১
‘সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কে’- প্রশ্নটি করা হলে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের কথা বলবেন। কেউ কেউ আবার স্যার ভিভ রিচার্ডসের নামটিও নিয়ে আসতে ভুলবেন না। ৯০ দশকের পর থেকে যারা ক্রিকেট দেখেছেন, তাদের অনেকেই শচীন টেন্ডুলকারকে এগিয়ে রাখবেন আধুনিক যুগের বিবেচনায়।
একই ঘটনা ‘সর্বকালের সেরা বোলার’ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ঘটবে। কেউ বলবেন সিডনি বার্নসের কথা, কারো কাছে ডেনিস লিলি, কারো কাছে ওয়াসিম আকরাম কিংবা কারো কাছে ম্যালকম মার্শাল। অনেকে আবার স্পিনারদেরও পেছনে রাখতে চাইবেন না। এদের কেউ কেউ হয়তো শেন ওয়ার্ন কিংবা মুরালিধরনকেও এগিয়ে রাখবেন।
মোট কথা হচ্ছে, ‘সেরা’ বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক। এতে মতানৈক্য থাকবেই। সকলেই একমত হওয়াটা এখানে খুবই দুরূহ ব্যাপার, কারণ এক্ষেত্রে অনেক বিষয়ই কাজ করে সেরা বাছাইয়ের জন্য। তবে এত কিছুর পরেও খুব অল্প কয়েকজন মানুষ আছেন, যারা কিনা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নিজেদের অবস্থানটা এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যান যে, তাদেরক সেরা বলতে খুব বেশি ভাবতে হয় না। বরং কেউ যদি তাদেরকে সেরা বলে স্বীকার না করেন, তাহলেই সেটি নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জন্টি রোডস হচ্ছেন এরকমই একজন মানুষ।
‘সর্বকালের সেরা বোলার কিংবা সেরা ব্যাটসম্যান’ নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, ‘সর্বকালের সেরা ফিল্ডার’ নিয়ে মোটামুটি কোনো বিতর্ক নেই। সেখানে জন্টি রোডসের বিকল্প ভাবাটাই দুষ্কর। চলুন শোনা যাক এই উড়ন্ত পাখিরুপী ক্রিকেটারের কিছু গল্প।
২
একজন দক্ষ ফিল্ডার হতে গেলে অনেকগুলো গুণের প্রয়োজন হয়। তবে এর মাঝেও আলাদাভাবে তিনটি গুণের কথা বলা যায়; বলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা, ক্যাচ ধরার ক্ষমতা আর বল ধরে থ্রো করার ক্ষমতা। ধারণা করা হয়, এই তিনটি বিষয়েই অন্য সবার চেয়ে অনেকখানিই এগিয়ে ছিলেন জন্টি রোডস।
ফিল্ডিং করার সময় বেশিরভাগ সময়েই দাঁড়াতেন পয়েন্ট, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট কিংবা গালি অঞ্চলে। তার সামনে বল ফেলে রান নেওয়ার সাহস খুব কম ব্যাটসম্যানই দেখিয়েছেন। এমনকি তার মাথার উপর দিয়ে কিংবা আশপাশ দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে বল পাঠানোর আগেও কয়েকবার চিন্তা করতেন তারা। কারণ, অন্যান্য ফিল্ডারদের জন্য যে ক্যাচ ধরাটা দুরূহ, সেটিই খুব অনায়াসে যেন ধরে ফেলতেন জন্টি।
১৯৯৭ সালে ভারতের সাউথ আফ্রিকা সফরের একটি টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচের কথা। ২৬ বলে ৩২ রান নিয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন শচীন। নিশ্চিত চার মারার মতো একটি শট খেলেছিলেন, কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিল, যে জায়গা দিয়ে বলটি যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন জন্টি। ক্যাচটি ধরার পর শচীনের অভিব্যক্তিটা দেখার মতো ছিল। এমনকি ড্রেসিং রুমে হতচকিত আজহারউদ্দিনের বিস্মিত চেহারাটিও ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।
ক্যাচটির ভিডিও
বল থ্রো করা কিংবা রান আউট করার ক্ষেত্রেও তিনি অন্যান্যদের চেয়ে এগিয়ে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাখির মতো উড়ে গিয়ে ইনজামাম উল হককে রান আউট করার দৃশ্যটি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা রান আউট হিসেবে বিবেচিত হয়।
রান আউটটির ভিডিও
ক্রিকেট দলে জায়গা পেতে হলে একজনকে ব্যাটসম্যান, বোলার, উইকেট কিপার কিংবা অলরাউন্ডার হতে হয়। ফিল্ডিংটা হচ্ছে একজন ক্রিকেটারের সেকেন্ডারি স্কিল। অথচ জন্টি রোডস তার ফিল্ডিং দক্ষতার জন্যেই দলে সুযোগ পান। সেটাও ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। সেই টুর্নামেন্টের সেরা ফিল্ডারের পুরস্কারটিও জিতে নেন জন্টি।
২১ বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকার পর দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে ভিন্ন রকম কিছু দেখানোর। দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা দেখেই ক্রিকেট বিশ্বের অন্যান্য দল ফিল্ডিংটাকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবা শুরু করলো। ক্রিকেট মানেই শুধু ব্যাটিং কিংবা বোলিং নয়, ফিল্ডিং দিয়ে যদি ৩০টি রানও বাঁচাতে পারেন, তাহলে ব্যাটিংয়ে ২৫০ রানের জায়গায় টার্গেট নেমে আসবে ২২০-এ। এর সাথে যদি অবিশ্বাস্য কিছু ক্যাচ ধরে ব্যাটসম্যানদের আউটও করতে পারেন, তাহলে তা হবে বাড়তি পাওনা।
জন্টি রোডসই ক্রিকেট বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি শুধুমাত্র তার ফিল্ডিং দক্ষতা দিয়েই অনেকদিন দলে টিকে ছিলেন। প্রথম ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ শেষেও তার ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৪.৯৫, কোনো পঞ্চোশোর্ধ ইনিংস ছিল না, ২০ রানের নিচেই আউট হয়েছেন ১৪ বার। কিন্তু এর পরেও দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে সমস্যা না হওয়ার কারণ ছিল, প্রতিটি ম্যাচেই ফিল্ডিং দিয়ে অন্তত ২০/২৫ রান আটকে দিতেন তিনি।
কিছু রান আউটের ভিডিও
এছাড়া তার অবিশ্বাস্য ক্যাচ কিংবা দুরূহ কোণা থেকে রান আউট করার ক্ষমতা কয়েকজন বোলারের চেয়েও বেশি কাজে দিত।
তবে ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ব্যাটিংয়ের প্রতিও মনোযোগী হন তিনি। এই কারণেই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ করতে পেরেছিলেন ৩৫.১২ গড় নিয়ে।
৩
পরিসংখ্যান অনেক কিছুই বলতে পারে না, আবার অনেক কিছুই পারে। পরিসংখ্যানের হিসেবেই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম এবং এই পর্যন্ত একমাত্র ফিল্ডার হিসেবে এক ইনিংসে ৫টি ক্যাচ ধরার কৃতিত্ব জন্টি রোডসের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ছিল কার্টেল ওভারের। ৪০ ওভারে ১৮১ রানের টার্গেট খুব বেশি ছিল না। প্রথম তিনজন ব্যাটম্যানের ক্যাচই ধরেন জন্টি রোডস, সব মিলিয়ে ৫টি। এর মাঝে ছিল ব্রায়ান লারা আর ডেসমন্ড হেইন্সের মতো ব্যাটসম্যানের ক্যাচ। লারার যে বলটি ক্যাচ উঠে, সেটি স্লিপে দাঁড়ানো দুজন, কাভার পয়েন্টে দাঁড়ানো একজন আর এক্সট্রা কাভারে দাঁড়ানো একজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল যে পিচের উপর বলটি পড়ছে কিন্তু ক্যাচ ধরার কেউ নেই। হঠাৎ করে ব্যাকওয়ার্ড কাভার পয়েন্ট থেকে প্রায় ১৫ গজ দৌড়ে আর ৫/৬ মিটার স্লিপ করে সুপারম্যানের মতো ক্যাচটি ধরে ফেললেন জন্টি রোডস! এরপর সিমন্সের ক্যাচটিও ছিল অসাধারণ। সিমকক্সের বলে লেগ সাইডে ফ্লিক করে বাউন্ডারির আশায় ছিলেন ৩৮ বলে ২৯ রান করে দুর্দান্ত খেলতে থাকা সিমন্স। কিন্তু শর্ট মিডউইকেটে দাঁড়িয়ে থেকে আরো একটি অসাধারণ ক্যাচ ধরেন জন্টি। সেই ম্যাচে ৪২ বলে ৪০ রানও করেছিলেন তিনি, সাথে ৫টি ক্যাচ। কালিনানের গুরুত্বপূর্ণ ৭০ রানের ইনিংস থাকার পরেও তাই ম্যাচ সেরার পুরস্কারটি পান জন্টিই।
এছাড়া ২০০৫ সালে ক্রিকইনফোর একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর থেকে সবচেয়ে রান আউট করা ফিল্ডারদের মাঝে জন্টির অবস্থান ছিল নবম আর ম্যাচ প্রতি সফলতার গড় হারের দিক থেকে ছিলেন তৃতীয়।
৪
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জন্টি দক্ষিণ আফ্রিকার হকি জাতীয় দলেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৯২ সালের অলিম্পিক দলেও ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার দল বাছাইপর্ব পেরুতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ অলিম্পিকেও তিনি দলে জায়গা পান। কিন্তু এবার বাদ সাধে ইনজুরি। ক্রিকেটীয় দক্ষতার কারণে ১৯৯৯ সালের উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ জন খেলোয়াড়ের একজন নির্বাচিত হন।
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ৪টি বিশ্বকাপ খেলেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করার জন্য ২০০০ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ২০০৩ বিশ্বকাপেই কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে একটি ক্যাচ ধরতে গিয়ে জন্টি রোডস ইনজুরিতে আক্রান্ত হন। ডাক্তারের হিসেব মতে, চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হতো। জন্টি এই অবস্থায় অবসর নিয়ে নেন।
তার কিছু দুর্দান্ত ক্যাচের ভিডিও
অবসর নেওয়ার পরে তিনি কিছুদিন আইপিএল আর বিভিন্ন জাতীয় দলের ফিল্ডিং এবং সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
৫
১৯৬৯ সালের ২৭শে জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার পিটারমারিতজবার্গের নাটাল প্রদেশে জন্ম নেওয়া এই খেলোয়াড় ২০০৪ সালে সাউথ আফ্রিকার টেলিভিশনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ‘গ্রেট সাউথ আফ্রিকান’দের মাঝে ২৯তম নির্বাচিত হন। সেরা একশোতে ক্রিকেটারদের মাঝে তার বাইরে ছিলেন শুধুমাত্র আর একজন- হ্যানসি ক্রনিয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক বোলার ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্সের মতে,
“এই পর্যন্ত সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটার যত কিছু পেয়েছেন তার মাঝে মাঠে এবং মাঠের বাইরে সব কিছু মিলিয়ে সেরা হচ্ছেন জন্টি রোডস।”
জন্টি রোডস অবসরে যাবার পর আরো অনেক ভালো ফিল্ডার এসেছেন, এদের মাঝে দুর্দান্ত ফিল্ডিং করেছেন এমনও কেউ কেউ আছেন। কিন্তু জন্টি রোডসের জায়গায় ধাক্কা দেবার মতো এখনো কেউ আসেননি, সেটি চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। অচিরেই কেউ আসবেন, এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।