Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক অজানা কল অফ ডিউটির গল্প

ভদ্রলোক খেলেছেন ৪২ টেস্ট, ৫ সেঞ্চুরি আর ১৫ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ২৭২৭ রান। গড় ৪০.১। ভদ্রলোকের নাম বার্ট সাটক্লিফ।

আরেক ভদ্রলোকের কথা বলা যাক। ইনি একজন বোলার। ১৯ টেস্টে নিয়েছেন ৪৩ উইকেট। নাম রবার্ট উইলিয়াম ব্লেয়ার, সংক্ষেপে বব ব্লেয়ার।

দু’জনের কারো রেকর্ডই এমন আহামরি কিছু নয়। তবে এসব দিয়ে এই দু’জনকে বিচার করতে গেলে ভুল হবে। সিংহহৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এই দু’জন ক্রিকেটার, নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় ম্যাচে লেখা হয়ে আছে তাদের নাম। যে ম্যাচ সম্পর্কে নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক ডিক ব্রিটেন্ডেন বলেছেন,

‘it was a great and glorious victory, a story every new zealand should learn at his mother’s knee.’

বার্ট সাটক্লিফ; Source: Wikipedia

সময়টা ১৯৫৩ সাল। ৫ ম্যাচের এক সিরিজ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকাতে গেল নিউজিল্যান্ড। টেস্টে তাদের অভিষেকের বয়স হয়েছিলো প্রায় দুই দশকেরও বেশি, এই সময়ের মধ্যে তারা জিততে পারেনি একটি টেস্টেও। এই অবস্থায় ডারবানে শুরু হলো প্রথম টেস্ট, সেই টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে ইনিংস ও ৫৮ রানের ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে গেলো স্বাগতিকরা।

প্রায় দশ দিন বিরতির পরে, ক্রিসমাসের আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর, দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হলো জোহানেসবার্গে। বক্সিং ডে টেস্ট ছিল সেটা। জোহানেসবার্গের পিচ ছিল সিমারদের স্বর্গরাজ্য। প্রথমদিনের খেলা যখন শেষ হলো, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ৮ উইকেটে ২৫৮ রান। পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ২ উইকেট ফেলে দিতে পারলেই খেলা শেষ, এটা ভেবেই হয়তো ড্রেসিংরুমে ফিরলেন নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা।

পরদিন ছিল উৎসবের দিন, ক্রিসমাস। একদিন বন্ধ থাকলো খেলা। আনন্দের সাথে ক্রিসমাসটা উদযাপন করে খুশিমনে ঘুমাতে গেলেন দুই দলের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু ২৬ তারিখ সবার ঘুম ভাঙলো এক দুঃসংবাদে, ট্রেন দুর্ঘটনায় নিউজিল্যান্ডে মারা গেছে ১৫১ জন। সেই ১৫১ জনের মধ্যে একজন নিউজিল্যান্ডের বোলার বব ব্লেয়ারের প্রেমিকা এবং বাগদত্তা নেরিসা লাভ।

বব ব্লেয়ার; Source: nzcricketmuseum.co.nz

নিজের দেশে এরকম এক দুর্ঘটনার পর নিউজিল্যান্ড দলের কারোরই আর খেলার ইচ্ছে ছিল না। সাথে দুর্ঘটনায় নিহতদের সম্পূর্ণ তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি তখনো। খেলা আর হবে কিনা এ নিয়েই যখন অনিশ্চয়তা, তখন দেশের মানুষের জন্য খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন নিউজিল্যান্ড ক্যাপ্টেন জিওফ র‍্যাবোন। ম্যানেজার জন কেরের সাথে বব ব্লেয়ারকে রেখে মাঠে গেল নিউজিল্যান্ড দল, পরিণত হলো ১০ জনের দলে। হোটেলে বব ব্লেয়ার শূন্য চোখে রেডিও টিউন করতে লাগলেন বারবার। মাঠে নিউজিল্যান্ডের পতাকা রাখা হলো অর্ধনমিত।

খেলা শুরু হতেই আগের দিনের সাথে আর মাত্র ১৩ রান যোগ করেই ২৭১ রানে অলআউট হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা।

জোহানেসবার্গের পিচ সিমারদের সাহায্য করছিলো আগে থেকেই। সেই পিচে এবার গোলাবর্ষণ শুরু করলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নিল অ্যাডক আর ডেভিড আয়রনসাইড। বিশেষ করে অ্যাডকের বলে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের। অবশ্য ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা একজন বোলারের গুড লেংথের বল যদি লাফিয়ে উঠে শরীরে আঘাত হানে, তখন আসলে ব্যাটসম্যানদের তেমন কিছু করার থাকেও না। চোখের পলকে র‍্যাবোন আর চ্যাপেলকে হারিয়ে নিউজিল্যান্ডের স্কোর হয়ে গেলো ৯/২।

এরপরে মাঠে নামলেন বার্ট সাটক্লিফ। অ্যাডকের দুটো বল ঠেকালেন। তৃতীয় বল লাফালো, হুক করতে চাইলেন সাটক্লিফ। কিন্তু বল লাফিয়ে আঘাত করল সাটক্লিফের কানে। সাথে সাথে দুই ভাগ হয়ে গেল কান, রক্তপাত শুরু হলো অবিরামধারায়। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সাটক্লিফকে।

এদিকে ‘গোলাবর্ষণ’ চলতে লাগলো সমানে। ২৪ রানে তৃতীয় উইকেট পড়ার পরে ক্রিজে আসলেন লরি মিলার। আসার সাথে সাথে অ্যাডকের আক্রমণ, তার বল লাগলো মিলারের বুকে। থুথুর সাথে রক্ত নিয়ে হাসপাতালে সাটক্লিফের সাথে যোগ দিলেন তিনিও।

নিউজিল্যান্ড তখন ২৪/৩ বটে, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, নিউজিল্যান্ডের দুজন প্লেয়ার তখন হাসপাতালে, আর একজন হোটেলে।

কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ কানে না তুলে মাঠে ফিরলেন লরি মিলার। জন বেক আউট হওয়ার পরে যখন তিনি মাঠে যখন ঢুকছেন, তখন ২৩০০০ দক্ষিণ আফ্রিকান দর্শক তাকে দেখে হইহই করে উঠলো। যেন ফিরে এসেছেন কোন দিগ্বিজয়ী বীর! স্কোর তখন ৫৭/৫। ফিরে ফ্রাঙ্ক মুনির সাথে যোগ করলেন ২৪ রান। তারপর আউট হয়ে গেলেন আয়রনসাইডের বলে।

লরি মিলার; Source: cricketcountry.com

স্কোর ৮১/৬। ফলোঅন এড়াতে তখনো দরকার ৪০ রান, হাতে আছে আর মাত্র ২ উইকেট।

ফ্রাঙ্ক মুনি অপেক্ষা করছিলেন টনি ম্যাকগিবনের জন্য। কিন্তু এই সময় তাকে অবাক করে বিশাল এক ব্যান্ডেজ মাথায় বেঁধে মাঠে নামলেন বার্ট সাটক্লিফ। শোনা যায়, সাটক্লিফকে নামতে নিষেধ করেছিলেন অধিনায়ক র‍্যাবোন। সাটক্লিফের জবাব ছিল,

‘স্কোরবোর্ডটা দেখো একবার।’

মিলারকে নামতে দেখে হইহই করে উঠেছিলো পুরো স্টেডিয়াম। সাটক্লিফ ফিরে আসায় দর্শকরা উঠে দাঁড়ালো তার জন্য।

সকল ব্যথা তুচ্ছ যখন; source: cricketcountry.com

সাটক্লিফের প্ল্যান ছিল খুব সাধারণ। অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। সবুজ এই পিচে রান তোলা খুব কঠিন। তার মানে, সামনে আর একটা উপায়ই খোলা আছে।

প্রথম দুই বল একটু ঠেকালেন। তারপরেই শুরু করলেন হাত খুলে মার। ফ্রাঙ্ক মুনির সাথে ৫৭ রানের জুটি গড়তে সময় নিলেন মাত্র ৪০ মিনিট। ফলোঅনের শঙ্কা দূর হলো নিউজিল্যান্ডের।

স্কোর তখন ১৩৮। ১৩৮ থেকে ১৫৪ রানের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেল নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং লাইন আপে। ১৩৮ রানে গেলেন মুনি, ১৪৬ রানে গেলেন ম্যাকগিবন, ১৫৪ রানে গেলেন ওভারটন। ইনিংস শেষ। নিউজিল্যান্ড ১৫৪/৯। দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের সাথে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন সাটক্লিফ।

কিন্তু এ কী অবাক কান্ড! ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে মাঠে নামছেন বব ব্লেয়ার! তাকে দেখে দর্শকরা পর্যন্ত স্তব্দ হয়ে গেল।

হোটেলে বসে রেডিওতে খেলার খবর পাচ্ছিলেন বব ব্লেয়ার । দলের অবস্থা শুনে মাঠে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ম্যানেজারকে জানান তিনি। সাটক্লিফ ছুটে গেলেন তাঁর কাছে।

‘দলের এই অবস্থা শুনে আমাকে আসতে হলো।’

ভেজা কণ্ঠে উত্তর দিলেন বব। মাঠের যে তখন কী অবস্থা! ড্রেসিংরুমে চোখ মুছছেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা, মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের চোখও ভেজা। ব্লেয়ারের ব্যথায় ব্যথিত দর্শকরাও।

নন স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়ানোর আগে গ্লাভস দিয়ে একবার চোখ মুছে নিলেন বব। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজলেন, হয়তো প্রেমিকাকেই। কে জানে!

সাটক্লিফ আর বব, এই দুজন মিলে মাত্র ১০ মিনিটে তুললেন ৩৩ রান। এর মধ্যে হিউ টেফিল্ডের এক ওভারে ৩ ছক্কা মারলেন সাটক্লিফ।

টেফিল্ডের ওভারে ছক্কা মারার মুহূর্ত; Source: cricketcountry.com

শেষ পর্যন্ত বব ব্লেয়ারের আউটের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সাটক্লিফের বীরত্বগাঁথা। তবে তিনি অপরাজিতই থেকে গেলেন, মাত্র ১১২ মিনিটে ১০৬ বলে ৮০ রান। দক্ষিণ আফ্রিকা পেলো ৮৪ রানের লিড।

এরপর এই ম্যাচ নিয়ে বলার আর তেমন কিছু নেই। ব্যাটিংয়ে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট হয় ১৪৮-এ। ৮৪ রানের লিড মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২৩৩ রান। নিউজিল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে মাত্র ১০০ রানে অলআউট হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ জেতে ১৩২ রানে।

বব ব্লেয়ার(দাঁড়ানো অবস্থায় সবার মাঝে); Source: espncricinfo.com

ইতিহাস বলবে সাটক্লিফের কথা, যিনি মাথায় আঘাত নিয়েও ফিরে এসে খেলেছিলেন ৮০ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস। কিন্তু ইতিহাস বব ব্লেয়ারের কথা বলবে না, বলবে না প্রেমিকা হারানোর অসহনীয় এক মানসিক ব্যথা সহ্য করে নেমেছিলেন মাঠে, দলকে বাঁচাতে। শারীরিক আঘাত দেখা যায়, দেখা যায় বলেই তা নিয়ে গৌরবগাঁথা লেখা হয়। কিন্তু মানসিক আঘাতের কথা অনেকে জানতে পারে না, অথবা জানতে চায় না।

তাই রক্তাক্ত সাটক্লিফ লাইমলাইটে এলেও নীরবে-নিভৃতেই থেকে যান বব ব্লেয়ার।

Featured Image: nzhistory.govt.nz

References: The sources are hyperlinked in the article

Description: This is a Bangla article about an unknown bravado of Newzealand cricketers.

Related Articles