সময়ের সাথে ক্রিকেট বদলেছে অনেক। টি টুয়েন্টি যুগ আসার সাথে মারকাটারি ক্রিকেটও বেড়েছে কয়েক গুণ। একটা সময় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রতিপক্ষকে আড়াইশো রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিলেও নিরাপদ ছিলো। কিন্তু বর্তমানে তিনশোর উপর রানও নিরাপদ নয়। ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন, ব্যাটিংয়ের আরো সুযোগ সুবিধায় স্ট্রোক খেলা খেলোয়াড়ও বাড়ছে দিন দিন। ভালো কিংবা খারাপ; যেকোনো বলকেই একজন ব্যাটসম্যান নিজেদের দিনে আছড়ে ফেলতে পারেন গ্যালারিতে বা দর্শক সারিতে। তবে কয়েকজন খেলোয়াড় মানেই বোলারদের জন্য বিভীষিকা। নিজেদের সহজাত ছয় মারার প্রবৃত্তিতে ক্যারিয়ারে ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন তারা। আজ আমরা দেখবো এরকম কয়েকজন খেলোয়াড় বা ব্যাটসম্যানকে, যাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে অন্তত ৩০০টি ছয়।
এবি ডি ভিলিয়ার্স (দক্ষিণ আফ্রিকা) – ৩২৮ ছয়
কিছুদিন আগেই এবির অবসরের ঘোষণায় শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, বরং পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরাও ব্যথিত হয়েছেন। স্টাইলিশ ও দৃষ্টিনন্দন সব শট খেলে সাবেক এই দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার দর্শকদের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন অনেক আগেই। মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রী খেতাব পাওয়া এই খেলোয়াড়ের নামের পাশে রয়েছে ৩২৮টি ছয়।
২০০৪ সালে ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড সফরে ওয়ানডে এবং টেস্ট ক্রিকেট দুটোতেই অভিষেক হয় এই ক্যারিশমাটিক ব্যাটসম্যানের। এরপরের ১৮ বছর নিজের চওড়া ব্যাটে বোলারদের শাসন করে আনন্দ দিয়ে গেছেন সব জায়গায়। ২২৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে হাঁকিয়েছেন ২০৪টি ছয়। পাশাপাশি টেস্ট ও টি টুয়েন্টিতে মেরেছেন যথাক্রমে ৬৪ ও ৬০টি ছয়।
দুর্দান্ত স্ট্রোক প্লেতে ভেঙেছেন গাদাখানেক রেকর্ডও। ২০১৫-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে মাত্র ১৬ বলে অর্ধ শতক এবং ৩১ বলে শতক হাঁকিয়ে দ্রুততম অর্ধশতক ও শতকের মালিকও হন এবি ডি ভিলিয়ার্স। সেই ম্যাচে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ১৬টি ছয় মেরে রোহিত শর্মার রেকর্ডটিও ছুঁয়ে ফেলেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই আচমকা অবসরের ঘোষণা না দিলে হয়তো আরো অনেক রেকর্ডই তার পায়ে লুটাতো।
মহেন্দ্র সিং ধোনি (ভারত) – ৩৪৩ ছয়
মহেন্দ্র সিং ধোনি শুধু ভারতের ত্রাতা হিসেবেই নন, বহির্বিশ্বে পরিচিত দুর্দান্ত এক অধিনায়ক হিসেবেও। ক্ষুরধার মস্তিষ্কের পাশাপাশি ব্যাটিংও পারেন সমানতালে। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে ধোনির ব্যাটিংয়ের ধারও বেড়েছে। তাই এই বয়সেও ভারত ভরসা করছে ধোনির চওড়া কাঁধের উপরেই।
২০০৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ওয়ানডে অভিষেক হলেও টেস্টের জন্য ধোনিকে অপেক্ষা করতে হয় আরো এক বছর। তবে প্রথমদিকে নিজেকে এত মেলে ধরতে না পারলেও ধীরে ধীরে ভারত ক্রিকেট দলের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেন। ওয়ানডে দশ হাজারি ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৩২ ম্যাচে ছয় হাঁকিয়েছেন ২১৮টি। ওয়ানডের পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেটে ধোনির ছয়ের সংখ্যা ৭৮টি এবং টি টুয়েন্টিতে ৪৭।
এখনো খেলে যাচ্ছেন এরকম খেলোয়াড়দের মধ্যে গেইল এবং ধোনির নামের পাশেই রয়েছে তিন শতাধিক ছয়। ৩৭ বছর হয়ে যাওয়ায় হয়তো আর বেশিদিন মাঠে থাকবেন না। তবে যতদিনই থাকেন, হেলিকপ্টার শটে হয়তো ছয় মেরে দর্শকদের আনন্দই দিয়ে যাবেন সাবেক এই ভারতীয় অধিনায়ক।
সনাৎ জয়াসুরিয়া (শ্রীলংকা) – ৩৫২ ছয়
মাতারা হারিকেন নামে খ্যাত শ্রীলংকান কিংবদন্তী সনাৎ জয়াসুরিয়া ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই খ্যাত ছিলেন দুর্দান্ত স্ট্রোক প্লের জন্য।
১৯৮৯ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় জয়াসুরিয়ার। ১৯৯১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন প্রথম টেস্ট ম্যাচ। ক্যারিয়ারে সর্বমোট ছয় হাঁকিয়েছেন ৩৫২টি। এর মধ্যে ২৭০টিই এসেছে ৪৪৫ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে। টেস্ট ক্রিকেটে জয়াসুরিয়ার ছয় সংখ্যা ৫৯টি। টি টুয়েন্টি যুগে বুড়িয়ে যাওয়া জয়াসুরিয়ার ছয় সংখ্যা ২৩টি।
তবে জয়াসুরিয়া বিখ্যাত হয়ে আছেন কয়েকটি দ্রুততম শতক হাঁকিয়ে। পাশাপাশি ডি ভিলিয়ার্স রেকর্ড ভাঙার আগপর্যন্ত জয়াসুরিয়ার দখলে ছিলো সবচেয়ে কম বলে অর্ধশতক হাঁকানোর রেকর্ড। ১৯৯৬ সালে ১৭ বলে অর্ধশতক করে রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছিলেন জয়াসুরিয়া। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৭০টি ছয়ের পাশাপাশি প্রথম শ্রীলংকান হিসেবে দশ হাজারি রানের ক্লাবেও প্রবেশ করেন তিনি।
ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (নিউজিল্যান্ড) – ৩৯৮ ছয়
টি টুয়েন্টি ঘরানার কয়েকজন মারকুটে ব্যাটসম্যানের নাম নিলে সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্র্যান্ডন ম্যাককালামের নাম আসাটা আবশ্যক। নিজের দিনে যেকোনো বোলারকেই পাড়ার বোলারে নামিয়ে আনার ক্ষমতা ছিলো এই ব্যাটসম্যানের।
মাত্র ২১ বছর বয়সে ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয় ম্যাককালামের। টেস্ট অভিষেক হয় এরও দুই বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মেরে খেলার স্বভাব ছিলো এই ব্যাটসম্যানের। ২৬০টি ওয়ানডে খেলে তিনি ছুঁয়েছেন বরাবর ২০০টি ছয় মারার মাইলফলক। পাশাপাশি অ্যাডাম গিলক্রিস্টের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্যারিয়ারে মেরেছেন ১০০টির উপর ছয়, ভেঙেছেন গিলক্রস্টের ১০০টি ছয় মারার রেকর্ডও। ১০১ টেস্টে ১০৭টি ছয় মারার পাশাপাশি টি টুয়েন্টিতেও মেরেছেন ৯১টি ছয়। তা-ও মাত্র ৭১টি ম্যাচ খেলেই।
২০১৬ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে অবসর না নিলে হয়তো সবচেয়ে বেশি ছয় মারার মুকুটটি উঠতো ম্যাককালামের মাথাতেই।
ক্রিস গেইল (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) – ৪৭৬ ছয়
নিজেকে নিয়ে নিজের লেখা বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘সিক্স মেশিন’। টি টুয়েন্টির ডন ব্র্যাডম্যান কি না এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, নিজেকে টি টিয়েন্টির সর্বকালের সেরা ভাবেন তিনি। তার মুখে এমন দম্ভ অবশ্য মানানসইও বটে।
১৯৯৯ সালে ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ করেন গেইল। এরপরের গল্প নিজের হাতেই লিখেছেন। একের পর এক রেকর্ড গড়েছেন। ওয়ানডেতে ২৮৪ ম্যাচে হাঁকিয়েছেন ২৭৫টি ছয়। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টি টুয়েন্টিতে মেরেছেন ১০০ এর উপর ছয়। মাত্র ৫৬ টি টুয়েন্টি ম্যাচে গেইলের ছয়ের সংখ্যা ১০৩টি। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৯৮টি ছয় মারলেও চার বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেটের বাইরে আছেন এই ব্যাটিং দানব।
নিজের দিনে গেইলকে আটকাতে পারে এমন বোলারের হয়তো জন্মই হয়নি এখনো। ঘরোয়া লিগের টি টুয়েন্টিতেও তাই গেইলের কদর আকাশছোঁয়া। ৩৯ বছর হয়ে গেলেও সামনের বিশ্বকাপ খেলাকে পাখির চোখ করেছেন ক্রিস গেইল। সেই সুযোগ আসুক বা না আসুক, আফ্রিদিকে সরিয়ে তিনিই যে হতে যাচ্ছেন ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ছয়ের রাজা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শহীদ আফ্রিদি (পাকিস্তান) – ৪৭৬ ছয়
শহীদ আফ্রিদি, যাকে দর্শকেরা নাম দিয়েছেন বুম বুম আফ্রিদি। হেলেদুলে আফ্রিদিকে মাঠে নামতে দেখলে সবার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসে, “ঐ তো আফ্রিদি নামছেন।” বিনোদনের ফেরিওয়ালা হিসেবে সুখ্যাতি ছিলো তার। ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেটের মালিক আফ্রিদি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয় মারার রেকর্ডটিও ধরে রেখেছেন।
১৯৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সী আফ্রিদির অভিষেক ঘটে কেনিয়ার সাথে। পরের বছরই শ্রীলংকার সাথে মাত্র ৩৭ বলে তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে দ্রুততম ওয়ানডে শতক করে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে, যে রেকর্ড টিকে ছিলো দীর্ঘ ১৭ বছর। ৩৯৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে আফ্রিদি হাঁকিয়েছেন সর্বোচ্চ ৩৫১ ছয়। সাথে টেস্ট ও টি টুয়েন্টিতে মেরেছেন যথাক্রমে ৫২ ও ৭৩টি ছয়। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডেতে অবসরের পর ২০১৮ সালে পুরোপুরিভাবে বিদায় জানান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে।