তামিম ইকবাল খান – বাংলাদেশ ক্রিকেটে নামটার সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন ক্রিকেটপ্রেমী খুঁজে পাওয়া দায়। তবে বিশ্ব ক্রিকেটে তামিম ইকবাল নামের জানান এসেছিল সেই ২০০৭বিশ্বকাপে। আরও নিদিষ্ট করে বললে, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। জহির খানকে গ্যালারিতে আছড়ে মারা সেই বিখ্যাত ছক্কাতেই তামিমের আগমনী বার্তা পেয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া। তামিম ইকবাল পরিচিতি পেয়েছিলেন লর্ডসে টিম ব্রেসনানকে মিড অনের উপর দিয়ে চার মেরে সেই বিখ্যাত উদযাপনেও, যাতে মিশেছিল আকাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার তীব্র প্রতিফলন। হ্যাঁ, আজকের বিষয়বস্তু থাকছে ২০০৯-২০১০ মৌসুমে ব্রিটিশ মুলুকে তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা দু’টি ইনিংস নিয়ে।
প্রথম টেস্ট, লর্ডস (১০৩ রান)
‘হোম অফ ক্রিকেট’ কিংবা ‘ক্রিকেটের মক্কা’ খ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন থাকে, একদিন লর্ডসে খেলবেন। আর লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তোলা… সেটা তো একেবারে সোনায় সোহাগা। সেটা যদি হয় বাংলাদেশী কোনো ক্রিকেটার, লর্ডসে খেলা আর অনার্স বোর্ডে নাম – দুটোই স্বপ্নপূরণের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে দাঁড়ায়!
২০১০ সালের সে সফরে প্রথম টেস্টে লর্ডসে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে জোনাথন ট্রটের দ্বিশতক (২২৬) এবং অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের অর্ধশতকে (৮৩) ভর করে ৫০৫ রান তুলে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশ পেসার শাহাদাৎ হোসেন রাজীব ২৮ ওভারে ৯৮ রান খরচায় ৫ উইকেট শিকার করে প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুলেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয় ২৮২ রানে। তামিম এবং জুনায়েদ সিদ্দিকী করেন যথাক্রমে ৫৫ এবং ৫৮ রান।
প্রথম ইনিংস ২২৩ এগিয়ে থাকার সুবাদে বাংলাদেশকে আবার ব্যাট করতে পাঠায় ইংল্যান্ড। ফলোঅনে পড়ে আবার ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। মাথায় উঁকি দিচ্ছে ইনিংস হারের সম্ভাবনা। জেমস অ্যান্ডারসনের প্রথম বলটা মিড-উইকেটে ঠেলে দিয়ে এক রান নেন তামিম ইকবাল। প্রথম ইনিংসে ঝড়ো ফিফটি করা তামিম দ্বিতীয় ইনিংসে চার মারেন ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে গিয়ে। টিম ব্রেসনানের শর্ট বলটাকে মিড উইকেট দিয়ে দুর্দান্ত পুল শটে চার মারেন তামিম। এরপর ইনিংসের দশম ওভারের শেষ বলে গ্রায়েম সোয়ানকেও জায়গায় দাঁড়িয়ে চমৎকার ড্রাইভে চার মারেন তামিম। ওই প্রথম ইংলিশ অধিনায়ক স্ট্রাউসকে কিছুটা চিন্তিত দেখাল।
এরপর খানিকটা রয়েসয়ে খেলতে লাগলেন তামিম। ইনিংসের একুশতম ওভারে গিয়ে কিছুক্ষণ রয়েসয়ে থাকার ঝাল মিটালেন প্রথম ইনিংসে চার উইকেট নেয়া স্টিভেন ফিনের উপর দিয়ে। টানা তিনবার বাউন্ডারি ছাড়া করলেন বলকে। কোনোটা ডাউন দ্য উইকেট দিয়ে, কোনোটা থার্ডম্যান দিয়ে, কোনোটা এক পায়ে ট্রেডমার্ক পুল শটে। ওভারের পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিয়ে নন-স্ট্রাইকে আসলেন তামিম। শেষ বলে কোনো রান না হওয়াতে গ্রায়েম সোয়ানের পরের ওভারে আবার স্ট্রাইকে তামিম।
সোয়ানের প্রথম বল থেকে কোনো রান এলো না। কিন্তু তামিমের বডি মুভমেন্ট আর ব্যাট আভাস দিচ্ছিল আসন্ন ঝড়ের। পরের তিন বলে ছয়, চার, ছয় সেই আশংকাকে সত্যি বানিয়ে ছাড়লো। ফিনের বলে সিংগেল নিয়ে ৪৯ বলে অর্ধশতকে পোঁছান। লর্ডসের গ্যালারী থেকে ব্যালকনিতে থাকা সতীর্থদের কড়া করতালিতে মুখরিত হলেন তামিম।
এরপর আবার কিছুক্ষণের জন্য খোলসে ঢুকে যান তামিম। ঊনত্রিশতম ওভারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে টিম ব্রেসনানকে দুইটি টিপিক্যাল ‘তামিমীয়’ শটে চার মেরে আবার খোলস ছেড়ে বেরোলেন। ৭৭ বলে অপরাজিত ৮৫ রান তখন। টিম ব্রেসনানের করা ইনিংসের ৩৫তম ওভারে আবার ‘ব্যাক টু ব্যাক’ চার মেরে ৯৫ রানে পোঁছালেন। পরের বল মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে দুই রান। ৯৭ রানে দাঁড়িয়ে তামিম ইকবাল।
আর দরকার তিন রান। তাহলেই নাম উঠে যাবে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে, যেটার জন্য তামিমের তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা। কতটা প্রতীক্ষার ছিল পরবর্তীতে লর্ডস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তামিমের কথায় সেটিই ফুটে উঠে৷ উইজডেনে উৎপল শুভ্রের লেখা অনুচ্ছেদে সেটা উঠে এসেছে এইভাবে,
লর্ডসে তাঁর প্রথম ইনিংসে ৫৫ রানে আউট হয়ে ফিরেছেন। ড্রেসিংরুমে ঢুকেই অ্যাটেনডেন্টকে বললেন, ‘শুধু সেঞ্চুরির জন্য অনার্স বোর্ড কেন? ফিফটির জন্যও একটা থাকা উচিত।’ অ্যাটেনডেন্ট উত্তর করলেন, ‘অনার্স বোর্ডে নাম লেখাতে সেঞ্চুরিই লাগবে।’ জবাবে হুট করে বলে দিলেন, ‘আচ্ছা, তা-ই হবে। সেঞ্চুরি না করে আমি এখান থেকে যাচ্ছি না।’
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ঠেকবে, যখন শুনবেন, সেই অনার্স বোর্ডে নাম তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন ক্রিকেটের দুই জীবন্ত কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার এবং ব্রায়ান লারা।
আচ্ছা, ম্যাচে ফেরা যাক। তিন রানের জন্য সিঙ্গেল খেলবেন, নাকি নিজের ওই মুহূর্তের সহজাত স্টাইলে শতকটা করে ফেলবেন, এ নিয়ে তামিম ইকবাল কি একটু নার্ভাসনেস অনুভব করছেন? নাহ, দেখে একদমই বুঝার উপায় নেই। টিম ব্রেসনানের পরের বলটা মিড অনের ওপর দিয়ে তুলে মারলেন। ছয় হলো না, হলো চার। এতেই এলো সেঞ্চুরি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লর্ডসে সেঞ্চুরি করলেন তামিম ইকবাল খান।
উদযাপনটাও ছিল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। সেঞ্চুরি করে দৌড়ের মধ্যে হেলমেট খুললেন, কিছু একটা ইশারা করলেন; তারপর ব্যাট এবং হেলমেট মাটিতে রাখলেন। দৌঁড়ে গিয়ে একটা লাফ দিলেন। এরপর কয়েকবার জার্সির পেছন দিকে হাত দিয়ে ড্রেসিংরুমের দিকে দেখালেন। বোঝাতে চাইলেন, ‘লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তোলার পরীক্ষায় পাস তো করলাম, এবার তবে লিখে ফেল!’ ওদিকে টিভি রিপ্লে দেখে স্কাই স্পোর্টসের কমেন্ট্রি বক্স থেকে উদযাপনের আসল অর্থ বের করতে চাইলেন ডেভিড গাওয়ার:
“See how much it’s means to him. Walk back, what the celebration exactly means. The board calls, yeah that’s me. I’m on the board.”
চ্যানেল ফাইভের কমেন্ট্রিতে মাইকেল ভন আরো দুর্দান্ত:
“He is off in running, to the balcony; that’s it, get into the board; Put his name on there. Good boy.”
রাজকীয় সেঞ্চুরি, রাজকীয় উদযাপন। তাতে লেখা হয়ে যায় ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের একটা দৃশ্য। যে দৃশ্য কল্পনায় প্রতীয়মান হয়ে আপনাকে আন্দোলিত করে তুলতে বাধ্য। সে-ও কী সেঞ্চুরি! ১৫ চার আর ২ ছয়ে মাঠ আলো করে মাত্র ৯৪ বলে। ১৯৯০ সালে লর্ডসে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের সেঞ্চুরি পেছনে ফেলে তামিম ইকবাল হয়ে যান লর্ডসের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। শেষ পর্যন্ত ফিনের বলে কাঁটায় কাঁটায় ১০৩ স্ট্রাইকরেটে ১০৩ রান করে আউট হন তামিম। বাংলাদেশও ম্যাচ হারে আট উইকেটের ব্যবধানে।
দ্বিতীয় টেস্ট, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ম্যানচেস্টার (১০৮ রান)
প্রথম ইনিংসে ইয়ান বেলের ১২৮ রান এবং শেষ দিকে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ম্যাট প্রায়রের ৯৩ রানের সুবাদে ৪১৯ রান করে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই জেমস অ্যান্ডারসনকে চার মেরে শুরু করেন তামিম ইকবাল। প্রথম টেস্টের মতো আবারও তামিম-ইমরুল জুটি জমতে থাকে। ষষ্ঠ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৩৪/০, তামিম অপরাজিত আছেন ১৮ রানে।
সপ্তম ওভারে অ্যান্ডারসনের প্রথম বলে স্কয়ার লেগ দিয়ে চার মারেন তামিম। তৃতীয় বলে ধারাভাষ্যকারের ভাষায় ‘ক্র্যাকিং শট’, অ্যান্ডারসন দেখলেন ২১ বছরের এক যুবকের ভয়ডরহীন তারুণ্য। লং অনের উপর দিয়ে গ্রায়েম সোয়ানকে ছক্কা মেরে ৪৩ বলে ৬ চার আর ১ ছয়ে ফিফটিতে পোঁছালেন। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তখন টানা পাঁচ ফিফটির রেকর্ডে তামিম।
দুই ওপেনার মিলে প্রথম সেশন কাটিয়ে দিলেন নির্বিঘ্নে। তামিম ৫৭ বলে ৬৫ রান করে অপরাজিত। আজমল শাহজাদের ইয়র্কারে পিচে ভূপাতিত হয়ে ঠিক পরের বলেই চার মেরে বুঝিয়ে দেন, সহজেই হাল ছাড়তে আসেননি। দলীয় ১২৬ রানে তামিমের ব্যক্তিগত ৭৮ রানের সময় আরেক ওপেনার ইমরুল কায়েস বিদায় নিলেন। নব্বইয়ের ঘরে সোয়ানকে তেড়েফুঁড়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে কয়েকবার আউট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করলেন। একত্রিশতম ওভারে সোয়ানকে চার মেরে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারে পোঁছালেন তামিম ইকবাল। আগের সেঞ্চুরির মতো একই ভঙ্গিতে দৌড়ে গিয়ে একটা লাফ দিলেন, ব্যাটে চুমু খেলেন। গ্যালারি আর সতীর্থদের সম্ভাষণের জবাব দিলেন। চাইলে এক দৌঁড়ে পিটারসেনের কাছে গিয়ে বলতে পারতেন, ‘যাও, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করে দিলাম।’ উল্লেখ্য, প্রথম টেস্টে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে তামিমকে ক্ষিপ্ত করার জন্য পিটারসেন বলেছিলেন,
“Cricket is so easy for you, right? You go to Old Trafford, then you will see.”
কিন্তু তামিম ইকবাল দেখালেন, ম্যানচেস্টার হোক কিংবা লর্ডস, নিজের দিনে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করতে পারেন তিনি। পিটারসেনও সাক্ষী হলেন একুশ বছরের এক যুবকের ব্যাটিং তাণ্ডবলীলার। অ্যান্ডারসনের বলে আউট হওয়ার আগে ১১৪ বলে ১১ চার আর এক ছয়ে করে যান ১০৮ রান।
সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় টেস্টও হারে ইনিংস এবং ৮০ রানে। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি রেখে আসতে না পারলেও তামিম নিজের দু’টি ইনিংস দিয়ে সেই সফর ইংলিশদের কাছে আজীবন মনে গেঁথে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসেন। পরে সে বছর জেতেন ‘উইজডেন টেস্ট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাবও।