Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে সঙ্কট এবং বাংলাদেশ

রোডেশিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে। ক্রিকেটে এককালের সেই বিস্ময়-জাগানিয়া নামটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে বিস্মৃতির অতলে। ১৯৮৩ থেকে অতীতের সবক’টি বিশ্বকাপ খেললেও এবারই প্রথমবারের মতো তারা খেলতে পারেনি না বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে। ক্রিকেটবিশ্ব যখন মজেছে বিশ্বকাপের উন্মাদনায়, তখনই এলো নতুন দুঃসংবাদ। দুর্নীতির অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডকে। ঐ দেশের স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন কমিটির সিদ্ধান্তে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আপাতত অভিভাবকহীনও হয়ে গেল। সেই সাথে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আরেকটি কালো অধ্যায়ে প্রবেশ করল। কেনিয়ার মতো আবার ক্রিকেটটাই না দেশটি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেই শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া চলে না।

অথচ এই জিম্বাবুয়েই একসময় দারুণ মানসম্পন্ন একটি দল ছিল। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে কাগজে-কলমে একধাপ এগিয়ে থাকলেও বাস্তবে ওদের আর আমাদের তফাৎ ছিল ব্যাপক। আজ আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি দুর্বার গতিতে, বড় দলগুলোকে নিয়মিত হারাচ্ছি, টেক্কা দিচ্ছি, নিজেরা বড় দল হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন জিম্বাবুয়ের এই ভগ্নদশা বেদনা দেয়। ক্রিকেটে আমাদের ‘বন্ধুপ্রতীম’ দেশটির এমন নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দেখাটা মোটেই সুখকর কিছু নয় আমাদের জন্য।

১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে; Image Credit: espncricinfo.com

১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পেয়ে রোডেশিয়া থেকে জিম্বাবুয়েতে পরিণত হওয়া দেশটি ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপে প্রথম খেলার সুযোগ পায়। প্রথম আসরে এসেই পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়, সেই আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে চেপে ধরে। যদিও কপিল দেবের ১৭৫ রানের দানবীয় ইনিংসের কারণে সেখানে জয়বঞ্চিত থাকতে হয় তাদের। তবু তারা ক্রিকেটে নিজেদের আগমনী বার্তা ভালোভাবেই জানিয়ে দেয়।

এরপর প্রতিটি বিশ্বকাপেই খেলে তারা। বড় কোনো সাফল্য না পেলেও নিজেদের শক্তিমত্তার স্বাক্ষর নিয়মিত রেখে যায় দারুণভাবেই। নিয়মিত ভালো খেলার ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে নবম দেশ হিসেবে টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করে জিম্বাবুয়ে। রাজনৈতিক কারণে অন্য ৮টি টেস্ট দলের মধ্যে শুধু ইংল্যান্ডই তাদের বিরোধিতা করে। বাকি দলগুলো সম্মতি জানায়। টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে প্রথম টেস্টেই ভারতকে চমকে দেয় তারা, জয়ের কাছাকাছি এক ‘বীরোচিত’ ড্র করে বাকি দলগুলোকে সতর্কবার্তা দেয় শুরুতেই।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের জিম্বাবুয়ে দলটি ছিল দারুণ শক্তিশালী; Image Credit: Getty Images

১৯৯৬-২০০৪ এই আট বছর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল। তখনই তাদের সেরা দলটি একসাথে খেলেছিল। বিশ্ব ক্রিকেটকে চমকে দেয়া সব পারফরম্যান্স করছিল দলটি। ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, নিল জনসন, মারে গুডউইন, হিথ স্ট্রিক, হেনরি ওলোঙ্গা, ক্রেইগ উইশার্ট, ডগলাস হন্ডোর মতো ক্রিকেটার তখন জিম্বাবুয়ে দলে খেলতেন। এসব ক্রিকেটারের সাথে যখন নতুনরাও উঠে আসছিল, ক্রমেই নিজেদেরকে বড় দলের কাতারে দলটি যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই ঘটে ছন্দপতন।

২০০৩ বিশ্বকাপে রবার্ট মুগাবে নামক স্বৈরশাসকের দুর্নীতি ও ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা সেদিন কালো ব্যাজ পরে মাঠে নামেন। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের রোষানলে পড়েন তারা, শুরু হয় জিম্বাবুয়ের অধঃপাতের সূচনা। ২০০৩-২০০৪ মৌসুমে মুগাবে সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রতিবাদে অকস্মাৎ অবসর নিয়ে ফেলেন জিম্বাবুয়ের একঝাঁক ক্রিকেটার, যাদের মধ্যে গ্রেট হওয়ার মতো সম্ভাবনাময় প্লেয়ারও ছিলেন কেউ কেউ। এরপর থেকেই মূলত দলটির পতন শুরু হতে থাকে। দারুণ শক্তিশালী একটি দল পরিণত হয় ক্ষয়িষ্ণু শক্তির দলে। অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ভুগতে থাকা দলটি ২০০৫ সালের শেষের দিকে নিজেদের টেস্ট খেলার অনুপযোগী মনে করে একসময় টেস্ট থেকেই স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যায়।

ছয় বছর নির্বাসনে কাটিয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে একসময় ফিরেও আসে তারা। কিন্তু আগের সেই জিম্বাবুয়ে আর ফিরে আসে না। টেস্ট তো দূরের কথা, ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টিতেও দলটি নেহায়েত সাধারণের চেয়েও নিচু মানের ক্রিকেট দলে পরিণত হয়। ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ খেললেও ভালো খেলেনি একদমই। ২০১৯ বিশ্বকাপ দশ দলে নেমে আসায় বাছাইপর্বের বাধাই পেরোতে পারেনি। নবাগত আফগানিস্তান বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করলেও জিম্বাবুয়ে রয়ে যায় অথৈ তিমিরেই।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা; Image Credit: Getty Images

একটা সময় ছিল, বাংলাদেশ শুধু সম্মানজনক পরাজয়ের জন্য মাঠে নামতো। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরও টেস্ট কি ওয়ানডে, ম্যাচের পর ম্যাচ, বছরের পর বছর শুধু হেরেই গেছি আমরা। জিম্বাবুয়ে তো তখন দারুণ শক্তিশালীই ছিল আমাদের তুলনায়। আমরা তখন কেনিয়া, এমনকি কানাডার সাথেও হেরেছি। বড় বড় দলগুলো আমাদের সাথে খেলতে ইতস্ততবোধ করতো। তাদের ব্যবসা হতো না, দর্শক হতো না আমাদের সাথে খেললে। তবু আইসিসির বাধ্যবাধকতায় খেলতে হতো মাঝেমধ্যে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারতাম না।

এমন অবস্থায় আমাদের চেয়ে যোজন-যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও আমাদের সাথে নিয়মিত হোম এবং অ্যাওয়ে সিরিজ খেলতে কখনোই দ্বিধা করতো না যে দলটি, তার নাম জিম্বাবুয়ে। হারতে হারতে খাদের কিনারায় চলে যাওয়া বাংলাদেশকে কথিত এলিট দলগুলোর সাবেক ক্রিকেটাররা সুযোগ পেলেই তির্যক কথা শোনাতে ছাড়তো না। একবার সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডেভিড হুকস মন্তব্য করেছিলেন,

‘বাংলাদেশকে একদিনেই টেস্ট হারাবে অস্ট্রেলিয়া।’

যদিও তার আশা সেদিন পূরণ হয়নি, তবে পারফরম্যান্স দিয়ে সেটার জবাবও সেদিন দেওয়া সম্ভব হয়নি। সাবেক অজি ক্রিকেটার জিওফ বয়কট একবার বলে দিয়েছিলেন,

‘আমার মা খেললেও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো খেলবেন।’

ভারতীয় বীরেন্দর শেবাগ তো আমাদের ‘অর্ডিনারি’ বলেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এত কিছুর পরও বিরামহীনভাবে যে দলটি আমাদের সাথে খেলে যেত, তারা হলো জিম্বাবুয়ে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর টানা পাঁচ বছর জয়হীন থাকার পর ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের সেই শক্তিশালী দলটিকে ৮ রানে হারিয়েই জয়খরা কাটিয়ে উঠেছিলাম আমরা। বড় দলগুলোর সাথে কালেভদ্রে জয় পেলেও জয়ের অভ্যাস জিম্বাবুয়ের সাথে টানা খেলেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম।

জিম্বাবুয়ের অন্যতম শক্তিশালী সেই দল, যারা নিয়মিতই বড় দলগুলোকে হারাতো; Image Credit: Getty Images

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট এখন মহাসঙ্কটে৷ একটা দেশের ক্রিকেট বোর্ড সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া মানে বিরাট আশঙ্কার ব্যাপার। দুর্নীতিমুক্ত একটি স্বচ্ছ ও স্বাধীন ক্রিকেট বোর্ড পুনর্গঠনে দেশটিকে আইসিসি ও অন্যান্য শক্তিশালী ক্রিকেট বোর্ডগুলোর এখানে সর্বাত্মক সহায়তা করা উচিত৷ সেই সাথে বর্ণপ্রথা বিলুপ্তিকরণের জন্য আইসিসির কঠোর হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দুঃসময়ে এই জিম্বাবুয়েই আমাদের সাথে সিরিজ খেলতে অনীহা দেখালে আমাদের ক্রিকেট-স্বপ্ন শুরুতেই যে হোঁচট খেত, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের কূটনৈতিকভাবে যেমন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের পাশে দাঁড়াতে হবে, তেমনি তাদের সাথে নিয়মিত ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ সিরিজ খেলে তাদের ক্রিকেটটাকে মাঠে রাখতে হবে। দুঃসময়ের বন্ধুদের আশা করি ভুলে যাবে না বিসিবি। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট বিলুপ্ত হয়ে গেলে ক্রিকেটের আরেকটি ঐতিহ্যও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। কেনিয়া, কানাডা, বারমুডার পথ যদি জিম্বাবুয়েও ধরে, তাহলে ক্রিকেটের বিশ্বায়নের স্বপ্নটা যে বাস্তবে রূপ নেবে না, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।

ক্রিকেটের বিখ্যাত ভাইদের অন্যতম অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার; Image Credit: Getty Images

বিশ্বকাপের পর আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আসছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল। টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটের ত্রিদেশীয় সিরিজে তারা খেলবে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সাথে। ইতোমধ্যেই সিরিজের সূচিও প্রকাশ হয়েছে। ১৪ই সেপ্টেম্বর আফগানিস্তান-জিম্বাবুয়ের ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে সিরিজটি। এফটিপি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সিরিজে একটি টেস্ট ও দু’টি টি-টুয়েন্টি খেলার কথা ছিল। কিন্তু দুই দেশের সম্মতিতে সেটাই রূপ নিচ্ছে ত্রিদেশীয় টি-টুয়েন্টি সিরিজে। জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের এই ঘোর দুঃসময়ে এই পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে বিসিবি’র একটি আন্তরিক ধন্যবাদ প্রাপ্যই বটে। জিম্বাবুয়ে’র ক্রিকেটে আবার ফিরুক জীবন, ঐতিহ্য থাকুক সমুজ্জ্বল, আবারও জেগে উঠুক বিশ্ব ক্রিকেট। আর তাতে বড় ভূমিকা রাখুক বিসিবি, এটাই এখন কাম্য। 

This article is in Bangla language. It is about the crisis in Zimbabwean Cricket and the appreciation for what BCB did for them.

Featured Image: Getty Images

Related Articles