১৯৮৫ সালে ফিফা সর্বপ্রথম অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ চালু করে। ২ বছর অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ ১৯ তম আসর বসেছিলো দিনকয়েক আগে ব্রাজিলে। অন্যান্য ফিফা স্বীকৃত টুর্নামেন্টের মতো এই বিশ্বকাপেও দেওয়া হয়ে সেরা খেলোয়াড়ের মর্যাদা। যেটি কি না গোল্ডেন বল নামে পরিচিত। এবারসহ মোট ১৯ জন খেলোয়াড়ের এই গোল্ডেন বল জেতার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, এই বয়সভিত্তিক দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই জাতীয় দলের চৌকাঠ পেরোতে পারেনি। বিভিন্ন সঙ্গত কারণেই বেশিরভাগ খেলোয়াড়রাই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। অনুর্ধ্ব বিশ্বকাপে গোল্ডেন বলজয়ী অনেক খেলোয়াড়ই কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে খুব সামান্যই নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন। আজ আমরা দেখবো সর্বশেষ দশ গোল্ডেন বলজয়ী বালকদের পরিণতি।
১৯৯৯ – ল্যান্ডোন ডোনোভান (যুক্তরাষ্ট্র)
বর্তমান ক্লাব: সান দিয়েগো সকার্স
ল্যান্ডন ডোনোভান নিজের নামের প্রতি পূর্ণ সুবিচার না করতে পারলেও হারিয়ে যাননি একাবারেই। অনুর্ধ্ব ১৭ দলের হয়ে ৪১ ম্যাচে ৩৫ গোল করে ২০০০ সালেই জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। আমেরিকার হয়ে ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১৫৭ ম্যাচ খেলে ৫৭ গোল করেন তিনি। যা কি না দেশটির হয়ে সর্বোচ্চ।
তবে ক্লাব ক্যারিয়ারে আহামরি কিছু করতে পারেননি তিনি। বেশিরভাগ সময়েই খেলেছেন মেজর সকার লিগে। মাঝে ধারে বায়ার্ন মিউনিখে ছিলেন এক মৌসুম। এভারটন ও বায়ার লেভারকুসেনে থাকলেও সেভাবে খেলার সুযোগই পেয়েছেন কম। ২০১৪ সালে অবসরের পর আবার ফিরে এসে খেলেছেন এলএ গ্যালাক্সির হয়ে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো অবসর ভেঙে বর্তমানে খেলেছেন মেজর সকার এরেনাতে।
২০০১ – ফ্লোরেন্ত সিনামা (ফ্রান্স)
বর্তমান ক্লাব: ক্লাবহীন
ফ্রান্সকে প্রথমবারের মতো অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ জেতাতে ফ্লোরেন্ত করেছিলেন নয় গোল। জিতেছিলেন গোল্ডেন বল ও বুট দুটোই। আর তাতেই লা হাভরে থেকে লিভারপুলে পাড়ি জমানোর সৌভাগ্য মেলে তার। এনফিল্ডে ৫৭ ম্যাচ খেলে আটটি গোল করেন তিনি। যার মধ্যে রয়েছে ২০০৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অলিম্পিয়াকোসের বিপক্ষে কামব্যাক করার গোলটি। লিভারপুলের পর খেলেছেন আরো দশটি ক্লাবে। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন সাতটি দেশে। কিন্তু কোথাও নিজেকে মেলে ধরার সুযোগই পাননি। বর্তমানে ক্লাবহীন অবস্থায় আছেন এই গোল্ডেন বলজয়ী খেলোয়াড়।
২০০৩ – সেস্ক ফ্যাব্রিগাস (স্পেন)
বর্তমান ক্লাব: মোনাকো
বয়সভিত্তিক দল থেকে আসা উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সেস্ক ফ্যাব্রিগাস। ২০০৩ সালের সেই ফাইনালে স্পেন হেরেছিলো ব্রাজিলের কাছে। কিন্তু পুরো দল থেকে দুজন খেলোয়াড় শুধু স্পেন জাতীয় দলের চৌকাঠ পেরোতে পেরেছিলো এবং বিশ্বকাপ জেতার সৌভাগ্যও হয়েছিলো। একজন হলেন ফ্যাব্রিগাস, অন্যজন হলেন ডেভিড সিলভা। মোট ৫ গোল করে সেবার গোল্ডেন বল ও বুট দুটোই বগলদাবা করেছিলেন সেস্ক। এর কিছুদিন পরেই ওয়েঙ্গারের অধীনে আর্সেনালে যোগ দেন তিনি। সেখানে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। আর্সেনাল অধ্যায় কাটিয়ে শৈশবের ক্লাব বার্সেলোনায় ফিরে যান সেস্ক। যাওয়ার আগে গানারদের হয়ে ৩০০ ম্যাচ খেলে ৫৮ গোলের পাশাপাশি ৯১ গোলে সহায়তাও করেন তিনি।
বার্সেলোনায় তিন মৌসুমে ১৫১ ম্যাচ খেলে ৪২ গোল ও ৫৭ অ্যাসিস্ট করেন এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডার। ২০১৪ সালে আবারো লন্ডনের ক্লাব চেলসিতে ফিরেন তিনি। চেলসির হয়ে ১৩৮ ম্যাচ খেলার প্রাক্কালে দুটি লিগ ও একটি এফএ কাপ জেতেন তিনি। বর্তমানে ফ্রেঞ্চ ক্লাব মোনাকোর হয়ে খেলছেন এই নন্দিত মিডফিল্ডার।
২০০৫ – এন্ডারসন (ব্রাজিল)
বর্তমান ক্লাব: অবসর
ব্রাজিল দল রানার্স আপ হলেও সেবার টুর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার জিতেছিলেন ব্রাজিলিয়ান এন্ডারসন। তার একবছর পরেই পোর্তোতে যোগ দেন তিনি। রোনালদিনহোর উত্তরসূরি খেতাব পাওয়া এই ফুটবলারের পিছনে ২০০৭ সালেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খরচ করে ২০ মিলিয়ন ডলার। প্রথম মৌসুমেই রেড ডেভিলদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেও ফিটনেস ইস্যুর জন্য কখনোই তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ব্রাজিল দলেও ব্রাত্য ছিলেন। সেলেকাওদের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন মাত্র ৮ বার। রেড ডেভিলদের হয়ে ৮ মৌসুমে ১৮১ ম্যাচ খেলে পাড়ি জমান ফিওরেন্টিনায়। সেখান থেকে তার্কিশ লিগে গিয়ে ২০১৮ সালেই অবসরের ঘোষণা দেন। তখন তার বয়স হয়েছিলো ৩১।
২০০৭ – টনি ক্রুস (জার্মানি)
বর্তমান ক্লাব: রিয়াল মাদ্রিদ
সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের মতোই আরেক নক্ষত্র টনি ক্রুস। বায়ার্ন মিউনিখের একাডেমিতে বেড়ে ওঠা টনি ক্রুস জার্মানিকে অনুর্ধ্ব ১৭ শিরোপা না জেতাতে পারলেও সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে নজরকাড়া পারফরম্যান্স করে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরেই বায়ার্ন মিউনিখের মূল দলে জায়গা করে নেন। ডেভিড আলাবা রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে বায়ার্নে অভিষেক হওয়া খেলোয়াড় ছিলেন এই ক্রুসই। আট বছর এই ক্লাবে খেলে ২০১৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান তিনি। বায়ার্নের হয়ে একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়াও রিয়ালের হয়েও এই শিরোপা জেতেন আরো চারবার।
অন্যদিকে ফ্যাব্রিগাসের মতোই জাতীয় দলের হয়েও বিশ্বকাপ জিতেন ক্রুস। ২০১৪ বিশ্বকাপে দলের প্রাণভোমরা ছিলেন এই প্রতিভাবান মিডফিল্ডার।
২০০৯ – সানি ইমানুয়েল (নাইজেরিয়া)
বর্তমান ক্লাব: ক্লাবহীন
নাইজেরিয়াকে রানার্স আপ করা সানি ইমানুয়েল নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। ২০০৯ সালে গোল্ডেন বল জেতার পরের বছরই লাৎসিওর যুব একাডেমিতে যোগ দেন তিনি। কিন্তু কখনোই সিনিয়র দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। ধারে এদিক-সেদিক কাটিয়ে বুঝতে পারেন যে ইতালি তার জন্য সঠিক জায়গা নয়। এবার পাড়ি জমান জেরুজালেমে। সেখানেও মোটে খেলতে পারেন একটি মাত্র ম্যাচ। তারপর সুইডেনের ক্লাব অস্কারশামের হয়ে নাম লেখান। সেখানেও মাঠে নামতে পারেন মাত্র ৪টি ম্যাচে। বর্তমানে এই ২৬ বছর বয়সী ফুটবলার ফ্রি এজেন্ট হয়ে আছেন।
২০১১ – জুলিও গোমেজ গঞ্জালেজ (মেক্সিকো)
বর্তমান ক্লাব: পাচুকা
নিজের ঘরের মাঠে মেক্সিকোকে শিরোপা জেতানো জুলিও গঞ্জালেজ দুই বছর পর জিতেছিলেন অনুর্ধ্ব ২০ কনকাকাফ শিরোপাও। কিন্তু এখনো পর্যন্ত জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। ২০১১ সালে পাচুকার যুব একাডেমি থেকে সিনিয়র দলে নাম লিখিয়ে খেলেছেন মাত্র ১৪টি ম্যাচ। এই ২৩ বছর বয়সী বালক এখন পর্যন্ত ধারে ঘুরে বেড়িয়েছেন মোট আটটি ক্লাবে। বলা বাহুল্য, তার নিকট ভবিষ্যতও অন্ধকার।
২০১৩ – কেলেচি ইহেইনাচো (নাইজেরিয়া)
বর্তমান ক্লাব: লেস্টার সিটি
নাইজেরিয়াকে চতুর্থবারের মতো অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ জেতাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ইহেইনাচো। ফাইনালে মেক্সিকোর বিপক্ষে গোল করার পাশাপাশি টুর্নামেন্টে করেছেন ছয় গোল। এই সাফল্যের এক বছরের মাথায় তিনি যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। যুব একাডেমিতে দারুণ পারফর্ম করায় ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সেই সিনিয়র টিমে খেলার সুযোগ করে দেন তাকে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অভিষেক হওয়া ইহেইনাচো সিটিজেনদের হয়ে মোট গোল করেন ২১টি। ২০১৮ সালে তিনি পাড়ি জমান আরেক প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব লেস্টার সিটিতে।
তবে অন্যান্য গোল্ডেন বলজয়ী নাইজেরিয়ানদের মতো হারিয়ে না গিয়ে জাতীয় দলেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত সুপার ইগলদের হয়ে ২৩ ম্যাচ খেলে ৮টি গোল করেছেন এই স্ট্রাইকার।
২০১৫ – কেলেচি এনকালি (নাইজেরিয়া)
বর্তমান ক্লাব: পোর্তো বি (আর্সেনাল থেকে ধারে)
নাইজেরিয়াকে ব্যাক-টু-ব্যাক ও রেকর্ড পঞ্চম শিরোপা এনে দেন কেলেচি এনকালি। অধিনায়কত্বের বন্ধনি পরেই গোল্ডেন বল জিতেন তিনি। ইহেইনাচোর মতো তিনিও পাড়ি জমান প্রিমিয়ার লিগে। নাম লেখান আর্সেনালের হয়ে। সেখান থেকে ধারে ডাচ সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে তিন গোল ও চার অ্যাসিস্ট করেন তিনি। তবে পূর্বসূরী ইহেইনাচোর মতো সিনিয়র দলে এখনো ঢুকতে পারেননি তিনি। তাই এই মৌসুমেই আবার আর্সেনাল থেকে ধারে হুয়েস্কায় পাড়ি জমিয়েছেন এই নাইজেরিয়ান।
২০১৭ – ফিল ফোডেন (ইংল্যান্ড)
বর্তমান ক্লাব: ম্যানচেস্টার সিটি
ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ জেতানো ফিল ফোডেন ছিলেন ম্যানচেস্টার যুব একাডেমি থেকে উঠে আসা ফুটবলার। বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জয়ের পাশাপাশি ক্লাবেও নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে দ্রুতই পেপ গার্দিওলার মন জয় করে নেন তিনি। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফেইনুর্দের বিপক্ষে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই অভিষেক ঘটে ফিল ফোডেনের। পেপ গার্দিওলার চোখে ইতিমধ্যেই ভবিষ্যতের সুপারস্টারে পরিণত হয়েছেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরেই বিবিসির ইয়াং পার্সোনালিটি অফ দ্য ইয়ার জিতেছিলেন ফোডেন। মাত্র ১৮ বছরের মধ্যেই সিটিজেনদের হয়ে ৪৩টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন তিনি। এই মৌসুমেও পেপ গার্দিওলার অধীনে আরো বেশি সময় ধরে মাঠে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। তাই বলা চলে, বেশিরভাগ গোল্ডেন বলজয়ীদের মতো হারিয়ে না গিয়ে ক্রুস, ফ্যাব্রিগাসদের মতো তারকা হওয়ার পথেই আছেন ফিল ফোডেন।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ