Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যার কবজির মোচড়ে মোহাবিষ্ট হয়েছিলো বিশ্ব

পরিসংখ্যানের মোটা খেরোখাতাটা টেনে নিয়ে যদি বসেন, তবে তাকে আপনার খুব একটা কেউকেটা গোছের কেউ মনে হবে না। গড়, রানসংখ্যা বা সেঞ্চুরিতে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন আরো কতজন। রেকর্ডের পাতায় ভূঁড়ি ভূঁড়ি ক্রিকেটার আছেন, যারা এক তুড়িতেই তাকে পেছনে ফেলতে পারেন।

আধুনিক ক্রিকেটে ‘ক্রিকেটেইনমেন্ট’ হিসেবে জায়গা করে নেওয়া, ইন্টারন্যাশনাল টি-টোয়েন্টি তিনি একেবারেই খেলেননি। আইপিএল খেলেছেন বটে, তবে সেখানেও তথৈবচ। ওডিআই গড় মাত্র ৩০.৭৬ আর টেস্ট গড় ৪৫.৯৭। পরিসংখ্যান তো তার সাদামাটাই, নাকি?

টেস্ট রান সংখ্যা পেরোয়নি নয় হাজার (১৩৪ টেস্টে ৮,৭৮১ রান), ৮৬ ওডিআইতে রানসংখ্যাও মাত্র ২,৩৩৮। টেস্টে ১৭ সেঞ্চুরী আর ওডিয়াইতে ৬টা, সবমিলিয়ে ২৩টা মোটে আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। এমন একজন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে আপনার কি আগ্রহ হচ্ছে? হওয়ার কথা?

হয়তো হবে না। যদি আপনি কেবলমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে সেই ব্যাটসম্যানটিকে বিচার করেন, তাকে সরাসরি খেলতে দেখেছে এমন মানুষদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, দেখবেন ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের এক হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠবে, ‘আরে বোকার হদ্দ, পরিসংখ্যানটার কী সামর্থ্য যে ওকে বোঝায়!

একদম তাই। আসলেই তাঁকে বোঝানোর সামর্থ্য নেই বোকা পরিসংখ্যানের। তার পুরো নাম ভেংগিপুরাপ্পু ভেংকট সাই লক্ষ্মণ; সংক্ষেপে, ভিভিএস লক্ষ্মণ। ক্রিকেট বিশ্বের আদুরে ডাকে যা হয়ে উঠেছিল ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ লক্ষ্মণ!

ভিভিএস লক্ষ্মণ; Image Credit: Deccan Chronicle

১.

একদম গোড়া থেকে শুরু করি তাহলে।

তার ২২তম জন্মতিথির ক’দিন বাদেই সবচেয়ে গৌরবের আর আনন্দের সংবাদটা পেলেন তিনি। অবশেষে ভারতের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পাচ্ছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আহমেদাবাদ টেস্টে শ্বেতশুভ্র রঙের ফরম্যাটে অভিষেক হয়ে গেল তার। শুরুটা ভালো হয়নি, মাত্র ১১ রান করেই ডোনাল্ডের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে আউট হয়ে গেছেন। দলও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। অভিষেক-ক্ষণটা যে খানিক উপভোগ করবেন, সে সুযোগও পেলেন না। পরে দক্ষিণ আফ্রিকার পাল্টা জবাব শেষে ভারত পিছিয়ে রইলো ২১ রানে। দ্বিতীয় পালার ব্যাটিংয়ে তিনি যখন নামছেন, ৮২ রানে ৪ উইকেট খুঁইয়ে ধুঁকছে ভারত। একটু পর নেই দ্রাবিড়ও। লিড মাত্র ৭০, এর মধ্যেই ব্যাটিংয়ের অর্ধেক হাওয়া।

সেখান থেকেই শুরু হলো তাঁর প্রতিরোধ। প্রথমে সুনীল যোশী, আর পরে কুম্বলেকে সঙ্গী করে আস্তেধীরে দলের ইনিংসটা নিয়ে গেলেন এমন এক অবস্থায়, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তখন প্রস্তুত ভারত।

প্রায় তিন ঘন্টার ব্যাটিংয়ে ধৈর্য্যের চূড়ান্ত পরিচয় দিয়ে ৫১ রানের (সেই ম্যাচে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর এটাই) মহামূল্যবান ইনিংসটাতে নিজের স্পেশালিটির কিঞ্চিৎ ট্রেইলারই হয়তো দেখিয়ে ফেলেছিলেন! তখন কে আর ভাবতে পেরেছিলো, পরের দেড় দশকে ভারতের লোয়ার অর্ডার নিয়ে এক ব্যাটিং মহারথীর লড়াইয়ের সূচনা হলো মাত্র!

২.

অভিষেকের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেঞ্চুরি পাননি তখনও। ওপেনিং করেছেন, তিনে নেমেছেন, চারে খেলেছেন, কিন্তু সেঞ্চুরিটা সেই অধরাই রয়ে গেছে। কলকাতা টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতেই করেছিলেন ৯৫, সেটাই ক্যারিয়ারসর্বোচ্চ। ওদিকে ‘শূন্য’ দিয়ে ওডিয়াই পথচলা শুরু হলেও, সেখানেও নেই কোনো মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স। মাস দুয়েক আগেই ২৫তম জন্মতিথি পেরিয়ে এসেছেন, নতুন বছর শুরু হয়ে গেছে, নব্বই দশক থেকে পৃথিবীও পাড়ি দিয়েছে পরের দশকে। তিনিও কি পাড়ি দিতে পারবেন সময়ের সাথে নতুন এক যাত্রাপথে? চেনাতে পারবেন নিজেকে, নতুন করে?

আগের দুই দু’টি টেস্ট যাচ্ছেতাই গেছে তার, দলেরও। অ্যাডিলেড ও মেলবোর্ন পেরিয়ে ভারত তখন খেলছে সিডনিতে। প্রথম ইনিংসে সর্বসাকূল্যে স্কোর বোর্ডে উঠল ১৫০, লক্ষণ করলেন ৭ রান। যে পিচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা তল খুঁজে পাননি, সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে জাস্টিন ল্যাঙ্গার হাঁকালেন দ্বিশতক, আর পন্টিং প্রায় দেড়শো (অপরাজিত ১৪১)। স্টিভ ওয়াহ’র ‘খুনে’ অস্ট্রেলিয়া ভারতের লড়াইয়ের সব স্বপ্নকে খুন করে ইনিংস ঘোষণা করলো ৫৫২তে, লিড গিয়ে ঠেকলো ৪০২ রানে।

এরপর লড়াইয়ের আর কোনো উৎসাহ থাকে না নিশ্চয়!

কিন্তু তাঁর থাকলো। তিনি খেললেন তার জীবনের স্মরণীয় মাস্টারক্লাস। একপাশ থেকে টপাটপ উইকেট পড়ছে, আর অন্যপাশে তিনি নির্বিকার ভঙ্গিমায় স্ট্রোকচ্ছটায় আলোকিত করছেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের চারপাশ।

কী ছিল না সেই ইনিংসে! ড্রাইভ, কভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, পুল, ফ্লিক… কবজির মোচড়ের যে কী মাধুর্য! যেন কত্ত সহজ ব্যাটিং করা; চাইলেই বুঝি ব্রেট লি, ডেমিয়েন ফ্লেমিং, গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্নদের অমন তুলোধুনো করা যায়!

ক্যারিয়ারের শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে এমন নত হয়ে ফিরলেও, প্রথম সফরটা স্মরণীয়ই ছিল তার; Image Source: Cricinfo

১৯৮ বলে ২৭ চারে ১৬৭ রান করে ‘ভিভিএস’ যখন ফিরছেন, তখন এসসিজির গ্যালারী থেকে ভেসে আসছে একটানা হাততালি আর হর্ষধ্বনির আওয়াজ। সেই যে ক্রিকেট বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করলেন তার কবজির মোচড়ে, পরের একযুগ ধরে তা অকাতরে করে গেছেন অনেক অনেকবার।

৩.

তিনি কিন্তু ক্রিকেটার না হয়ে হতে পারতেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রও। তার বাবা-মা দুজনই হায়দরাবাদের বিখ্যাত ডাক্তার। তাঁর বাবা ডা. শান্তারাম এবং মা ডা. সত্যাবামা, কখনোই ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাননি। বরং বলে দিয়েছিলেন,

‘তোমার রক্তে ডাক্তারি আছে হয়তো, তবে চাইলে তুমি ক্রিকেটারও হতে পারো। তুমি তোমার মনের কথা শোনো। আমরা তোমার সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না।’

সপরিবারে লক্ষ্মণ; Image Credit: Getty Images

লক্ষ্মণও এটাই বলেছেন সবসময়। তার বাবা-মা তার কাছে ছিল সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তার জন্য সবচেয়ে সেরা আশীর্বাদ। ক্রিকেটার হওয়ার গল্পটা শুনিয়েছিলেন লক্ষ্মণ,

‘সেই নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটটা আজকের অবস্থায় ছিল না। তখন পেশা হিসেবে ক্রিকেট বেছে নেয়া খানিক কঠিনই ছিল বৈকি। বরং তার চেয়ে ডাক্তারি পেশা বেছে নেয়া ছিল হয়তো সহজ। ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলাম, মার্কসও ভালোই পেতাম। হয়তো মেডিকেলেও ভর্তি হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের ব্যাপারটাকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি।’

ক্রিকেটার হওয়ার পথে কৃষ্ণমোহন মামার অবদানও অস্বীকার করেন না তিনি। ভাগ্যিস, লক্ষ্মণের মামা আর বাবা-মা যথাযথ সহযোগিতাটা দিয়েছিলেন। নইলে ক্রিকেট যে কী হারাতো, ভাবা যায়?

৪.

তার সেই সিডনি ক্ল্যাসিকের পর বছর পেরিয়ে গেলেও দ্বিতীয় কোনো ক্ল্যাসিকের জন্ম তখনো দিতে পারেননি তিনি। তার প্রিয় প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া ঘরের মাঠে এলেও সুবিধা করতে পারেননি মুম্বাইয়ে প্রথম টেস্টে। দ্বিতীয় টেস্টের ভেন্যু কলকাতার ইডেন গার্ডেন।

স্টিভ ওয়াহ তখন সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক। যেখানেই তার পা পড়ে, অ্যালেক্সান্ডারের মতো সেই অঞ্চলই তার পদানত হয়। অজি পতাকার বিজয়োৎসব বাকি কেবল ভারতের মাটিতে, তাই স্টিভের জন্য ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ হিসেবে আবির্ভূত হলো এই ভারত অভিযান। মুম্বাইয়ে জিতে সেই পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া, বাকি দুই টেস্টের একটিতে জিতলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু কে জানতো, তখন স্টিভের ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ বিজয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন একজন লক্ষ্মণ?

অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৫ রানের জবাবে ভারত অলআউট হয়ে গেল ১৭১ রানে, ২৭৪ রানে পিছিয়ে থেকে পড়ল ফলোঅনে। দ্বিতীয় পালার ব্যাটিংয়ে নেমে ভারত ব্যাটিং অর্ডারে দেখালো চমৎকার মুন্সিয়ানা।

প্রথম ইনিংসে ছয় নাম্বারে নামা লক্ষণ ৯৭ রানে ৭ উইকেট হারানো ভারতকে ১৭১ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন, লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়েই। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে খেলেছেন ৫৯ রানের নান্দনিক ও স্ট্রোক-ঝলমলে ইনিংস। এর চেয়েও বড় কথা, ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ক্যাসপ্রোভিচ-ওয়ার্নদের খেলতে তার একটুও সমস্যা হয়নি। যেন এইসব বোলারদের খেলা কত্ত সহজ!

কোচ জন রাইট আর দলনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি মিলে নিলেন সময়ের অন্যতম সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। ভিভিএস লক্ষণকে দ্বিতীয় ইনিংসের ‘নাম্বার থ্রি’ স্পটটি দিয়ে দিলেন অবলীলায়। জন রাইট লক্ষ্মণকে ডেকে বললেন,

‘আমি তোমার ব্যাটিং দেখেছি ঘরোয়া ক্রিকেটে। তোমার মধ্যে সক্ষমতা আছে, সামর্থ্যের অভাব নেই মোটেও। নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, আর উপভোগ করো খেলাটা।’

রাইটের প্রশংসায় লক্ষ্মণ পরে বলেছিলেন,

‘একজন কোচ যখন এভাবে সাহস দেন, তখন আপনার আত্মবিশ্বাস অন্য চূড়ায় পৌঁছে যাবেই।’

তৃতীয় দিনে লাঞ্চের আগেই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা ভারত যেখানে তৃতীয় দিন পুরো খেলতে পারবে কি না তা নিয়েই সংশয় ছিল, সেখানে তারা ব্যাটিংয়ে নামলো পঞ্চম দিনেও! তৃতীয় দিনশেষে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাত্র বিশ রান পিছিয়ে থেকে লড়াইয়ের আভাস জানিয়ে রেখেছিলো তখনই; ভিভিএস ১০৯ আর দ্রাবিড় খেলছিলেন ৭ রান নিয়ে। পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়ালেও একটা উইকেটও পড়লো না। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের খাটিয়ে মেরে লক্ষ্মণ অপরাজিত আছেন তখন ২৭৫ করে, আর সঙ্গী দ্রাবিড় ১৫৫। বিহ্বল ও বিরক্ত স্টিভ ওয়াহ শেষ অবধি পন্টিং তো বটেই, এমনকি হেইডেন-ল্যাঙ্গার-স্ল্যাটারকে পর্যন্ত বোলিং দিয়েছিলেন। তবুও লক্ষ্মণের দৃঢ় কঠিন মনোসংযোগে আঁচড় পর্যন্ত কাটা যায়নি।

ইতিহাস গড়ে ফিরছেন লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড়; Image Credit: Getty Images

পঞ্চম দিন ভোরে লক্ষ্মণের ট্রিপল সেঞ্চুরি দেখার সুখস্বপ্ন চোখে এঁকে ভারতীয়দের ঘুম ভাঙলেও ২৮১তেই থেমে যায় একবিংশ শতকের রোমাঞ্চকর ধ্রুপদী অভিযাত্রাটা। এই একটা ইনিংস ক্রিকেটের গতিপথ বদলে রেখেছে অনেকটা ভূমিকা। আজকাল ফলোঅনের বদলে দলগুলো দ্বিতীয় পালার ব্যাটিং সেরে নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই একটা ইনিংস নিয়ে কত গল্পগাঁথা, কত কত মাহাত্ম্য-আলেখ্য। এক সামান্য বঙ্গসন্তানের কী সামর্থ্য তার ২৮১কে ঠিকঠাক তুলে ধরে!

পরের চেন্নাই টেস্ট জিতে, ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে যে ভারত সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে টেনে মাটিতে নামালো, সেখানেও লক্ষ্মণ খেলেছিলেন চতুর্থ ইনিংসে ৬৬ রানের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ আরেকটি ইনিংস। তার ‘বিশেষ’ সময়ে ‘বিশেষ’ ইনিংস খেলার সামর্থ্যের কারণেই হয়তো অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল ‘ভিভিএস’-য়ের অমন এক সার্থক পূর্ণ উদ্ভাবন করেছিলেন!

তাঁর ক্যারিয়ার জুড়ে এমন কত কত ইনিংস!

পঞ্চম দিনের ভাঙা ট্র্যাকে ম্যাচ জেতানো ইনিংস দরকার? লক্ষ্মণ আছেন। ম্যাচ বাঁচানো দরকার? কোনো সমস্যা নেই, লক্ষ্মণ আছেন। সবাই হাঁসফাঁস করতে করতে ফেরত গেছেন প্যাভিলিয়নে, কেউ নেই আর। তবুও আছেন লক্ষ্মণ। একা হাতে টেইল-এন্ড দিয়েই প্রতিপক্ষ থেকে ঠিক ম্যাচ বের করে নিতে আছেন তিনি। লক্ষ্মণ অসুস্থ, পায়ে বা হ্যামস্ট্রিংয়ে যন্ত্রণা হচ্ছে তার, কোনো সমস্যা নেই, ঠিকই ম্যাচ বের করে নেবেন তিনি।

যেমনটা অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন মোহালি টেস্টে।

উল্লাসের কারিগর মধ্যখানে, উচ্ছ্বসিত প্রজ্ঞান ওঝা; Image Source: cricket.com.au

জয় থেকে ৯২ রান দূরে থাকতে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলা ভারত ঠিকই ১ উইকেটে ম্যাচ জিতে নিয়েছিলো ভিভিএসের ৭৯ বলে অপরাজিত ৭৩ রানের কল্যাণে। অনেকটা এক পায়ে খেলেই ম্যাচ বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হতবিহ্বল পন্টিংয়ের চোখে-মুখে কোনো জবাব ছিল না। হয়তো ঘোর অমাবস্যা ঘনিয়ে আসা মুখে ভাবছিলেন, এই ভদ্রলোকটা কী আসলে?

৫.

লক্ষণ নিজেকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কী-ই বা ভাববেন নিজেকে?

শতাধিক টেস্ট খেলা ক্রিকেটার তিনি। প্রায় দেড়শ’ বছর বয়সী টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৬৬ জন ক্রিকেটারের গলায় এই বরমাল্য জুটেছে। তারই হায়দরাবাদের আরেক ক্রিকেটার কবজির মোচড়ে দুনিয়া মাতানো মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের ক্যারিয়ার থেমে গেছে ৯৯ টেস্টেই। তিনি ত্রয়োদশ সর্বোচ্চ টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ একটাও বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাননি!

কী অসম্ভব ব্যাপার!

তার চেয়ে নিরস কত ক্রিকেটারের ভাগ্যে বিশ্বকাপভাগ্য জুটেছে, অথচ তার ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময় দলে থিতু হতে পারেননি। আর ২০০৩ সালে থিতু হলেও সেবার বিশ্বকাপ দলে জায়গা হারালেন দীনেশ মঙ্গিয়ার কাছে। তখনই একবার আশংকা জেগেছিল মনে, তিনি হয়তো আর বিশ্বকাপ খেলতে পারবেন না। তার শঙ্কা সত্যি হয়ে তাকে চিরআক্ষেপের একটি জায়গায় বন্দী করে দিয়েছে ভাগ্য।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তিকালে; Image Source: Cricinfo

২০০৬ সালের পর আর একটিও ওয়ানডে খেলেননি। পরে শ্বেত পোষাকটাকে আরো রাঙাতে বিদায় বলে দেন রঙিন পোষাককেই।

অথচ ওডিআই ক্রিকেটেও কিন্তু তার কবজির মোচড়ে ঠিকই মোহাবিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লাহোরে সিরিজ-নির্ধারণী সেই পঞ্চম ওডিআইতে ম্যাচ জেতানো ১০৭ তো ছিলই, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চারটা সেঞ্চুরিই কি কম জৌলুসপূর্ণ ছিল? কিংবা ব্রিসবেন আর সিডনির সেই মাস্টারক্লাস?

হ্যাঁ, টেস্টের মতো সাদা বলের ক্রিকেটেও তাঁর প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়াই।

৬.

আমরা আমাদের আলোচনার শুরুতে ফিরে যাই।

পরিসংখ্যানের কি আদৌ সামর্থ্য আছে ভিভিএস লক্ষ্মণের ‘ব্যাটসম্যানশিপ’ বোঝাবে? সেখানে কি লেখা আছে সেই বিখ্যাত পার্থ টেস্টের ৭৯ রানের ইনিংসের মাহাত্ম্য? ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ৯৬, জোহানেসবার্গের ৭৩, কিংবা কলম্বোতে ৪র্থ ইনিংসের অপরাজিত ১০৩ ইনিংসকেই বা ব্যাখ্যা করবে কীভাবে? অ্যাডিলেডের ভীষণ চমৎকারিত্বের ১৪৮-কে কতটা তুলে ধরতে পারে ঐ বোবা পরিসংখ্যান?

পরিসংখ্যানে তো আদতে কিছু সংখ্যাই হিজিবিজি করে লেখা, ব্যাটসম্যানশিপ কই? কবজির মোচড়ের যে মোহাবিষ্টতা দর্শকের চোখে লেগে থাকে, সেই সৌন্দর্য্য কই? দলের চরমতম দুঃসময়ে যার ব্যাটে একই সঙ্গে দোল খায় প্রয়োজনের আবাহন আর নান্দনিকতার চূড়ান্ত উৎকর্ষতা, সেই দৃশ্যাবলী কই?

নেই। কিচ্ছু নেই।

বোবা পরিসংখ্যানটা কেবল ক’টা সংখ্যা দিয়ে সাজানো, সেখানে ক্রিকেটপিয়াসী মন রাঙানো কোনো গল্প নেই। তাই ভিভিএস লক্ষ্মণ পরিসংখ্যানের আবরণে যা-ই হন না কেন, একজন ক্রিকেটপিয়াসী মাত্রই জানেন, তাকে স্বচক্ষে দেখা দর্শকমাত্রই জানেন, ভদ্রলোক কেবলমাত্র আর দশজনের মতো কোনো ব্যাটসম্যান বা ক্রিকেটার নন। তিনি একজন ব্যাটিং মায়েস্ত্রো, একজন শিল্পী, একজন ‘কবজির মাস্টার’। যিনি ক্রিকেটের একটা সময়কে, একটা প্রজন্মকে, একটা সময়ের দর্শককুলকে মোহাবিষ্ট করেছিলেন, মোহগ্রস্থ করেছিলেন।

This article is in Bangla language. This is an article that is based on the biography of Vangipurapu Venkata Sai Laxman, commonly known as V.V.S. Laxman, a former Indian cricketer and currently a cricket commentator. He is known for his numerous match-winning and match-saving innings, and his special ability to consolidate unprecedented support from non-specialist tail-end batsmen to do unbelievable stuff. This has accorded him a unique status among cricketing legends.

Featured Image: Cricinfo

 

Related Articles