Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পিটার ড্রুরি: ধারাভাষ্যের ম্যারাডোনা

ফুটবল ২২ জন খেলোয়াড়ের খেলা এটা সবাই জানে। অনেকের ধারণা এর বাইরে আর কিছুই নেই এই খেলায়। এই কিছুদিন আগেও আমাদের এই ব-দ্বীপের লোকজন ফুটবলে কোচের ভূমিকার ব্যাপারে খুব বেশী কিছু জানতো না। কিন্তু আমাদের মিডিয়াতে ইউরোপিয়ান ফুটবলের প্রসারের সাথে সাথে লোকে আজ মরিনহো না গার্দিওলা এ নিয়েও তর্কে মাতে। আপনি যদি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেন তবে পুরো বাস্তবতায় বসে দেখছেন। কিন্তু যখন ঘরে বসে দেখেন তখন কি সেই আমেজ পান? অবশ্যই না। সেই আমেজটা এনে দিতে পারে ধারাভাষ্যকারগণ তাদের কণ্ঠ ও শব্দের দ্বারা।

যদি জিজ্ঞাসা করা হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় লিগ কোনটি? অধিকাংশই বলবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। অথচ ইংলিশ দলগুলোর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পারফর্মেন্স বেশ তথৈবচ। তবে কেন এর এত জনপ্রিয়তা?

প্রথমেই আসে সম্প্রচার কোয়ালিটি এবং এর পরেই আসবে ধারাভাষ্যের কথা। ইপিএলের বহুল জনপ্রিয়তায় ধারাভাষ্যের অবদান ব্যাপক। তুলনামূলক মলিন স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান লিগের তুলনায় ইপিএলের ধারাভাষ্য অতুলনীয়। আজ এক কিংবদন্তীতুল্য ধারাভাষ্যকারকে নিয়েই এই লিখাটি।

কে এই পিটার ড্রুরি

উপমা চয়নে পিটার অনবদ্য; Source: AZ Quotes

নাম পিটার ড্রুরি; মূলত পেশাগতভাবে ইংলিশ লিগেই তাঁর ধারাভাষ্য জীবনের শুরু। একপর্যায়ে তাঁর সন্মোহনী কথা ও কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে খেলাধুলা বিষয়ক মিডিয়া টাইকুন বিবিসি তাঁকে নিজেদের প্যানেলে নিয়ে নেয়। সেই সুবাদে ড্রুরির গন্ডি ইপিএল পেরিয়ে এফএ কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও বিশ্বকাপেও বিস্তৃত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিটার ড্রুরির ফ্যান, ফলোয়ারের সংখ্যা অনেক খেলোয়াড়ের মনেও ঈর্ষা জাগাবে।

ধারাভাষ্য শিল্পের সাথে আমাদের ক্রীড়ামোদীরা তেমন একটা পরিচিত নয়। যুগে যুগে অনেক ধারাভাষ্যকার নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছেন। ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টাইন বিশ্বকাপে এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের আমিততেজী ধারাভাষ্য আজও বিশ্বকাপ ইতিহাসে অমলিন। ফুটবল ধারাভাষ্যের কাঠামো প্রায় সব জায়গায়ই এক। সেটা হলো, ধারাভাষ্যকার থাকেন দুজন। প্রথমজন থাকেন মূলত শব্দসৈনিক প্রকৃতির আর দ্বিতীয়জনের কাজ মূলত কথা কম বলে ম্যাচ বিশ্লেষণ করা এবং তাঁর সেই বিশ্লেষণ তুলে ধরা। পিটার ড্রুরির ভূমিকা মূলত সেই শব্দসৈনিকেরই। পিটারও তেমনই কখনো বিশেষণের বা উপমার মন্দায় ভোগেন না। মিলি সেকেন্ডের মধ্যেই ঠিকই বের করে নেন সঠিক শব্দ। ‘সঠিক শব্দ’ বলাটা অনেকটা সাদামাটা শোনায়, আসলে মুহুর্তেই বেরিয়ে আসে নতুন কোনো শব্দ বা উপমা। ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবনে মাঠে তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল বিখ্যাত। বলা হতো, কঠিনতম ডিফেন্সের মাঝেও তিনি ঠিকই ফাঁক খুঁজে নিতেন। পিটার ড্রুরিও তেমনই। মুহুর্তের মাঝেই, প্রচন্ড উত্তেজনাকর বা হতবাক করা অবস্থাতেও নিত্যনতুন উপমা বের করে আনার ক্ষমতার জন্যই তাঁকে ডাকা হয়ে থাকে ‘ধারাভাষ্যের ম্যারাডোনা’।

পিটারের কিছু অনবদ্য ধারাভাষ্য

২০১০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সিফিয়ের সাবালালার গোলটির কথা মনে আছে? শানিত প্রতিআক্রমণে হওয়া গোলটির পর ড্রুরির মন্তব্য পুরো আফ্রিকার কাছে তাঁকে করে তোলে জনপ্রিয়। “শাবালালা…বাফানা বাফানা…দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গোল…আফ্রিকার প্রথম গোল… জাবুলিনা…ইটস টাইম ফর আফ্রিকা (শাকিরার গানের আদলে)…অন্ধকারের পর আলোর যুগের প্রথম ঝলসানো…”। আফ্রিকানরা ড্রুরির কথায় নিজেদের অতীতও খুঁজে পায়। কেউ কি ভেবেছিল এই অন্ধকারের মহাদেশে আদৌ বিশ্বকাপ হবে?

উপমা নির্বাচনে পিটার দারুণ সিদ্ধহস্ত। দায়েই নামে একজন খেলোয়াড় চেলসির সাথে দারুণ একটি গোল করেন চারজন ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে। ড্রুরি বলতে থাকেন, “দায়েই এইমাত্র অসামান্য কিন্তু সাধারণ একটি গোল করলেন…কারণ চারজন চেলসি ডিফেন্ডার বলতে গেলে ডি বক্সে তাঁকে সঙ্গ দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন!

আরেকবার কোনো এক ম্যাচে প্রতিপক্ষ কোচ প্রচন্ড রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলাচ্ছিলেন। কিন্তু ম্যাচের শেষ দিকে বুদ্ধিদীপ্ত এক ফ্রি কিক থেকে গোল করে সেই দেয়াল ভেঙে দেন একজন। ড্রুরি চিৎকার করে বলতে থাকেন, “অপকৌশল ৮৭ মিনিট পর্যন্ত তার আধিপত্য বজায় রাখলেও হেরে গেল ব্যক্তিগত কৌশলের কাছে।” আর্সেনালের সাথে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ৮-২ গোলে জেতা ম্যাচের ছয় নম্বর গোলের সময় আর্সেনাল বল হারালে ড্রুরি বলতে থাকেন, “আর্সেনাল আর্সেনালের মতোই খেলছে!…বল পার্কের থেকে ইয়ং…আবার পার্ক…ইয়ং…পার্ক…গোল। এই নিন ছয়টি কারণ (ছয় গোলের দিকে ইঙ্গিত করে) কেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই হতে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়ন।” অপর আরেক ম্যাচে লিভারপুল নিজেদের মাঠে হারতে বসছিল। ৮০ মিনিট অবধি পিছিয়ে, খেলছিলও বাজে। ৮২ মিনিটের দিকে সমতায় ফেরার পর ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিটখানেক আগে বাইরে থেকে দেয়া এক শ্যুটে ম্যাচ জেতার পথে লিভারপুল। তো খেলাটি হচ্ছিল দুপুরে। ড্রুরি বললেন, “প্রিয় লিভারপুল ফ্যান, এখনো লাঞ্চের সময় হয়নি, ভাববেন না আপনি ভুল দেখছেন (পেটে খিদের কারণে), লিভারপুল জয়ের পথে…”

ফুটবল ধারাভাষ্য জগতে পিটার এক কিংবদন্তী ; Source: Football365

বিশ্বকাপে মেসির বসনিয়ার সাথে করা দারুণ সেই গোলটির পর বলেন, “মেসি…হিগুয়েন…মেসি দুর্দম্য…গোল…যে গোলটি বিশ্ব চাচ্ছিল…ব্যতিক্রমের বিস্ফোরণ…সবাই জানে মেসি মাঠে থাকা মানে শেষ বাঁশির আগবধি ম্যাচ আপনার না।” ইপিএলে এক ম্যাচের আগে ঘরোয়া সমর্থকেরা খুব সুন্দর করে গ্যালারির তিন পাশ ভরে রেখেছেন তাদের একই রঙের জার্সির সমর্থক দিয়ে, কিন্তু তাদের গানের কোরাস ঠিক তাল মিলতেছিল না। ড্রুরি সেটাকে উল্লেখ করেন, “অভূতপূর্ব রঙের স্বরানৈক্য”!

ইংলিশ ফুটবল কমিউনিটিতে এখনো এমন অনেকে আছেন যারা পিটার ড্রুরির ম্যাচের শুরুতে সেই ম্যাচ নিয়ে ভূমিকা শোনার জন্য আগে আগে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। আসলেই তাঁর ভূমিকাগুলো অসাধারণ। যেবার পুঁচকে লিস্টার সিটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংলিশ লিগ জেতার পথে, সামনে একমাত্র বড় বাঁধা ম্যানসিটি, যারা আবার নিজেরাও শিরোপা দৌড়ের দল। সেই ম্যাচের আগে বলেন, “স্বপ্নের স্বার্থকতা পূরণে…সৌন্দর্যের স্বার্থকতা স্বপ্নপূরণের দৃশ্যে…অসাধ্য দায়িত্ব জন্ম দেয় উদ্ভট কল্পনা…শুরুতে যুক্তি ম্যানসিটিকে শিরোপাপ্রত্যাশী বানালেও ভাগ্যবিধাতা লিস্টারকে এনে দাঁড় করিয়েছে স্বপ্নের দুয়ারে…তারা কি পারবে?

বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে দেন সেই বিখ্যাত উক্তি, “ফুটবল কী? শুধুই কি একটি খেলা? না, এটি জীবন।” (ঠিক তখনই পর্দায় ভেসে উঠে বিখ্যাত ক্রাইস্ট দ্য রিডেমারের ভাস্কর্যের ছবি।) পিটার তৎক্ষণাৎ বলে উঠেন, “আজ তিনি কাকে আলিঙ্গন করবেন? আর্জেন্টিনা না জার্মানি?” গোতজে যখন গোল দেন ফাইনালে তখন পর্দায় ভেসে উঠে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মেরকেলের দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়ার ছবি। পিটার বলতে থাকেন, “সবচেয়ে দামী আসনের চ্যান্সেলার থেকে সবচেয়ে কম দামী আসনে বসা জার্মানও এখন দাঁড়িয়ে। জার্মানি আবার এক হয়েছে ২৪ বছর পরে। ক্রাইস্ট দ্য রেডিমার তোমাদের আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত।

ক্রাইস্ট দ্য রিডেমারের ভাস্কর্য; Source: Askideas.com

উত্তেজনায় যেন আরো শানিত সব বাক্য আসে তাঁর তূণ থেকে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যখন ম্যানইউর এভরার কাঁধ সমান লাফিয়ে হেডে গোল দেন তখন পিটার বলতে থাকেন জোরে জোরে, “নিউটন তো বলেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু আছে!” বায়ার্নের সাথে মেসি যখন অসাধারণ ড্রিবলিং এ ডিফেন্ডার বোটেংকে অবলীলায় ছিটকে ফেলে গোল দেন তখন পিটার বলেন, “সে সবাইকে শিশু বানাচ্ছে…মাইক্রোফোন হাতে এই গোলটি নিয়ে কিছু না বলতে পারলে আমি আমার বাচ্চাদের কাছে কী বলতাম?

একবার এক ম্যানচেস্টার ডার্বির আগে সমীকরণ এমন ছিল যে, ডার্বি যে জিতবে লিগ জেতার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে তার। সেই ম্যাচ শুরুর আগে পিটার বলেন, “(খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী) ঈশ্বর ছয়দিন ব্যাপী পৃথিবী বানিয়েছেন। আর সপ্তম দিনটা?… এটা শুধুই ফুটবলের…।”

একজন কবি বা কথাশিল্পী তাঁর শিল্পকর্মের জন্য উপযুক্ত স্থান খোঁজেন, সময় নেন এবং লিখেন। কিন্তু এই পেশায় যারা থাকেন তাদের সবই করতে হয় চকিতে। যে জায়গা থেকে কেউ পাস দেয়, সেই জায়গা থেকেই কেউ গোল করে। পাসের সময় গলার স্বর যা থাকে গোলের সময় তা বাড়িয়ে করতে হয় বহুগুণ। গোলের রকমভেদে লাগে উপযুক্ত শব্দ। এসব করার জন্য সময় পান একদমই কম। এই ভিন্নভাষার পেশাকে আরেক ভাষায় বর্ণনা করা বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু পিটারের মাহাত্ম্য এই লেখায় যা বর্ণিত হলো, তা ছাপিয়েও অনেক বেশী।

তারা শান্ত মঞ্চে স্তিতধী-সৌম্য কোনো কবি নন, তারা ক্রীড়াজগতের কথাশিল্পী। আর সেই কথাশিল্পীদের মাঝে পিটার ড্রুরি এক কিংবদন্তী, ধারাভাষ্যের ম্যারাডোনা।

ফিচার ছবিসত্ত্ব: ITV ARCHIVE

Related Articles