Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বার্সেলোনার লা মাসিয়া: ঐতিহাসিক স্থান থেকে অধঃপতন

লা মাসিয়া শব্দের শুদ্ধ বাংলা হলো খামারঘর। যদি ফুটবলের সাথে মিলিয়ে বলা যায়, তবে ফুটবলের খামারঘর বেশি গ্রহণযোগ্য। বিশ্বের অন্য সকল ক্লাবের তুলনায় বার্সেলোনার আলাদা একটি পরিচয় আছে। সেই পরিচয়ের স্থানটি হলো লা মাসিয়া। ইয়োহান ক্রুয়েফের হাতে গড়া লা মাসিয়ার কারণে শুধু বার্সেলোনা নয়, লাভের দেখা পেয়েছিলো স্পেনও। এই লা মাসিয়া থেকে উঠে এসেছেন লিওনেল মেসি। এছাড়াও আছেন পেদ্রো, ডেভিড ভিয়ার মতো আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়; সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজের মতো মিডফিল্ডাররা; জেরার্ড পিকে, কার্লোস পুয়োলের মতো ডিফেন্ডার এবং পেপে রেইনা ও ভিক্টর ভালদেসের মতো তারকা গোলরক্ষকরা।

লা মাসিয়া ও লা মাসিয়া থেকে বের হওয়া সেরা রত্নেরা; Image Source: fcbarcelona.com

কিন্ত গত কয়েক বছর লা মাসিয়া সেভাবে আর খেলোয়াড়দের জোগান দিতে পারছে না। যেখানে টিটে ভিলানোভা একটি একাদশই সাজিয়েছিলেন লা মাসিয়া থেকে আসা খেলোয়াড়দের নিয়ে, সেখানে বর্তমান বার্সেলোনা দলে লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বলতে গেলে গত কয়েক বছরে এক সার্জি রবার্তো ছাড়া কেউ বার্সেলোনা দলে থিতু হতে পারেননি। অনেকে দলে আসলেও নিয়মিত হতে পারেননি। কিন্ত কেন এরূপ পতন?

দায়ী যখন লুইস এনরিকে

লা মাসিয়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে দারুণ একটি স্কোয়াড সাজিয়েছিলেন পেপ গার্দিওলা। তিনি চাইতেন অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়দের নিয়ে তার স্বপ্নের একাদশকে গড়তে, করেছিলেনও তা-ই। তার দলে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তার পাশাপাশি ছিলেন ভিয়া, পেদ্রোরা। পেপ গার্দিওলার যুগে বার্সাও প্রায় যা কিছু জেতা যায় জিতেছে। গার্দিওলার পর ভিলানোভা কোচ হয়ে আসেন। তার দর্শনও গার্দিওলার মতো ছিলো। প্রমাণিত তারকা খেলোয়াড় কেনা নয়, অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা তরুণদের সুযোগ করে দেওয়ার স্বভাব ছিলো তার। একবার তো পুরো একাদশ সাজিয়েছিলেন লা মাসিয়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে। কিন্ত লুইস এনরিকে কোচ হয়ে আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

লুইস এনরিকে; Image Source: Getty Image

অল্প বয়সী যুব ফুটবলারদের সই করানোর ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৫ সালে বার্সেলোনাকে দলবদলের বাজারে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়। এরপর ন্যু ক্যাম্পে বার্সা সমর্থকদের হাতে ব্যানার দেখা যায়, “আর নয় লা মাসিয়া’”। ওদিকে লুইস এনরিকেও প্রমাণে বিশ্বাসী, ফলাফলে বিশ্বাসী। খেলোয়াড় গড়তে নয়। তাই তিনি একরকম লা মাসিয়ার যুব খেলোয়াড়দের উপেক্ষা করে চললেন। তার স্কোয়াডে তরুণ লা মাসিয়ার খেলোয়াড় বলতে ছিলেন রাফিনহা আলকানতারা ও সার্জি রবার্তো। মার্ক বাত্রা, সার্জি সাম্পার, মুনির এল হাদ্দাদি, সান্দ্রো রামিরেজকে তিনি কোনো সুযোগ কখনোই দেননি। তার পছন্দসই খেলোয়াড় আর্দা তুরান, জেরেমি ম্যাথিউ, পাকো আলকাসের ও আন্দ্রে গোমেজ কেনা হলেও তারা ছিলেন চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ। লুইস এনরিকের এরূপ কর্মের ফল এখনও চলমান। বার্সেলোনা অঢেল টাকা ঢেলে খেলোয়াড় কিনছে, কিন্তু লা মাসিয়ার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না।

একজন দায়িত্ববান পথপ্রদর্শকের অভাব

হাভিয়ে গার্সিয়া পিয়েমেন্তা। লা মাসিয়া নিয়ে যাদের জানাশোনা আছে তাদের অনেকের সাথেই এ নামটি পরিচিত। তার হাত ধরেই ফুটবলার তৈরি হতো লা মাসিয়ায়। সেখানকার সবকিছুই পিয়েমেন্তা দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। তাকে একজন আদর্শ ফুটবল কারিগর হিসেবে আখ্যা দিলেই সবথেকে মানানসই হয়। তার ফুটবল দর্শনের ছায়াতেই গড়ে উঠেছেন মেসি, ইনিয়েস্তা বা জাভির মতো ফুটবলাররা। সেগুন্ডা ডিভিশনে তে টানা ৫ বছর বার্সেলোনা বি দল খেলার পর সেই ডিভিশন থেকে অবনতি হলে পিয়েমেন্তাকে বার্সেলোনা বি দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই বছর পর বার্সেলোনা বি দলকে আবার সেগুন্ডা এ ডিভিশনে ফিরিয়ে আনেন তিনি।

গার্সিয়া পিয়েমেন্তা, লা মাসিয়ার আস্থা; Image Source: fcbarcelona.com

এ সাফল্যের পরে তাকে বার্সেলোনা জুভেনাইল এ দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ধারাবাহিক সাফল্যের দেখা পেলেও বার্সেলোনা বি’র অবনতি হতে থাকে। পিয়েমেন্তা জুভেনাইল এ দলের দায়িত্ব নেবার পর লা মাসিয়াতেও দৈন্যদশা চলতে থাকে। তিনি ছিলেন লা মাসিয়ার আস্থা। তাই তার অনুপস্থিতির জন্য এবং নতুন কোচের সাথে বনিবনা না হবার কারণে অনেক তরুণ খেলোয়াড় লা মাসিয়া ছেড়ে চলে যায়। এবং মাঝের সেই বছর বার্সেলোনা বি দলেও কোনো প্রতিভাবান খেলোয়াড় আসেনি। তাই বার্সেলোনা বি বাধ্য হয় বাইরে থেকে খেলোয়াড় কিনতে। যদিও তাদের সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। শুধু মাঝের দুই বছরে লা মাসিয়ার বড্ড ক্ষতি হয়ে গেছে।

তবে গার্সিয়া পিয়েমেন্তা ফিরে এসেছেন বার্সেলোনা বি দলে। আবারও দেখভাল করতে শুরু করেছেন লা মাসিয়াকে। অনেক খেলোয়াড়, যারা লা মাসিয়া ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন, তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। পিয়েমেন্তাও চেষ্টা করছেন যারা লা মাসিয়া ছেড়ে চলে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে। এবং আশ্বাস দিয়েছেন বাইরে থেকে কোনো খেলোয়াড় কেনা হবে না, শুধুমাত্র লা মাসিয়ানদের দিয়েই গঠিত হবে বার্সেলোনা বি দল।

সংস্কৃতির বদল

পেপ গার্দিওলা বলেছিলেন, “লা মাসিয়া থেকে যারা পূর্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে বের হয়, তারা যেন বাকি সবার থেকে ভিন্ন।” আসলেই তা-ই! লা মাসিয়ার একজন খেলোয়াড়কে ছোট থেকে শেখানো হয় কাতালানদের পাসিং ফুটবল, তাদের সংস্কৃতি। তাই লা মাসিয়া থেকে বেড়িয়ে আসা খেলোয়াড়দের খেলার ধরণই ভিন্ন হয়।

পেপ গার্দিওলা, বার্সেলোনার টিকিটাকার পথপ্রদর্শক; Image Source: Getty Image

কিন্তু ফুটবল বদলাচ্ছে। বর্তমান সময়ে ফুটবলের গতির কাছে হার মেনেছে সবকিছুই। সব দলই চায় মৌসুম শেষে শিরোপা ঘরে তুলতে। কিন্তু সবসময় সৌন্দর্যের ফুটবল খেলে গেলে সেটা সম্ভব হয় না। এরূপ ধারণা বর্তমানে বার্সেলোনার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে বলে বার্সেলোনার ভেতরও গতির বিষয়টি ঢুকে গেছে। তাই পেপ সেগুরা ও রবার্ট ফার্নান্দেজ খুঁজে চলছেন গতির ফুটবলের সাথে মানাসই ফুটবলারদের।

বোর্ডের গোয়ার্তুমি

সময়ের সাথে চলতে গিয়ে বার্সেলোনার ফুটবল দর্শনেও গতির বিষয়টা চলে এসেছে। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও জাভি না থাকার কারণে মাঝমাঠের সেই কারুকাজ ভবিষ্যতে দেখার সম্ভবনা কম। তাই দরকার গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা ফুটবলাদের। কিন্তু এরূপ ফুটবলাদের থাকতে হয় দুর্দান্ত শারিরীক গঠন, যা লা মাসিয়াদের ভেতর সচরাচর থাকে না। ইনিয়েস্তা, জাভি, মেসি বা পুয়োলরা কখনোই দুর্দান্ত শারিরীক গঠনের অধিকারী ছিলেন না। তাই বোর্ডের এরূপ খেলোয়াড়প্রীতির কারণে কাতালান রীতিনীতি অনেকটা ভেঙে গেছে।

লা মাসিয়ার সেরা রত্ন, যদিও মেসি শারীরিকভাবে শক্তিশালী নন; Image Source: AFP

তাই পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, শুধুমাত্র এ কারণে লা মাসিয়া থেকে খেলোয়াড় তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ। পিয়েমেন্তার অনুপস্থিতিতে বার্সেলোনা বি দলে একের পর এক বাইরের খেলোয়াড় কেনা হয়েছে। লা মাসিয়ানরা তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত বলে দল ছেড়েছেন। একই ধারা বজায় রেখে বার্সেলোনা মূল দলে খেলার মতো যোগ্য কোনো খেলোয়াড় উঠে আসেনি। ফলে বার্সেলোনাকেও বাইরে থেকে খেলোয়াড় কেনার দিকে ঝুঁকতে হয়েছে।

সবার মাঝে জাভি, ইনিয়েস্তাকে খোঁজার প্রবণতা

জাভি, ইনিয়েস্তা অথবা সার্জিও বুসকেটসের মতো খেলোয়াড় লা মাসিয়া তৈরি করেছে সত্য। কিন্তু আবারও আরেকবারের জন্য একদম জাভি বা বুসকেটসের মতো খেলোয়াড়কে লা মাসিয়া উপহার দেবে এমনটা ভাবা অাকাশ কুসুম কল্পনার মতো। জাভির বিদায়ের পর বার্সেলোনা লা মাসিয়া থেকে এবং বাইরে থেকে খেলোয়াড় কিনে তার শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করেছে। কিন্ত মাঠে সেই জাভির মতো কারুকাজ কেউ করতে পারেনি। প্রতিভাবান লা মাসিয়ান ডেনিস সুয়ারেজকে জাভির স্থানেই বার্সেলোনায় আনা হয়েছিল। তাকে দেওয়া হয়েছিল তার রেখে যাওয়া ৬ নম্বর জার্সি। কিন্ত তার মতো খেলা তো ডেনিস কখনো খেলতেই পারেননি, উল্টো চাপে পড়ে নিজের স্বাভাবিক খেলার দক্ষতাও হারিয়েছেন। যার দরুন বর্তমান দলে তার স্থান প্রায় নেই বললেই চলে।

জাভির উত্তরসূরী বার্সেলোনা এখনও বের করতে পারেনি; Image Source: Marca

একইরকম ঘটনা ঘটেছে সার্জিও সাম্পারের ভাগ্যে। সবাই ভেবেছিলো সাম্পার সার্জিও বুসকেটসের যোগ্য উত্তরসূরী। কিন্ত মাত্র কয়েকটা ম্যাচে সুযোগ দিয়েই তাকে প্রায় ক্লাব থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

তবে দোষ সমর্থক বা বোর্ডের নয়। বুসকেটস, জাভি ও ইনিয়েস্তার মধ্যমাঠের কারুকাজ আর তাদের সাথে মেসির রসায়ন থেকে কাতালানদের যে ভ্রম সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বের হয়ে আসা কষ্টকর। তারা না থাকলেও তাদের মতো খেলা উপভোগ করার জন্য কাতালানরা এখনও ব্যাকুল। কিন্তু এ ধারণা বার্সেলোনার ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেই জুটিকে ফিরে পাওয়া যাবে না, যাবে না গার্দিওলার আমলের নান্দনিক ফুটবল। খেলার ধরণ পাল্টাবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই অবিলম্বে বোর্ড ও কাতালান সমর্থকদের এরূপ ধারণা থেকে বের হয়ে আসাটা জরুরি।

সার্জি রবার্তোর পর আর কোনো লা মাসিয়ান বার্সেলোনা মূল দলে নিয়মিত হতে পারেননি; Image Source: Twitter

তবে এটা সত্য যে, বর্তমানে বা বিগত কয়েক বছর যাবত লা মাসিয়া থেকে সেভাবে প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসেনি। অথবা বার্সেলোনা বি-তে ভালো করলেও তারা বার্সেলোনার মূল দলে খেলা ও বার্সেলোনার স্কোয়াডে সুযোগ করে নিতে প্রস্তুত না। এ কারণেই রাইট-ব্যাকের অভাব থাকলেও বার্সেলোনা বি থেকে সার্জি প্যালেন্সিয়াকে মূল দলে স্থায়ী করা সম্ভব হয়নি। করা যায়নি সার্জি কুয়েঙ্কাকেও, যাকে বলা হয় বার্সেলোনা বি দলের সেরা প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের একজন। যদিও বার্সেলোনা খেলোয়াড় হারিয়েছে এটাও সত্য। জর্দি এমবুলা, সার্জিও গ্রিমালদো ও হেকটর বেয়েরিন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ভালভার্দে চান লা মাসিয়ানদের ব্যবহার করতে; Image Source: Marca

বার্সেলোনা এবার অনেক তারকা খেলোয়াড় কিনলেও আর্নেস্তো ভালভার্দের পরিকল্পনা যে বার্সেলোনার বয়সভিত্তিক দল নিয়ে তা পরিষ্কার। যদিও কোচ আগ্রহ দেখালে তা লা মাসিয়ার জন্যই ভালো হবে। বার্সেলোনা প্রাক-মৌসুমের খেলা দেখে ভালভার্দে অভিভূত। সার্জিও কুকুরেলা, সার্জি মিরান্দা ও রিকি পুইগের খেলা দেখে তিনি যে বিস্মিত হয়েছেন তা তিনি নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। তাই দলের দ্বিতীয় পছন্দের লেফট-ব্যাক লুকাস দিনিয়েকে বিক্রি করে সুযোগ করে দিয়েছেন সার্জি মিরান্দাকে। এছাড়াও মুনির এল হাদ্দাদি এবার তার পরিকল্পনায় থাকবেন। হয়তো ক্ষীণ একটা সুযোগ রয়েছে, কিন্ত এতে করে লা মাসিয়ার সেই জৌলুস ফিরে পাবার সম্ভাবনা কতটুকু তা বলা সম্ভব নয়।

ফিচার ইমেজ: Getty Image

Related Articles