শচীন টেন্ডুলকার, ভিভ রিচার্ডস, সুনীল গাভাস্কার, রিকি পন্টিং… এভাবে বলতে থাকলে তালিকাটা বেশ বড় হয়ে যাবে। অবশ্য একজনকে কীসের ভিত্তিতে কিংবদন্তি বলা হবে, তা নির্দিষ্ট হলে তালিকাটা অন্য রকম হতে পারত। ১৪০ বছরের বেশি বয়সের ক্রিকেটে কিংবদন্তির নির্দিষ্ট সংখ্যা না খুঁজে বরং অসংখ্য বা অনেক বলে ফেলাই উচিত। সেসব কিংবদন্তির মধ্যে যে ক’জনের নাম প্রথমদিকেই আসবে, তাঁরা হলেন ডন ব্রাডম্যান, ভিভ রিচার্ডস, শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, কুমার সাঙ্গাকারা, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, মাহেলা জয়াবর্ধনে, জ্যাক ক্যালিস প্রমুখ। এই ছোট্ট তালিকায় কিন্ত একজনের নাম থাকা উচিত হলেও নেই। তিনি কিংবদন্তি হয়েও একটি বিষয়ে এই কিংবদন্তিদের থেকেও আলাদা। বাকিরা যা করতে পারেননি, তা–ই করেছেন তিনি। এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা তিনি কে।
তিনি পৃথিবীর একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি ৪০০ রান করেছেন এক ম্যাচেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক তাঁর ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে যা পারেননি। ২০০টি টেস্ট খেলে কখনও ৪০০ রানের ইনিংস খেলতে পারেননি লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। টেস্টে সর্বোচ্চ গড়ের মালিক (৯৯.৯৪) স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও পারেননি। শচীনের আদর্শ ভিভ রিচার্ডসও না। ফার্স্ট ক্লাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ডটাও (৫০১ অপরাজিত) লারার দখলে।
চারশ করা এত কষ্ট! এত মহান ব্যাটসম্যানরা সারা জীবনে একবারও করতে পারলেন না। ব্র্যাডম্যান ৪০০ থেকে ৬৬ রান দূরে থেমে গেছেন। লারার এই অর্জনের আগে হয়তো তাঁরা ভাবতেও পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪০০ করা সম্ভব। যদিও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে লারার আগেও ৪০০ রানের অধিক ইনিংস খেলেছেন ৮ জন। যেকোনো স্তরেই চারশর বেশি রানের ইনিংস খেলা বিশাল ব্যাপার। তবু আন্তর্জাতিক আর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের মাঝে ফারাক তো অবশ্যই আছে। লারাও আন্তর্জাতিক রেকর্ড করার প্রায় ১০ বছর আগে ইংলিশ কাউন্টিতে ৫০১ রান করেছিলেন ৪২৭ বলে।
টেন্ডুলকার, যাঁর ব্যাটিংয়ের ভক্ত অনেকেই। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে স্বার্থপরের মতো এত লম্বা সময় খেলার সুযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিকে তো তা নেই। তবু সুযোগ পেলেও চারশ করা অত সহজ নয়! আন্তর্জাতিক টেস্টে ২৮ জনের ৩১টি তিনশর বেশি রানের ইনিংস রয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জনই চারশর আগে আউট হয়ে গেছেন। এখন আপনি বলতে পারেন, যাঁরা অপরাজিত ছিলেন, তাঁরা তো করে ফেলতে পারতেন চারশ। আর যাঁরা আউট হয়েছেন, তাঁরা তো ব্যর্থই! তাহলে ধরে নেয়া যাক, যাঁরা ৩৫০–এর ওপরে গিয়ে অপরাজিত ছিলেন, তাঁরা হয়তো চারশ করতে পারতেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা তো মাত্র ১। বাকি ৭ জন অপরাজিত থাকলেও অনেক দূরে ছিলেন। ৪০০ রান থেকে ১ রান কম থাকলেও তো এটা নিশ্চিত নয় যে তিনি ৪০০ করবেন। আর বাকি সাতজন তো ছিলেন অনেক দূরে, ৫০ রানেরও বেশি।
৪০০–এর কাছাকাছি, ৩৫০–এর ওপর মানদণ্ড হিসেবে ধরলে তা করতে পেরেছেন মাত্র পাঁচজনই। এর মধ্যে আউট হয়েছেন চারজন। শুধু ৩৬৫ রান করে অপরাজিত ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স, সেটা লারার মহাকাব্যিক ইনিংসের ৪৬ বছর আগে। আর তখন সেটাই ছিল টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর। সোবার্সও হয়তো ধরে নিয়েছিলেন এটাই সর্বোচ্চ থাকবে অনেক বছর। থেকেছেও প্রায় ২৬ বছর। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৭৫ রান করেই আবার ১৯৯৪ সালে সোবার্সের রেকর্ড ভেঙেছিলেন ব্রায়ান লারা। ২০০৩ সালে ৩৮০ রান করে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন অস্ট্রেলিয়ার মেথু হেইডেন। এর মাস ছয়েক পরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৪০০ রান করে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ডটা আবার নিজের করে নেন লারা।
২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে তিন ম্যাচ হেরে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রশ্ন উঠছে লারার অধিনায়কত্ব নিয়ে। হোয়াইটওয়াশ এড়াতে শেষ ম্যাচ জিততেই হবে। লারা খেলে ফেললেন চার শ রানের অভাবনীয় এক ইনিংস। তবে সেই ম্যাচ জিততে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যে সিরিজে বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে কেউ চারশ রান করে সে সিরিজের ফলাফল নিয়ে আর কতটা ভাবার আছে! লারাও হয়তো দুঃসময় ভুলে উদযাপনেই মেতে ছিলেন!
লারার ৪০০ রানের ইনিংসের পরে ৩০০–এর বেশি রানের ইনিংস খেলা হয়েছে ১২টি। এর মধ্যে অপরাজিত ছিলেন পাঁচজন। সর্বোচ্চ ৩৭৪ রান করতে পেরেছেন শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়াবর্ধনে। কোনো ব্যাটসম্যান ৩০০ রান করার পরও দল কেন ইনিংস ঘোষণা করে? জয়ের জন্যই তো! আর এই পাঁচজনেরই কিন্তু নিজের দল সেসব টেস্টে জয়লাভ করেছে। সবশেষ ওয়ার্নার ৩৩৫–এ অপরাজিত থাকা অবস্থায় অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ঘোষণা করে। শেষে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁরা জেতেও। এ রকম হাশিম আমলা (৩১১*), মাইকেল ক্লার্ক (৩২৯*), করুন নায়ার (৩০৩*), আজহার আলী (৩০২*) সবারই দল জিতেছে।
তবে ৩০০–এর বেশি রান করে অপরাজিত থেকেছেন আর দল জেতেনি- এরকম দুজন ব্যাটসম্যান রয়েছেন। সে অনেক আগের কথা, ১৯৩৩ সালে। প্রথমে ব্যাট করে ২০০–এর আগে অলআউট হয় নিউজিল্যান্ড। এরপর ওয়ালি হ্যামন্ডের ৩৩৬ রানে ভর করে ৫৪৮ করে ইংল্যান্ড। পরে নিউজিল্যান্ড বিনা উইকেটে ১৬ রান করে। ম্যাচ হয়ে যায় ড্র। তবে ম্যাচটা ছিল তিন দিনের!
আরেকজন হচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার মার্ক টেলর। ১৯৯৮ সালে তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৩৩৪ রানের ইনিংস খেলেন। কিন্ত ম্যাচটা হয়ে যায় ড্র। অবশ্য তাঁর অত বড় ইনিংস খেলার কারণে অস্ট্রেলিয়া জিততে পারেনি, তা-ও বলা যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেটে ৫৯৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। জবাবে পাকিস্তানও করে ৫৮০ রান। এরপর আবার অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে ২৮৯ রান করে। ম্যাচের পাঁচ দিনও পার হয়ে যায়।
তাহলে, এই যে অসংখ্য কিংবদন্তি এত এত টেস্ট খেলে গেলেন, কিন্তু কেউই ৪০০ রানের ইনিংস খেলতে পারলেন না। ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার তো ২৪৮ রানই করতে পেরেছেন সর্বোচ্চ। পৃথিবীতে একমাত্র ব্রায়ান লারাই ৪০০ রানের ইনিংস খেলতে পারলেন। নিশ্চয়ই সেটা সহজ কাজ নয়। লারার এই অসাধ্য কাজ করার কারণে অনেকে তাঁকে স্বার্থপরের তকমাও দিয়েছেন। কিন্তু ১৪৩ বছরে কেউ স্বার্থপর হয়ে কিংবা না হয়েও তো এ অসাধ্য সাধন করতে পারেননি। এ জন্য তো স্বার্থপর লারা একটা স্যালুট পেতেই পারেন। তাহলে লারাকে মনে মনে একটা স্যালুট দিয়েই দেন না!
স্যালুট, ব্রায়ান চার্লস লারা।