‘নো মুশতাক, নো টেস্ট’

১২ নভেম্বর, ২০১৯।

ইন্দোরের দেবী অহল্যা বাঈ হোলকার বিমানবন্দরে নেমেছিলাম ভরদুপুরে। বিমানবন্দরটা বিশেষ কিছু বড় নয়। তবে বেশ শুনশান। সূর্য মধ্যগগণে থাকলেও হেমন্তকাল বলেই কি না, রোদ অত চড়া নয়। বিমানবন্দরের আঙিনায় পরিচয় হলো অটোচালক রাধে’র সঙ্গে। বিদেশের মাটিতে নতুন শহর-জায়গাকে জানতে ট্যাক্সি-অটো চালকরা পর্যটকদের বিরাট অবলম্বন। আবার পর্যটকের পকেট কাটতেও জুড়ি নেই এই চালক সম্প্রদায়ের।

গাড়িতে চড়ে বসতেই টুকটাক আলাপ শুরু পঁচিশ পার হওয়া রাধে’র সঙ্গে। ছেলেটা বিবাহিত, বাবা-মা, ভাইদের নিয়ে ওর সংসার। ইন্দোর সম্পর্কে তার দেয়া প্রথম তথ্য অন্তর্জাল দুনিয়ার কল্যাণে আগেই জানা ছিল। রাধে গর্বভরেই বলে উঠলো, টানা তিন বছর (২০১৭, ২০১৮, ২০১৯) ভারতের ‘ক্লিন সিটি’র স্বীকৃতি ইন্দোরের দখলে।

ইন্দোরের বিখ্যাত মানুষের কথা উঠতেই এই অটোচালকের চোখমুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রাধে জানায়, বলিউড অভিনেতা সালমান খানের জন্ম এই শহরে। বক্স অফিস কিং, ভাইজান, সাল্লু – অনেক নামেই ডাকা হয় ৫৩ বছর বয়সী সালমানকে। ইন্দোরে বাড়ি আছে, মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া হলেও এই অভিনেতার বসতি এখন মুম্বাইয়ে। ৫৩০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের শহরটা অবশ্য আরও অনেক সফল মানুষকে বুকে ধরেছিল। ভারতবর্ষে সংগীত জগতের কিংবদন্তি কিশোর কুমারের বাড়ি আছে এই শহরের উপকণ্ঠে। কোকিলকণ্ঠী সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, হালের পলক মুচ্ছলও জন্মেছেন এখানে।

ক্রিকেটই যেহেতু ইন্দোরে আগমনের হেতু, সেহেতু ক্রিকেট নিয়ে কথা হবেই। রাধে অবশ্য ক্রিকেটের বিষয়ে খুব আগ্রহী নয়। ‘ভেজিটেরিয়ান সিটি’ ইন্দোরে জন্ম বিদেশের মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান (১১২, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ১৯৩৬) সৈয়দ মুশতাক আলী, যার নামে এখন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট রয়েছে। তখনই চোখ আটকে গিয়েছিল, মুশতাক আলীর সন্ধান করতেই হবে। 

‘দ্য ওয়াল’ খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ের জন্মও ইন্দোরে। যদিও তিনি বেড়ে উঠেছেন ব্যাঙ্গালুরুতে। ভারতের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক সিকে নাইডুর মৃত্যু (১৯৬৭ সালে) হয়েছে এই শহরে। লেগ স্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি’র ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে উঠাও এখানে। আরও অনেক কিংবদন্তির নাম জড়িয়ে আছে ইন্দোরের সঙ্গে।

Image Credit: Wikimedia

মুশতাক আলীর খোঁজে এক সন্ধ্যা

পরিকল্পনা অনুযায়ী মুশতাক আলীর সন্ধান শুরু করি বাংলাদেশ-ভারত ইন্দোর টেস্ট চলাকালীনই। মধ্য প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (এমপিসিএ) মিডিয়া ম্যানেজার রাজীব রাইসোডকারের কাছে সহযোগিতা চাইলাম। ঠিকানা ও মুঠোফোন নাম্বার চাইলেও তিনি একটা মুঠোফোন নাম্বার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেটি মুশতাক আলীর বড় ছেলে গুলরেজ আলীর নাম্বার।

কল করতেই ফোনের ওপ্রান্তে রাশভারী কণ্ঠের জবাব আসল। পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য জানাতেই রাজি হয়ে যান। ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যার পর সময় দেন। এর মাঝে ইন্দোরের ক্রিকেটার যতীন সাক্সেনা এসে হাজির হন আমাদের হোটেলে। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের তরুণ সংগঠক আহমেদ সাব্বির রুবেলের মাধ্যমে যতীন জানতে পেরেছিলেন ইন্দোরে আমাদের অবস্থানের খবর। যতীন ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমি, পারটেক্স স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। সেই সূত্রেই তার সঙ্গে পরিচয় ছিল ফেসবুকের মাধ্যমে।

মুশতাক আলী, গুলরেজ আলীদের সম্পর্কে বলতেই যতীন জানালেন, অনেকদিন তারও যাওয়া হয় না ওই বাসায়। স্বেচ্ছায় নিজের গাড়িতে গন্তব্যে নিয়ে যেতে আগ্রহ দেখালেন এই ক্রিকেটার। সন্ধ্যার পর যতীনের গাড়ি চেপে শহরের একপ্রান্তে শালিমার পাম্পস আবাসিক এলাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল।

‘এক্স’ বিল্ডিংয়ের ৪০১ ফ্লাটের কলিংবেল চাপতেই বের হয়ে আসেন দীর্ঘকায় গুলরেজ আলী। বেশ সানন্দে বসার ঘরে নিয়ে বসালেন। তারপর ঘন্টা দুয়েকের আড্ডা। যেন মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। সাদা-কালো যুগে ভারতের কিংবদন্তি মুশতাক আলী ও তার ক্যারিয়ার, তার ঠিকুজি সবিস্তারে জানালেন গুলরেজ আলী।

১৯১৪ সালে ইন্দোরেই জন্ম মুশতাক আলীর। ঘুমের মাঝেই ৯০ বছর বয়সে ২০০৫ সালে পরলোকগমন করেন তিনি। ১০ বছর ধরে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে চলছে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। এখন বিভিন্ন প্রদেশে এই টুর্নামেন্টের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুশতাক আলী ছিলেন বড় তারকা ক্রিকেটার।

মারকাটারি ব্যাটিংয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। বলিউড, সংগীতজগতেও তার ভক্ত ছিল অনেক। খোদ দিলীপ কুমারই ব্যাটসম্যান মুশতাকের পাড় ভক্ত ছিলেন।

কিংবদন্তি পিতার খুব বেশি ক্রিকেটীয় স্মারক সংরক্ষিত নেই গুলরেজ আলীর কাছে। মুশতাক আলীর ব্যবহৃত ব্লেজার, প্যান্ট-শার্ট, ব্যাগ সব কিছুই পাতিয়ালা জাদুঘরে রাখা। পুরনো অ্যালবাম, কর্নেল সিকে নাইডু ট্রফিটা হাতেই পিতাকে নিয়ে স্মৃতির অতলে ডুবে যান সত্তরোর্ধ্ব গুলরেজ আলী।

মুশতাক আলীর ছেলে গুলরেজ আলী; Image Credit: SHAYAN ACHARYA / The Hindu

মুশতাক আলীকে আপনি ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে দেখেছিলেন কত বছর?

না, আমি ওনাকে খেলোয়াড় হিসেবে দেখিনি। আমার জন্ম ১৯৪৮ সালে, বাবা অবসরে গেছে ১৯৫২ সালে। আমি ওনার কিছু প্রথম শ্রেণির ম্যাচ দেখেছি, রঞ্জির ম্যাচ দেখেছি।

বড় হওয়ার পর ওনার সাথে ওই সময়ের ক্রিকেট নিয়ে কথা হতো কি আপনার?

আগের সময় নিয়ে ওনার সঙ্গে কথা হতো। ১৯৩৬ সালে ভারত ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল জাহাজে। যেতে ১ মাস লেগেছিল। পুরো ভারতীয় দল জাহাজে গিয়েছিল। জাহাজেই অনুশীলন করতে করতে গিয়েছে। এক জায়গায় ম্যাট বসিয়ে অনুশীলন করত।

ওনাকে তো সবাই ব্যাটিংয়ের কিংবদন্তি হিসেবেই জানে। কিন্তু উনি নাকি স্পিন বোলিংও করতেন?

বাবার ক্যারিয়ার আসলে শুরু হয়েছিল স্লো লেফট আর্ম বোলার হিসেবে। ইন্দোরে জন্ম নেয়া প্রথম ক্রিকেটার আমার বাবাই ছিলেন। আমার দাদা ব্রিটিশ আমলে পুলিশের এসপি ছিলেন। ১৯২৬ সালে ইন্দোরের রাজা হোলকার সিকে নাইডুকে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে নাগপুর, তারপর ইন্দোরে নিয়ে আসেন। আমার বাবার সৌভাগ্য যে, সিকে নাইডু আমাদের ঘরের পাশেই বাসা নেয়। সিকে নাইডুর মোটরবাইক ছিল। উনি আসতে যেতে দেখতেন, একসাথে অনেক বাচ্চা খেলছে। সেখানে আমার বাবা, ওনার ছোট ভাই সিজে নাইডু, জাগদালে সাহেবরা ছিলেন। আমার বাবাকে ওনার হয়তো আলাদা কিছু মনে হয়েছিল। বিশেষ প্রতিভা বলতে পারেন। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার সময় আমার দাদাকে শুভেচ্ছা জানাতেন উনি। একদিন চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসেন। আমার দাদার নাম ছিল খান সাহেব ইয়াকুব আলী। ব্রিটিশরা খান সাহেব উপাধি দিয়েছিল উনাকে। সিকে নাইডু দাদাকে বলেন, মুশতাককে আমি হায়দরাবাদ নিয়ে যেতে চাই। তখন বাবার বয়স ১৪ বা ১৫। তখন দাদা না করে দিলে কিন্তু ক্রিকেট ক্যারিয়ারই হতো না বাবার। কিন্তু দাদা বাবাকে পাঠিয়েছেন উনার সাথে।

তখন হায়দরাবাদে বাহারামউদ্দৌলা টুর্নামেন্ট হতো। মধ্য প্রদেশের দলও খেলত। ওখানে গিয়ে বাবা হ্যাটট্রিক করেন বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে। তারপর ১৯৩৪ সালে ভারতীয় দলে সুযোগ পান।

স্পিনার থেকে ওপেনার হিসেবে ব্যাটিংয়ে আসার গল্পটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে…

বাবা ভারতীয় দলের হয়ে ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে যান। তখনকার অধিনায়ক ছিলেন মহারাজ কুমার বিজয় নাগারাম। প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে বাবা ভালো করেছিলেন। প্রথম ম্যাচে ৭০, তৃতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন। তখন টেস্টে বিজয় মার্চেন্ট ও বাবাকে দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনিংয়ে পাঠান অধিনায়ক। প্রথম ইনিংসে ফলোঅন করে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিল ভারত। বাবা ও বিজয় মার্চেন্ট ২০৩ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন, যেটা পরে গাভাস্কার ও চেতন শর্মা ভেঙেছিল। রান, মিনিট সমান। ২০৩ মিনিটে ২০৩ রান। আমার বাবা ১১২ রান করেছিল। বিজয় মার্চেন্ট ৭৮ রান করে অপরাজিত ছিল। পরে উনিও সেঞ্চুরি করেছিলেন।

প্র্যাকটিসে মগ্ন মুশতাক আলি; Image Credit: Raymond Kleboe / Getty Images

উনি অনেক আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন। ওনার ব্যাটিং, ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে কখনো কথা হয়েছে কি?

ইংল্যান্ডে ওই ইনিংসের পরই ব্যাটসম্যান হিসেবে উনার নতুন ক্যারিয়ার শুরু হয়ে যায়। বাবা বলতো, এখন যে ওয়ানডের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, উনি বলতেন, এসব উনি টেস্ট ম্যাচেই খেলেছেন। অফের বল লেগে, লেগের বলে অফে খেলতেন নিয়মিত। মানুষ এসব খুব পছন্দ করত। উনি বলতেন, মানুষ টাকা খরচ করে আসে, ওদের ভিন্ন কিছু দরকার। সারাদিন ব্যাটিং করে ১০০ করে মজা নিই। উনি দর্শকদের জন্য খেলতেন। ৭৮, ৮০, ৯০ যেখানেই থাকতেন, মেরে খেলতেন। একবার ৯০ রানে থাকার সময় ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ওনাকে বলেছিলেন, তুমি সেঞ্চুরির কাছাকাছি। বি কেয়ারফুল, ইয়াং ম্যান। বাবা উত্তরে বলেছেন, ওকে স্যার থ্যাংক ইউ। পরের তিন বলেই তিনটি চার মেরে বাবা সেঞ্চুরি করেছেন।

মুশতাক আলীর মতো কিংবদন্তির ছেলে হিসেবে নিশ্চয়ই গর্ব হয় আপনার…

আজ যেমন মানুষ শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্রর শেবাগ, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিকে পছন্দ করে, এসব তখনকার সময়ে আমার বাবার মাঝে ছিল। কলকাতায় এমনও হয়েছে, ৪টার সময় দিনের আলো চলে যেত। ম্যাচ বন্ধ হয়ে যেত। পরে ৪টা থেকে ৬টা অব্দি দর্শকদের অটোগ্রাফ দিতে হয়েছেন ওনাকে। সবাইকে অটোগ্রাফ দিয়েই বাবা স্টেডিয়াম থেকে বের হতেন।

কলকাতাতেই আরেকবার দারুণ এক ঘটনা ঘটেছিল। তখন এক টেস্টে নির্বাচকরা বাবাকে বাদ দিয়েছিলেন। তখন ওখানকার মানুষ বলতে শুরু করে, ‘নো মুশতাক, নো টেস্ট’। রীতিমতো স্লোগান, মিছিলের মতো। তারপর চাপে পড়ে নির্বাচকরা বাবাকে দলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে সম্ভবত এটি হয়েছিল। নিউ জিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া হবে প্রতিপক্ষ। দলে সুযোগ পেয়েই ৭০’র বেশি রানও করেছিলেন সেবার। ১০ বছর তো বিশ্বযুদ্ধের কারণে উনি খেলতেই পারেননি।

বিজয় মার্চেন্টের সঙ্গে; Image Credit: Navbharat Times

তখন তো অবিভক্ত ভারত ছিল। ঢাকায় উনি কখনো গিয়েছেন বা খেলেছিলেন বলে জানা আছে কি আপনার? বা এমন কোনো তথ্য?

না, উনি ঢাকায় খেলেননি। কলকাতায় অনেক খেলেছেন। বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।

ইন্দোরে ওনার জন্ম। এই ফ্ল্যাট তো নিশ্চয়ই নয়। ইন্দোরের কোথায় ওনার জন্মস্থান?

এটা শহরেই, ছউনি অঞ্চল বলা হয়। নেহেরু স্টেডিয়ামের কাছাকাছি। ওখানে আমার ছোট বোন থাকেন। ১২০ বছরের জায়গা, বিল্ডিং নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। আমার দাদা অবশ্য উত্তর প্রদেশ থেকে এখানে এসেছিলেন। বাবার জন্ম এখানে। বাবাই একমাত্র, যার জন্ম এখানে, ইন্দোরের হয়ে খেলেছেন। ওই সময়ে ইন্দোরের হয়ে খেলা বাকিরা বাইরে থেকে এসেছিলেন।

আপনার শোকেসে অনেক ট্রফি দেখছি। আপনার বাবার স্মৃতির কী কী আছে এখানে?

সব ট্রফি উনি পাতিয়ালা জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছিলেন। ব্লেজার, প্যান্ট-শার্ট, ব্যাগ, ব্যাট সবকিছুই আসলে পাতিয়ালা জাদুঘরে আছে। কর্নেল সিকে নাইডু ট্রফিটাই শুধু আমার কাছে আছে।

আপনার বাবা নাকি ঘুমের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন?

বয়স তো অনেক হয়ে গিয়েছিল। ৯২ বছর বয়সে ঘুমের মাঝেই মারা গেছেন। ওই বয়সেও সব কিছু ঠিকঠাক করতেন। আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত একসাথেই বসে ছিলাম। এটা আগের বাসায়। সকালে আমার মুম্বাই যাওয়ার ছিল। বলেছিলেন, এখানের কিছু নিয়ে ভেব না, ভালোভাবে যাও। আমার বাবা সময়ের প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। ৭টার অনুষ্ঠান, ঠিক সাড়ে ৬টায় প্রস্তুত হয়ে থাকতেন। অনুষ্ঠান দেরি হলেই চলে আসতেন। ওনাকে বুঝাতে হতো, এখন মানুষের নানা কারণে একটু দেরি হয়ে যায়। ওনার নতুন নতুন কাপড় পড়ার শখ ছিল। খুব স্টাইল করে চলতেন, পারফিউম ব্যবহারেরও বড় শখ ছিল ওনার।

Image Credit: Keystone / Getty Images

সিনেমা, সংগীত জগতের তারকাদের সঙ্গেও তো ওনার বেশ সখ্যতা ছিল…

সিনেমা জগতেও বাবার অনেক কাছের লোক ছিল। দিলীপ কুমার ওনার বড় ভক্ত ছিলেন। দিলীপ কুমার তো মুম্বাই ম্যাচ হলে সবসময় মাঠে থাকতেন। ভারতের কিংবদন্তি শিল্পী কেএল সেহগাল সাহেব। উনি একবার করেছিলেন কি, একটা ম্যাচ চলছিল, উনি ম্যাচ দেখতে গিয়েছেন। বাবা দ্রুত আউট হয়ে বসেছিলেন। সেহগাল সাহেব বাবাকে বলেন, ‘মুশতাক সাহেব, আপনি এখানে বসে আছেন কেন?’ উত্তরে বাবা বলেন, ‘সেহগাল সাহেব, আমি আউট হয়ে গেছি।’ সেহগাল সাহেব বলেন, ‘আমি তো আপনার খেলা দেখতে এসেছি।’ বাবা বলেন, ‘এটা ক্রিকেট ম্যাচ, একবার আউট হলে আজ আর সুযোগ নেই।’ সেহগাল সাহেব বলেন, ‘না, না, এটা হতে পারে না। আমি আম্পায়ারকে গিয়ে অনুরোধ করছি, আপনাকে আবার ব্যাটিংয়ে দিক।’ পরের ম্যাচের আগে জানানো হবে, জানিয়ে ওইবার নিস্তার পেয়েছিলেন বাবা। অভিনেত্রী মধুবালা, চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হোসেনের সাথেও বাবার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল।

আপনাদের পরিবারের তিন প্রজন্মের ক্রিকেট খেলেছে। আপনার বাবার পর আপনিও খেলেছেন, আপনার ছেলে খেলেছে। আপনি এমপিসিএ’র কর্মকর্তা ছিলেন শুনেছি। এখন আর কেউ কি ক্রিকেটারের সঙ্গে আছে?

বাবাকে আমি ছোট থেকে দেখতাম, বাবার সাথে যেতাম। মুম্বাই, কলকাতা সাথে যেতাম। এভাবে দেখে আমারও শখ হয় ক্রিকেট খেলার। ১৪ বছর বয়সে আমি মধ্যপ্রদেশের স্কুল দলে নির্বাচিত হই। ১৯৬৫ সালে ১৬ বছর বয়সে রাজস্থানের বিরুদ্ধে রঞ্জিতে আমার অভিষেক হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫, টানা ২০ বছর খেলেছি। দুলীপ ট্রফি, এমসিসি, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলেছি। আমি ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলাম, সাথে বাঁহাতি বোলার। আমি ২,৪৫০ রান করেছিলাম, ১৯৪ উইকেট আমার। আমার ২ বোন, এক ছোট ভাই। বোন একজন যুক্তরাষ্ট্রে, আরেকজন ইন্দোরে।

আমার ছেলে আব্বাস আলী খান, আইপিএল, আইসিএল, ভারতীয় ‘এ’ দলে খেলেছে। মধ্য প্রদেশের অধিনায়ক ছিল, দুই বছর ত্রিপুরার অধিনায়ক ছিল। ১১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে আব্বাস, ও ১৮ বছর খেলেছে। ও এখন মধ্যপ্রদেশের হেড কোচ।

আব্বাস আলী খান; Image Credit: ICL

***

পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো মুশতাক আলীকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেছিলেন। পুরনো অ্যালবামে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মুশতাকের ছবি দেখিয়ে গুলরেজ আলী বলছিলেন,

‘জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাবাকে; ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে, এবং পাকিস্তানের হয়ে খেলতে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু বাবা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।’

রাত গভীর হয়, মুশতাক আলীকে নিয়ে গল্প যেন ফুরোয় না। একটা সময় আলাপ থামিয়ে বিদায় নিতেই হয়। ছেলের মুখে কিংবদন্তি পিতার গল্প শোনার রোমাঞ্চ নিয়ে যতীন সাক্সেনার সহযোগিতায় মাঝরাতে ফিরে আসি আমাদের আস্তানায়।

This article is in Bangla language. It is a long interview of Syed Gulrez Ali, the son of Syed Mushtaq Ali, an Indian cricket legend. In this interview, Gulrez Ali talked about his father, his son along with himself, while remembering the good old memories of Syed Mushtaq Ali along the way. 

Featured Image: Muntasir Nirob

Related Articles

Exit mobile version