ইংরেজিতে দু’টো প্রবাদ খুব জনপ্রিয় — ‘Morning shows the day’ এবং ‘All’s well that ends well’। কিন্তু স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে দু’টোর কোনোটিই খাটে না। টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১৮ ও ১ দিয়ে, শেষটা তো করলেন শূন্য দিয়েই। অথচ এর মাঝে ব্যাট হাতে যা করেছেন, তাতে সমগ্র ক্রিকেটবিশ্ব মেনে নিয়েছে তার একচ্ছত্র শ্রেষ্ঠত্ব। ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেটে চলে যাওয়ায় কি না দীর্ঘ ২০ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে অজি এই কিংবদন্তি সর্বসাকুল্যে খেললেন ৫২ টেস্ট!
তবে এই ৫২ টেস্টের ৮০ ইনিংসে স্যার ডনের উইলো থেকে ছুটেছে রানের বন্যা। ৯৯.৯৪ গড়ে ২৯ শতকের সাহায্যে করেছেন ৬৯৯৬ রান। তার ৯৯.৯৪ গড় যেকোনো খেলায়, যেকোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে একটা অনন্যসাধারণ কীর্তি।
চলুন দেখে নেয়া যাক সংখ্যায় সংখ্যায় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বর্ণাঢ্য টেস্ট ক্যারিয়ার।
৯৯.৯৪
টেস্ট ক্যারিয়ারটা শেষ করেছিলেন ১০০ ছুঁইছুঁই গড় নিয়ে। শেষ ইনিংসে মাত্র চার রান করলেই যেখানে গড় একশ’ স্পর্শ করত, সেখানে ‘ডাক’ই মেরে বসলেন স্যার ডন। তাতে কী, সর্বোচ্চ টেস্ট গড়ের তালিকায় ডনের ধারেকাছেই যে নেই কেউ! ন্যূনতম ২০০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটারদের তালিকা করলে ৬১.৮ গড় নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে নামটা আসে ব্র্যাডম্যানেরই উত্তরসূরি স্টিভেন স্মিথের। অর্থাৎ, স্মিথের চাইতে ব্র্যাডম্যানের টেস্ট গড় প্রায় ৬১.৭ শতাংশ বেশি। তার এই ব্যাটিং গড়কে কেন অনতিক্রম্য ধরা হয়, তা এই একটি পরিসংখ্যান থেকেই বোধগম্য হয়।
৯৫.১৪
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ গড়ধারী ব্যাটারের নাম স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ২৩৪ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে তার সংগ্রহ ৯৫.১৪ গড়ে ২৮০৬৭ রান। ৫০ রান পেরিয়েছেন ১৮৬ বার, যার ১১৭ বারই ছুঁয়েছেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কমপক্ষে ৫০ ইনিংস ব্যাট করেছেন এমন ব্যাটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় ভারতের বিজয় মার্চেন্টের (৭১.৬৪)।
১২
মাত্র ৫২ টেস্ট আর ৮০ ইনিংসের ক্যারিয়ারে ২৯ বার শতক করার কীর্তি রয়েছে স্যার ডনের। তবে শতককে দ্বিশতক বানাতেও জুড়ি ছিল না এই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের। ক্যারিয়ারে দুইশ পেরিয়েছেন ১২ বার, যে রেকর্ডটা এখনো রয়েছে অক্ষত। কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন লঙ্কান গ্রেট কুমার সাঙ্গাকারা, তবে ১১টি দ্বিশতক হাঁকাতে তিনি খেলেছেন ২৩৩ ইনিংস — সংখ্যার হিসেবে যা ব্র্যাডম্যানের প্রায় তিনগুণ।
৬৯.০৫
টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডনের কনভার্শন রেট অবিশ্বাস্য — প্রায় ৬৯.০৫%। অর্থাৎ ৪২ বার খেলা পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের ৬৯.০৫ শতাংশকেই তিনি রূপান্তর করেছেন শতকে। তাই ৫২ টেস্টের ক্যারিয়ারে ২৯ শতকের বিপরীতে অর্ধশতক কেবল ১৩টি। টেস্ট ক্রিকেটে ৫,০০০ বা তার বেশি রান করেছেন, এমন ব্যাটারদের মধ্যে ব্র্যাডম্যানের পর সবচেয়ে ভালো কনভার্শন রেট ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলির (৫১.৯২%)। টেস্টে ৫২টি পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংসের ২৭টিকেই শতকে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছেন কোহলি।
৬
টানা ছয় টেস্ট ম্যাচে শতরান করা প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেইড ওভালে দুটো দ্বিশতক দিয়ে শুরু, পরের মাসে মেলবোর্নে ফিরে ১৬৯। পরের বছর ট্রেন্টব্রিজ, লর্ডস আর হেডিংলিতে টানা তিন শতক — যার দুটোতেই আবার ছিলেন অপরাজিত। টানা ছয় টেস্টে শতক হাঁকানোর কীর্তি না থাকলেও টানা পাঁচ টেস্টে শতক আছে দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফ ও ভারতের গৌতম গম্ভীরের।
৫,০২৮
একটি নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বাধিক টেস্ট রানের রেকর্ড স্যার ডনের। ক্যারিয়ারের ৫২ টেস্টের ৩৭টিই খেলেছেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, রান করেছেন ১৯ সেঞ্চুরি ও ১২ ফিফটিতে ৫,০২৮। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তো বটেই, যেকোনো নির্দিষ্ট দলের বিপক্ষে ৫০০০ এর অধিক রান করা একমাত্র ব্যাটার ব্র্যাডম্যান। যদিও এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্যার জ্যাক হবস (অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) ৪,০০০ রানও করতে পারেননি। অজিদের বিপক্ষে ৫৪.২৬ গড়ে ১২ শতকের সাহায্যে ৩,৬৩৬ রান করেছিলেন এই ইংরেজ কিংবদন্তি।
৪৫২
অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে যেকোনো উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের অংশীদার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্য ওভালে ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে বিল পন্সফোর্ডের সাথে ৪৫২ রান যোগ করেন স্যার ডন। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার হয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ উইকেটেও সর্বোচ্চ জুটিতে নাম রয়েছে ব্র্যাডম্যানের। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৪৬ সালে পঞ্চম উইকেটে ৪০৫ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন ব্র্যাডম্যান ও সিড বার্নস। ষষ্ঠ উইকেট জুটির রেকর্ডটাও ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই, ১৯৩৭ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ৩৪৬ রানের জুটিতে ব্র্যাডম্যানের সঙ্গী ছিলেন জ্যাক ফিঙ্গলটন।
২৪.৯৭
ডন ব্র্যাডম্যানের খেলা ৫২ টেস্টে সব মিলিয়ে ২৮,০২২ রান করেছে অস্ট্রেলিয়া, যার ৬,৯৯৬ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। অর্থাৎ, দলের প্রায় ২৪.৯৭% রানে অবদান রেখেছেন ব্র্যাডম্যান। ন্যূনতম ২০ টেস্ট খেলেছেন, এমন ব্যাটারদের মধ্যে দলীয় রানে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন ব্র্যাডম্যানই। তালিকায় তার পরই আছেন ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ হিসেবে পরিচিত ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি জর্জ হেডলি। ২২ টেস্টের ক্যারিয়ারে দলের সংগ্রহে তার অবদান ২১.৬১%। হেডলির পরের নামটা তারই স্বদেশি ব্রায়ান লারার, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহে লারার অবদান ১৮.৯৬।
৯৭৪
কোনো একটি টেস্ট সিরিজে সর্বাধিক রানের কীর্তিও স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। ১৯৩০ সালের অ্যাশেজে ৫ ম্যাচে ৭ ইনিংসে ১৩৯.১৪ গড়ে ৯৭৪ রান সংগ্রহ করেন তিনি। ৭ ইনিংসের চারটিই ছিল শতরানের ইনিংস, ক্যারিয়ারসেরা ৩৩৪-ও ছিল এই সিরিজেই। কোনো টেস্ট সিরিজে ৯০০ রান করেছেন ব্র্যাডম্যান ছাড়া শুধু একজনই — ১৯২৮-২৯ অ্যাশেজে ৫ ম্যাচে ৯ ইনিংসে ৯০৫ রান করেছিলেন ওয়ালি হ্যামন্ড।
১০৮.৫৩
দল যখনই বিপদে, তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। দলের স্কোরবোর্ডে রান ১০-এর কম থাকাবস্থায় ক্রিজে এসেছেন, এমন টেস্ট ম্যাচগুলোতে এই অজি কিংবদন্তির গড় চোখ কপালে তোলার মতো — ১০৮.৫৩!
৬
ব্যাট হাতে রানের বন্যা বইয়ে দিলেও ছক্কা মারতে কিছুটা কৃপণই ছিলেন স্যার ডন। ক্যারিয়ারে ৬১৮টা চার হাঁকালেও ব্র্যাডম্যানের উইলো থেকে এসেছিল কেবল ৬টি ছক্কা, যার ৫টিই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, একটি ভারতের বিরুদ্ধে।
৫৮.২০
৩৩৮টি প্রথম শ্রেণির ইনিংস খেলে ব্র্যাডম্যানের শতক সংখ্যা ছিল ১১৭। অর্থাৎ, ২২১ ইনিংসে তিনি সেঞ্চুরি করেননি। সেই ২২১ ইনিংসে তার গড় ছিল ৫৮.২০। অথচ ৫৮.২০ গড়ধারী যেকোনো ব্যাটারকেই সমীহ করে খেলবে যেকোনো দল। ডন ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং ক্যারিশমার একটা অনন্য দৃষ্টান্ত এই পরিসংখ্যান।
৭
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান এক পঞ্জিকাবর্ষে ১০০-এর বেশি ব্যাটিং গড় অর্জন করেছেন সাতবার। এর মাঝে ১৯৩২ সালে তার গড় ছিল চোখ ধাঁধাঁনো — ৪০২! সে বছর খেলা তিন ইনিংসের একটিতে আবার করেছিলেন শূন্য। বাকি দুই ইনিংসের কোনোটিতেই আউট হননি, একটিতে তো অপরাজিতই ছিলেন ২৯৯ রানে।