Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিরাট কোহলি: দ্বিতীয় শচীন নাকি প্রথম কোহলি?

খেলার মাঠের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা তার উগ্র উদযাপন- যেটাই হোক না কেন, তার জন্য হয়তো আপনি তাকে অপছন্দ করতেই পারেন। তবে যদি একজন ক্রিকেটপ্রেমী হন, তবে আপনি এটি মানতে বাধ্য যে, বর্তমান সময়ের ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন বিরাট কোহলি।

বিশ্বকাপ জয়ের পর কোহলির কাঁধে ক্রিকেটের কিংবদন্তী; Source: ABC

উত্থানের গল্প

১৯৮৮ সালের ৫ নভেম্বর দিল্লীর এক পাঞ্জাবী পরিবারে বিরাটের জন্ম। বাবা প্রেম কোহলি ছিলেন পেশায় আইনজীবী, মা সরোজ দেবী গৃহিণী। প্রেম-সরোজ দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বিরাট সবার ছোট। বাবা-মা আর বড় ভাই-বোনের সাথেই তার বেড়ে ওঠা। পরিবারের ভাষ্যমতে, বিরাটের বয়স যখন তিন বছর, তখন প্রথম সে ব্যাট-বল নিয়ে খেলতে থাকে। অবশ্য পরিবারের কেউ তাকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেনি। তবে কি তারা এটা আন্দাজ করেই নিয়েছিলে যে, এই ছেলে বড় হয়ে একদিন বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়াবে?

কোহলির বয়স তখন ৯ বছর। পাড়ার ক্রিকেটে তার দুর্দান্ত বিচরণ। এক প্রতিবেশী পরামর্শ দিলেন, ছেলের প্রতিভাকে এসব গলির ক্রিকেটে নষ্ট না করে তাকে কোনো ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দাও। বাবা প্রেম কোহলিও মনে মনে সেটাই চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাকে ওয়েস্ট দিল্লী ক্রিকেট একাডেমিতে কোচ রাজকুমার শর্মার অধীনে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই ক্রিকেটে বিরাটের হাতেখড়ি।

আশিস নেহরার কাছ থেকে পুরস্কার নিছেন কোহলি; Source: India.com

২০০২ সালের পলি উমরিগার ট্রফিতে দিল্লী অনূর্ধ-১৫ দলের হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরাটের ক্রিকেট যাত্রা শুরু। সেই টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। পরের বছর নেতৃত্বের ভার এসে পরে বিরাটের ওপরেই। ২০০৩ সালে একবার একাডেমির ক্রিকেটের এক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হয়ে আসেন ভারতীয় ক্রিকেটার আশিস নেহরা। সেসময় নেহরা ছিলেন ভারতীয় দলের নিয়মিত মুখ। সেই টুর্নামেন্টে ভালো করার বদৌলতে নেহরার হাত থেকে পুরস্কার নেয় সেই ছোট্ট বিরাট। তার ঠিক এক যুগ পর বিরাটের নেতৃত্বে ভারতীয় দলে খেলেন আশিস নেহরা।

২০০৪-০৫ মৌসুমে অনূর্ধ-১৭ দলের হয়ে বিজয় মারচেন্ট ট্রফিতে ৭ ম্যাচে ৭৫৭ রান করেন বিরাট, যা ছিল টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে লিস্ট-এ ক্রিকেটে দিল্লীর হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। সে বছরই অনূর্ধ-১৯ দলে ডাক পান। নভেম্বরে তামিলনাড়ুর বিপক্ষে খেলার সু্যোগ পান। তবে সবার নজরে আসেন ঠিক তার পরের মাসেই। ২০০৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তার বাবা চলে যান না ফেরার দেশে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরের দিনই কর্ণাটকের বিপক্ষে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। সেই ম্যাচে বিরাটের ব্যাট থেকে আসে ৯০ রান। আউট হওয়ার সাথে সাথেই চলে যান বাবার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে। বাবার মৃত্যুর তারিখটি স্মরণীয় রাখতেই বিরাট ১৮ নম্বর জার্সি পরিধান করেন। এই জার্সি পরে যখনই খেলতে নামেন, তখনই তিনি অনুভব করেন, বাবা যেন তার সাথেই আছেন।

কৈশোরে; Source: HelloTravel

২০০৮ সালে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন বিরাট। ডি এল মেথডে দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ-১৯ দলকে ১২ রানে হারায় ভারত। সেই টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ছিলেন বিরাট। সে বছরই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল র‍য়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু ত্রিশ হাজার ডলারে দলে ভেড়ায় তাকে। ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর শ্রীলংকার বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার।

ক্যাপ্টেন কোহলি

২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় বিরাটের। ২০১২-তে ভারতীয় ওয়ানডে দলের সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে ব্যর্থতার কারণে ধোনি টেস্ট থেকে অবসর নিলে অধিনায়কের দায়িত্ব পান বিরাট। ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব পেয়ে বিরাটের ব্যাট যেন আরো বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। অবশ্য অধিনায়ক হওয়ার পর মাঠে তার আচরণেও অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব পেয়ে বিরাটের ব্যাট আরো বিধ্বংসী হয়ে ওঠে; Source: Pinterest

টেস্ট ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন হিসেবে অভিষেক হওয়ার পর ক্যারিয়ারের প্রথম তিন ইনিংসেই বিরাট তুলে নেন সেঞ্চুরি। প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে বিদেশের মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটি তারই। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়েই একমাত্র খেলোয়াড় ও অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে টানা ৪টি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড করে ফেলেছেন তিনি।

আইপিএল ক্যারিয়ার

২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুতে যোগ দেন বিরাট। ২০০৯ সালের ফাইনালে ডেকান চার্জারসের কাছে হেরে যায় তার দল। অবশ্য গেইল, ডি ভিলিয়ার্সদের মতো তারকাদের দলে ভেড়ালেও শিরোপার মুখ এখনও দেখা হয়নি আরসিবির। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে যে কোহলির কোনো সেঞ্চুরিই ছিল না, সেই কোহলিই গত আসরে চারটি সেঞ্চুরি করেন আইপিএলে। এ পর্যন্ত ১৪৯টি আইপিএল ম্যাচ খেলে তার সংগ্রহ ৪,৪১৮ রান।

রয়েল চ্যালেঞ্জারস ব্যাঙ্গালুরু; Source: IPLT20.com

অর্জন ও মাইলফলক

ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান বিরাট কোহলি, ৫২ বলে তুলে নিয়েছিলেন সেই শতকটি। বিশ্বের দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে আট ও নয় হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। দ্রুততম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এক, পাঁচ, ছয় ও সাত হাজার রান করার রেকর্ডটিও তার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩০টি সেঞ্চুরি করার ক্ষেত্রেও তিনি দ্রুততম, আর টি-টুয়েন্টিতে হয়েছেন দ্রুততম সময়ে এক হাজার রানের মালিক। ২০১০-১৬ সাল, এই সময়টুকুতে ভারতীয় খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ রানের অধিকারী তিনি।

দুর্দান্ত সব রেকর্ডের মালিক তিনি; Source: Vipin Pawar / BCCI / SPORTZPICS

২০১২ সালে ‘আইসিসি ওডিআই প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত হন বিরাট। ২০১১-১২ আর ২০১৪-১৫ সালে বিসিসিআই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কারও আছে তার ঝুলিতে। ২০১৩-তে পান অর্জুন পুরস্কার। আর ২০১৭ সালে বিরাটকে সম্মানিত করা হয় ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করে।

মাঠের বাইরের বিরাট

মাঠের ভেতরের উগ্রতা, দৃঢ়তা, বদমেজাজ এগুলোর বাইরে যে বিরাটের এক বিশাল হৃদয় রয়েছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। ২০১৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিরাট কোহলি ফাউন্ডেশন। জনসচেতনতা সৃষ্টি, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কাজ করে এ সংগঠন। ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে সংগঠনের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বলিউড সুপারস্টার এবং ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। সেখানে কোহলি নেতৃত্ব দেন All hearts FC দলের হয়ে। বিপক্ষ দল All Stars এ খেলেন বলিউড তারকারা। ২০১৭ সালের আইপিএল চলাকালীন ডা. অপর্ণা দেশমুখ পরিচালিত পুনের একটি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করেন বিরাট। সেখানে অর্থ সহায়তাও করেন তিনি।

গত বছর স্টার ইন্ডিয়া এবং বিসিসিআই এর উদ্যোগে ‘নায়ি সোচ’ নামে একটি কর্মসূচির আয়োজন করা হয়, যেখানে একজন সন্তানের বড় হওয়ার পেছনে তার মায়ের ভূমিকা এবং অবদান বর্ণনা করা হয়। অক্টোবরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে সব ভারতীয় খেলোয়াড় নিজেদের মায়েদের নাম সম্বলিত জার্সি গায়ে খেলতে নামেন। এর আগে এটি নিয়ে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়। সেখানে বিরাট জানান, “আমি যতটা কোহলি, ঠিক ততটাই সরোজ।

জার্সিতে তাদের মায়ের নাম লেখা; Source: Surjeet Yadav/IANS

ভারত-পাকিস্তান এর বৈরি সম্পর্কের মাঝে বিরাট যেন সৌহার্দ্যের দূত। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ১৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজয়ের কিছুদিন পরই নিজের স্বাক্ষর করা একটি ব্যাট শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশনে দান করেন বিরাট। এর আগে আফ্রিদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিলে ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর সম্বলিত কোহলির ১৮ নম্বর জার্সি তাকে উপহার দেওয়া হয়।

বিশ্বের সবচয়ে ধনী ক্রিকেটারদের তালিকাতেও নাম লিখিয়েছেন বিরাট কোহলি। কোহলির ব্র্যান্ড ভ্যালু বর্তমানে প্রায় ৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নামিদামি ২০টিরও অধিক কোম্পানির সাথে চুক্তি রয়েছে তার। ব্যবসায়ী হিসেবেও খুব একটা কাঁচা নন তিনি। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এফসি গোয়া টিমের, ইন্টারন্যাশনাল প্রিমিয়ার টেনিস লিগে ইউএই রয়েলস এবং প্রো রেসলিং লিগে  ব্যাঙ্গালুরু ইয়োধাস এর সহ-মালিকানা রয়েছে তার নামে।

বিরাট কোহলি-আনুশকার প্রেম বিনোদন জগতের শীর্ষ খবরের একটি হয়ে ছিল বেশ ক’বছর ধরে। ২০১৩ সালে একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দুজনের পরিচয় হয়। গত ১১ ডিসেম্বরেই তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন।

জড়ালেন বিয়ের বাঁধনে; Source: timesnownews.com

৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কোহলির সেঞ্চুরির সংখ্যা ৫১টি। শচীনের বহু রেকর্ড তিনি ভেঙেছেন ইতোমধ্যে। অনেকে তার মধ্যে শচীনের ছায়া খুঁজে পান। হয়তো শচীনের সর্বোচ্চ রান এবং সেঞ্চুরির রেকর্ডটি তিনিই একসময় ভাঙবেন। তবে তার জন্য এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বিরাটকে। অবশ্য নিজেকে কখনো শচীনের সাথে তুলনা করেন না তিনি। তার মতে, শচীনের মতো হওয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। ভক্তদেরও তিনি শচীনের সাথে তাকে তুলনা করতে নিষেধ করেন। ‘দ্বিতীয় শচীন’ শব্দটি শুনলে তার নাকি অস্বস্তিই লাগে। নিজের মতো খেলতেই ভালোবাসেন তিনি। পরিশ্রমী বিরাটের প্রিয় ফুটবলার তার মতোই আরেকজন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। দারুণ স্টাইলিশ ব্যাটিং আর ধারাবাহিক পারফর্মেন্স দিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় শচীন নন, বরং নিজ নামেই অবস্থান গড়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন বিরাট।

ফিচার ইমেজ- Danish Siddiqui/Reuters

Related Articles