সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সংবাদ সম্মেলনে বসে এ কথা বলেছিলেন তামিম ইকবাল। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট ও আউটফিল্ড দেখেই এই মন্তব্য। মাসখানেক পর ২০১৮ সালে এসে পেলেন নতুন বছরের উপহার। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে তাকে দেওয়া হল পাঁচ লাখ টাকার জরিমানার খড়গ! অর্থাৎ মুখ খুললেই বিপদ। সেটা আপনি পাড়ার ব্যাটসম্যান হন আর বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানই হন। বিপক্ষে বলেছেন, তো মরেছেন।
তামিমের এই খবরের পাতাটা একেবারে কালো কুচকুচে। পরের পাতাটা একেবারে সাদা। ইস্যু যদিও এক। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ তারই দেশের সেরা স্টেডিয়াম মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এমসিজি) উইকেট নিয়ে সমালোচনা করলেন। না, তাকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) জরিমানা করেনি। উল্টো আইসিসির পক্ষ থেকে স্মিথের কন্ঠে গলা মিলিয়ে ‘বাজে’ তথা, ‘পুওর’ খেতাব দিয়েছে এমসিজিকে। ভাবা যায়! যে মাঠে টেস্ট-ওয়ানডে ক্রিকেটের অভিষেক হয়েছিল, সেই মাঠের উইকেটের সমালোচনা করলেন স্বদেশী দলের অধিনায়ক। বাংলাদেশ হলে এতক্ষণে সর্বনাশ হয়ে যেত!
অ্যাশেজের বক্সিং ডে টেস্ট এতটাই বিরক্তিকর ছিল যে ক্রিকেটাররাও যেন ধৈর্য্য হারিয়েছিলেন। পাঁচ দিনের ম্যাচে উইকেট পড়েছিল আঙুলের কড়া গুনে ২৪ খানা। কিন্তু ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকরা মজা পাননি। তা কেনই বা পাবেন! দেখার মতো কোনকিছুই তো উপহার দিতে পারেননি ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা। সে কারণেই ক্ষ্যাপা স্মিথ। সংবাদ সম্মেলনে সব রাগ গিয়ে ঝেড়ে দিলেন উইকেটের উপর।
স্মিথ বলেছিলেন, ‘কিছু একটা আসলে করা দরকার। উইকেটের পরিবর্তন পাঁচদিনেও হয়নি। আরও কয়েকদিন খেললেও কাজ হত না। না আছে কোনো পেস, না বাউন্স! স্পিনের জন্যও কিছু নেই। বল যায় না, আউট হয় না। এটা আসলে কারো জন্যই ভাল না।’
এতসব কটু কথা বলেও কোনো আশংকার মুখে পড়েননি স্মিথ। ভেবে দেখুন তো, ক’দিন আগেই এই দলটি নিজেদের বেতন-ভাতায় লভ্যাংশের দাবিতে সবাই মিলে একাট্টা হয়েছিল। তার মাসখানেকের মধ্যেই এমন মন্তব্য। বাংলাদেশের তামিম ইকবাল এই অবস্থায় পড়লে কী বিপদেই না পড়তেন!
মাশরাফি বিন মুর্তজার রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল তামিমদের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের। ম্যাচে ৯৭ রানে অলআউট এক দল। অন্য দল সেই রান তুলতে গিয়ে পৌঁছল ২০তম ওভার পর্যন্ত। তা বিরক্তি হওয়াটা তো একরকম ফরজ নাকি? সেটাই হয়েছিলেন তামিম। তার উপর আবার ওই ম্যাচের আগে ১০ দিন মাঠে একটা বলও গড়ায়নি। সবমিলিয়ে একটি স্পোর্টিং উইকেট তো আশা করাই যেতে পারে এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচে। না, সেটা হয়নি। শ্রীলঙ্কান কিউরেটর গামিনি ডি সিলভা কিছু করেছেন কি করেননি, উইকেট নিয়ে সমালোচনা থামাতে পারেননি ক্রিকেটারা।
উইকেট নিয়ে তামিম সেবার বলেছিলেন, ‘আমার প্রশ্ন আপনাদের কাছে, সবসময় একটি অজুহাত দেওয়া হয় যে মিরপুরে অনেক খেলা হয়। এবার তো ১০ দিন খেলা হলো না। এর পর এমন উইকেট? এটা কিউরেটর উত্তর দিতে পারবে ভালো। আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লাগছে, এত দর্শক এল মাঠে। কিন্তু এসে দেখল একদল ৯৭ করছে, আরেক দলের সেটি করতে শেষ ওভার পর্যন্ত যেতে হয়েছে, দর্শকের জন্য এটি হতাশাজনক। আমরা সবাই চাই বিপিএল পরের ধাপে যাক। কিন্তু এ রকম জঘন্য উইকেটে খেলা হলে তো হতাশাজনক। কী কারণে এরকম উইকেট বানানো হচ্ছে, আমার ধারণা নেই।’
তাতেই অঘটন তামিমের জন্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। কোনো দায়মুক্তি নেই। অন্যদিকে, স্টিভেন স্মিথ রীতিমত শাস্তি দাবি করেছেন এমসিজির দায়িত্বে থাকা কর্তা-কর্মীদের। তার অভিযোগে নড়েচড়ে বসেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে আইসিসি। স্মিথের মতো তামিমও যদি শাস্তি দাবি করতেন, তাহলে কী কাণ্ডটাই না হতো!
মূলত, নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই এই কাজ করেছে বিসিবি। এই মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এমনিতেই দু’খানা ডিমেরিট পয়েন্ট ‘খেয়ে’ বসে আছ। তামিমের মন্তব্য যদি আইসিসির নজরে আসে, তাহলে আবারও খোঁজখবর করা শুরু করবে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থাটি। শেষ পর্যন্ত তাদের চোখেও যদি তামিমের ভাষায়, ‘জঘন্য’ মনে হয়, তাহলে জুটবে আরও দুটি ডিমেরিট পয়েন্টস। ব্যস! চণ্ডীপাঠ সারা হয়ে যাবে বিসিবির। লজ্জার মাথা তো খেতেই হবে, এই ঢাকার হোম অব ক্রিকেটে আর কখনও ম্যাচও গড়াবে না। সেটাই ভয় কর্তা ব্যক্তিদের। তাই তো জ্যৈষ্ঠ ক্রিকেটারদেরও মুখ চেপে ধরা।
অথচ এই অঘটনের শুরুটা কিন্তু বিসিবির হাত ধরেই। টানা খেলার কারণে মাঠের ঠিকমতো পরিচর্যা হয় না। ফলাফল, পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা বিঘ্ন। শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড সিরিজের পর কয়েক মাস ধরে মাঠের ক্ষত সারানোর কাজ শুরু করে বোর্ড। শুধুমাত্র উইকেট রেখে তুলে ফেলা হয় পুরো স্টেডিমায়ের মাটি। এরপর বিদেশ থেকে ঘাস এনে লাগানো, উইকেটের সাজসজ্জা; সবমিলিয়ে কম চেষ্টা করেনি দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ কর্তা সংস্থাটি। কিন্তু সুফল মেলেনি। সবুজ গালিচা হারিয়ে গিয়েছে, বাদামি চেহারা নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য দ্রুত ভেন্যু প্রস্তুত করতে গিয়ে আউটফিল্ডে ঢালা হুয়েছে বালি। তাতে আউটফিল্ড আরও ধীর অর্থাৎ, স্লো হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া দল মিরপুরে হারল বাংলাদেশের কাছে। ওই ম্যাচেই আইসিসির রেফারি স্টেডিয়ামের আউটফিল্ডকে ‘পুওর’ ঘোষণা করলেন। ‘উপহার’ হিসেবে বিসিবি পেল দুটি ডিমেরিট পয়েন্ট। সবমিলিয়ে একরকম লেজেগোবরে অবস্থা!
সে অবস্থার উন্নতি কতটা হল না হল, তামিমের মন্তব্যে সব ঝাল গিয়ে পড়ল। সস্তা শাস্তিতে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা। ঘটনাটি এখানে থামলেও পারত। কিন্তু নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনে সকাল বেলা ক্রিকেটার, নির্বাচক, কোচ; সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল ছাপা চিঠি। বিষয়, গণমাধ্যমে কথা বলা প্রসঙ্গে ‘এমবার্গো’। অর্থাৎ সংবাদ মাধ্যমে কথা বলা যাবে না। টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে প্রতিদিন যাকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হবে, তিনিই শুধু কথা বলবেন। তাছাড়া কোনো ক্রিকেটার-কোচ বা নির্বাচক প্যানেলের কোনো সদস্য কোনো টেলিভিশনের টক শো-তে যেতে পারবেন না, কোনো পত্র-পত্রিকায় লিখতে পারবেন না, কোনো সংবাদমাধ্যমে এক্সক্লুসিভ কমেন্ট বা সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না। ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে এটা চুক্তির বাইরে যারা আছে তাদের জন্যও প্রযোজ্য।
চিঠির শুরুতে লেখা ছিল, ‘রিমাইন্ডিং’। অর্থাৎ, মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত, এমন নির্দেশনা সবসময়ই থাকে। কিন্তু কেউ এসবের ধার খুব একটা ধারে না। তবে কোনো আন্তর্জাতিক সিরিজ চলাকালীন সময়ে আবার খুব কড়াকড়ির সঙ্গে মানা হয়। কিন্তু এখন কেন? এর পিছনেও তামিমের মন্তব্য ও শাস্তির ইস্যুটি জড়িত। ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের কেউ যেন গণমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে বেফাঁস না করে ফেলে তাই আগেভাগেই বিসিবির এই তরিকা।
যেমন বোর্ডের মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেছেন, ‘এটা একটা প্রোটোকল, শুধু মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রিকেটাররা সাম্প্রতিক সময়ে কোনোরকম অনুমতি ছাড়া অনেক কথা বলছে গণমাধ্যমের কাছে, যা অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করছে। এগুলো ক্রিকেটারদের নিজেদের জন্যও যেমন ক্ষতিকর, বোর্ডের জন্যও ক্ষতিকর।’
যতই প্রোটোকল থাকুক, সত্য কখনও গোপন থাকে না। কিন্তু সেই সত্যই স্মিথদের নায়ক বানায়, তামিমদের বানায় ভিলেন!
ফিচার ইমেজ- ESPN Cricinfo