
দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে সাধারণত একজন খেলোয়াড়ের কথাগুলোই হুবহু তুলে দেওয়া হয়, সেখানে প্রশ্নোত্তরের কোনো ব্যাপার থাকে না। এই প্রতিষ্ঠানটি এবার কিছুটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছিলো, বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় স্টিফেন কারি ও ফুটবলার নেইমারকে নিয়ে একটি প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন করেছিলো দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন। দুটি ভিন্ন খেলার মানুষের জীবন যুদ্ধের মিল-অমিল কিংবা তাদের জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় দিক ফুটে উঠেছিলো সেখানে। পাঠকদের জন্য সেই কথোপকথন বাংলায় তুলে ধরা হলো এখানে।
প্রতিবেদক: এই নির্দিষ্ট খেলাটাকেই জীবনের মূল অবলম্বন হিসেবে বেছে নিতে হবে- শৈশবের ঠিক কোন সময়ে আপনারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন?
স্টিফেন কারি: আমার ছোটবেলা কেটেছিলো নর্থ ক্যারোলাইনায়। তখন আমার বয়স ছিল ছয় বছর, রেক লিগের একটি ম্যাচ খেলছিলাম। দর্শকসারিতে খুব সম্ভবত ১৫ জন মানুষ ছিল। খেলার একপর্যায়ে টু-অন-ওয়ান ফাস্ট ব্রেকে আমি বল পেয়ে যাই এবং রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা সেসময়ে আমাকে ঘিরে ধরে। অন্যসময় হলে পাশে যে আছে তাকেই হয়তো বলটা বাড়িয়ে দিতাম, কিন্তু সেদিন আমি তা না করে কিছুটা লাফিয়ে উঠে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি মোড় নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার সতীর্থের দিকে বলটা বাড়িয়ে দিলাম।

এই দৃশ্য দেখে দর্শকসারিতে থাকা ১৫ জন মানুষই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। ঠিক সেই সময়েই আমি বুঝতে পারি, এই খেলাটার মাধ্যমেই আমি সৃজনশীল কিছু করতে পারবো। সেদিন থেকেই আমার জীবনের সবকিছু এই বাস্কেটবলের সাথে জড়িয়ে গেলো। নেইমার, তুমি কীভাবে ফুটবলের সাথে জড়িয়ে গেলে?
নেইমার: আমার জীবনে এরকম দুটি মুহূর্ত আছে। আমার যখন তিন বছর বয়স তখন মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো যে আমি কী উপহার চাই, আমি দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে একটা ফুটবল বেছে নিয়েছিলাম। পরের মুহূর্তটি আসে যখন আমার বয়স ছয় অথবা সাত বছর, সেবার সান্তোস একটি শিরোপা জেতার পর আমি আর বাবা খুব উল্লাস করছিলাম। হঠাৎ দেখি খুব দামী একটি গাড়িতে চড়ে সান্তোসের খেলোয়াড়েরা আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি তাদের দিকে হাত নাড়ালাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও একদিন তাদের মতো হবো।
কারি: মজার ব্যাপার হচ্ছে, তুমি অন্যদের খেলতে দেখে উৎসাহিত হয়েছো, কিন্তু আমার জন্য ব্যাপারটি ছিল অন্যরকম, আমার বাবা নিজেই এনবিএতে খেলতো…
নেইমার: তোমার বাবাও একজন খেলোয়াড় ছিলেন! আমার বাবাও তো ফুটবল খেলতেন।
কারি: তবে তোমার বাবা ফুটবলার ছিল বলে তোমাকেও তা হতে হবে এরকম চাপ তোমার উপর ছিল না, তুমি নিজেই খেলাটার মাঝে আগ্রহ খুঁজে নিয়েছো। কিন্তু আমার কাছে বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিলো।
প্রতিবেদক: বাবাদের নিয়েই যখন কথা হচ্ছে, যদি আজকের এই সাক্ষাৎকারে আপনাদের বদলে আপনাদের বাবারা থাকতেন তবে তারা আপনাদের ব্যাপারে ঠিক কোন গল্পটা এখানে বলতেন?
কারি: কলেজে পড়াকালীন এক NCAA টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে বড় একটি শট নিয়ে আমার স্কুলকে সেই ম্যাচ জিততে সাহায্য করেছিলাম। শটটা নিয়েই আমি বাবার দিকে তাকিয়ে তাকেই সেটা উৎসর্গ করেছিলাম। বাবার কারণেই বাস্কেটবল আমাদের পরিবারের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলো তাই আমার প্রতিটি সাফল্যে সবচেয়ে খুশি হতেন আমার বাবা। সেই মানুষটাকে যখন কিছু উৎসর্গ করতে পেরেছিলাম, সেটার অনুভূতি আসলেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় বাবা এখানে থাকলে এই গল্পটাই বলতো।
নেইমার: আমার ক্ষেত্রেও বাবার অবদান অনেক বেশি, ছোটবেলায় অনুশীলনের সময়ে বাবা প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে শিখিয়ে দিতো। মাঠে কখনো কোনো ভুল কিছু করলে সাথে সাথে বাবা বাঁশি বাজিয়ে আমাকে সতর্ক করে দিতো। এই বাঁশি বাজিয়ে আমাকে সতর্ক করার গল্পটাই হয়তো বাবা এখানে বলতো।

প্রতিবেদক: এনবিএ ফাইনালস কিংবা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল- বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি টুর্নামেন্টের ফাইনালেই খেলোয়াড় এবং দর্শক- দুই ভূমিকাতেই থাকার সুযোগ আপনারা পেয়েছেন। দর্শক হিসেবে একটি ফাইনাল উপভোগ করা নাকি খেলোয়াড় হিসেবে সেই আসরের ফাইনাল ম্যাচ খেলা- কোনটা আপনাদের কাছে বেশি কঠিন বলে মনে হয়েছে?
কারি: দেখুন ফাইনাল ম্যাচ হোক কিংবা অন্য সাধারণ ম্যাচ, অনুশীলনে কিন্তু তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য আছে শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে। ফাইনালের আগে আশেপাশের সবাই অনেক বেশি চিন্তায় থাকে, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের এত কাছাকাছি আসার পর একটু চিন্তিত থাকাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তবে আশেপাশে যতই মাতামাতি হোক, সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকাটাই সেই সময়েই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। নিজের লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র সরে গেলে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাবে।
নেইমার: আমি কিন্তু আমার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের চেয়ে টিভিতে তোমার এনবিএ ফাইনালস দেখার সময়েই বেশি ভয়ে ছিলাম। আমার কাছে মাঠে খেলাটাই বরং তুলনামূলক সহজ কাজ বলে মনে হয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল বলে সবার প্রত্যাশার পারদই অনেক উঁচুতে থাকে, কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর সেসব নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ থাকে না। মাঠের কাজটা তো সব ম্যাচেই এক, তাই তখন আলাদা কিছু আর মনে হয় না। কিন্তু এনবিএ ফাইনালস দেখার চাপটা অন্যরকম, আমি তোমাকে এবং তোমার দল ওয়ারিয়র্সকে খুব পছন্দ করি। আমার দুর্ভাগ্যের জন্যই বুঝি তোমরা হেরে গেলে- খেলা দেখার সময়ে এই ভয়টা খুব বেশি কাজ করে।
কারি: আমার বাবা যখন আমার খেলা দেখেন তখন তিনিও এই ভয়ে থাকেন।
নেইমার: সেই ভয় আমার বাবার মনেও কাজ করে।
প্রতিবেদক: আপনারা নিজেরাও বাবা হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন, নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে কিছু বলুন।
কারি: বাচ্চাদের নিয়ে তো অজস্র গল্প আছে, তবে আমার বড় মেয়ে রিলের একটা গল্প আলাদাভাবে বলতে হয়। যখন আমি সাধারণ পোষাকে থাকি তখন সে আমাকে বাবা বলেই ডাকে। কিন্তু যখন আমি ওয়ারিয়র্সের জার্সি পরি, তখন সে আমাকে স্টিফেন কারি কিংবা নাম্বার থার্টি বলে ডাকে! মানে বাবা ও খেলোয়াড়- আমার এই দুটো সত্ত্বাকে সে নিজের মতো আলাদা করে নিয়েছে।
নেইমার: স্কুলে থাকাকালীন আমার ছেলে ডেভি লুকা টেলিভিশনের একটি বিজ্ঞাপনে আমাকে দেখতে পায়। সেটা দেখে লুকা তার বন্ধুদের বলে, “বিজ্ঞাপনের এই লোকটাই আমার বাবা।” কিন্তু তার বন্ধুরা সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তর্ক-বিতর্ক এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, শেষপর্যন্ত তাদেরকে টিচার্স রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তার বাবা এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলো না বলে সেদিন ডেভি বেশ কষ্ট পেয়েছিলো।

প্রতিবেদক: ল্যাব্রন, ড্যুরান্ট, মেসি, রোনালদো- এমন সব জীবন্ত কিংবদন্তীদের সাথে খেলার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
কারি: এমন মহান খেলোয়াড়দের সাথে খেলার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে নিজের খেলায় আরো উন্নতি করার চাপটা আপনাআপনিই চলে আসে। লেব্রনের সাথে প্রথমবার খেলার পর মনে হয়েছিলো যেভাবেই হোক আমাকে এমন একজন বড় খেলোয়াড় হতেই হবে। এরকম খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেললে হয়তো আপনার দুর্বলতাটা সবার সামনে চলে আসতে পারে, কিন্তু সেটাই আপনাকে বড় হওয়ার পথ তৈরি করে দিবে।
নেইমার: মেসি আর রোনালদো- দুজনকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছি আবার বার্সেলোনায় মেসিকে সতীর্থ হিসেবেও পেয়েছি। মেসি তো আমার আদর্শ ছিলেন, অনুশীলন কিংবা খেলার মাঠ- দু’জায়গাতেই তার মতো মহান খেলোয়াড়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তো দানব, তার মুখোমুখি হওয়াটা সবসময়ই আলাদা চাপের ছিল, তবে সেখানেও অনেক কিছু শেখার ছিল।

প্রতিবেদক: ধরা যাক, আমরা আপনাদের জীবন নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনাদের জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে এমন কোন দৃশ্য আপনারা সেই সিনেমায় রাখতে চাইবেন?
কারি: ২০১২ সালের গ্রীষ্মের ঘটনা এটা, আমার পায়ে দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী বাড়িতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমি সবসময়ই আশাবাদী একজন মানুষ, জীবনের সবকিছুতেই সবসময় ভালো দিকটা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই সময়ে হুট করে খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো এই দুঃখের দিন বুঝি আর কখনোই শেষ হবে না। তখন আমার স্ত্রী বলে উঠলো, “তুমি কে এটা তুমি ভুলে যেও না।” এই একটা কথা আমার আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলো! দু-তিন বছর পর আমি আবার কোর্টে ফিরলাম এবং আবারো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলাম। সেদিনের সেই মুহূর্তটাই হয়তো এরকম প্রত্যাবর্তনে বড় অবদান রেখেছিলো।
নেইমার : আমার জীবনে এরকম দুটো মুহূর্ত আছে। প্রথম ঘটনাটা ২০১৪ বিশ্বকাপের, আমার আজীবনের স্বপ্ন ছিল ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলার। সেই স্বপ্নে থাকার সময়েই হুট করে ইনজুরিতে পড়ে গেলাম। তখন মনে হচ্ছিলো সবকিছু বুঝি শেষ হয়ে গেছে, আমি আর কোনোদিন মাঠে ফিরতে পারবো না। সেই কঠিন সময়ে আমার পরিবার আমাকে নানাভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে ফিরে আসার পথটা সহজ করে দিয়েছে।

পরের মুহূর্তটা এই বছরের, অস্ত্রোপচারের পর বিশ্বকাপটা খেলতে পারবো কি না এ ব্যাপারে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সেসময়েও আমার পরিবার, বান্ধবী ও বন্ধুরা আমাকে সাহস দিয়ে গেছে। এই দুটো মুহূর্তই আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের অনুপ্রেরণাই আমাকে আবার স্বপ্ন দেখার সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
প্রতিবেদক: এটাই শেষ প্রশ্ন, আপনাদের লকার রুমে সবচেয়ে মজাদার মানুষ কে?
কারি: আমাদের ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে মজাদার মানুষ ক্লে থম্পসন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে নিজে হয়তো এই ব্যাপারটা জানে না! থম্পসন এমন একজন মানুষ যে সবকিছুতেই দেরি করবে। সে অনুশীলনেও দেরি করে আসে, একবার তো ম্যাচের আগে অনুশীলনেও আসেনি! কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই ম্যাচেই সে মাত্র তিন কোয়ার্টারে ৬০ পয়েন্ট স্কোর করেছিলো! এরকম একজন বিচিত্র মানুষ লকার রুমে থাকলে মজার ঘটনা এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়।
নেইমার: সবচেয়ে মজার মানুষ দানি আলভেজ, মানুষ হিসেবেও সে অসাধারণ। ড্রেসিংরুমে সে সবসময় নানা ধরনের দুষ্টুমি করতেই থাকে, সবাইকে সে আলাদা আলাদা ডাকনাম দিয়ে সেই ডাকনাম ধরেই ডাকবে। তার মজার গল্পের ঝুলি যেন অফুরন্ত। তবে সে যখন ইনস্টাগ্রামে গান গাওয়ার ভিডিও পোস্ট করে তখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই।