বাসায় অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ওয়ানডে অধিনায়ক এই সফরটাকে দেখছেন খুব গুরুত্বের সাথে। কারণ, তার মতে এটাই বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু করার আদর্শ সময়
বাসায় এই কঠিন পরিস্থিতি রেখে ওয়ানডে দলে যোগ দেওয়া কতটা কঠিন ছিলো?
বেশ কঠিন। তবে একই সাথে আমি সবসময় পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ইতিবাচক ছিলাম। এটা সত্যি যে, আমার স্ত্রী অসুস্থ। একইসাথে এটাও সত্যি যে, আমি স্কোয়াডে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সবসময় আশাবাদী ছিলাম। একমাত্র সমস্যা হলো, আমি ওয়ানডে দলের বাকিদের সাথে রওনা দিতে পারিনি। কারণ ওর (স্ত্রীর) ইনজেকশন শেষ হওয়ার তারিখ ছিলো ১৫ জুলাই।
আমি সুমন ভাইকে (নির্বাচক হাবিবুল বাশার) বললাম যে, আমি ১৫ তারিখের আগে যেতে পারবো না। উনি বললেন, এর পরে গেলেও সমস্যা নেই। এটা আমার কাজ সহজ করে দিয়েছে। তারপরও অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে যাওয়াটা খুব সোজা কাজ ছিলো না। তবে আমার এটা বলা দরকার যে, আমি এই প্রথম ওকে অসুস্থ রেখে দেশের বাইরে যাচ্ছি না। ফলে এই ধরনের পরিস্থিতি, আমি সামলে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। এখন একটা ভালো ব্যাপার হলো, আমি অনুশীলন ম্যাচটা খেলতে পারলাম। এটা দরকার ছিলো। কারণ, আমি অনেকদিন হয় কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলি না।
বলা হয়, ২০০৯ সালে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ইনজুরিতে পড়ার জন্য আপনি কখনোই ক্যারিয়ারের সেই সেরা জায়গাটায় যেতে পারলেন না। আরেকবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের কথা এলে কী মনে হয়?
এটা সত্যি। কিন্তু এ নিয়ে হা-হুতাশ করার কোনো অর্থ নেই। আমি এ নিয়ে অসুখীও নই বা আমি এটা নিয়ে ভয়ও পাই না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যত যন্ত্রণাদায়কই হোক, ব্যাপারটা মেনে নেওয়া এবং সামনে তাকানো। ২০০৯ সালে আমি ওখানে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ায় কিছুই হয়নি। ফলে ওই স্মৃতি নিয়ে কথা বলাটা এখন অর্থহীন। কিন্তু এটা এমন একটা ব্যাপার, যা আমি স্মৃতি থেকে মুছেও ফেলতে পারবো না।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও আপনাকে এরকম পরিস্থিতিতে যেতে হয়েছিলো। দল টেস্টের পরাজয়ের কারণে মনোবল ভাঙা অবস্থায় ছিলো; এখনও তা-ই। এ অবস্থায় অধিনায়ক হিসেবে আপনার কাজটা কী হবে?
এই স্তরে কেউ কোনো প্রস্তুতি ছাড়া মাঠে নামে না। আমার ধারণা, ওরা ওদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছে। কিন্তু ব্যাপারগুলো কাজে দেয়নি। এটা খুব স্বাভাবিক যে, দল যখন হারে তখন মানসিকতাটা দুর্বল হয়ে যায়। আমার প্রথম কাজ হবে ওদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করা। কারণ, আমরা মানসিকভাবে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলাম, তার ওপরই নির্ভর করছে ওয়ানডে সিরিজের ফল। আমি বিশ্বাস করি না যে, আমাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর মতো স্কিল নেই। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে।
আমার মনে হয়, আমাদের আরও ইতিবাচক হতে হবে। যদি মনে হয়, উইকেটে রান আছে, তাহলে আমাদের রানের পেছনেই ছুটতে হবে। কারণ, টেস্টে কী হয়েছে, সেজন্য আমরা হতাশ হয়ে থাকলে সামনে এগোতে পারবো না। আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের আরও বেশি চাওয়া থাকতে হবে। আমাদের যদি ৩০০ রান করতে হয়, তাই করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা যেন সঠিক মানসিকতায় খেলতে পারি। নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলার কোনো অর্থ নেই। আমরা যদি ব্যর্থও হই, আমাদেরকে সঠিক প্রক্রিয়ায় কাজটা করতে হবে।
আপনি বলছিলেন যে, ওয়ানডে দলে নতুন যারা এসেছে, এরা ওয়েস্ট ইন্ডিজে বড় একটা ভূমিকা রাখবে। কারণ, তারা টেস্ট সিরিজের ড্রেসিংরুমে ছিলো না…
ঠিক এরকম নয় ব্যাপারটা। আমি যেটা বলতে চেয়েছি যে, ওরা যেহেতু ওই (টেস্টের) বাজে ফলাফলটা কাছ থেকে দেখেনি, ওদের সামনে সুযোগ থাকছে ফাঁকা মাথায় নতুন কিছু করার। এটা সত্যি যে, আপনি যখন হারবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস কমে যাবে। আর ওয়ানডে দলে নতুন যারা যোগ দিচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিতভাবেই হবে না। একইসাথে তারা নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। তাতে আমরা বাধ্য হবো ওদের ব্যাপারে দীর্ঘ মেয়াদে ভাবতে।
আপনার কী মনে হয়, এই সিরিজ দিয়ে আমাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো? আর নতুন কোচ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
দেখুন, বিশ্বকাপের আগে আর ১২ মাস সময় আছে। ফলে এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। এখনও কিছু জায়গা আছে যেটা পূরণ করা দরকার। আমাদের সামনে এগোনোর আগে প্রতিটা ব্যাপার বিবেচনায় নিতে হবে। এখন একজন নতুন কোচ এসেছেন। তিনি নিশ্চয়ই বড় একটা অবদান রাখতে পারবেন। কারণ, তিনি খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখবেন।
আমার ধারণা, দল এখন সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল আছে। ফিল্ডিং কোচ এসেছেন, ব্যাটিং কোচও দ্রুত দলের সাথে যোগ দেবেন। কোচিং সেটআপে অন্যরাও আছেন। এদিক থেকে দল স্থিতিশীল আছে। যে দলটা আমাদের বিশ্বকাপে যাবে, অন্তত পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকে একই দল নিয়ে আমাদের খেলা উচিত। আমাদের এখন বৃহত্তর চিত্রটা নিয়ে ভাবতে হবে। আপনাকে অবশ্যই খেলোয়াড়দের সেই সময় দিতে হবে যাতে তারা বিশ্বকাপের আগে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। ফলে আমার ধারণা, এটা বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু করার আদর্শ সময়। একইসাথে আমাদের একমুখী হয়ে গেলে চলবে না। আমরা টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিকে বাদ দিয়ে দিতে পারবো না।
আপনি সবসময় বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে ২০ সদস্যের প্রাথমিক দলের কথা বলে থাকেন…
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা ভালো একটা আইডিয়া। আমাদের ২০ জনের একটা দল তৈরি করতে হবে, সেটা দেখতে যেমনই লাগুক না কেনো। ইনজুরির সমস্যা না হলে এই দল নিয়েই চলতে হবে। এটা নির্বাচক, কোচ ও অধিনায়কের যার যার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সহজ করে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, খেলোয়াড়রা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করবে।
টেস্ট সিরিজে মুশফিক ছয় নম্বরে ব্যাট করেছেন। ওয়ানডেতেও কী তা-ই হতে যাচ্ছে?
কোনো কারণ নেই। কারণ, আপনি দেখে থাকবেন, মুশফিক ওয়ানডেতে চার নম্বরে কত ধারাবাহিক। সে নিজে অন্য কোথাও ব্যাট করতে চাইলে আলাদা কথা। নইলে সে চারেই ব্যাট করবে। আমি বিশ্বাস করি, ও চারে ব্যাট করবে এবং কোচ এটাতে একমত হবেন। দলের সেরা ব্যাটসম্যানের চারে ব্যাট করা উচিত। আমি একইসাথে চাইবো, সে উইকেটরক্ষণও করুক। কারণ এনামুল (হক বিজয়) দারুণ একজন ফিল্ডারও বটে।
আপনি কিছু জায়গার কথা বলছিলেন, যা ফাঁকা আছে। একটু খুলে বলবেন?
আমি মনে করি, সুযোগ নেওয়ার জন্য কিছু জায়গা আছে। যেমন আমরা এখনও তামিমের সঙ্গী কে হবে, এটা খোঁজ করছি। বা এখনও আমরা তিন নম্বরে উপযুক্ত কাউকে পাইনি। একইসাথে আমার মনে হয়, সাত ও আট নম্বরে আমাদের কাউকে খুঁজে পেতে হবে। সেটা আমরা একজন সিম বোলার নিই বা একজন বাহাতি স্পিনার বা একজন অফস্পিনার।
মুস্তাফিজকে নিয়ে কী ভাবছেন? সে তো ইনজুরির কারণে দলে যাওয়া-আসার মধ্যে আছে। সাথে অনেকেই মনে করছে, সে তার জাদুটা হারিয়ে ফেলেছে…
দেখুন, ও ইনজুরি থেকে ফিরছে। ফলে এটা আশা করা ঠিক হবে না যে, ও এসেই কিছু একটা করে ফেলবে। বরং আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, ও সঠিক পরিমাণে সেরে উঠেছে এবং সঠিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমার ওর যে ব্যাপারটা পছন্দ, তা হলো, ও এসব নিয়ে খুব চিন্তা করে না। এটা উপকারী। কারণ, এতে ও নিজের মাথার মধ্যে অনিরাপত্তাটাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
সিনিয়রদের নিয়ে কি দুশ্চিন্তা আছে?
আমার মনে হয় না সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাকে নিয়ে ভাবার কোনো দরকার আছে। ওদের কারো যদি খারাপ সময় যায়ও, সেটা নিয়েও ভাবার কিছু নেই। কারণ, এরা পরীক্ষিত পারফর্মার ও ম্যাচ উইনার। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, ওরা যেন নিজেদের কমফোর্ট জোনে থেকে নিজেদের সেরাটা দিতে পারে। এখানে বাকিদের আসলে এগিয়ে আসতে হবে এবং ওদের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দিতে হবে।