ফুটবল কি শুধুই গোলের খেলা? যেহেতু গোল ব্যাপারটাই খেলার গতিপথ ঠিক করে দেয়, অনেকের মতে তা-ই। আর এজন্যই বোধকরি, পাদপ্রদীপের আলোটা সবসময় স্ট্রাইকার বা ফরোয়ার্ডদের উপরে থাকে, বাকিরা থাকেন আলোর ঠিক নীচের অন্ধকারে। অন্ধকারে থেকে যায় একজন সেন্টার ব্যাকের ক্লিয়ারেন্স কিংবা একজন মিডফিল্ডারের সেই অসাধারণ লং বল, যেখান থেকে আক্রমণের শুরু। এগুলো কেউই দেখে না, সবাই বরঞ্চ ম্যাচশেষে স্কোরকার্ড দেখে গোল কে করলো এটুকু দেখে নিতে পারলেই খুশি। সবাই বড় যান্ত্রিক, অবশ্য আস্তে আস্তে ফুটবলটাও সেরকমই হয়ে উঠছে। আর এই যান্ত্রিকতার হাতেই খুন হচ্ছে ফুটবল মাঠের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ও অনিন্দ্যসুন্দর পজিশনটি, এটাকিং মিডফিল্ডার বা নাম্বার টেনরা হারিয়ে যাচ্ছেন।
পরিচয়
এটাকিং মিডফিল্ডারদের বা নাম্বার টেনদের বলা হয়ে থাকে ফুটবল মাঠের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড় হিসেবে। তারা খেলে থাকেন ঠিক স্ট্রাইকারের পেছনে, সাধারণত ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। অনেক কোচ তাদের ব্যবহার করেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে, সেক্ষেত্রে কিছু কোচ তাদের ব্যবহার করেন মাঝমাঠে, আবার কেউ কেউ আক্রমণে।
ফুটবল মাঠে জোন থাকে সব মিলিয়ে ১৮টি, মাঠেক উলম্বভাবে ৩ ভাগে ও আনুভূমিকভাবে ৬ ভাগে ভাগ করলে এই ১৮টি জোন পাওয়া যায়। এই ১৮টির মধ্যে মাঠের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল জোন হিসেবে ধরা হয় প্রতিপক্ষের ডি বক্সের ঠিক বাইরের জোন ১৪-কে। এটাকিং মিডফিল্ডার, সহজ কথায় নাম্বার টেনরা মূলত এই জোনেই অপারেট করেন।
মাঠে এই নাম্বার টেনরাই সাধারণত আক্রমণের কারিগর থাকেন। এটাকিং মিডফিল্ডারদের প্রধান এট্রিবিউটসগুলো হলো ড্রিবলিং, পাসিং, ভিশন ও শুটিং। এরা স্রেফ গোল করান না কিংবা শুধু আক্রমণ গড়ে তোলেন না, মাঝে মাঝেই গোল করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা কাকার কথা। এই দুজনই একদম ক্ল্যাসিক এটাকিং মিডফিল্ডার বা নাম্বার টেন, কিন্তু এরা শুধু গোল করিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, ক্যারিয়ারজুড়ে নিজেরাও করেছেন প্রচুর গোল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নাম্বার টেনদের গোলগুলো হয় চোখধাধানো, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোল কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে কাকার সেই গোল ভুলতে পারবেন না কোনো ফুটবল ভক্তই!
সব সৃষ্টিতেই অপূর্ণতা থাকে, কোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তিই নিখুঁত নন। ফুটবলারদের ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। এজন্যই ফুটবল মাঠের এই অনন্য সৃষ্টিশীল নাম্বার টেনরা হন খানিকটা আলসে। রক্ষণে তেমন একটা সাহায্য করেন না, প্রেসিংয়ের বেলায়ও তাদের বড় অনীহা। ক্রুইফ একবার বলেছিলেন,
একজন খেলোয়াড় এক ম্যাচে গড়ে বল পায়ে রাখে ৩ মিনিট। বাকি ৮৭ মিনিট সে কী করে সেটি দিয়েই বোঝা যায় সে ভালো খেলোয়াড় কি না।
ক্রুইফ সবসময় ভাবতেন সময়ের অনেক সামনে, ফুটবল ইতিহাসে খেলার সব দিকের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেখেছেন এমন একজনের নাম বলতে হলে বলতে হবে ক্রুইফের নামই। সে যা-ই হোক, ক্রুইফের ভাষ্যমতে, বাকি ৮৭ মিনিট যে ম্যাচে প্রভাব রাখবে না, তারা ভালো খেলোয়াড় নন। প্রশ্ন আপনিই করতেই পারেন, তাহলে কি ক্রুইফের ভাষ্যমতে এটাকিং মিডফিল্ডাররা ভালো খেলোয়াড় নন?
উত্তরটি সোজাসুজি দেওয়া একটু কঠিন। কারণ, এটাকিং মিডফিল্ডাররা নিজেদের পায়ে বল না থাকার বাকি সময়টা নিশ্চয়ই মাঠে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন না কিংবা বসে বিশ্রাম নেন না! তারা বাকি সময়টুকুতেও প্রতিপক্ষকে প্রেস করেন কিংবা রক্ষণে সাহায্য করেন, কিন্তু সেটা একজন বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার বা একজন নাম্বার এইটের চেয়ে কম। আর এই কারণেই ফুটবলের আধুনিকায়নের সাথে সাথে এই এটাকিং মিডফিল্ডার বা নাম্বার টেনরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন, বেঁচে আছেন মাত্র অল্প কয়জন!
অবলুপ্তির কারণ
আধুনিক ফুটবলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ওয়ার্করেট। আপনাকে পুরো মাঠে খেটে খেলতে হবে, যেন আপনার দলকে আপনি সবসময় সাহায্য করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক এই যুগের স্ট্রাইকারদের। আগের যুগে দেখা যেত প্রতিপক্ষের বক্সে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পায়ে বল থাকলে স্ট্রাইকাররা ঢিমেতালে হাঁটতেন, অপেক্ষা করতেন কখন তার মাঝমাঠ কিংবা রক্ষণ বলের পুনঃদখল নেবে এবং সে আবার আক্রমণে অংশ নেবে। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক ফুটবলে কি আপনি সেটা দেখবেন? নাহ। বরং দেখবেন যখন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের পায়ে বল থাকে তখন রক্তের গন্ধ পাওয়া হাউন্ডের মতোই তাদের দিকে ছুটে যান স্ট্রাইকাররা। এখান থেকেই আসলে আন্দাজ করা যেতে পারে আধুনিক ফুটবলে ওয়ার্করেটের গুরুত্ব কতখানি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে প্রেসিং। বিংশ শতাব্দীতে প্রেসিং করা দলের সংখ্যা ছিলো হাতেগোনা, প্রেসিং তখন ছিলো কিছু নির্দিষ্ট দলের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ফুটবল ধীরে ধীরে যত সামনে এগিয়েছে, প্রেসিং অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সব দলেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি দলই কোনো না কোনোভাবে প্রতিপক্ষকে প্রেস করবেই, সবাই হয়তো বা ক্লপের দলের মতো গিগেনপ্রেস করবে না, তবে প্রেসিংটা অবশ্যম্ভাবী।
সত্যি বলতে কী, এই তিন ক্ষেত্রেই ধরা খেয়ে গেছেন এটাকিং মিডফিল্ডাররা। এটাকিং মিডফিল্ডারদের এট্রিবিউটগুলো গবেষণা করলে আপনি ওয়ার্করেট কিংবা পরিশ্রমী, এই ব্যাপারগুলো খুঁজে পাবেন না। এটাকিং মিডফিল্ডাররা মাঠের আলসে শিল্পী, যাদের হাতে তুলি ধরিয়ে দিলে তারা এঁকে যাবেন একের পর এক অপরূপ চিত্রকর্ম, কিন্তু সেই তুলিটা নিজে নিজে হাতে তুলে নিতে তাদের বড্ড আলসেমি। আর তাদের স্বভাবে এই পরিশ্রম না করার ব্যাপারটি থাকার জন্যই আধুনিক কোচরা তাদের পরিত্যাগ করে একজন হাইব্রিড নাম্বার এইটকে খেলাতেই পছন্দ করেন। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, আধুনিক ফুটবলে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনটির ব্যবহার কমে গেছে। বিভিন্ন ধরনের ট্যাকটিকাল দিক বিবেচনা করে কোচদের কাছে এই ফর্মেশনটি তুলনামূলক দুর্বল ও অপছন্দের, ৪-৩-৩ এখন আদর্শ ফর্মেশন। দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের সাথে একজন এটাকিং মিডফিল্ডার খেলানোর বদলে কোচরা এখন একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পাশে দুজন হাইব্রিড নাম্বার এইট খেলাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
হাইব্রিড নাম্বার এইট ব্যাপারটিকে একটু ব্যাখ্যা করা যাক, সাধারণত একজন নাম্বার এইট এমন একজন খেলোয়াড় যে কি না মাঝমাঠ থেকে গিয়ে আক্রমণে অংশ নেয়, তবে রক্ষণেও সহায়তা করে। একজন হাইব্রিড নাম্বার এইট হচ্ছে এমন একজন যার মিডফিল্ডের সব পজিশনে খেলা খেলোয়াড়দের কিছু এট্রিবিউট, যেমন- পাসিং, ট্যাকলিং, ড্রিবলিং ইত্যাদি। একজন হাইব্রিড নাম্বার এইটকে খেলানো এজন্যই সুবিধাজনক যে তিনি একইসঙ্গে দলকে ডিফেন্সিভ এবং অফেন্সিভ আউটপুট দেবেন, এবং তারা প্রচণ্ড ফ্লেক্সিবল, মাঝমাঠের বেশ কয়েকটি পজিশনে খেলতে পারেন তারা, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পল পগবা, টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচ, ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন, কেভিন ডি ব্রুইনে, এরন রামসির কথা। এজন্য বর্তমানে কোচরা দলে হাইব্রিড নাম্বার এইট ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক রিয়াল মাদ্রিদকে, গত ৫ মৌসুমে যারা জিতেছে ৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, যার মধ্যে শেষ তিনবার ছিল টানা। শেষ তিনবারের দলের মাঝমাঠ যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাবো একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ক্যাসেমিরোর দুই পাশে ছিলেন দুজন হাইব্রিড টনি ক্রুস ও লুকা মদ্রিচ, অন্যদিকে এটাকিং মিডফিল্ডার হামেস রদ্রিগেজ ও ইস্কো ছিলেন বেঞ্চে।
এভাবেই প্রায় সব দলই একজন এটাকিং মিডফিল্ডার ছাড়াই সাফল্য পাওয়ায় তাদেরকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছে, বর্তমান ফুটবলে শিল্পীর চেয়ে কর্মীর কদর বেশি। এজন্যই উনাই এমেরি মেসুত ওজিলকে বেঞ্চে রেখে ম্যাতেও গেন্দুজিকে খেলিয়েছেন বেশ কয়েকদিন, কারণ তার কাছে সৌন্দর্যের চেয়ে ফলাফলের মূল্যটা বেশি। তবে ফিরে আসার পর ওজিলের দুর্দান্ত ফর্ম তাকে হয়তো বুঝিয়েছে, শিল্প অমূল্য, তাকে কখনোই ছুড়ে ফেলে দিতে নেই।
মেসুত ওজিল, হামেস রদ্রিগেজ, ফিলিপে কৌতিনহো, ইস্কো অ্যালারকন, ডেভিড সিলভা- প্রায় বিলুপ্ত নাম্বার টেনদের শেষ বংশধর এই অল্প ক’জনই। হয়তো একটা সময় আসবে, যখন ফুটবলে আর নাম্বার টেনদের অস্তিত্ব থাকবে না, যখন ফুটবলে শিল্পের চেয়ে শ্রমের মূল্যই বেশি হবে। সেদিন আসবে কি না, সে চিন্তা ডাস্টবিনে থাকুক, এখনকার মতো এই অল্প কয়জনকে উপভোগ করা যায়, যতদিন সম্ভব, যতটুকু সম্ভব!