বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘রেকর্ডের বরপুত্র’ সাকিব আল হাসান। প্রায় এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পদচারণা। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনকে, সাংবাদিকদেরকে ক্রিকেটের পরিসংখ্যান-ইতিহাসের অলিগলি ভ্রমণের কাজে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন সাকিবই। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হওয়ার পর থেকে ব্যাটে-বলে পরিসংখ্যানে, রেকর্ডের অনেক পাতায় নিজের নাম সংযোজন করেছেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজেও অর্জনের ভারে সমৃদ্ধ হয়েছে বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ার।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্টে ২০০ উইকেট পেয়েছেন সাকিব। চট্টগ্রাম টেস্টের আগেও তার উইকেট সংখ্যা ছিল ১৯৬টি। ক্যারিবিয়ানদের দ্বিতীয় ইনিংসে কাইরেন পাওয়েলকে স্ট্যাম্পড করে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
বোলিংয়ের এই অর্জন সাকিবকে নিয়ে গেছে আরও বড় মঞ্চে। টেস্টে ৩ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের মালিকদের ক্লাবে ১৪তম সদস্য হন এই বাংলাদেশি। তবে সবচেয়ে কম টেস্ট খেলে এই অভিজাত ক্লাবে পৌঁছে গেছেন ৩১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। গত ২৪ নভেম্বর ছিল ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথামের জন্মদিন, এবং সাকিবের রেকর্ড গড়ার দিন। জন্মদিনেই বোথামকে ছাড়িয়ে যান তিনি। ৫৪ টেস্টে সাকিব ৩ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের কীর্তি গড়লেন, যার জন্য বোথামের লেগেছিল ৫৫ টেস্ট।
চট্টগ্রাম টেস্টে ৩৫ রান, ৫ উইকেট। মিরপুর টেস্টে ৮০ রান, চার উইকেট। ধারাবাহিক এই পারফরম্যান্সেই ক্যারিয়ারে ‘অন্যরকম’ এক হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে ফেলেছেন সাকিব। বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে হয়েছেন সিরিজসেরা ক্রিকেটার, বাংলাদেশও ক্যারিবিয়ানদের ধবলধোলাই করে সিরিজটা জিতেছে ২-০ তে।
নিজেদের ইতিহাসে তিনবার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। কাকতালীয় হলেও সত্যি, তিনবারই সিরিজসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব!
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০ তে হারায় বাংলাদেশ। সেটিই ছিল প্রতিপক্ষকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের ইতিহাস। সেখানেও সিরিজ সেরা ছিলেন অধিনায়ক সাকিব। ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়েকে তিন ম্যাচের সিরিজে ৩-০ তে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ। ওই সিরিজেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠেছিলো বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারের হাতে। ২০১৮ সালেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাতেই ক্যারিয়ারে অন্যরকম এক হ্যাটট্রিক পূর্ণ করলেন সাকিব। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো ফরম্যাটেই বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক নেই বাঁহাতি এই স্পিনারের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, ২০০৯ সাল
মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেল বাংলাদেশ। বোর্ডের সঙ্গে সিনিয়র ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খর্বশক্তির একটি দল নামিয়ে দিলো ক্যারিবিয়ানরা। সেন্ট ভিনসেন্টে ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে বোলিং করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েন মাশরাফি, নেতৃত্বের ভার চলে আসে সাকিবের উপর। ওই টেস্টে মাশরাফি ব্যাটিং করলেও আর বোলিং করতে পারেননি। জয় আসে ৯৫ রানে। ব্যাটিংয়ে ৪৭, বোলিংয়ে ৫ উইকেট নেন সাকিব।
গ্রেনাডায় দ্বিতীয় টেস্টে আর ছিলেন না মাশরাফি, অধিনায়ক ছিলেন সাকিবই। বাংলাদেশ চার উইকেটের জয়ে উইন্ডিজদের ধবল ধোলাই করেছিলো। ছক্কা মেরে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন ৯৬ রানে অপরাজিত থাকা বাংলাদেশ অধিনায়ক। বোলিংয়ে ৮ উইকেট, ব্যাটিংয়ে ১১২ রান করে ম্যাচ সেরাও হয়েছিলেন। সিরিজসেরার পুরস্কারটাও হাতছাড়া হয়নি। বলা বাহুল্য, ওই সফরে ওয়ানডেতেও সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন এই বাংলাদেশি।
গত রোববার মিরপুরে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাকিবকে ২০০৯ সালে ছক্কা মেরে জয় নিশ্চিত করার স্মৃতি মনে করতে বলেছিলেন এক সিনিয়র সাংবাদিক। নয় বছর আগের সেই সময়কে তিনি বলেছেন, নতুন কিছুর শুরুর মঞ্চ।
সাকিব বলেছেন,
‘ওটা ছিল আমাদের কোন কিছুর শুরু, আর এটা আমাদের উন্নতির যে ধারা আছে সেটা যে অব্যাহত আছে তার রূপ। এই অর্জনটা অনেক বড়। এর বেশ কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, আমরা কাউকে ফলোঅনে ফেলতে পারলাম। যেকোনো দেশের সাথেই যেকোনো অবস্থায় জয়টা অনেক বড় ব্যাপার। তারপরও আমাদের ওপরের র্যাংকিংয়ের কোনো দেশের সাথে এমন রেজাল্ট করি নাই, সেই দিক থেকে এটা অনেক বেশি স্পেশাল। সেখানে যখন শুরুটা করেছি, ওই সিরিজটি আমাদের ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট ছিল। প্লাস আমরা যখন নিউজিল্যান্ডের সাথে হোয়াইটওয়াশ (২০১০ সাল, ওয়ানডেতে) করি প্রথমবারের মতো, আমাদের উন্নতির যে ধারা, আমাদের বিশ্বাস তৈরি হওয়ার জন্য বড় ভিত তৈরি করে দিয়েছে এই দুইটা সিরিজ।’
জিম্বাবুয়ে সিরিজ, ২০১৪ সাল
মিরপুর স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে হারিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে। সাকিবের অবদান ছিল ব্যাটিংয়ে ২০ রান, বোলিংয়ে ৭ উইকেট । খুলনায় দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ জিতেছিল ১৬২ রানে। সেখানে ব্যাটে বলে দুর্বার সাকিব, ম্যাচসেরাও হয়েছিলেন। প্রথম ইনিংসে ১৩৭ রানের পর ৮০ রানে ৫ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ রান এবং বোলিংয়ে ৪৪ রানে ৫ উইকেট। দুর্দমনীয় অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। চট্টগ্রামে তৃতীয় টেস্টে ১৮৬ রানে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ; দুই ইনিংসে ৮৮ রান এবং ১ উইকেট পেয়েছিলেন সাকিব। তিন ম্যাচে ২৫১ রান ও ১৮ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরা হন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ, ২০১৮ সাল
হাফ ফিট থাকা সত্ত্বেও সিরিজটা খেলতে নেমে গিয়েছিলেন সাকিব। নিয়মিত অধিনায়ক বলে নেতৃত্বের ব্যাটনও তার হাতেই ছিল। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছিলো ৬৪ রানে। ম্যাচে ৩৫ রান এবং ৫ উইকেট ছিল সাকিবের অবদান। মিরপুরে বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক জয়; ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারায় ক্যারিবিয়ানদের, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার ইনিংসে জয়ের রেকর্ড। ৩৮ বার ইনিংসে হারা বাংলাদেশ প্রবেশ করলো নতুন যুগে। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে গুরুত্বপূর্ণ ৮০ রানের ইনিংস খেলেন সাকিব, বল হাতে নিলেন চার উইকেট। সিরিজসেরা হয়ে পূর্ণ করলেন ‘অন্যরকম’ এই হ্যাটট্রিক।
অথচ এই সিরিজে তার খেলা নিয়ে সংশয় ছিল অনেক। বিশেষ করে প্রথম টেস্টে গত রোববার ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক সাকিবও জানালেন তেমন তথ্য। তিনি বলেছেন,
‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম টেস্টটা আমি খেলতে চাই নি। একমাত্র কোচের কারণেই খেলাটা হয়েছে। আমি কখনোই খেলতাম না। আমাকে যতবার বলেছে, আমি বলেছি আমি পারবো না। কারণ আমার ঐ বিশ্বাসই ছিল না। আপনারা যদি আমার বোলিং দেখেন, আমি তিন-চার ওভারের স্পেল করেছি। কারণ আমার শরীরের অবস্থাই ওইরকম ছিল না। কিন্তু ও যেটা বলেছে যে, তুমি ম্যাচ খেলেই ফিট হতে পারবা। আমার মনে হয় আমি একমাত্র খেলোয়াড়, ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটে যে ম্যাচ খেলে ফিট হই। তবে একটা জিনিস ভালো যে, আমি ছোট ছোট কন্ট্রিবিউশন করতে পেরেছি, স্পেশালি নতুন বলে ব্রেক-থ্রু’গুলো আমার কাছে মনে হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অবশ্যই সবাই ভালো বোলিং করেছে, তবে ওই কন্ট্রিবিউশনগুলো আমি মনে করি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সিরিজে জেতার পেছনে।’
ক্যারিয়ারে মোট ৫ বার সিরিজসেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন সাকিব। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে এটাই যে সর্বোচ্চ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাকি ক্রিকেটদুনিয়ার হিসেবেও কিন্তু সাকিবের এই অর্জন খুব পিছিয়ে নেই। টেস্টে সর্বোচ্চ ১১ বার সিরিজ সেরা হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান গ্রেট মুরালিধরন।
বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক অবশ্য একটা জায়গায় এখন শীর্ষেই আছেন। কারণ বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার সিরিজসেরা হয়েছেন সাকিবই। তবে সেখানে তার সঙ্গী হিসেবে আছেন জেমস অ্যান্ডারসন, ইংলিশ এই পেসারও ৫ বার সিরিজসেরা হয়েছিলেন। চারবার সিরিজসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন পাকিস্তানের লেগ স্পিনার ইয়াসির শাহও। তিনবার করে এই অর্জন রয়েছে স্টিভ স্মিথ, বিরাট কোহলি, ভারনন ফিল্যান্ডার ও হাশিম আমলার।