ভালো হবার এই এক জ্বালা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখবার আগে থেকেই আপনার নামের আগে ‘তারকা’ তকমা সেঁটে গেলেও, বিরাট কোহলি আপনার ‘টার্গেট উইকেট’ হতে পেরে নিজেকে ধন্য ভাবলেও, এমনকি অভিষেক টেস্টেই স্টিভেন স্মিথকে কাঁপিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেও আপনাকে শুনতে হবে,‘আচ্ছা, আরও ভালো কি হওয়া যায় না?’ জোফরা আর্চার এ মুহূর্তে ঠিক যেমনটি শুনছেন।
কেউ কেউ তো শুধু ‘আরও ভালো আর্চারকে চাই’ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, রীতিমতো গবেষণা করে প্রমাণ করতে চাইছেন, চাইলেই আর্চার আরও ভালো হতে পারেন। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে আর আর্চারের বোলিং দেখে এ লেখকেরও মনে হচ্ছে, তাই তো!
এবারের বিলেতি গ্রীষ্মে এখন অব্দি তিনি বোলিং করেছেন ৩৬ গড়ে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু উইকেটও নিয়েছেন, চার সপ্তাহে খেলে ফেলেছেন তিন টেস্ট। এরপরও আর্চারকে শুনতে হচ্ছে, পারফরম্যান্সটা ঠিক ‘আর্চার’ পর্যায়ের নয়। হ্যাঁ, অভিষেকের বছরে বোলিং দিয়ে যে ‘হইহই কাণ্ড-রইরই ব্যাপার’ বইয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেট-দুনিয়ায়, তা ঠিক পাওয়া যায়নি এ বছরে। তবে দলের চাহিদা মেনে বল তো করছেন ঠিকই।
প্রশ্ন যদি হয় দলের চাহিদা, বেন জোনস গলদ দেখছেন সেখানেই। ইংল্যান্ড নাকি এখনো খুঁজেই বের করতে পারেনি, দলে আর্চারকে তারা ঠিক কোন ভূমিকায় খেলাবে। আর্চার কি নতুন বলের বোলার? নাকি একজন এনফোর্সার? নাকি গতিতারকা? সুইং বোলার, নাকি সিম বোলার? নাকি এর সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে তাকে দিয়ে কেবল লাইনে বল করালেই মিলবে সাফল্য? ইংল্যান্ড এখনো হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।
চাইলে আর্চার হতে পারেন এর সবই, ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো সময়ে সামর্থ্যর প্রমাণ রেখেছেন সব ক্ষেত্রেই। ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্যে প্রশ্নের উত্তর জানাটা তাই জরুরি হয়ে পড়েছে আরও। অপব্যবহারে আর্চারের মতো সোনার ডিমপাড়া হাঁস নইলে যে অকালে জীবন দেবে!
প্রশ্নটা যদি গতির হয়
ক্রিকেট-দুনিয়াকে তিনি সর্বপ্রথম দুলিয়ে দিয়েছিলেন এক্সপ্রেস গতি দিয়েই, আর্চার-কেন্দ্রিক আলোচনা তাই গতি দিয়ে শুরু করাই শ্রেয়। ক্রিকভিজ থেকে পাওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, এখনো নিজের নবম স্পেল পর্যন্ত আর্চার বল করছেন গড়ে ৮৫ কি.মি/ঘণ্টা বা তার চাইতে বেশি গতিতে। ইংল্যান্ডের আর সব বোলারদের মধ্যে এক মার্ক উডই কেবল গতি তুলতে পারছেন এর চাইতে বেশি।
কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর্চারের অভিষেকের পর থেকে মার্ক উড বল করেছেন ৫৫৫টি, বিপরীতে কেবল খাটো লেংথেই আর্চার বল ছুঁড়েছেন ৫১৫ বার। অভিষেক হতে সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট মিলিয়ে আর্চার এখন অব্দি বল করেছেন ২,৪৪২টি। বিপরীতে উডের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা প্রায় অর্ধেকমাত্র (১,২২৯টি)। বিশ্ব ক্রিকেটেই তো সমসাময়িক তার চাইতে বেশি বল ছুঁড়তে হয়েছে কেবলমাত্র প্যাট কামিন্সকে। সেই বলগুলোতে কামিন্সের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩৮.০৭ কিলোমিটার। আর আর্চার তুলেছেন ১৩৮.০৬ কি.মি।
১০ টেস্টের ছোট্ট ক্যারিয়ারেই আর্চার স্পিডগানে ১৪০ কি.মি/ঘণ্টা ছাড়িয়েছেন ৭৯৯ বার, বাদবাকি সব ইংরেজ সিমারদের সম্মিলিত সংগ্রহ যেখানে ৬৬৬। পুরাতন মাইলেজের হিসেবে ফেরত এসে যদি মানদণ্ড ধরা হয় ঘণ্টাপ্রতি ৯০ মাইল গতিকে, আর্চার (১৩০টি) এখানেও এগিয়ে আছেন এক ব্যবধানে।
কিন্তু এ তো গোটা ক্যারিয়ারের হিসেব। আর্চারের কাঁধে চাপা তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটের অমানবিক কর্মভার বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, গতিক্ষয় তো ধরা পড়ছে সাদা চোখেই। ক্রিকভিজের সংরক্ষিত উপাত্তও সমর্থন করছে দর্শকের এই দৃষ্টিকে। অভিষেক টেস্টে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বলেই যেখানে গতি ছিল ১৪০ কি.মি.র ওপরে, সেই সংখ্যাই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে নেমে এসেছে ষোল শতাংশে। অবশ্য তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট মিলিয়ে যে ধকল যাচ্ছে তার শরীরের ওপর দিয়ে, তাতে গতি না কমাটাই হতো অস্বাভাবিক।
তবে কি ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট আর্চারের কাছে সেই এক্সপ্রেস গতি চাইতে পারবে না আর? পারবে না কেন, অবশ্যই পারবে! কিন্তু সেজন্যে যে তাকে মার্ক উডের মতো বাঁচিয়ে খেলাতে হবে।
প্রশ্নটা যদি লাইনের হয়
ধারণাটা সর্বজনবিদিত, এমনকি দু’দিন আগে স্কাই স্পোর্টসের পর্দায় শেন ওয়ার্নও তাল মিলিয়ে গিয়েছেন এই দাবিতে। তার চোখে, সাদা বলে আলো ছড়ানো যতটা সোজা, সাদা পোশাকে ঠিক ততটাই কঠিন। কেননা,
“সাদা বলে আপনাকে নির্ভর করতে হবে বৈচিত্র্যের ওপর। আর লাল বলে আপনার মূল অস্ত্র হবে ওভারের পর ওভার একই জায়গায় ক্লান্তিহীন বল করে যাওয়া। এই ফরম্যাটের ক্রিকেটে আপনার কাজ হবে ফিল্ডিং দিয়ে আক্রমণ করা, বিপরীতে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আপনি চাইবেন বল দিয়ে আক্রমণ করতে।”
ওয়ার্নের দাবিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যে দেবেন, সে উপায়ও তো নেই। সাদা পোশাকে দুর্দান্ত সফল ক্রিকেটারদের অনেকেই তো ইদানীং আঁতিপাঁতি করে হাতড়ে বেরাচ্ছেন লাল বলে সাফল্যের রাস্তা, লাল বলের ক্রিকেটটা দুরস্ত বলেই বোধ করি।
তবে তাই বলে সবাই যে এই সমস্যাতে ভুগছেন, তা কিন্তু নয়। এমনিতে জফরা আর্চার পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন রঙিন পোশাকের ক্রিকেট দিয়েই। স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে হোবার্ট হারিকেনস, রাজস্থান রয়্যালস কিংবা খুলনা টাইটান্সের হয়ে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই চোখে পড়েছে সবার আগে। ইয়র্কার, স্লোয়ার বাউন্সার থেকে শুরু করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মোক্ষম সব হাতিয়ারই আছে তার তূণে। আর এসব অস্ত্রের ভিড়ে আড়ালে পড়ে গিয়েছে লাইন-লেংথের ওপর তার অসামান্য নিয়ন্ত্রণ। পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার আবির্ভাবের পর থেকে স্ট্যাম্পে কিংবা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের চ্যানেলে তার চাইতে বেশি বল রাখতে পেরেছেন মাত্র তিনজন বোলার। আর টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্যের সূত্র তো জানা আছেই, স্ট্যাম্প কিংবা চ্যানেলে অবিরত বল করে যাওয়া।
আপনার অজান্তেই তাই সাসেক্সের হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে আর্চার বল করছেন ২৩.৭৯ গড়ে। টেস্ট ক্রিকেটে যে ৩৮ উইকেট পেয়েছেন এখন অব্দি, তার শতকরা ৪১ ভাগই এসেছে স্ট্যাম্প লাইনে বল করে, বাকিদের ক্ষেত্রে যে গড় মাত্র ২৯ শতাংশ।
আর্চার কি তবে লাইন বোলার? উত্তরটা তো পরিসংখ্যানই দিয়ে দিচ্ছে।
আর্চার কি নতুন বলের বোলার?
উত্তরটা একদম সোজাসাপ্টা দিয়ে দেয়াই ভালো, লাল বলের ক্রিকেটে আর্চার নতুন বলের বোলার নন। কারণ, আর্চার সুইং বোলারই নন। এমনকি তার অভিষেকের পর থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে কমপক্ষে তিনশ’ বল করা পেসারদের সকলেই বাতাসে বল বাঁকানোর কারুকার্য দেখিয়েছেন তার থেকে বেশি। ব্রিটিশ মুলুকে ইনিংসের শুরুর দিকে যেখানে সুইংটাই ব্রহ্মাস্ত্র, আর্চারের হাতে নতুন বল তুলে দেয়াটা সেখানে প্রশ্নসাপেক্ষ।
এর চাইতে বরং আর্চারকে আনা যায় প্রথম বদলি বোলার হিসেবে। কেননা, বিলেতের মাটিতে খেলা হয় ডিউক বলে, আর এই ডিউক বলে সিমটা থাকে পুরু। আবার সিমটা পুরু বিধায় সিমের স্থায়িত্বও বেশি। যেহেতু আর্চার সুইং করাচ্ছেন না (কিংবা পারছেন না), অথচ বলে বেশ ভালো রকমের সিম মুভমেন্ট আছে, তার তাই আসা উচিৎ প্রথম চেঞ্জেই।
পরিসংখ্যানও সমর্থন করছে আর্চারকে সিম বোলার বলার দাবিটি। সমস্ত ইংলিশ বোলারদের ভেতরে এখন অব্দি আর্চারের চাইতে বেশি সিম মুভমেন্ট করাতে পেরেছেন কেবলমাত্র স্টুয়ার্ট ব্রড।
আর্চার কি এনফোর্সার?
রসদে গতির সঙ্গে দুর্দান্ত এক বাউন্সার মজুদ আছে বলে আর্চারকে ‘এনফোর্সার’ বলে চালিয়ে দেয়া বেশ সহজই। মরা পিচে আর নরম হয়ে যাওয়া পুরনো বলে বাদবাকি ডেলিভারিতে উইকেট পাওয়া যখন অসম্ভবের নামান্তর, এক ‘এক্সপ্রেস’ আর্চারের বাউন্সারেই থাকে উইকেট প্রাপ্তির আশা। এমনকি ২০১৯ সালে ৪০-৭৯ ওভার সময়কালে তার ১৯.৬৪ গড়ে পাওয়া ১৪ উইকেটও সম্মতি জানাচ্ছিল এই পরিসংখ্যানে। কিন্তু এবারের গ্রীষ্মে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে পুরো ১৮০°। পুরনো বলে তিনি ৯৫ গড়ে উইকেট নিয়েছেন মোটে একটি।
একটা কারণ হতে পারে, ব্যাটসম্যানরা ইদানীং তার বাউন্সারগুলো ছেড়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ক্রিকভিজ থেকে পাওয়া উপাত্তমতে, ২০১৫ থেকে হিসেব করলেও আর্চারের বাউন্সারই সবচেয়ে বেশিবার ‘লিভ’ করেছেন ব্যাটসম্যানরা।
চাইলে ব্যাটসম্যানদের এই ডাক করা কিংবা সরে যাওয়ার ব্যাখ্যা করা যায় ভালো-মন্দ দু’রকমই। একটা অর্থ হতে পারে, ব্যাটসম্যানরা তার বাউন্সারে আক্রমণ করতে ভয় পাচ্ছেন, খেলবার চাইতে সরে যাওয়াকেই নিরাপদ ভাবছেন। আবার নেতিবাচক অর্থ হতে পারে, আর্চার তার বাউন্সারের ধার হারিয়েছেন। যেন আগের মতো গা-সইসই বাউন্সার দিতে পারছেন না, ব্যাটসম্যানরা তাই ব্যাটে খেলবার বদলে সরে যাবার জন্যে সময় পাচ্ছেন পর্যাপ্ত।
অবস্থাদৃষ্টে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাকেই মনে হচ্ছে খানিকটা বেশি যৌক্তিক। এবং আরও একবার সামনে চলে আসছে আর্চারের ওয়ার্কলোডের প্রসঙ্গ। অমন তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটের গুরুভার কাঁধে নিয়ে বলের পরে বল নিখুঁত বাউন্সার দিয়ে যাওয়াটা তো অতিমানুষিকই হতো।
ইংল্যান্ড তাই আর্চারকে ‘এনফোর্সার’ রূপে ব্যবহার করতে চাইলে বোকামিই করবে। বিশেষতঃ আর্চারের চাইতে অর্ধেক কর্মভার নিয়ে মার্ক উড যখন প্রস্তুতই আছেন।
শেষ অব্দি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ‘আরও ভালো’ আর্চারকে পেতে কী করতে হবে? প্রথমত, ইনিংস সূচকের পরিবর্তে আর্চারকে বোলিংয়ে আনতে হবে প্রথম বদলি হিসেবে, সুইংয়ের চাইতে সিম মুভমেন্টটা যখন দেখা দেবে মুখ্য অস্ত্র হয়ে। দ্বিতীয়ত, এনফোর্সারের পরিবর্তে আর্চারকে ব্যবহার করতে হবে লাইন বোলার রূপে। এবং, আর্চার বাউন্সার দেবেন, তবে তা কোনোমতেই ওয়াগনারের অবিশ্রান্তধারা মানবে না। বরং হঠাৎ আগমনে তা হতচকিত করে দেবে ব্যাটসম্যানদের।
এ সবই অবশ্য পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে করা পূর্বানুমান। এর সবকিছু ঠিকঠাক করেও আর্চার যে সফল হবেন, এর নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না এখনই। তবে সফলতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যে পুরো ষোল আনাই আছে, তা অন্তত বলা যাচ্ছে। আর্চারের আগেই তো প্যাট কামিন্সকে অস্ট্রেলিয়া ব্যবহার করেছে একই ভূমিকায়। আর বলাই বাহুল্য, বর্তমান টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষ বোলারের নাম প্যাট কামিন্স।