প্রতিবার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পরপরই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে গোল্ডেন বুট দাবিদারদের পারফরম্যান্স। ব্যতিক্রম নয় রাশিয়া বিশ্বকাপও। শুরু থেকে যাদের উপর স্পটলাইট ছিলো তাদের অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন, আবার অনেকে দেখিয়েছেন চমকও। মেসি, আগুয়েরো, মুলারদের পাশাপাশি নেইমারের মতো তারকাদের গোলখরা ছিলো চোখে পড়ার মতো। তেমনি গোলের বন্যা বইয়ে নিজেদের জাত চিনিয়েছেন লুকাকু, রোনালদো, হ্যারি কেনরা। গোল্ডেন বুটের রেসে হ্যারি কেনের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও একটি জায়গায় অনেক কিংবদন্তীকেই পেছনে ফেলেছেন পর্তুগাল সেনসেশন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। স্পেনের সাথে প্রথম ম্যাচে স্পটকিক থেকে গোল করে টানা চার বিশ্বকাপে গোল করার কীর্তি গড়েন বর্তমানের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। যে কীর্তির ভাগীদার আছেন আরো তিন কিংবদন্তী ফুটবলার। ব্রাজিলের পেলে, পশ্চিম জার্মানির উয়ে সিলার এবং জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা। চলুন দেখে আসা যাক এই চার ফুটবলারের কীর্তি গাঁথা।
১) পেলে (ব্রাজিল)
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পান ফুটবলের এই কিংবদন্তী। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ খেলতে সুইডেন যান কালোমানিক খ্যাত ‘পেলে’। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি। আর তাতেই দেন কোচের আস্থার প্রতিদান। সেই ম্যাচে একটি অ্যাসিস্টও করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে তার একমাত্র গোলে ব্রাজিল হারায় ওয়েলসকে। সেমিফাইনালের ড্রামাটিক ম্যাচে ফ্রান্সের সাথে হ্যাটট্রিক করে বসেন এই বিস্ময় বালক। ব্রাজিল ম্যাচটি জেতে ৫-২ গোলে। ফাইনালেও পেলে চমক অব্যাহত থাকে। পেলের জোড়া গোলেই স্বাগতিক সুইডেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে সেলেসাওরা।
পরের আসরে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় চিলিতে। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর সাথে এক গোলের পাশাপাশি এক অ্যাসিস্ট করে দলকে ২-০ গোলে জেতাতে সাহায্য করেন পেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরের ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান তিনি। তবে ব্রাজিল ঠিকই টানা দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেয় তৎকালীন জুলে রিমে ট্রফি।
১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মানুষের প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে থাকে। পেলে তখন বিশ্বসেরা তারকা। পাশাপাশি ব্রাজিল দলে ছিলেন গ্যারিঞ্চা, টোস্টাও, জেয়ারজিনহোর মতো তারকারা। সেই বিশ্বকাপে পেলে নিজের প্রথম গোলটি করেন বুলগেরিয়ার সাথে, ফ্রি কিকের মাধ্যমে। কিন্তু বুলগেরিয়া খেলোয়াড়দের মারাত্মক ট্যাকলে পড়ে হাঙ্গেরির সাথে ম্যাচটি মিস করেন তিনি। শেষ ম্যাচে পর্তুগালের সাথে ফিরলেও শেষ রক্ষা হয়নি ব্রাজিলের। ইউসেবিওর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ম্যাচটি হেরে গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে পেলের ব্রাজিল।
১৯৭০ এ এসে পেলে জিতে নেন ব্রাজিলের হ্যাটট্রিক শিরোপা। সাথে জুলে রিমে ট্রফিটিই চিরদিনের জন্য নিজেদের করে নেয় তারা। সেই বিশ্বকাপে মূলত কিছুটা নিচে নেমে এসে প্লেমেকারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেবার গোল্ডেন বলের পুরস্কারটি বগলদাবা করেন তিনি। টুর্নামেন্টে ফাইনালে ইতালির সাথে এক গোলের পাশাপাশি চারটি গোল করেন তিনি। তাতেই প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা চার বিশ্বকাপে গোল করার কীর্তি গড়েন তিনি। বিশ্বকাপে পেলের গোলসংখ্যা মোট ১২টি।
২) উয়ি সিলার (পশ্চিম জার্মানি)
পেলের মতো সেই একই চার বিশ্বকাপে গোল করে তার কীর্তিতে ভাগ বসান পশ্চিম জার্মানির এই স্ট্রাইকার। ‘৬০ এর দশকের ফুটবলে স্ট্রাইকার হিসেবে নাম কুড়িয়েছিলেন এই হামবুর্গ স্ট্রাইকার। যদিও এই চার বিশ্বকাপে একবারও শিরোপা জেতা হয়নি উয়ি সিলারের। সর্বোচ্চ কীর্তি ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলা। ইংল্যান্ডের কাছে হেরে সেবার রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পশ্চিম জার্মানিকে।
প্রথম বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে আর্জেন্টিনা ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সাথে একটি করে গোল করেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে সেবার আর গোলের দেখা পাননি তিনি। পরের বিশ্বকাপেও গ্রুপপর্বে সুইজারল্যান্ড ও চিলির সাথে একটি করে গোল করেন সিলার। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার কাছে ১-০ গোলে হেরে বাদ পড়ে সিলারের পশ্চিম জার্মানি।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে পৌঁছায় সিলারের দল। তবে সেবারও দুটির বেশি গোল করতে পারেননি তিনি। গ্রুপপর্বে স্পেনের সাথে গোল করার পাশাপাশি কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের সাথেও একটি গোল করেন তিনি। ১৯৭০ বিশ্বকাপে এসে তিন গোল করতে সক্ষম হন সিলার। গ্রুপপর্বে দুই গোলের সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে আগেরবারের ফাইনালের প্রতিশোধ নেওয়া ম্যাচে ইংল্যান্ডের সাথে একটি গোল করেন সিলার। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে টানা চার বিশ্বকাপে গোল করে পেলের পাশে নাম ওঠান সাবেক এই পশ্চিম জার্মানির স্ট্রাইকার। বিশ্বকাপে সর্বমোট ২১ ম্যাচ খেলে ৯টি গোল করেন তিনি।
৩) মিরোস্লাভ ক্লোসা (জার্মানি)
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক মিরোস্লাভ ক্লোসা এই কীর্তি গড়েন সর্বশেষ বিশ্বকাপে। ২০০২ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে টানা চার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৬ গোল করেন বিশ্বকাপজয়ী এই জার্মান খেলোয়াড়। ২০০২ বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের সাথে হ্যাটট্রিক করেন ক্লোসা। গ্রুপের পরবর্তী দুই ম্যাচেও আয়ারল্যান্ড ও ক্যামেরুনের সাথে একটি করে গোল করে গোল্ডেন বুটের রেসে যোগ দেন ক্লোসা। তবে বাকি টুর্নামেন্ট জুড়ে গোলের দেখা পাননি তিনি। জার্মানিও ব্রাজিলের সাথে ফাইনালে ২-০ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়েই টুর্নামেন্ট শেষ করে।
পরের আসরে স্বাগতিক হিসেবে খেলতে নামে জার্মানি। কোস্টারিকা ও ইকুয়েডরের সাথে জোড়া গোল করেন ক্লোসা। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে করেন আরেকটি গোল। সেই আসরে পাঁচ গোল করে সিলভার বুট জিতে নেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। ২০১০ বিশ্বকাপেও চারটি গোল করেন। গ্রুপপর্বে একটি গোল করার সাথে সেকেন্ড রাউন্ডে ইংল্যান্ডের সাথে করেন আরেকটি গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্লোসার জোড়া গোলে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় জার্মানি।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ১৪ গোল নিয়ে ব্রাজিল কিংবদন্তী রোনালদোর ১৫ গোলের পেছনে থেকে বিশ্বকাপ শুরু করেন ক্লোসা। গ্রুপপর্বে ঘানার সাথে বদলী নেমে একটি গোল করে রোনালদোকে ছুঁয়ে ফেলেন তিনি। সেমিফাইনালে রোনালদোর ব্রাজিলের বিপক্ষেই গোল করে বনে যান বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড়। টানা চার বিশ্বকাপে গোল করার পাশাপাশি জিতে নেন বহু আরাধ্য সোনালি ট্রফিটিও।
৪) ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ( পর্তুগাল )
স্পেনের সাথে অনবদ্য হ্যাটট্রিকের সাথে চার বিশ্বকাপে গোল করা চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড বুকে নাম ওঠান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে আগের তিন বিশ্বকাপে একটি করে গোল পাওয়া রোনালদো এবার প্রথম ম্যাচেই পেয়ে যান তিন গোল। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইরানের সাথে গোল করে বিশ্বকাপে গোলের খাতা খোলেন পর্তুগালের অধিনায়ক। পরবর্তী বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে করেন একটি গোল। ২০১৪ বিশ্বকাপে পর্তুগাল গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিলেও ঘানার সাথে একটি গোল করে টানা তিন বিশ্বকাপে গোল পেয়ে যান তিনি।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সুযোগ ছিলো পেলে, সিলার, ক্লোসার সাথে নাম ওঠানোর। সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী স্পেনের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে দলকে হারের মুখ থেকে বাঁচান। পরের ম্যাচে তার একমাত্র গোলেই মরক্কোকে হারায় পর্তুগাল। এখন পর্যন্ত গোল্ডেন বুটের রেসে ভালোভাবেই টিকে আছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত পর্তুগালকে কতটুকু নিয়ে যেতে পারেন এ নেতা।