মায়াঙ্ক আগারওয়ালকে ক্রিকেট-পাগল বললেও একটু কম বলা হয়।
মেলবোর্ন থেকে ১৪ ঘন্টার বিমানযাত্রা শেষ করে ব্যাঙ্গালুরু পৌঁছালেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে দেখা গেলো একটা কফির দোকানে। সেখানে তিনি নিজের ব্যক্তিগত কোচ আর মুরালিধরনের সাথে আলাপ করছিলেন, এই সফরে কী ঠিক করেছেন আর কী ভুল করেছেন, তাই নিয়ে!
ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে, কাজ করতে এবং ক্রিকেট খেলতে যেন এতটুকু ক্লান্তি নেই তার।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে একদিন ছুটি কাটিয়েছেন। তার মধ্যেও পরিবারের পাশে থাকার পাশাপাশি ছুটেছেন কোচের পেছনে। এরপরই যোগ দিয়েছেন কর্ণাটক দলে। সেখানে দলের সাথে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন।
কর্ণাটক দলের অনেকে তাকে ‘মনকি’ বলে ডাকেন। আগারওয়াল মানলেন যে, এই বন্ধুরা তার কাছে একটা পার্টি পাওনা হয়ে আছেন। টেস্ট দলে খেলে ফেলার উপলক্ষে এই পার্টিটা হবে। কিন্তু আগারওয়াল সেটা এখনই দিতে রাজি হচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, কর্ণাটক রঞ্জি জিতলে তারপর একবারে পার্টিটা হবে।
আপাতত তাই পার্টি নয়, আগারওয়ালের চিন্তা জুড়ে কেবলই ক্রিকেট; এবার রঞ্জি ক্রিকেট।
ক্রিকেটপাগল এই তরুণ এখন ভারতীয় ক্রিকেটেরই আলোচ্য বিষয়। শুরুতে অস্ট্রেলিয়াগামী ভারতীয় দলের অংশ ছিলেন না। একটু বরং হতাশায়ই ভুগছিলেন। পুরো মৌসুমে দুই হাজারের ওপর রান করেও ভারতের কোনো দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আরেক তরুন ওপেনার পৃথ্বি শ’র ইনজুরিতে হঠাৎ ভাগ্য খুললো তার, ডাক পেয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় খেলার জন্য।
সে সময় নির্বাচকদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। একটা ছেলে, যার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুতি নেই, তিনি কী করে ওরকম ভয়ঙ্কর একটা সফরে দলের অংশ হবেন?
আগারওয়াল বুঝিয়ে দিলেন, তার প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি ছিলো না। এবার ভারতের ঐতিহাসিক সফরে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি দলের। মেলবোর্নে দুই ইনিংসে করলেন ৭৬ ও ৪২ রান। সিডনিতে খেললেন ৭২ রানের এক ইনিংস। ভারতের ইনিংস সূচনাটা প্রায় একা হাতেই সামলালেন।
এই সময়ই তৈরি হলো আগারওয়ালকে নিয়ে নতুন আগ্রহ… কে এই তরুণ মায়াঙ্ক আগারওয়াল?
আগারওয়াল ভারতীয় ক্রিকেটের বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের কাঠামো ধরে উঠে আসা এক তরুণ ব্যাটসম্যান। সেই অনূর্ধ্ব-১৩ দলে থাকা অবস্থা থেকে মোটামুটি নজর কেড়ে ফেলেছিলেন তিনি। ব্যাঙ্গালোরের বিশপ কটন বয়েস স্কুলের এই ছাত্রটি শুরু থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দর শেবাগের মতো করে।
অনুর্ধ্ব-১৯ কুচবিহার ট্রফিতে ৫৪ গড়ে ৫ ম্যাচে ৪৩২ রান করে নিজের আগমনীটা জানান দিয়েছিলেন। এরপর ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া যুব দলের বিপক্ষে হোবার্টে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ১৬০ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১০ যুব বিশ্বকাপে ছিলেন সর্বোচ্চ স্কোরার। এরপর চলে এলেন ভারতীয় ‘এ’ দলে।
শুরুতে এখানে ধারাবাহিকতার অভাবে বেশ ভুগেছেন। সে সময় তাকে সীমিত ওভারের বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান বলে বিবেচনা করা হচ্ছিলো। কিন্তু ২০১৩-১৪ সালে রঞ্জি অভিষেকের পর থেকে নিজের নতুন পরিচয় তৈরি করলেন, হয়ে উঠলেন বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের এক উঠতি তারকা।
মূলত এই পরিচয়টা তৈরি হলো ২০১৪-১৫ মৌসুমে এসে। সে বছর মৌসুমের অর্ধেকটা সময় বেঞ্চেই কাটিয়েছিলেন। রাহুল দ্রাবিড় যেটাকে বলেছেন আগারওয়ালের জন্য ‘ওয়েক-আপ কল’। আর এখান থেকেই জেগে উঠে রানের বন্যা ছোটালেন এই কর্ণাটকি তরুণ, যার ফল হিসেবেই ‘এ’ দল হয়ে এখন ভারতীয় দলে তিনি।
আগারওয়াল যখন ভারতীয় দলে ডাক পেলেন, তখন অনেকে মনে করেছিলেন এই তাসমানিয়ান সফরের জন্য তিনি তৈরি নন। কিন্তু আসল সত্যিটা হলো, তিনি তখন মাত্রই ওই অঞ্চল থেকে, নিউজিল্যান্ড থেকে চার সপ্তাহের লম্বা একটা সফর শেষ করে এসেছেন। নিউজিল্যান্ডে ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে একগাদা ম্যাচ খেলে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছেন।
আগারওয়াল তখন চিন্তা করছিলেন, জাতীয় দলে ডাক আসতেও পারে। কিন্তু নিজেই বলছিলেন, সেই ডাক না আসা নিয়ে হতাশায় ভোগার সময়টাও ছিল না তার কাছে,
‘আমরা এই সময়ে অনেক খেলা খেলছিলাম। ফলে আমার তখন কোনো একটা জায়গায় চুপ করে বসে দলে সুযোগ না পাওয়ার জন্য হতাশ হওয়ার সময়টাই ছিল না। আমি তখন স্রেফ নিজের সামনের ম্যাচটা নিয়ে ভাবতে পারছিলাম। আমি ভাবছিলাম, যে ম্যাচটা সামনে আসবে, সেটাতে কী করে সেরাটা দেওয়া যায়। আমার মাথা সবসময় খুব পরিষ্কার ছিল। ক্লাব খেলা হোক, রঞ্জি ট্রফির খেলা হোক, আইপিএল খেলা হোক, আমি সবসময় একইরকমভাবে প্রস্তুতি নিই। একটা নির্দিষ্ট উপায় আমার জন্য কাজে লাগে। আর আমি সেটা বদলানোর কোনো কারণ দেখিনি।’
এই প্রস্তুতির উপায় না বদলানো নিয়ে আগারওয়াল ভালো সমর্থন পেয়েছেন জাতীয় দল থেকেও। বিশেষ করে কোচ রবি শাস্ত্রীর কথা বলছিলেন। কোচ তাকে বলেছেন, নিজের স্টাইল বদলানোর কোনো দরকার নেই।
এই তথ্য জানাতে গিয়ে আগারওয়াল বলছিলেন,
‘রবি (শাস্ত্রী) স্যার আমাকে এটাই বলেছেন। বক্সিং ডে টেস্টের দু’দিন আগে তিনি এ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, রঞ্জি ট্রফি স্তরে আমি যা করে সাফল্য পেয়েছি, সেটা বদলানোর কোনো কারণ দেখেন না তিনি। তিনি বলেছেন, ‘যাও, ওখানে গিয়ে তুমি যা করছিলেন, তাই করো।’ এই ধরণের কথা দ্রুত অনেক আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়, আর সবকিছু সহজ হয়ে যায়।’
জাতীয় দলে আগারওয়ালের শুরুটা সহজ হওয়ার আরেকটা কারণ ছিলেন লোকেশ রাহুল।
যদিও এই সফরে রাহুলের সময়টা ভালো যায়নি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে তার উপস্থিতি আগারওয়ালের সময়টা সহজ করে দিয়েছে। কারণ লোকেশ রাহুল তার অনেক পুরনো বন্ধু। এমনকি মায়াঙ্কের বিয়েতে ‘বেস্ট ম্যান’ও ছিলেন এই লোকেশ রাহুল। দু’জনের সম্পর্ক কমপক্ষে ১৫ বছর পুরোনো।
একটা বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্পে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো দু’জনের। তারপর থেকে তারা যেন ‘হরিহর আত্মা’ হয়ে উঠেছেন। ২০১০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দু’জন একসাথে ইনিংস শুরু করতেন। আগারওয়ালের যখন রঞ্জি অভিষেক হলো, অন্য প্রান্তে তখন এই লোকেশই ছিলেন। দু’জনই একসাথে আইপিএলেও ব্যাট করে থাকেন।
এর মধ্যে লোকেশ রাহুল জাতীয় দলে চলে এসেছেন। অবশেষে আগারওয়ালও এসে যোগ দিলেন বন্ধুর সাথে। কিন্তু শুরুটা হলো একটা ট্রাজেডি দিয়ে। সারাটা জীবন দুই বন্ধু পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিশিয়ে লড়াই করেছেন। সেই আগারওয়াল এসে মেলবোর্নে বন্ধুর বাদ পড়া জায়গায় জাতীয় দলে ঢুকলেন।
ব্যর্থতার ফল হিসেবে মেলবোর্ন টেস্টে জায়গা হলো না লোকেশ রাহুলের, আর সেই জায়গায় অভিষেক হলো আগারওয়ালের।
আগারওয়াল অবশ্য জানালেন, রাহুলের দিক থেকে এই বাদ পড়ার পরও সর্বোচ্চ সমর্থনও পেয়েছেন তিনি,
‘কোনো অর্থেই এটা ভূতুড়ে কিছু ছিল না। বরং ও ড্রেসিংরুমে ছিল বলে আমার কাজটা সহজ হয়েছে। এটা একটা পেশাদার খেলা। আর এখানে এক বন্ধুর বদলে আরেক বন্ধু দলে সুযোগ পেতেই পারে। ও বরং আমাকে অভিষেকের আগে শান্ত রাখছিলো। আমার কীসে ভালো হয়, সেটা খেয়াল করছিলো। ওর টেস্ট অভিষেকের স্মৃতি আমার সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছিলো। বলছিলো, এমসিজির ওই গুহার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন লাগে।’
আপাতত বন্ধুর সাথে এই স্তরে একসাথে খেলা হলো না। তবে পরের টেস্টেই সেই স্বপ্নপূরণ হয়ে গেলো, একসাথে ভারতের হয়ে ইনিংস শুরু করলেন দুই বন্ধু। উদ্বোধনী জুটিতে অবশ্য বড় রান হলো না। তবে এতদূর যখন এসেছেন, সেটাও নিশ্চয়ই হবে একদিন।