এই মহাবিশ্বে সম্ভবত ক্রিকেটই একমাত্র খেলা, যেখানে খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যকে ছাড়িয়ে শুধু খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার স্থানটাই নির্ধারণ করে দিতে পারে বিজয়ী দলের নাম। পিচ নামক এই রহস্যভরা জায়গাটা তাই সর্বদাই থাকে ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের কেন্দ্রে, ক্রিকেট-রোমান্টিকরা গালভরে ডাকেন ‘বাইশ গজের দুনিয়া’ বলে। চলুন, বাইশ গজের এই দুনিয়ার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালানো যাক আজকে।
পিচের আকার ও মাপজোখ
পিচের দৈর্ঘ্য তো আগেই বলা হয়েছে। তবে এই বাইশ গজ দৈর্ঘ্যটা হলো মূলত দুই প্রান্তের স্ট্যাম্পের মধ্যবর্তী দূরত্ব। স্ট্যাম্পের বাইরে দুই প্রান্তের বোলিং ক্রিজকে বিবেচনায় নিলে পিচের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২২.৫৬ মিটার বা ২৪.৬৭ গজ। পিচের প্রস্থ ৩.৬৬ মিটার বা ৪ গজ, তবে ম্যাচের সময়ে ব্যবহৃত অংশের প্রস্থ ৩.০৫ মিটার বা ১০ ফুট। উভয় প্রান্তের স্ট্যাম্পের ১.৩৩ গজ সামনে দাগ কাটা হয়, যাকে বলে পপিং ক্রিজ।
এক্ষেত্রে একটু বাড়তি তথ্য দিয়ে রাখা যাক। দূরদর্শনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার ক্ষেত্রে অনেক সময়ে পর্দায় শর্ট লেন্থ, গুড লেন্থ, ফুল লেন্থ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ ভেসে ওঠে। সাধারণভাবে, স্ট্যাম্প থেকে ২ মিটারের মধ্যের জায়গাটাকে বলা হয় ইয়র্কার লেন্থ, ২ থেকে ৬ মিটারকে বলা হয় ফুল লেন্থ, ৬ থেকে ৮ মিটারকে বলা হয় গুড লেন্থ, যার মধ্যে ৭ থেকে ৮ মিটারের জায়গাটা হলো ব্যাক অব আ লেন্থ, আর ৮ থেকে পিচের মাঝ পর্যন্ত জায়গাটাকে বলা হয় শর্ট লেন্থ।
পিচ তৈরির প্রক্রিয়া
ক্রিকেট ম্যাচের জন্য আদর্শ পিচ তৈরি একটা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। চলুন, এর প্রক্রিয়াগুলো ধাপে ধাপে জেনে নেওয়া যাক।
পিচ স্কয়ার তৈরি
পিচের জায়গা জুড়ে তিন ফুট গর্ত করা হয়। এই জায়গাকেই পিচ স্কয়ার বলে। পিচ স্কয়ারের ভেতরের আলগা মাটি তুলে ফেলে জায়গাটা পুরোপুরি খালি করে ফেলা হয়। এরপর সেখানে পানি দেওয়া হয় এবং ভারী রোলার দিয়ে রোল করা হয়, যেন পিচের ভিত্তিটা যথেষ্ট মজবুত হয়।
পিচ স্কয়ার ভরাট করা
এরপর নুড়ি পাথর ছড়িয়ে একটি স্তর তৈরি করা হয়। এর উপরে পূর্বে তুলে ফেলা আলগা মাটি ফেলা হয় এবং একটি স্তর তৈরি করা হয়। ভারী রোলার দিয়ে আবারও রোল করা হয় জায়গাটা সমতল করা হয়। এরপর নয় ইঞ্চি ইটের দুটো স্তর বিছানো হয়। ইটের মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করতে ব্যবহৃত হয় কাঠকয়লা আর সূক্ষ্ম বালি। ইটের স্তরের ওপর মাটির মিশ্রণের নয় ইঞ্চির একটা স্তর থাকে। মাটির মিশ্রণের এক তৃতীয়াংশ থাকে কালো মাটি, এক তৃতীয়াংশ লাল মাটি, আর বাকিটা থাকে মোরাম নামক এক প্রকার সূক্ষ্ম বাদামি বা লাল মাটি। এরপর এর ওপর পানি ছিটানো হয়। এরপর এর ওপর আরেকটি মাটির মিশ্রণের ৩ ইঞ্চির স্তর দেওয়া হয়, যেখানে ১ ভাগ থাকে কালো মাটি, ১/২ ভাগ লাল মাটি, ২ ভাগ মোরাম এবং ২ ভাগ জৈব সার। এর উপরিভাগে ঘাসের স্তর বিছানো হয়। ঘাসের উপরে আবার ৬ ইঞ্চির মাটির মিশ্রণের একটা স্তর দেওয়া হয়, যেখানে ১ ভাগ থাকে কালো মাটি, ১/২ ভাগ লাল মাটি, ২ ভাগ মোরাম এবং ২ ভাগ জৈব সার।
পানি আর সূর্যের তাপের ব্যবহার
এরপর পিচটাকে এক বা দুই দিন রোদে ফেলে রাখা হয়। এরপর থেকে দিনে দুইবার করে পানি দেওয়া হয়, তবে সূর্যের তাপের ওপর নির্ভর করে পানি দেওয়ার পরিমাণ বাড়তে পারে। এভাবে প্রতিদিন পানি দেওয়া ও রোলিং করার মাধ্যমে খেলার উপযোগী পিচ প্রস্তুত করা হয়।
প্রথমবার ঘাস কাটা
এরপর পিচ এরিয়ার চারপাশে দড়ি দিয়ে জায়গাটা নির্দিষ্ট করা হয় এবং প্রথমবারের মতো ঘাস কাটা হয়। ৭ থেকে ৮ মিলিমিটার উচ্চতার ঘাস রেখে বাকিটা ছেঁটে ফেলা হয়।
ঘাসের ঘনত্ব পরীক্ষা ও ঘাস তুলে ফেলা
এরপর ঘাসের ঘনত্ব পরীক্ষা করা হয় এবং প্রয়োজনে যন্ত্রের সাহায্যে ঘাস তুলে ঘনত্ব কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঘাসের ঘনত্ব বেশি থাকলে পেস বোলাররা বেশি সাহায্য পান, ব্যাটসম্যানদের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতেই ঘাস তুলে ফেলার এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
দ্বিতীয়বার ঘাস কাটা
এরপর দ্বিতীয়বারের মতো ঘাস কাটা হয়। এবার ঘাসের উচ্চতা সাধারণত কিউরেটরের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, তবে সাধারণত একেবারে ছোট করে ফেলা হয় না।
পিচে পানি দেওয়া
এরপর পিচে পানি দেওয়া হয়। পানির পরিমাণ নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। তাপমাত্রা আর বাতাসের আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে পানির পরিমাণ বাড়ানো-কমানো হয়।
রোলিং
এরপর পিচ রোল করা হয়। পিচ রোলিংয়ের সময়ে খেয়াল রাখতে হয়, পিচ যেন খুব বেশি ভেজা বা শুকনো না থাকে।
শেষবার ঘাস কাটা ও পিচ রোলিং
খেলার জন্য পিচ প্রায় প্রস্তুত হয়ে এসেছে। এখন শেষবারের মতো ঘাস কাটা হয়, এবং পিচ রোল করা হয়। দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলোতে পিচে ঘাসের পরিমাণ সাধারণত স্বাগতিক দলের চাওয়ার ওপর নির্ভর করে, আইসিসির টুর্নামেন্টে এই সিদ্ধান্তের ভার থাকে আইসিসির ওপর।
স্ট্যাম্প বসানো ও দাগ কাটা
এরপর পিচের দুই প্রান্তে বাইশ গজ দূরত্ব রেখে তিনটি করে মোট ছয়টি স্ট্যাম্প বসানো হয় এবং পপিং ক্রিজের দাগ কাটা হয়।
ব্যস, আর অপেক্ষা কীসের, এবার দুই দল মাঠে নামলেই খেলা শুরু!
পিচের রকমফের
সাধারণত পিচকে চারটি আদর্শ ভাগে ভাগ করা যায়: ফ্ল্যাট বা ডেড পিচ, হার্ড পিচ, সবুজ পিচ, এবং ‘ডাস্টি’ বা ধূলিমলিন পিচ।
১. ফ্ল্যাট পিচ
এ ধরনের পিচের শেষ ঘাসটাও রোল করে ফেলা হয়। পাশাপাশি ময়েশ্চারের ছিটেফোঁটাও থাকে না, ফলে পেসাররা কোনো বাড়তি সহায়তা আদায় করতে পারেন না। এ ধরনের পিচ সহজে ভাঙে না, ফলে স্পিনাররাও তেমন কোনো সাহায্য পান না। ব্যাটসম্যানদের জন্য এ ধরনের পিচ স্বর্গস্বরূপ। ফ্ল্যাট পিচে স্বাভাবিকভাবে প্রচুর রান ওঠে, তাই ইদানিং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এ ধরনের পিচের ব্যবহার বেড়েছে।
২. হার্ড পিচ
এই পিচে সাধারণত ঘাস থাকে না, এবং পিচের গঠন খুব মজবুত হয়। পাশাপাশি এই পিচে পেসাররা ভালো বাউন্স পান, মাটিতে পড়ার পর বলের গতির তেমন পরিবর্তন হয় না। সব মিলিয়ে এই পিচ থেকে পেসারদের জন্য কিছুটা সুবিধা থাকে, তবে বাউন্সের তারতম্য কম থাকায় এবং বল দ্রুত ব্যাটে আসায় ভালো টেকনিকের ব্যাটসম্যানদের জন্য রান করা তেমন কঠিন কাজ নয়।
৩. সবুজ পিচ
পিচে ঘাস থাকার অর্থ পিচে অসমান বাউন্স থাকবে। ঘাসের আচ্ছাদনের ফলে বল আর পিচের মধ্যে ঘর্ষণ কম হয়। ফলে বোলারের হাত থেকে বেরোনোর সময়ে আর ব্যাটসম্যানের কাছে পৌঁছানোর সময়ে বলের গতির পার্থক্য কম থাকে। আবার এই ঘাসের কারণে বল অনেকক্ষণ নতুন থাকে, বলের সিম দ্রুত ক্ষয়ে যায় না। অর্থাৎ পেস বোলাররা যা যা চাইতে পারেন, তার সবই সরবরাহ করে সবুজ পিচগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই পিচগুলো হয়ে ওঠে পেসারদের ‘স্বর্গ’, আর ব্যাটসম্যানদের ‘নরক’।
৪. ধূলিমলিন পিচ
এই ধরনের পিচের গঠন ততটা মজবুত নয়, ফলে এই পিচ দ্রুত ভাঙতে থাকে। এর ফলে বল মাটিতে পড়ার পর পিচ বলকে ‘গ্রিপ’ করে আঁকড়ে ধরে। এই ধরনের পিচে স্পিনাররা প্রচুর সাহায্য পান, কেননা বল মাটিতে পড়ার পর কতটুকু ঘুরবে সেটা ব্যাটসম্যানের জন্য আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব। সাধারণত উপমহাদেশের মাটিতে টেস্টের চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে পিচের এই রূপ দেখা যায়।
ড্রপ-ইন পিচ
এটি বিশেষ ধরনের পিচ। ড্রপ-ইন পিচ মূলত ব্যবহার করা হয় বহুমাত্রিক ব্যবহারের উপযোগী স্টেডিয়ামগুলোতে। এই ধরনের স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল, রাগবি প্রভৃতি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, অ্যাডিলেড ওভাল এই ধরনের বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী স্টেডিয়ামের উদাহরণ।
যেহেতু এই ধরনের স্টেডিয়ামে বিভিন্ন প্রকারের খেলা অনুষ্ঠিত হয়, এই স্টেডিয়ামে ক্রিকেট পিচ থাকলে তা যেমন অন্য খেলার স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তেমনি ক্রিকেট পিচেরও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়। তাই এই ধরনের স্টেডিয়ামে ব্যবহৃত হয় ড্রপ-ইন পিচ। ড্রপ-ইন পিচ হলো এক ধরনের পিচ যা মূলত স্টেডিয়ামের বাইরে তৈরি করা হয়, এরপর মৌসুমের শুরুতে স্টেডিয়ামে বসানো হয়, এবং মৌসুম শেষে তুলে ফেলে ঐ স্থানটি বালু, মাটি এবং ঘাস দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের উদাহরণই দেখা যাক। এমসিজিতে ব্যবহৃত ড্রপ-ইন পিচের দৈর্ঘ্য ২৪ মিটার, প্রস্থ ৩ মিটার ও গভীরতা ২০ সেন্টিমিটার।
মূলত কালো মাটির ওপর ঘাসের আস্তরণ বসিয়ে এই পিচ তৈরি করা হয়। এরপর এর চারপাশে স্টিলের ফ্রেম বসানো হয়। ক্রিকেটের মৌসুমের শুরুতে ৩০ টনের একটি কাস্টমাইজড ট্রেইলারের মাধ্যমে পিচটিকে স্টেডিয়ামে আনা হয় এবং বসানো হয়। মৌসুমের শেষে আবার পিচটাকে তুলে ফেলা হয় এবং বালু আর কৃত্রিম ঘাস দিয়ে ঐ ফাঁকা স্থানটা পূরণ করে অন্য খেলার উপযোগী করা হয়।
ড্রপ-ইন পিচ যেকোনো মাঠের যেকোনো স্থানে বসানো যায় বলে অনেকেই এই পিচ পছন্দ করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান রমিজ রাজা সম্প্রতি পাকিস্তানের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার পিচের আবহ আনতে আস্ট্রেলিয়া থেকে ড্রপ-ইন পিচ নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে ড্রপ-ইন পিচ সম্পর্কে অনেকেরই অভিযোগ করেছেন। গ্লেন ম্যাকগ্রা এ ধরনের পিচকে ‘অতিমাত্রায় ফ্ল্যাট’ বলে অভিহিত করেছিলেন, মিচেল জনসন তুলে ধরেছিলেন পঞ্চম দিনেও উইকেটের না ভাঙার বিষয়টি, ব্র্যাড হজ বলেছিলেন ড্রপ-ইন পিচের বৈচিত্র্যহীনতার ব্যাপারে। পার্থের অপ্টাস স্টেডিয়ামের ড্রপ-ইন পিচের কিউরেটর ব্রেট সিপথোর্প স্বীকার করেছেন বিষয়গুলো,
“পিচের চারপাশে স্টিলের ফ্রেম থাকায় এই পিচগুলো সহজে ভাঙে না, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই টেস্টের পঞ্চম দিনে প্রত্যাশিত সুবিধাটা পান না স্পিনাররা। আর তাছাড়া সব ড্রপ-ইন পিচ তৈরি হয় একই ধরনের মাটি দিয়ে, পিচের আচরণেও তাই সাদৃশ্য পাওয়া যায়।”
তবে ড্রপ-ইন পিচ হোক বা প্রথাগত, পিচের ধরন মূলত নির্ভর করে স্বাগতিক দেশের আবহাওয়া, কন্ডিশন, মাটির প্রকৃতি আর স্বাগতিক দলের স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রের ওপর। আর এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই পিচকে খেলার উপযোগী করে গড়ে তোলেন দক্ষ কিউরেটর আর মাঠকর্মীরা। আর সেই পিচকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনার বাকি দায়িত্বটা থাকে মাঠের ক্রিকেটারদের ওপর।