান্ধবী পলাকেই বিয়ে করার দিন অতিথিদের আগমনের আগে জানেত্তি তার হবু বউকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অতিথি আসার আগ পর্যন্ত তিনি যদি দৌড়ান, তার কোনো আপত্তি আছে কি না! নিজের এই আপোষহীনতার জন্য ইন্টারকে ৩৬ বছর বয়সেও এসে জেতাতে পেরেছিলেন ট্রেবল। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে অফিসিয়াল ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন ১,১১২টি!
মাঠের বাইরেও অসাধারন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। কোনোরকম বিতর্কেও জড়াননি কখনো। ইন্টার মিলান ও আর্জেন্টাইন সতীর্থ এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোকে নিয়ে ইতালিতে গড়ে তুলেছিলেন পথশিশুদের জন্য বড় একটি চ্যারিটি সংস্থা। নিজের স্ত্রী পলাকে নিয়ে আর্জেন্টিনার গরীব পরিবারের জন্যও গড়ে তুলেছেন চ্যারিটি।
পাওলো মালদিনি বলেছিলেন, নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ‘শ্রদ্ধাষ্পদ প্রতিপক্ষ’। রায়ান গিগস তার সম্পর্কে বলেছিলেন, নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ ও পরিপূর্ণ এক খেলোয়াড়। মরিনহো বলেছিলেন,
‘জানেত্তিকে কোচিং করানো আমার জন্য একটি সম্মানজনক ব্যাপার।’
তাই তো কঠোর পরিশ্রমী ও বিনয়ী হাভিয়ের জানেত্তির প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায় মাথা নত হয়ে আসে সব ফুটবলবোদ্ধাদের। আর বিদায়বেলায় সান সিরোতে ‘এল কাপিতানো’র সাথে সাথে কান্নারও রোল পড়ে যায়।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ