তামিম ইকবাল নিজের শেষ তিনটি একদিনের ইনিংসে যথাক্রমে ৬৫, ১২৮ এবং ৯৫ রান করেছেন। শুধুমাত্র এই তিনটি ইনিংসেই নয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তামিম ৬ ম্যাচে যথাক্রমে ৬৪*, ২৩, ৪৭, ৬৫, ১২৮ এবং ৯৫ রানের ইনিংস খেলেছেন। এই ৬ ম্যাচে ৮৪.২৪ ব্যাটিং গড়ে করেন ৪২২ রান। প্রস্তুতি ম্যাচেও তিনি ভালোভাবেই তার প্রস্তুতি সেরে নিয়েছিলেন। ত্রিদেশীয় সিরিজ সামনে রেখে আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে করেছেন ৮৬ রান এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সামনে রেখে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছেন ১০২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস।
তামিম ইকবাল ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকেই দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই তিনি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দুই ম্যাচে বড় ইনিংস খেলেছেন। প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪২ বলে ১২৮ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। এটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও তামিম খেলেছেন অনবদ্য ইনিংস। স্টার্ক, কামিন্স এবং হ্যাজলেউডের গতি এবং বাউন্সের সামনে যখন দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা খাবি খাচ্ছিলেন, তখন তিনি অপরপ্রান্তে দৃঢ়তার সাথে ব্যাট করছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনটি ছয় এবং দ্বিগুণ চারের মারে ১১৪ বলে ৯৫ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফিরেন। এজন্য নিজেকে কিছুটা অভাগা ভাবতেই পারেন তিনি। কারণ পুরো ইনিংসে সাবলীলভাবে ব্যাট করে শতক থেকে মাত্র পাঁচ রান দূরে থাকতেই স্টার্কের বলে হ্যাজলেউডের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন। এই নিয়ে তৃতীয়বার নড়বড়ে নব্বইতে কাটা পড়েন তিনি। তিনবারই তিনি ৯৫ রানে আউট হন।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রানের একটি ইনিংস খেলে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দেন তামিম। এরপর ভালো-মন্দে বিশ্বকাপ শেষ করে দেশে ফেরেন তামিম ইকবাল। তারপর থেকেই তার বদলে যাওয়ার শুরু হয়। দেশসেরা ব্যাটসম্যান থেকে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার জন্য তিনি বেশ আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। ঘরের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৩২ রানের ইনিংস খেলে প্রায় ১৬ বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন।
সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১১৬* রানের ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ওডিআই সিরিজ জয় পেতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। এবং শাহরিয়ার নাফিস, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসাবে ব্যাক টু ব্যাক শতক হাঁকানোর কীর্তিও গড়েন। সিরিজের শেষ ম্যাচেও তিনি ৬৪ রানের ইনিংস খেলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা তিনটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার পর ভারতের বিপক্ষে পরের সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৬০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
ক্যারিয়ারে এর আগেও তামিম টানা চার ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছেন। ২০১২ এশিয়া কাপে যখন দলে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তখনই তিনি এই কীর্তি গড়েন। আবারও টানা চার ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস দিয়ে শুরু করলেন। তামিম ইকবাল ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর এখন পর্যন্ত ৩০টি আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ খেলেছেন। ৩০ ম্যাচের মধ্যে ২৯ ইনিংস ব্যাট করে ৫৯.৫৩ ব্যাটিং গড়ে ১,৫৪৮ রান করেছেন। ক্যারিয়ারের নয়টি শতকের মধ্যে পাঁচটি করেছেন এই ৩০ ম্যাচে। এ সময়ে বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাটসম্যান মাত্র চারটি শতক করেছেন।
তামিম পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি করে শতক হাঁকান ২০১৫ বিশ্বকাপের পর। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ ছাড়া বাকি চারটি ম্যাচেই তার শতকে জয়লাভ করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের হয়ে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর একদিনের ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান করেছেন মুশফিকুর রহিম। তিনি তামিমের চেয়ে ৬৭৬ রান পিছিয়ে আছেন। এতেই বোঝা যায় তামিম বাংলাদেশের অন্যান্য ক্রিকেটারদের থেকে ঠিক কতটা এগিয়ে আছেন। বিশ্বকাপের পর গত দু’বছরে তামিম ইকবাল খেলেছেন এমন ১৬টি ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ১৬ ম্যাচে ৭৩.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ১,০৩৪ রান করেছেন। দ্বিতীয়তে থাকা সৌম্য সরকারের চেয়ে ৪৯৬ রান বেশি।
গত দু’বছরের সাফল্যে অনেকেই কোচ চান্ডিকা হাতুরেসিংহের কোচিং, মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব, মুস্তাফিজের কাটার কিংবা সৌম্যর আগ্রাসী ব্যাটিংকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু তামিম শুরুটা করে না দিয়ে গেলে সবকিছুই ফ্যাকাসে হয়ে যেতো। বিশ্বকাপের আগে ছিলেন দেশসেরা ব্যাটসম্যান আর এখন তিনি বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৪১ ম্যাচে ২৯.৬৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪,১২৫ রান। তার মধ্যে মাত্র চারটি হলো শত রানের ইনিংস। সেসময় সাকিব আল হাসান ছয়টি ওডিআই শতক নিয়ে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবার সবচেয়ে শতক হাঁকানোদের তালিকায় প্রথম স্থানে ছিলেন। এরপর তামিম আরও পাঁচটি শতক হাঁকালেও সাকিব সেই ছয়েই আটকে আছেন।
তামিম ইকবাল টেস্ট ক্রিকেটে সেরাদের কাতারে নাম লেখাতে শুরু করেছেন ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনা টেস্ট দিয়ে। সিরিজের প্রথম টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ এবং শূন্য রান করে আউট হওয়ার পর খুলনা টেস্টে ১০৯ ও ২৫ এবং চট্টগ্রাম টেস্টে ১০৯ ও ৬৫ রান করেছেন। বিশ্বকাপের পর ওডিআইতেও ফর্মে ফিরেছেন তিনি। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচানো ২০৬, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচজয়ী ১০৪ এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচজয়ী ৮২ রানের মতো ইনিংস খেলেছেন। তামিম ইকবাল নিজের শেষ ১৪টি টেস্টে ৪৯.৪৮ ব্যাটিং গড়ে ১,২৩৭ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে আটটি শতকের চারটি এসেছে শেষ ১৪ ম্যাচে।
গত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি শতক হাঁকানোর পাশাপাশি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট- সব জায়গাতেই তামিম ইকবালের ব্যাট জয়ের হাসি হেসেছে। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে তিনি শেষ দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪৬ এবং ক্যারিয়ার সেরা ১৫৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। বিপিএল, পিএসএলের মতো ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতেও তার রানক্ষুধা ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধুমাত্র দু’বছরেই না, তামিমের রানের ক্ষুধা থাকুক আরও লম্বা সময় ধরে। কারণ এরকম বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের যে এত অল্পতেই তুষ্ট হতে নেই!