সালটা ১৯৯৯, স্টেডিয়ামটা ক্যাম্প ন্যু। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের খেলা চলছে, ৯২ মিনিট। স্কোরলাইন ১-১, কর্নার কিক নেবেন ডেভিড বেকহ্যাম। মিনিটখানেক আগেই বেকহ্যামের আরেকটি কর্নার থেকে দলকে সমতায় ফিরিয়েছেন টেডি শেরিংহ্যাম। কর্নার নিলেন বেকহ্যাম, মাথা ছোঁয়ালেন শেরিংহ্যাম, বল এলো বাচ্চাদের মতো চেহারার এক নরওয়েজিয়ানের কাছে। পা ছোঁয়ালেন তিনি… গোল!
ইউনাইটেডের উল্লাসের সাগরে হতাশায় ডুবে গেলো বায়ার্ন শিবির, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সাথে ইউনাইটেড জিতে নিলো ট্রেবলও। জয়সূচক গোল করা সেই নরওয়েজিয়ানের নাম ছিলো ওলে গানার সলশায়ের, বাচ্চাদের মতো চেহারার জন্য ইউনাইটেড সমর্থকরা যাকে আদর করে ডাকতো ‘বেবি ফেইসড অ্যাসাসিন’। সাবস্টিটিউট হয়ে নেমে খেলা বদলে ফেলেছেন বহুবার, এবার ইউনাইটেডে এসেছেন অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজার হিসেবে। এবারও পাচ্ছেন অর্ধেকটা সময়, প্রিয় দলকে বাঁচাতে।
খেলোয়াড়ি জীবন
সলশায়েরের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় নরওয়ের ক্লাব মোল্ড এফকে-তে, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে দলে যোগ দেন তিনি। প্রথম সিজনেই ২৬ ম্যাচে ২০ গোল করে তাক লাগিয়ে দেন। পরের সিজনেও ছিলেন আগুনে ফর্মে, ১৬ ম্যাচে করে ফেলেছিলেন ১১ গোল। কিন্তু এই পারফরম্যান্সেই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে ২.২৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইউনাইটেড তাকে নিয়ে আসে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। অভিষেকেই তাক লাগিয়ে দেন তিনি, সাবস্টিটিউট হিসেবে নামার ৬ মিনিটের মাথায় করে বসেন গোল। সবাই বুঝেছিলো, স্যার অ্যালেক্সের জহুরী চোখ রত্ন চিনতে ভুল করেনি। প্রথম সিজনেই তিনি জিতে নেন প্রিমিয়ার লিগ, অবশ্য ফার্গি আমলে তা ছিল বলতে গেলে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
ইউনাইটেডের হয়ে এই স্ট্রাইকার খেলেছেন দীর্ঘ ১১ বছর। এই সময়ে ৩৫৯ ম্যাচ খেলে করেছেন ১২৩ গোল, করিয়েছেন ৩১টি। হলুদ কার্ড পেয়েছেন ২০ বার, লাল কার্ড ১বার। সবচেয়ে অবাক করা পরিসংখ্যান হচ্ছে, ৩৫৯ ম্যাচে সলশায়ের খেলেছেন ১৯ হাজার ৮৭৬ মিনিট, মানে ম্যাচপ্রতি গড়ে ৫৫ মিনিটের একটু বেশি। এর কারণ ছিল প্রথম থেকে খেলানোর চেয়ে তাকে সাবস্টিটিউট হিসেবে খেলাতেই বেশি পছন্দ করতেন ফার্গি, বেঞ্চ থেকে এসেই যে বারবার খেলা বদলে দিতেন এই স্ট্রাইকার! এভাবে হুট করে নেমে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেবার জন্যই ইউনাইটেড সমর্থকগোষ্ঠী তার নাম দেয় ‘বেবি ফেইসড অ্যাসাসিন’।
সলশায়েরের প্রথম ও একমাত্র লাল কার্ডের গল্প কিছুটা অদ্ভুত। নিউক্যাসলের বিপক্ষে এক হোম ম্যাচে জঘন্য এক ফাউলের জন্য তাকে লাল কার্ড দেখান রেফারি। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এই লাল কার্ডের পর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে থাকা দর্শকদের কাছে থেকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছিলেন তিনি!
১৯৯৯ সালে একবার তো নটিংহ্যাম ফরেস্টের উপর পুরো তাণ্ডব চালান তিনি! ফরেস্টের মাঠে ফেব্রুয়ারিতে তাকে ফার্গি নামান সাবস্টিটিউট হিসেবে। সাদা জার্সি পরে যখন নামছেন, তার অসাধারণ সাবস্টিটিউট পারফরম্যান্সগুলোর জন্য প্রমাদ নিশ্চয়ই গুনছিলো ফরেস্ট সমর্থকরা। কিন্তু সলশায়ের যে এমন প্রলয়কান্ড ঘটাবেন, সেটা কে ভেবেছিলো! মাঠে নামার ১২ মিনিটের মধ্যে করেছিলেন গুনে গুনে ৪ গোল! নরওয়ে থেকে উড়ে আসা এক ঘুর্ণিঝড়ে উড়ে গিয়েছিলো নটিংহ্যাম। সেই বছরই বার্সেলোনাতে হয় সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল, যেখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ‘ফার্গি টাইমে’ জিতে নেয় সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাইনাল।
ফাইনালের আগেই জোড়া আঘাত পেয়েছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, সাসপেনশনের কারণে ফাইনাল খেলতে পারবেন না রয় কিন ও পল স্কোলস! ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ পর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা হিসেবেই ঠিক ইউনাইটেড বক্সের সামনে ফ্রি কিক পেয়ে যায় বায়ার্ন। মারিও বাসলারের ফ্রি কিকটা গোল আর বলের মাঝখানের দেয়ালে ডিফ্লেক্টেড হয়ে পিটার স্মাইকেলকে ফাঁকি দিয়ে জড়িয়ে যায় জালে। বায়ার্ন মিউনিখ ১, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ০!
ম্যাচজুড়েই আক্রমণ করতে থাকে রেড ডেভিলরা, কিন্তু সব আক্রমণই জার্মান দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফলশূন্য হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। ৬৭ মিনিটে ফার্গুসন ব্লংকভিস্টকে তুলে নামালেন শেরিংহ্যামকে, ৮১ মিনিটে অ্যান্ডি কোলকে উঠিয়ে নামালেন সলশেয়ারকে। তার মনে হয়তো আশা ছিল, কেউ এই ম্যাচ জেতাতে পারলে তার সুপার সাবই পারবেন!
৯১ মিনিটের মাথায় মাঠের বাম পাশে কর্নার পেলো ইউনাইটেড। নিতে এগিয়ে গেলেন বেকহ্যাম, বায়ার্ন বক্সে চলে এলেন গোলকিপার স্মাইকেল। বেকহ্যামের কর্নারটা ঠিকমতো ক্লিয়ার হলো না, বক্সের বাইরে বল পেয়ে গেলেন রায়ান গিগস। গিগসের দুর্বল শটটা গোল হতো না, কিন্তু সেটায় পা লাগিয়ে দিলেন শেরিংহ্যাম। গোল! বায়ার্ন সমর্থকদের উল্লাসে ভাটা পড়লো, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইউনাইটেড শিবির।
মিনিটখানেক পরে আবার ইউনাইটেডের কর্নার, আবারও এগিয়ে গেলেন বেকহ্যাম, তবে এবার স্মাইকেল থাকলেন নিজের গোলেই। বেকহ্যামের কর্নারে মাথা ছোঁয়ালেন শেরিংহ্যাম, ফার পোস্ট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো বল। বাদ সাধলেন সলশায়ের। ফার পোস্টে দাঁড়িয়ে থাকা সলশায়ের পা বাড়িয়ে দিলেন… গোল! সুপার সাবের কল্যাণে ‘ফার্গি টাইমে’ শিরোপা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। ততক্ষণে ট্রফিতে লাগিয়ে ফেলা হয়েছিলো বায়ার্নের রিবনও, কিন্তু সলশায়ের নামক ‘আপদ’ বিপাকে ফেললো উয়েফাকেও! ট্রেবল জিতলো ইউনাইটেড, প্রথম ইংলিশ দল হিসেবে, একমাত্র ইংলিশ দল হিসেবে।
সে বছর এভারটনের সাথে ডিসেম্বরে আবার ৪ গোল করেন সলশায়ের। ২০০২ সালের পর হাঁটুর ইনজুরি তাকে ভোগায় দীর্ঘদিন, তিন সিজন সেই ইনজুরির সাথে লড়াই করে ফিরে আসেন ২০০৬ সালে। ফিরে আসার পর প্রথম গোল করেন চার্লটনের সাথে। শেষমেষ ২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট, ইউনাইটেড ক্যারিয়ার শুরুর ঠিক ১১ বছর ৩ দিন পর বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড থেকে বিদায় নেন আরেকজন কিংবদন্তি।
কোচিং ক্যারিয়ার
২০০৮ সালে কোচ হিসেবে অভিষেক হয় সলশায়েরের, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রিজার্ভ দলের দায়িত্ব নেন তিনি। তার অধীনে সেই রিজার্ভ দলে খেলেছিলেন বর্তমানের তারকা পল পগবা ও জেসে লিনগার্ড। রিজার্ভ দল তার অধীনে খেলেছিলো ২৫ ম্যাচ, এর মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ১৬টি জয়, ৫টি ড্র ও ৪টি পরাজয়। এই সময় তার দল ম্যাচপ্রতি গোল করেছিলো ২.০৮টি, হজম করেছিলো ০.৮৮টি, ম্যাচপ্রতি পয়েন্ট ২.১২।
আড়াই বছর রিজার্ভ দলের দায়িত্বে থাকার পর ২০১১ সালে ফিরে যান নিজের শৈশবের ক্লাব মোল্ড এফকে-তে। সেখানে কোচিং করান ৪ বছর, এ সময় তার অধীনে খেলা ১২৩ ম্যাচে ৬৮ জয় তুলে নেয় তার দল, ড্র করে ২৪টি ও হারে ৩১টি ম্যাচ। এ সময় তার দল ম্যাচপ্রতি গোল করেছিলো ১.৮৫টি, হজম করেছিলো ১.২৪টি, ম্যাচপ্রতি পয়েন্ট ১.৮৫। এ সময় তিনি মোল্ড এফকে-কে প্রথমবারের মতো নরওয়েজিয়ান লিগ জেতান, সেটি ছাড়াও জিতিয়েছেন আরও একটি লিগ ও একটি নরওয়েজিয়ান কাপ।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কার্ডিফ সিটিকে রেলিগেশন থেকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। সেখানে ব্যর্থ হন তিনি, রেলিগেটেড হয় কার্ডিফ। তার অধীনে ৩০ ম্যাচে ৯ জয়, ৫ ড্র ও ১৬ হার থেকে ম্যাচপ্রতি গড়ে ১.০৭ পয়েন্ট পায় কার্ডিফ, যা রেলিগেশন এড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। কার্ডিফের পর আবার তিনি ফিরে যান মোল্ড এফকে-তে। সেখানে দ্বিতীয় দফায় তার অধীনে ১১৮ ম্যাচ খেলে মোল্ড, জয় তুলে নেয় ৬৬ ম্যাচে, পরাজয় ও ড্র যথাক্রমে ৩৩ ও ১৯ ম্যাচ। ম্যাচপ্রতি তারা গোল করতো ১.৮৭টি, হজম করতো ১.২২টি, ম্যাচপ্রতি তারা তুলে নিতো ১.৮৪ পয়েন্ট। এ সময় তিনি তুলে নেন তার তৃতীয় নরওয়েজিয়ান লিগ শিরোপা এবং দ্বিতীয় নরওয়েজিয়ান কাপ।
এবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল দলের অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি, ঠিক খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই সিজনের মাঝখানে। হোসে মরিনহোর অধীনে সিজনটা বেশ জঘন্যই যাচ্ছিলো ইউনাইটেডের, লিগে আছে ৬ নাম্বারে। শীর্ষে থাকা লিভারপুলের সাথে পয়েন্টের ব্যবধান ১৯, চারে থাকা চেলসির সাথেও ১১। গত সিজন পুরোটা জুড়ে যেখানে গোল খেয়েছিলো মাত্র ২৮টি, এবার সেটা পেরিয়ে গেছে তারা মাত্র ১৭ ম্যাচেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বে খেলাটা পিএসজির সাথে। সলশায়েরের কাজটা সহজ নয়।
সলশায়ের পারবেন কি না, সেই প্রশ্নটা সময়ের উত্তরের জন্য তুলে রাখা যাক। তবে ‘সুপার সাব’ সলশায়ের ইউনাইটেডের ভাঙা তরী তীরে না ভেড়াতে পারলেও কাছে আনতে পারবেন, এই আশা করতে ইউনাইটেড সমর্থকদের দোষ কোথায়!