‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ নামটির এর সাথে পরিচয় ২০০২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল সবাইকে বিস্ময় উপহার দিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে নিয়ে যায়। তো, সেবার ব্রাজিলের সফলতা নিয়ে পত্রিকায় অনেক গল্প বলা হয়েছে। যে তথ্যটি বেশ নাড়া দেয়ার মতো ছিল সেটা হল ব্রাজিলের কোচ লুই ফিলিপ স্কলারির ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ নীতি ব্যবহার করা। ব্রাজিল দলটির রণকৌশল সাজানো এবং বিজয় ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে সান জু’র আর্ট অব ওয়ারের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা জানান স্কলারি। ২০০২ এর বিশ্বকাপে একজন সাধারণ ফুটবল বোদ্ধাও বিস্মিত না হয়ে পারবেন না যে কীভাবে প্লে অফ ম্যাচ খেলে বিশ্বকাপে খেলতে আসা দলটি ট্রফি নিয়ে যেতে পারে। দলটি তুরস্কের মতো এশিয়ার একটি দল বা তুলনামূলক দুর্বল দলের সাথে অনেক কষ্ট করে জিতেছে বা বলা যায় দ্য আর্ট অব ওয়ারের ‘প্রতারণার কৌশল’ মেনে হারিয়ে দিয়েছে। মনে রাখার বিষয় ওই ম্যাচটিতে তুরস্কের দুজন খেলোয়ার লাল কার্ড পেয়েছিলেন। ১০ নাম্বার জার্সিধারী প্লেয়ার রিভালদোর মত এত বড় তারকা খেলোয়াড়ও জেতার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। অবশ্য এখানে নীতিবাক্য দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
খেলা হচ্ছে পৃথিবীর আদিম যুদ্ধকলারই একটি শৈল্পিক রূপ। এখানে জেতার জন্যই সব আয়োজন। জিতলে সবাই বাহবা দিবে আর হারলে দুয়ো। কীভাবে জিতেছেন তা নিয়ে খুব কম লোকই প্রশ্ন করবে, জেতার আনন্দটাতে ভাগ বসাবে সবাই। ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপেই দেখুন না কীভাবে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ম্যারাডোনা হাত দিয়ে ইংল্যান্ডের জালে বল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড এখনো মাফ করতে পারে নি ম্যারাডোনার এই প্রতারণা বা কৌশলের কথা। ইংল্যান্ড মনে করে ম্যারাডোনার এই একটি গোলের কারণে তারা ছিটকে পড়ে যায় ম্যাচ থেকে। উল্লেখ্য এই ম্যাচটিতেই ম্যারাডোনা আরেকটি গোল করেন যা শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃত। সে যাই হোক, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ঘরে নিয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। যুদ্ধে জয়টা গুরুত্বপূর্ণ, খেলাতেও। প্রতারণা, ছলনা জেতার কৌশলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। হোক সেটা খেলার মাঠ বা যুদ্ধমাঠ।
তো ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইটির নামের সাথে পরিচয় হলো ২০০২ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। তখন থেকেই বইটি কিভাবে পড়া যায়, কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে নিয়ে প্রশ্ন বা আগ্রহ জাগত। মফস্বল ছেড়ে একদশক আগে যখন ঢাকায় আসলাম তখন সুযোগ হলো বইটি পড়ার। বইটি পড়ার পর এবং বইটি নিয়ে বিভিন্নজনের লেখা পড়ে জানতে পারলাম শুধু ২০০২ বিশ্বকাপ নয় এর আগের বারেও ব্রাজিলের ট্রফি জয়ের পেছনে রয়েছেন সান জু। ১৯৯৪ সালে কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার অসামান্য কোচিংয়ে প্রায় ২৪ বছর পর ফুটবল বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে ব্রাজিল। আলবার্তো পেরেইরা নিজের অনন্য কোচিং সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব দেন সান জু’কে। ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ বইয়ের কৌশলগুলো অনুসরণ করেই নাকি তিনি ব্রাজিলের শিরোপা অর্জন নিশ্চিত করেন।
আমরা যদি বিশ্বজুড়ে ফুটবল দলের ম্যানেজার ও কোচদের দিকে তাকাই দেখবো তাদের কৌশলের সাথে সান জুর অনেক মিল। ফুটবলে সান জু’র নীতি কিভাবে কাজে লাগানো যায় চলেন এটার দিকে একটু দৃষ্টি দেই:
‘নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে’
খেলাধূলাতে এটা হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ। নিজেদের সক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোন দলই বিজয়ী হতে পারে না। বড় দল হওয়ার সকল রসদ থাকা সত্ত্বেও অনেক দলকে দেখেছি গো-হারা হারতে। তার পেছনে কারণ ছিল আত্মবিশ্বাসের অভাব। ২০১৪ সালে জার্মানীর কাছে ব্রাজিলের গো-হারার পেছনে কারণ ছিল পুরো ব্রাজিল দলটি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল এবং চাপের মুখে তাসের ঘরের মতো সব পরিকল্পনা, সব রক্ষণ ভেঙ্গে পড়েছিলো। যেকোন খেলাতেই আত্মবিশ্বাস প্রাথমিক শর্ত।
সান জুর এই আত্মবিশ্বাসের বটিকা একটু ভিন্নতর ভাষায় পাবো ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত লিভারপুল দলের ক্রেস্টে। সেখানে লেখা ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক এলোন’ অর্থাৎ তুমি আর কখনো একা হাঁটবে না। এই দলটা অনেকবার প্রমাণ করেছে যে সান জুর কাছ থেকে জয়ী হওয়ার সঠিক ফর্মূলা পাওয়া যায়।
‘আপনার প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হলে আপনি হবেন অপরাজেয়, আর বিজয়ের সম্ভাবনা আক্রমণে’
বিশ্বে এমন কোন ফুটবল ম্যানেজার বা কোচ নেই যারা এই নীতিটা জানে না। আপনার টিমের ডিফেন্স বা প্রতিরক্ষা যদি শক্তিশালী হয় তাহলে আপনার দল কম গোল খাবে। আর আপনার টিম যদি আক্রমণে শক্তিশালী হয় তাহলে বেশি গোল দিতে পারবে। কিন্তু এই ডিফেন্স ও অ্যাটাকের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে থাকে ফুটবল দলগুলো। ফুটবলে আমরা অনেক সময় এমন দল দেখি যারা ডিফেন্সিভ খেলে থাকে। মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলে আক্রমণ শানায়। অনেক সময় ছোট দলগুলো শক্তিশালী দলের সাথে খেলার সময় পুরো শক্তি দিয়ে ডিফেন্স শক্তিশালী রাখে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী দল পুরো শক্তি নিয়ে একের পর এক আক্রমণ শানায়। এতে করে অনেক সময় শক্তিশালী দলের ডিফেন্স দুর্বল হয়ে যায়। এই সুযোগে গোল দিতে দেখা যায় আপাতত দুর্বল দলটিকে। তবে ডিফেন্সিভ খেলা দলগুলোকে ফুটবল সমর্থকরা পছন্দ করে না। ফুটবলের সৌন্দর্য তার আক্রমণে, গোলের বাহারে। তবে আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে আবার ডিফেন্স দুর্বল করা যাবে না। আধুনিক ফুটবলের আদর্শ দলগুলো এই ফর্মূলাই মেনে চলে।
‘যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শত্রুপক্ষের কৌশলকে আক্রমণ করা’
প্রত্যেক দলেরই নিজস্ব কৌশল থাকে। ফুটবলের সারবত্তা হলো বিপক্ষ দলের কৌশলকে লন্ডভন্ড করে দেওয়া। গত ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানি স্বাগতিক ব্রাজিলের বিরুদ্ধে এ কাজটাই করেছিল। ব্রাজিল নিজের খেলাটা খেলতেই পারছিলো না, জার্মানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে পড়েছিল।
একটি ফুটবল দল একটি সেনাদলের মতোই। সেনাপতি বা কোচের কৌশলই দলকে বিজয়ী করে আনতে পারে। আর সেরা দল সেটাই যে বিপক্ষ দলের কৌশলের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে এবং তারপর বিপক্ষের কৌশলকে তছনছ করে দিতে পারে।
‘তোমার শত্রুকে জানো এবং নিজেকে জানো এবং শত যুদ্ধেও তুমি পরাস্ত হবে না’
এটা যুদ্ধ, ফুটবল তথা জীবনের সব ক্ষেত্রেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফর্মূলা। পরাজয়ের নিশ্চিত উপায় হচ্ছে শত্রুকে নিয়ে এবং নিজেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা। ফুটবল খেলাতেও একটি দলকে তার দুর্বলতা নিয়ে ভালো জ্ঞান রাখা দরকার এবং সেটা কিভাবে লুকানো যায় সেই কৌশল জানা থাকতে হবে। আবার তার শক্তির জায়গা কোথায় সেটাও জানা দরকার এবং আক্রমণের সময় সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানতে হবে।
কোন ফুটবল দল যদি লং পাসে দুর্বল থাকে তাহলে ছোট ছোট পাসে বল সরবরাহ করতে হবে। দলে যদি কৌশলী খেলোয়ারের ঘাটতি থাকে তাহলে প্রতিপক্ষ দলের কৌশলী খেলোয়ারকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল নিতে হবে। মেসি, রোনালদো বা নেইমারের বিপক্ষে আমরা প্রতিপক্ষ দলকে চড়াও হতে যে দেখি তার পেছনে এই নীতিটাই কাজ করে। বিপক্ষ দলের সেরা খেলোয়ারটাকে যথাসম্ভব নিষ্ক্রিয় করে রাখার সচেতন প্রচেষ্টা দেখবেন অহরহ। প্রয়োজন হলে শারীরিক আক্রমণ করে অনেক ফাউল করতেও দেখা যায়।
‘যুদ্ধ করা এবং সব যুদ্ধে জেতা অসাধারণ দক্ষতার নিদর্শন নয়; যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম দক্ষতা’। খুব অল্পজনই এ প্রচেষ্টা নিয়ে থাকে। ফুটবলে এটা করতে হয় ম্যাচের অনেক আগে থেকেই। দক্ষ কোচ বা ম্যানেজাররা ম্যাচ শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রতিপক্ষের সাথে মাইন্ড গেইম খেলেন এবং তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন এমন একজন ম্যানেজার।
মাঠে বল গড়ানোর অনেক আগে থেকেই প্রতিপক্ষ ম্যানেজারের সাথে মাইন্ড গেইম খেলতে দেখা যেতো ফার্গুসনকে। প্রতিপক্ষ দলের কৌশলকে ভেস্তে দেওয়ার তার এই কৌশল বেশিরভাগ সময়ই ব্যাপকভাবে সফল হতে দেখা যেতো।
‘সব যুদ্ধেই রয়েছে ছলচাতুরি’
আধুনিক ফুটবল দলের এটা একটা কমন বৈশিষ্ট্য হয়ে দাড়িয়েছে। খেলোয়ারদের পজিশন পরিবর্তন, আক্রমণের প্রকৃতি পরিবর্তন, ছলনাপূর্ণ পাসিং, খেলোয়ারের পরিবর্তনে ভিন্নতা এ সবগুলোই আধুনিক ফুটবলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ফুটবলে সান জু’র এমন বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। ফুটবল তো আসলে জীবনেরই একটি প্রতিচ্ছবি। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য কাজ করেছেন সান জু। ফুটবল তার বাইরে যাবে কোথায়?
যুদ্ধমাঠে সান জু যেমন কার্যকর তেমনি ফুটবল মাঠেও সমভাবে কার্যকর। সান জু শুধু যুদ্ধ মাঠে বিজয়েরই ফর্মূলা দেননি বরং ফুটবলের ম্যানেজারদের জন্য ও দিয়েছেন। আজকের জমানায় সান জু থাকলে হয়তো তিনি একজন ভালো ফুটবল ম্যানেজার হতে পারতেন!