স্বভাবতই কিংবদন্তিদের তালিকায় নাম লিখিয়েও বিশ্বকাপের দুর্ভাগাদের তালিকায় নাম থাকবে ভারতীয় সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির। কারণ কলকাতার এই ‘দাদা’ ক্যারিয়ারে একবারও বিশ্বকাপ জয়ের সাধ পাননি। অধিনায়ক হিসেবে দারুণ সফলতা, ব্যাটে রানের ফোয়ারা তুলেও বিশ্বকাপে নিজের প্রতি প্রত্যাশার বাস্তবায়ন করতে পারেননি। মূলত জনপ্রিয় বলেই বিশ্বকাপে গাঙ্গুলির প্রতি থাকত প্রত্যাশার বাড়তি চাপ। ক্রিকেটে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন চাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও কেবল বিশ্বকাপটাই ঘরে আনা হয়নি তার।
সৌরভ গাঙ্গুলির পর ভারত জাতীয় দলে আর কোনো বাঙালি নিয়মিত হতে পারেননি। আবার এটাও সত্যি যে, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো খুব বেশি ক্রিকেটার ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরাও হতে পারেননি। সাবেক জাতীয় দলের এই অধিনায়ক অবসর নিয়েছেন আরও আগে, কিন্তু এখনও তাকে ঘিরে আলোচনার পারদ নামেনি। অবসরের পর কর্মক্ষেত্রের পরিধি বাড়িয়েছেন, চেপে বসেছে দায়িত্বের ভার। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের কর্তা, বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হওয়ার পাশাপাশি টুর্নামেন্টগুলোতেও থাকে তার অংশগ্রহণ। মাত্র শেষ হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ছিলেন দিল্লী ক্যাপিটালসের উপদেষ্টা। শুধু কি তাই? দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থা বিসিসিআই’য়ের বিভিন্ন আয়োজনে, প্রয়োজনে আর পরামর্শে গাঙ্গুলির ডাক পড়ে হরহামেশা।
আর বিশ্বকাপকে সামনে রেখে যখন বর্তমান ক্রিকেটারদের মুখ বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলো, তখন ডাক পড়ে সাবেকদের, বেড়ে যায় কদর। দল কেমন হলো, কাদের থাকা উচিত ছিল, কাদের নয়, কিংবা এবারের বিশ্বকাপে কারা কতদূর যেতে পারেন; এসব আলোচনা আর বিশেষণে মুখর হন কিংবদন্তি সাবেক ক্রিকেটাররা।
এবারের বিশ্বকাপে গাঙ্গুলির চোখে ফেবারিট তারই দল ভারত। বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি আর রোহিত শর্মাদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি ভারত এমনিতেও বিশ্বকাপ মাতাতে প্রস্তুত। তবে গাঙ্গুলির পছন্দের তালিকায় ভারত ছাড়াও সেমিফাইনালের জন্য হাতে রাখছেন ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে। চলতি মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে ভারত কতটা সুবিধা করতে পারবে, কিংবা দলের কোথায় কী পরিবর্তন করা যেত, কোন সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না, এগুলো নিয়ে সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। মাত্রই শেষ হওয়া আইপিএলে তার অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে।
এই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে চার নম্বরে কাকে ব্যাট হাতে দেখতে চান?
শুরুতে অবশ্যই বিজয় শঙ্করকে দেখতে চাইবো। কারণ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে সে যা করে দেখিয়েছে, তার পুরস্কার হিসেবেই বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছে। এমন তো না যে, শঙ্করকে হুট করে দলে নেওয়া হয়েছে। বিতর্ক-সমালোচনা থাকবেই, তারপরও আমি মনে করি ওর ব্যাটিং টেকনিক দারুণ, বড় আসরে পারফর্ম করার সেই মেধাটাও ওর মধ্যে আছে। পাশাপাশি ইংলিশ কন্ডিশনে ওর বোলিংও অনেক কাজে দেবে বলে মনে হয়। উইকেটে ও বলের সিম কাজে লাগাতে পারে, বলে বৈচিত্র্যও আছে ভালো। সবকিছু মিলিয়েই আমি ৪ নম্বরে বিজয় শঙ্করকে চাইবো।
কাগজে-কলমে এখনও মিডল অর্ডারের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ পাওয়া যায়নি। তারপরও আপনি কি লোকেশ রাহুলকে ৩ নম্বরে এনে বিরাট কোহলিকে ৪ নম্বরে দেখতে চাইবেন?
টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে এমন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের মূল শক্তিই হলো প্রথম তিন ব্যাটসম্যান। শিখর ধাওয়ান, রোহিত শর্মা আর বিরাট। যদি দু’জন প্রায় সব ম্যাচে খেলে, তাহলে ৪-৫ নম্বর পজিশন নিয়ে খুব অল্পই দুর্ভাবনা থাকবে।
বিশ্বকাপ দল থেকে ঋষভ পান্তকে বাদ দেওয়া নিয়ে আপনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন…
হ্যাঁ, সে অসাধারণ একজন ক্রিকেটার। অবশ্যই বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল তার। কিন্তু পান্তের জন্য এটা শেষ বিশ্বকাপ নয়, সে অনেকগুলো বিশ্বকাপ খেলতে পারবে বলে আমি মনে করি। সুযোগ না পাওয়ার ব্যাপারটাও সে মানিয়ে নিয়েছে বলেই আমি মনে করি। জাতীয় দলের হয়ে সে বেশ কিছু অসাধারণ ক্যাচ নিয়েছে, নজরকাড়া ব্যাটিং করেছে। তার মধ্যে নেতৃত্বগুণও আছে। এটা কেবল সময়ের ব্যাপার যে, ঋষভ পান্ত ভারতের হয়ে তিন ফরম্যাটেই দীর্ঘদিন খেলবে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট বিলিয়ে এসে অনেকবার সমালোচিত হয়েছেন পান্ত…
এগুলো আমাকে খুব একটা ভাবায় না। ক্রিকেটে কিছু সময়ে এমন হবেই, একটা সময়ে আপনিও শিখবেন। কিন্তু সে (ঋষভ পান্ত) ব্যতিক্রমী কিছু ইনিংসও খেলেছে। ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লীর উইকেট তাকে বিপদেও ফেলেছে। ব্যাটে বল আসাটা পান্ত দারুণ উপভোগ করে।
ক’দিন পরই বিশ্বকাপ। তার মধ্যেই ইনজুরি নিয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খেলে গেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আপনি কি এটা সমর্থন করেন?
দেখুন, ইনজুরির সময় কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, সেটুকু বোঝার ক্ষমতা ধোনির আছে। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে তুচ্ছ ব্যাপারেও অনেক কিছু হয়। কিন্তু ও (ধোনি) জানে, কীভাবে এগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে হয়।
আইপিএলে এবার কোন নতুন ক্রিকেটার আপনার নজর কেড়েছে?
শুভমান গিল, তার মধ্যে আপনি এক্স-ফ্যাক্টর দেখতে পাবেন। সে এবং পৃথ্বী শ অসাধারণ ক্রিকেটার। তাদের দুজনকেই আগামীতে জাতীয় দলের তিন ফরম্যাটে দেখতে পাচ্ছি।
কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম বলুন, যারা এবারের বিশ্বকাপে ব্যবধান গড়ে দিতে পারে…
আন্দ্রে রাসেল, কী অসাধারণ ফর্মে সে আছে! আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এবারের বিশ্বকাপে আন্দ্রে রাসেল, শেই হোপ, ক্রিস গেইল, ওশেন থমাস ও আরও কয়েকজনসহ এবারের উইন্ডিজ দল খুবই গুরুত্ব দিয়ে খেলবে, খুবই সিরিয়াস একটা দল হবে। আমি মনে করি, এবারের বিশ্বকাপে উইন্ডিজ হলো কালো ঘোড়া। আর তাই আন্দ্রে রাসেল বিশ্বকাপে অনেক বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে।
দিল্লী ক্যাপিটালসের কথা বলুন। এবারের আইপিএলে কেমন দেখলেন?
আমরা আইপিএলে যতটুকু করতে পেরেছি, তার জন্য সবার অংশগ্রহণ ছিল বলেই পেরেছি। ক্রিকেটাররা পর্যাপ্ত অনুশীলনের সময় পায়নি। এমনও হয়েছে, সরাসরি ম্যাচে নেমে যেতে হয়েছে। তো এটা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো ছিল। দলকে একটা জোনের মধ্যে রাখা, শিখর, পৃথ্বী, পান্ত, শ্রেয়স আয়ার, রাবাদা; সবাই মিলেই এটা করতে পেরেছে।
রিকি পন্টিংয়ের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আমরা দুজন খুবই ভালো বন্ধু। একটা সময় ছিল, যখন উইকেটে আমরা একে অপরের প্রতিপক্ষ ছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্ব বেড়েছে, নতুন উচ্চতায় গেছে। এবারের আইপিএলে দিল্লীর হয়ে সে ছেলেদের নিয়ে দারুণ কিছু কাজ করেছে। মাঠেও তার ফলাফল মিলেছে।
আপনি কি মনে করেন, রিকি পন্টিং ভবিষ্যতে ভারতের কোচ হতে পারেন?
এটা আপনাকে প্রথমে তাকেই (রিকি পন্টিং) জিজ্ঞেস করতে হবে। সে নিজের জন্মভূমি থেকে বছরের ৮-৯ মাস বিদেশে থাকতে তৈরি কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। কিন্তু হ্যাঁ, আপনি যদি তার সামর্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি বলবো নিঃসন্দেহে পন্টিং ভারতের প্রধান কোচ হিসেবে যোগ্য প্রার্থী।