ভারতকে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতানোর সময় থেকেই তাকে মনে করা হতো দলটির ভবিষ্যত নেতা। ছিলেন অসামান্য এক ফিল্ডার। কিন্তু কোনো এক কারণে ক্যারিয়ারটা ততো লম্বা হয়নি। ২০০৬ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এবার ক্রিকেটকেই বিদায় বলে দিলেন মোহাম্মদ কাইফ।
সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় বলার পর নিজের ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলেছেন মোহাম্মদ কাইফ
আপনার বয়স এখন ৩৭। আরও বছর দুই খেলে যেতে পারতেন। এখনই কে মনে করলেন যে, আর কিছু দেওয়ার নেই?
এটা ঠিক যে, সময় ছিলো। কিন্তু রঞ্জি খেলা মানে বছরে পাঁচ মাস ব্যস্ত থাকা। আমি এখন অন্ধ্র ও ছত্তিশগড়ের কিছু নতুন প্রতিভাকে নিয়ে কাজ করছি। আমার বাচ্চারা বড় হয়ে উঠছে। আমার ছেলে কবিরের বয়স এখন ছয়। আর মেয়ে ইভা মাত্র এক বছর বয়সী। এখন আমার পরিবারের আমাকে প্রয়োজন।
আপনি ২০০৫-০৬ মৌসুমে ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন। তারপরও কখনো ভারতীয় একাদশে নিশ্চিত হতে পারেননি। এই অনিশ্চয়তা আপনার ক্রিকেটের কটা ক্ষতি করেছে।
২০০২ ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের সময় আমার বয়স খুব জোর ২১। পরের চার বছরে আমি আমার সেরা ফর্মে ছিলাম। এই সময় আমি অসাধারণ খেলছিলাম এবং বল দারুন দেখছিলাম। তারপরও নিয়মিত সুযোগ পাইনি। এটা অবশ্যই আমাকে হতাশ করেছে। আমি ২০০৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পাই। এমন না যে, আমার বয়স তখন ৩৫ হয়ে গেছে। এমনকি ২০০৬ রঞ্জিতেও আমি সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ছিলাম। ফাইনালে ৯২ ও ১০৯ রানের ইনিংস খেলেছিলাম বাংলার বিপক্ষে।
আমি ১২৫টা ওয়ানডে খেলেছি। সম্ভবত কোচ ও অধিনায়কের সাথে যেভাবে আলাপ করা উচিত ছিলো, তা আমি কখনো পারিনি। ২০০৮ সালে কানপুর টেস্টে শচীন যখন ইনজুরিতে পড়লো, আমাকে ডাকা হলো। কিন্তু মাঠে নামানো হলো না। আমার রান এসবে কখনো শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু ক্যারিয়ারটা অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে।
সেই অনুর্ধ্ব-১৯ বছর বয়স থেকে আপনাকে মনে করা হতো টেস্ট ব্যাটসম্যান। অথচ খেলেছেন মাত্র ১৩টি টেস্ট। অভিষেক সেঞ্চুরির পর আর মাত্র তিনটি ইনিংস সুযোগ পেয়েছেন।
টেস্টে আমি কখনো ধারাবাহিক হতে পারিনি। ২০০৬ সালে নাগপুরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিলাম। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চেন্নাইতে প্রত্যাবর্তন টেস্টে ৬৪ করেছিলাম। আমি ৯১ করার পর আমাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
২০০৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজটা আপনার ক্যারিয়ার কার্যত শেষ করে দিয়েছে। অন্য ব্যাটসম্যানরাও যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন, আপনার প্রতি কি বেশি কঠোর হয়ে গিয়েছিলো তারা?
ওই সময়ে আমাদের জন্য ওই ধরনের কন্ডিশন খুব কঠিন ছিলো। অন্যদের মতো আমিও ওখানে ধুঁকেছি।
আপনার স্ট্যান্স ও গ্রিপ খুব অপ্রচলিত ছিলো। আপনি ব্যাট ধরতেন দুই হাত অনেক দূরে দূরে রেখে। আপনার কী মনে হয়, আরও ভালো কোচিং আপনাকে ভালো ব্যাটসম্যানে পরিণত করতে পারতো?
আমি কখনো কেতামাফিক কোচিং পাইনি। ফলে আমি কখনো কপিবুক ব্যাটসম্যানও হয়ে উঠতে পারিনি। আমার খেলাটা প্রচলিত ক্রিকেট ছিলো না। যাতে করে আমার কাঁধ ও কনুই একটা রেখায় থাকে। ফলে আমি কখনো টেকনিক্যালি নিখুঁত হতে পারিনি।
আমার ওই ধরনের গুণ ছিলো না যে, মাথার পজিশন ঠিক রাখবো বা এসব। আমি ম্যাচেই বেশি ফোকাস করেছি। উত্তর প্রদেশের হয়ে অনেক ম্যাচ খেলেছি। এর ফলে আমার ম্যাচ টেম্পারামেন্ট অনেক উন্নত হয়েছে। ফিল্ডিংয়ের ফাঁক খুঁজে পাওয়া বা ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সাড়া দেওয়া; এসব আমার স্কিলে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা, আমি রান করতে পেরেছি।
তার মানে কখনোই এসব বেসিক নিয়ে কাজ করেননি?
একেবারে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে কিছু উপদেশ পেয়েছি। আমি যখন বাদ পড়লাম, ২০০৮ আইপিএলের সময় আমির সোহেল (সাবেক পাকিস্তানী তারকা) বললেন যে, আমার দুই হাতের ফাঁকটা কমানো উচিত। তাতে আমি শটে আরও শক্তি দিতে পারবো।
আমি একটু লাজুক থাকায় সিনিয়রদের কাছে এসব নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পেতাম। আমি কখনো গ্রেগ চ্যাপেলের মতো কোনো ক্রিকেট মস্তিষ্কের কাছে সহায়তা পাইনি। এটা আমার উন্নতির পথে অন্তরায় ছিলো। আমি নেটে অনেক ঘাম ঝরিয়েছি। কিন্তু কখনো কখনো আপনাকে সঠিক লোকের সাথে উন্নতির জন্য পরামর্শ চাইতে হয়। আমি তখন চাইলে যেকোনো সিনিয়রকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে, খেলার ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতে পারতাম।
আপনি ও যুবরাজ এই শতকের প্রথম দশকে একটা ফিল্ডিংয়ের মানদন্ড দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। পয়েন্ট ও কাভার পয়েন্টে রান আটকে ফেলেছিলেন। এটার রহস্যটা একটু বলবেন?
একটা দলের জন্য ফিল্ডিং জুটি ব্যাটিং জুটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন খেলছি, তখন লেগসাইড ওয়াইডের আইন শক্ত হয়ে গেছে। বোলাররা প্রায়শ অফস্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে বল করতো। ফলে কাভার ও পয়েন্টে ফিল্ডারদেরকে একেবারে তৎপর থাকতে হতো। একজন ব্যাটসম্যানকে আপনি যখন চার-পাঁচ বল স্ট্রাইকে আটকে রাখতে পারবেন, তখনই উইকেট নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
যুবরাজ ও আমি আমাদের প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের স্টাইলটা পড়ার চেষ্টা করতাম। উইকেট একটু স্লোয়ার হলে আমরা কাছাকাছি চলে আসতাম, উইকেটে বাউন্স থাকলে এক গজ আড়াআড়ি সরে যেতাম। আমরা খুব দ্রুত নিজেদের মধ্যে পজিশনটা বদলাতাম। ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্ক দেখে এটা করতাম। আপনি যদি ফিট থাকেন এবং ক্ষিপ্র হন, তাহলে যা পরিকল্পনা করছেন, তার পঞ্চাশ ভাগ অন্তত অর্জন করতে পারবেন।
২০০৪ সালে করাচি ওয়ানডেতে শোয়েব মালিকের ক্যাচটা কেমন মনে আছে? সেটা এখনও ইউটিউবে হিট দেয়।
যেসব তরুণ তারকা সবসময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে চায়, তাদের জন্য এই ক্যাচটা একটা উদাহরণ। আমি তখন ভারতীয় দলে সবচেয়ে ফিট খেলোয়াড়। বল যখন শূন্যে উড়ছিলো, আমি সেটাকে আমার একটা বিশেষ কিছু করার সুযোগ হিসেবে নিলাম। এ জন্যই তো আমরা ট্রেনিং করি। এরকম একটা মুহুর্তের জন্যই তো আমরা বেঁচে থাকি। আমি আশা করছিলাম, এমন কিছু করবো যে, আমি হিরো হয়ে যাবো। ক্যাচটা আমার ছিলো না। এটা লং অনে বাদানির (হেমাং) দিকে যাচ্ছিলো। আমি লং অফে ছিলাম। বল যেহেতু বেশ উঁচুতে ছিলো, আমি একটা চান্স নিলাম।
আমি যখন দৌড়াচ্ছিলাম, তখনও নিশ্চিত ছিলাম না যে, ক্যাচটা নিতে পারবো কি না। এটা জীবনের একটা বিরাট প্রতীক হয়ে গেছে। জীবনে অনেক সময় আসে, আমরা জানি না, কোথায় যাচ্ছি; তারপরও একটা বিশ্বাস নিয়ে দৌড়াতে হয়। মনে করতে হয়, শেষ মুহুর্তে কিছু একটা হবে। ওই ক্যাচটাও শেষ ন্যানো সেকেন্ডে হয়ে গেলো।
মনে হয়, আপনি আপনারা সেরাটা সবসময় পাকিস্তানের জন্য তুলে রাখতেন?
আমাকে সবসময় ন্যাটওয়েস্টের সেই ইনিংসের জন্য (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস ফাইনালে ৮৭*) মনে রাখা হয়। কিন্তু আমি আরও কিছু ইনিংসকে আমার হৃদয়ের কাছে রাখি। এর মধ্যে একটা ২০০৪ সালে আমাদের প্রতিবেশীদের বিপক্ষে ৭১ রানের অপরাজিত ইনিংস। আমরা সিরিজে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলাম। দ্রাবিড় ও আমার ইনিংস সিরিজটা শেষ ম্যাচে নিয়ে গিয়েছিলো। লক্ষনের দারুন এক সেঞ্চুরিতে আমরা জয় পেয়েছিলাম।
সেঞ্চুরিয়নে আমি হ্যাটট্রিক বল সামলালাম। আমার ভূমিকা ছিলো, শচীনকে বিশ্বাস দেওয়া যে, কাইফ আছে। ওকে বিশ্বাসটা দেওয়া যে, তুমি নিজের শট খেলতে পারো। ওই ইনিংসে ও উন্মুক্তভাবে খেলতে চাচ্ছিলো। এরকম অবস্থায় সমর্থন লাগে।
আপনার যে ফিটনেস ছিলো, যেমন ফিল্ডিং করতেন, তাতে আজকের দিনে খেললে আরেকটু বেশি গুরুত্ব পেতেন বলে মনে হয়?
সত্যি বলি, আমি কোনো আফসোস নিয়ে যাচ্ছি না। আমি ভারতের সোনালী প্রজন্মের সাথে খেলেছি। আমি একমত যে, সিস্টেম এখন অনেক পেশাদার। আমাদের তখন সব নিজেরা করে নিতে হতো। তখন আমরা ছিলাম স্বশিক্ষিত। তারপরও আমি যা অর্জন করেছি, আমি সন্তুষ্ট।
ফিচার ইমেজ: AFP