‘নো ফিজ, নো রিয়্যাক্ট’, ফেসবুকে দিল্লি ক্যাপিটালসের যেসব পোষ্ট বা ছবিতে মোস্তাফিজ ছিলেন না, তাতে এই কমেন্টের বন্যাই ছুটেছে। আর মোস্তাফিজুর রহমানকে যখন দিল্লি তাদের একাদশে রাখবে না, তখন তো ক্ষোভের আগুন আকাশ ছোঁবেই।
আনরিখ নরকিয়া হয়তো তার জীবনেও এত গালি খাননি, কিংবা খাবেনও না, এবার মোস্তাফিজের জায়গায় খেলায় যতটুকু ‘গালি’ উপহার পেয়েছেন। একই দলের দু’জন, অথচ মোস্তাফিজ ও নরকিয়াকে যেন মুখোমুখি করে নামিয়ে দেওয়া হলো বক্সিং রিংয়ে!
মোস্তাফিজ নাকি নরকিয়া, কে ভালো? উত্তরটা দিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল নরকিয়ার হাতে। কিন্ত দক্ষিণ আফ্রিকান এই পেসারের পারফরম্যান্সই বরং ক্ষোভের আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে! মোস্তাফিজের চেয়ে দুই ম্যাচ কম খেলেই নরকিয়া উইকেট পেয়েছেন একটি বেশি। তবে মোস্তাফিজের ইকোনমি যেখানে ছিল আটের নিচে, নরকিয়ার নয়ের উপরে। আর এ কারণেই কথা উঠছে, মোস্তাফিজের জায়গায় নরকিয়াকে তোলা হলো, কিন্ত উইকেট পেলেও রান তো নরকিয়া দিয়ে দিচ্ছেন বেশি!
মোস্তাফিজ ৮ ম্যাচে ৮ উইকেট পেয়েছেন, নরকিয়া ৬ ম্যাচে ৯টি। আর মোস্তাফিজের ইকোনমি ছিল ৭.৬৩, নরকিয়ার ৯.৭২! নরকিয়ার ২৪.১১ বোলিং গড়ের বিপরীতে মোস্তাফিজের ছিল ৩০.৫০। এই পারফরম্যান্সের বিচারে আসলে দুজনের একজনকে আলাদা করা কঠিনই বটে! দু’জনের এই পারফরম্যান্স ম্যাচে প্রভাব রাখল কতটুকু? এ হিসাবে চাইলে সে চেষ্টাটা করা যায় অবশ্য। ইএসপিএন ক্রিকইনফো প্রতিটি ম্যাচে প্রত্যেক পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে ‘ইমপ্যাক্ট’ হিসেবে একটা সংখ্যা দেয়। ব্যাটিংয়ের জন্য ‘ইমপ্যাক্ট রান’, বোলিংয়ের জন্য ‘ইমপ্যাক্ট উইকেট’ – দুটো মিলিয়ে ‘টোটাল ইমপ্যাক্ট’।
ধরুন, কেউ একজন ৪০ রান করলেন। তো ম্যাচে কতটুকু চাপের মধ্যে এই পারফরম্যান্স এলো, সেটির উপর নির্ভর করে ইমপ্যাক্ট রান বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। মূল রান ৪০ হলেও ম্যাচের চাপ, পরিস্থিতি বিবেচনায় ইমপ্যাক্ট রান ‘৪৫’-ও হতে পারে। এই চাপ হিসাবের ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয় কত ওভারে কত রান লাগে, ক্রিজে থাকা ব্যাটার ও পরবর্তীতে আসবেন যেসব ব্যাটার তাদের কোয়ালিটি, বোলারদের কোয়ালিটি ও তাদের কত ওভার করে বাকি, পিচ-কন্ডিশন এবং সেটি ব্যাটার কিংবা বোলারের জন্যে কত কঠিন। এই ইমপ্যাক্টের ক্ষেত্রে ব্যাটিং স্কোর, উইকেট, ইকোনমি রেটের চেয়ে গুরুত্ব পায় কতটুকু চাপের মধ্যে সে পারফরম্যান্স এলো, সেটা।
‘টোটাল ইমপ্যাক্ট’-এর দিকে তাকালে দেখা যায়, মোস্তাফিজই এগিয়ে। মোস্তাফিজের ক্ষেত্রে যেটা ২১৮.৩, নরকিয়ার সেখানে ১৫৪.৭৯। মোস্তাফিজের চেয়ে যদিও নরকিয়া ম্যাচ খেলেছেন কম, তাই টোটাল ইমপ্যাক্টের গড়ে নজর বুলানো যাক। সেক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই। মোস্তাফিজের গড়ে প্রতি ম্যাচে ইমপ্যাক্ট ২৭.২৮, নরকিয়ার ২৫.৭৯।
নরকিয়ার এ নাম্বারটা অনেক ভালো হতে পারত যদি নিজের প্রথম ম্যাচেই ১৪ বলে ৩৫ রান দিতেন না। শেষে বিপদজনক নো বল করে ম্যাচ থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন। ওই ম্যাচটায়ই শুধু নরকিয়ার টোটাল ইমপ্যাক্ট নেগেটিভ এসেছে। মোস্তাফিজেরও নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ছিল এক ম্যাচেই।
নরকিয়া ছয় ম্যাচের চারটিতেই ইমপ্যাক্ট নাম্বারটা ত্রিশের উপরে রাখতে পেরেছিলেন। মোস্তাফিজও সমান ম্যাচে তা পেরেছেন, তবে মোস্তাফিজের আট ম্যাচের চারটিতে এসেছিল ইমপ্যাক্ট ত্রিশের বেশি। সে কারণে অধিক ম্যাচে প্রভাব রাখতে পারা বিবেচনায় নরকিয়াকেই এগিয়ে রাখতে হয়। গড় চিন্তা করলে আবার মোস্তাফিজই এগিয়ে থাকেন, সেটি অত্যন্ত সামান্য ব্যবধানে হলেও!
ইমপ্যাক্ট উইকেটের ক্ষেত্রে কোন ব্যাটারের উইকেট পেলেন, সেটির সাথে ম্যাচ পরিস্থিতিও বিবেচনায় আসে। উইকেট মোস্তাফিজের আটটি, আর ইমপ্যাক্ট উইকেট ৭.৫৩। নরকিয়ার উইকেট ছিল ৯টি, ইমপ্যাক্ট উইকেট ১০.৩৭। অর্থাৎ ম্যাচপ্রতি মোস্তাফিজের ইমপ্যাক্ট উইকেট ০.৯৪টি, আর নরকিয়ার ১.৭৩টি। মোস্তাফিজের চেয়ে কম ম্যাচ খেলেই নরকিয়ার ইমপ্যাক্ট উইকেট বেশি। ম্যাচপ্রতি ইমপ্যাক্ট উইকেটের হিসেবে নরকিয়া তাই অনেকখানিই এগিয়ে, কিন্ত ইমপ্যাক্ট উইকেট কম নিলেও ম্যাচপ্রতি যে টোটাল ইমপ্যাক্ট, সেটির হিসেবে তো আবার মোস্তাফিজই থাকেন কিছুটা এগিয়ে!
নরকিয়া যে ম্যাচে ১৪ বলে ৩৫ দিয়েছিলেন, সে ম্যাচটা বাদ দিলে তার টোটাল ইমপ্যাক্টের গড় দাঁড়ায় ৩৪.৭২। যার মানে মোস্তাফিজের থেকে ৭.৪৪ বেশি। কিন্ত নরকিয়ার খারাপ করা ম্যাচ বাদ দিলে মোস্তাফিজেরটা কেন নয়? নরকিয়া সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকেই ইনজুরিতে। আইপিএল শুরুর সময়েও তিনি পুরো ফিট হয়ে উঠতে পারেননি, এরপর রিহ্যাব কার্যক্রম নিজেরাই সম্পন্ন করবে বলে দিল্লি ক্যাপিটালস দক্ষিণ আফ্রিকার কাছ থেকে এনে নেয় নরকিয়াকে। ওই ম্যাচটাতে সম্পূর্ণ ফিট না হওয়া সত্ত্বেও নরকিয়াকে মাঠে নামিয়েছিল দিল্লি!
কিন্ত ওই ম্যাচটা বাদ দেওয়ার আসল কারণ, রান দিলেও নরকিয়ার ‘টোটাল ইমপ্যাক্ট’ এর সহায়তায় ম্যাচে প্রভাব বুঝানো। তবে নিশ্চিতভাবেই নরকিয়ার থেকে আরও বেশি আশা করেছিল দিল্লি ক্যাপিটালসও। এর আগের দুই মৌসুমের অসাধারণত্বেই যে তাকে রিটেইন করেছিল দিল্লি! ২০২০ ও ২০২১ আইপিএল মিলিয়ে ৭.৬৫ ইকোনমিতে ২৪ ম্যাচে নরকিয়া নিয়েছিলেন ৩৪ উইকেট।
আর ২০২২ আইপিএলে উইকেট পেলেও ৯.৭২ ইকোনমিতেই বেধেছিল যত বিপত্তি! সে কারণেই মোস্তাফিজ নাকি নরকিয়া, লেগে গিয়েছিল বিতর্ক। বিদেশি কোটার কারণে সরাসরি মোস্তাফিজের জায়গা নরকিয়া নিলেও এতে দলের কম্বিনেশনেরও ছিল প্রভাব। দিল্লিতে বাঁহাতি পেসারের চাহিদা পূরণের জন্য যে ছিলেন চেতন সাকারিয়া ও খলিল আহমেদও। আর যে নরকিয়া গেল সিজনেও ছিলেন ‘অটো চয়েজ’, সেই নরকিয়ারই একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক, সেটিতে মোস্তাফিজ-প্রেমের অবদান কতটুকু?
ফিট হন আর না-ই হন, সব মিলিয়েই তো আদতে হিসাব করতে হয়। সেক্ষেত্রে মোস্তাফিজ ও নরকিয়াকে আলাদা করতে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর যে ‘ইমপ্যাক্ট’ এর সহায়তা নেওয়া, সেটি বিবেচনায়ও কি দু’জনের কে বেশি ভালো করেছেন, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল?
উইকেটের গুরুত্ব টি-টোয়েন্টিতেও অপরিসীম, উইকেটই যে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আবার রান আটকানোর গুরুত্বই বা কম কীসে! দিনশেষে রানেরই তো খেলা। একজন রান আটকাচ্ছেন, আরেকজন উইকেট নিচ্ছেন; কাকে বেছে নেবেন? বেছে নিতেই বা হবে কেন! আইপিএলে পারফরম্যান্সের সঙ্গে সঙ্গে তো দলীয় কম্বিনেশনটাও সমান গুরুত্ব পায়, তাই দলে জায়গা পাওয়ার যোগ্য হলেও অনেক সময় সুযোগ হয় না। তাই বলে কি যে সুযোগ পেল, তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে হবে? মোস্তাফিজ যেমন উপভোগ্য, নরকিয়াও তো তেমনই!
কাগিসো রাবাদা ও এনরিখ নরকিয়া – ২০২২ আইপিএলের আগের দুই মৌসুমে জুটি বেঁধেছিলেন এ দুজন। আগামী মৌসুমে নরকিয়ার সঙ্গে মোস্তাফিজ, একজনের ‘কাটার’ আর আরেকজনের ‘পেস’… কেমন লাগবে প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইনআপের ভেঙ্গে পড়া দেখতে?