‘আনপ্লেয়েবল’ শব্দটার সঙ্গে বাংলাদেশের চেনা-জানা অনেক দিনেরই।
সেই তো দেড় যুগ আগের এক সকালে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘আনপ্লেয়েবল’ হয়ে গিয়েছিলেন চামিন্দা ভাস, বিশ্বকাপ ম্যাচের স্কোরকার্ড হঠাৎই পড়া যাচ্ছিল হকি স্কোরকার্ডের মতো: ৪-৫। তার সতীর্থ মুত্তিয়া মুরালিধরনের রহস্যটা তো এই জন্মে ধরতেই পারল না বাংলাদেশ, ১১ টেস্টে দিয়ে এসেছে ৮৯ উইকেট। শুধু অমন নামে-ভারে ওজনদার বোলাররাই ত্রাস ছড়িয়েছেন, সেটাও নয়। ভারতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মোটে ১৪ ওয়ানডে, তারপরও স্টুয়ার্ট বিনির সেরা বোলিং অ্যানালাইসিস যে ৪ রানে ৬ উইকেট, তার পেছনেও তো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সামনে আচমকা তিনি ভিনগ্রহের বোলার হয়ে উঠেছিলেন বলেই।
বারবার এমন শিকার হওয়ার পর শিকারি হতে কেমন লাগে, বাংলাদেশ অবশ্য সেটা এখন ভালোই জানে। মোস্তাফিজুর রহমানের আদলে এমন এক ‘আনপ্লেয়েবল’ বোলারকে তো বাংলাদেশও পেয়েছে!
মোস্তাফিজকে খেলা যায় না: সত্যি নাকি মিথ্যা?
ব্যাটসম্যান ক্রিজে শুয়ে পড়ছেন, ব্যাট চালিয়ে বলের নাগাল পাচ্ছেন না, কিংবা বল মিস করছেন হরহামেশা… মোস্তাফিজের বলে এমন কিছু টিভি পর্দায় দেখে দেখে অভ্যস্তই হয়ে গেছে আপনার চোখ। কিন্তু মোস্তাফিজকে খেলা যে কতটা দুরূহ, তা সম্ভবত বোঝা যায় ওই তথ্যে, যে লেংথে বল করতে মানা করে টি-টোয়েন্টি বোলিংয়ের শাস্ত্র, সেই স্লট লেংথে টানা বল করেও মোস্তাফিজ তুলকালাম বাঁধিয়ে দিচ্ছেন দুনিয়ায়!
প্রমাণও তৈরি। প্রথম কথা হচ্ছে, কোন বলগুলোকে ‘স্লট বল’ বলা যাবে? পেস বোলারদের ক্ষেত্রে, স্টাম্প থেকে ৩-৬ মিটার দূরত্বে পড়া বলগুলোকেই ‘স্লট বল’ বলা হয়। ‘হিটিং আর্ক’ তৈরি সহজ বলে এই লেংথে বল ফেলা মানেই ব্যাটসম্যানের হাতে নির্ঘাত কচুকাটা হওয়া।
আইপিএলের তথ্য-উপাত্তগুলো সহজলভ্য বলে আশ্রয় খোঁজা হচ্ছে সেখানেই। দেখা যাচ্ছে, মোস্তাফিজুর রহমানের অভিষেকের পর থেকে স্লট লেংথের প্রথম অর্ধেকটায় (৩-৪.৫ মিটার) বল ফেলে বোলাররা রান বিলিয়েছেন ওভারপ্রতি ৯.৮৪ করে। আর পরের অর্ধটায় (৪.৫-৬ মিটার) বল ফেললে আরও একটু বেশি, ৯.৯৪ করে। কেবলমাত্র ফুলটস বল করেই বোলাররা ভয়ে থাকেন এর চেয়ে বেশি, যে লেংথে ওভারপ্রতি রান এসেছে ৯.৯৬ করে।
মোস্তাফিজ অনন্য এখানেই। ২০১৬তে নিজের অভিষেক আইপিএল মৌসুমে স্লটে বল ফেলে মোস্তাফিজ রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ৮.৫৬ করে। ২০২১ সালে তো আরও কম, মাত্র ৭.২৫ রেটে! কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে স্লটে বল করে এর চেয়ে কম রান দিয়েছেন কেবলমাত্র জসপ্রীত বুমরাহ আর অ্যান্ড্রু টাই। বুমরাহর মিতব্যয়িতার কারণটা তো বুঝতে পারা যায় খুব সহসাই, অ্যাকশনের কারণেই তার ইয়র্কার মিস হওয়া বলগুলোও ব্যাটসম্যানরা সীমানাছাড়া করতে পারেন না খুব একটা। আর টাইয়ের সাফল্যের মূল কারণটা ‘নাকল বল’, ব্যাটসম্যানরা সেই বলের জারিজুরি বুঝে ফেলতেই টাইয়ের সোনালি দিন তাই অতীত; ২০১৭ আর ২০১৮ সালে স্লটে বল করে যিনি রান দিয়েছিলেন বলপ্রতি এক করে, সেই তিনিই ২০১৯ সালে রান খরচা করেছেন ওভারপ্রতি ১৪.৬৫ করে।
ওপরের ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, মোস্তাফিজের যে বলগুলো স্লট লেংথের পেছনের অর্ধেকটায় পড়েছে, আইপিএলে সেখান থেকেই তার উইকেট সবচেয়ে বেশি। বাকি বোলারদের গড়ের চেয়ে ওভারপ্রতি ১.৫৭ করে কম রানও দিয়েছেন তিনি। আর ২০১৬ ও ২০২১ সালে তার ইকোনমি রেট তো আরও বিস্ময়কর, মাত্র ৭.৫!
একে তো বেশির ভাগ বলই করেন ডেথ ওভারে, তার ওপর ২৬ শতাংশ বলই ফেলেছেন স্লটে; তবুও যখন সাফল্যের সঙ্গে উতড়ে যাচ্ছেন, তখন তো মোস্তাফিজকে খেলা যায় না বলেই স্বীকৃতি দিতে হয়!
কেন মোস্তাফিজকে খেলা যায় না?
বেশি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে কি না, একটা ঝুঁকি অবশ্য থেকে যায়। তবুও মোস্তাফিজের বোলিং পরিকল্পনা কেমন, পরিসংখ্যানে তাকিয়ে তার একটা ধারণা নেওয়া যেতেই পারে। আইপিএলের পরিসংখ্যান টেনে দেখা যাচ্ছে, মোস্তাফিজের ভেতরের পেসার-সত্ত্বা ইয়র্কারের চেষ্টা করেছেন ২৭৫ বলে, এর ২৯ শতাংশ বলে সফলও হয়েছেন। তবে ইয়র্কারের চেষ্টায় ব্যর্থই হয়েছেন বেশি, ওই বলগুলো ফুল-টস কিংবা হাফ-ভলি হয়ে গেলে মারও খেয়েছেন, যদিও বাকিদের মতো নয়। আর তার লো ফুলটসগুলো মারাও সহজ কম্মো নয়, ৩টি ফুলটসে তো উইকেটও পেয়েছেন।
তবে মোস্তাফিজকে মোস্তাফিজ বানিয়েছে তার ‘স্পিনার-সত্ত্বা’। দেখা যাচ্ছে, ডেথ ওভারে বল করলেও গুড লেংথেই তিনি বল ফেলতে চেয়েছেন বেশি। এবং সেখানে বল করতেও যে তিনি ভয় পাচ্ছেন না, তার কারণ বল কিছুটা সামনে পড়ে স্লট বল হয়ে গেলেও রান নেওয়া যাচ্ছে না।
জসপ্রীত বুমরাহ, আরপি সিং, শোয়েব আখতারদের মতো ‘হাইপার-এক্সটেন্ডেড আর্ম’ নিয়ে জন্মেছিলেন বলে কিছুটা বাড়তি সুবিধা ঈশ্বরপ্রদত্তই ছিল। শোয়েব যেমন গতির জন্য, কিংবা বুমরাহ যেমন ব্যাটসম্যানের সামনে অদ্ভুত একটা কোণ তৈরির জন্য ব্যবহার করেন ওই সাহায্যটাকে, মোস্তাফিজ বাহুটাকে ব্যবহার করতেন বলে বাড়তি স্পিন যোগ করতে। পেসারদের মতো ব্যাকস্পিন নয়, বরং স্পিনারদের মতো ওভারস্পিনটাই তার তূণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
‘করেন’ না লিখে ‘করতেন’ কেন লেখা হচ্ছে, সে রহস্যটা তো আপনার জানাই। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটিয়ে পরের বছরই পড়েছিলেন কাঁধের চোটে, চিড় ধরেছিল তার সুপিরিয়র ল্যাব্রাম পেশিতে। দ্রুতগতিতে বল ছোড়ার কারণে যে চোটটা সাধারণত বেসবল পিচারদেরই হয়। কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কোচের দায়িত্ব সামলানো রিচার্ড হ্যালসলও যেমনটা বলেছিলেন।
‘যদি আপনি বেসবলের দিকে তাকান, অনেক পিচারেরই এ ধরনের চোট হয়। পিচারদের ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে থ্রো করতে হয়।’
প্রশ্ন হতেই পারে, ওরকম ৯০ মাইল গতিতে মোস্তাফিজ তো কখনোই বল করেননি টানা। তবুও মোস্তাফিজ চোটে পড়লেন কেন? উত্তরটাও খুব সহজ। কেবল গতিটাই তো মোস্তাফিজের বোলিংয়ের একমাত্র উপাদান নয়, বরং উইকেটে পড়ার পর তার বলগুলো যে বিচ্যুতি কিংবা ডেভিয়েশন আদায় করে নেয়, সেখানেই মোস্তাফিজ হয়ে ওঠেন ‘আনপ্লেয়েবল’। মোস্তাফিজের আসল ‘ফিজ’-ও লুকিয়ে সেখানেই।
নিচের গ্রাফটা লক্ষ্য করুন। উইকেটে পড়ে মোস্তাফিজের বল কতটুকু ডানে কিংবা বাঁয়ে সরেছে, সেটাই দেখানো হয়েছে সেখানে।
২০১৬-তে মোস্তাফিজের বেশির ভাগ বলই উইকেটে পড়ার পর ডান হতে বাঁয়ে অন্তত আধ মিটার বিচ্যুত হতো। কিছু কিছু বল তো প্রায় এক মিটার কাছাকাছিও সরেছে। সংখ্যাটা কত বড়, তা বোঝাতে স্টাম্পের সঙ্গে তুলনা দিলেই চলছে। স্টাম্পের প্রস্থ ০.২৩ মিটার, অর্থাৎ বলকে লেগ স্টাম্পের বাইরে ফেলেও অফ স্ট্যাম্পের বেশ কিছুটা বাইরে দিয়ে বল নেওয়ার সামর্থ্য ছিল মোস্তাফিজের। এত বেশি ডেভিয়েশন পাওয়ার পেছনে তো আর তুকতাকের হাত নেই, কাঁধের আর বাহুর জোরেই মোস্তাফিজকে সেটা আদায় করতে হতো।
চোট থেকে ফেরার পরে যা হয়েছে, মোস্তাফিজ তার কাঁধ আর কনুই ব্যবহার করছেন না আগের মতো, ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর স্বার্থেই। যে কারণে ওভারস্পিনও পাচ্ছিলেন না আগের মতো। মাঝের কিছুদিন তার বলে ডিপও কমে গিয়েছিল তাই।
তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ওই ডিপ আর ডেভিয়েশন যেন ফেরত এসেছে তার বলে। কাঁধ আর কনুই নয়, এবার ব্যবহার করছেন কবজি।
২০১৬ সালের মোস্তাফিজের সঙ্গে তুলনায় গেলে আমরা বুঝতে পারছি পরিষ্কার, এই মোস্তাফিজ কাটার দেওয়ার আগে কবজি বাঁকাচ্ছেন অনেক বেশি। আর যখন বল ছাড়ছেন, তখন অনেকটা দরজার গোল হাতল ঘোরানোর মতো করে হাতটা চালিয়ে দিচ্ছেন বলের ওপর দিয়ে। ফলে বলে ওভারস্পিনও পাচ্ছেন অনেক বেশি। ওভারস্পিনের কারণেই বলটা যে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আচমকা মাটিতে পড়ে যায়, ইংরেজিতে যাকে আমরা ডিপ বলি, সেটা নিশ্চয়ই জানা আছে আপনার।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনও যে এই কবজি বাঁকিয়ে আর সোজা করে (ইংরেজিতে বললেই ভালো শোনায়, ‘ককিং অ্যান্ড আনককিং’) বলে বাড়তি ডিপ আদায় করেন, তা জানিয়েছিলেন একবার। ব্যাটসম্যানকে বোকা বানাতে গেলে একই অস্ত্র ব্যবহার করছেন মোস্তাফিজও।
ডিপ আর ডেভিয়েশন মিলিয়ে মোস্তাফিজ ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে যান এখনো। কিন্তু ২০১৬ সালের মোস্তাফিজের সঙ্গে এই মোস্তাফিজের পার্থক্য হয়ে গেছে গতিতে। এখনকার মোস্তাফিজ ইচ্ছেমতো গতির হেরফের করতে পারেন না।
ওই মোস্তাফিজ আর নেই…
আর কিছু থাকুক কি না-ই থাকুক, এখনকার সব পেসারদের তূণে দুটো বল অন্তত আছে: ফাস্ট বল আর স্লোয়ার বল। স্লোয়ারের আবার অফ-কাটার, লেগ-কাটার, ব্যাক অব দ্য স্লোয়ার ধরন থাকলেও মোটা দাগে গতির পরিসীমাটা একই থাকে।
নিচের গ্রাফটা দেখুন। ডোয়াইন ব্রাভো, টাইমল মিলস, সন্দ্বীপ শর্মা আর জোফরা আর্চারের লেখচিত্রে দুটো চূড়া পাওয়া যাচ্ছে, যেখান থেকে স্লোয়ার এবং ফাস্ট বলগুলোর মাঝে পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। ব্রাভোর চেষ্টা করা স্লোয়ারগুলোর বেশিরভাগেরই গতি থাকে ১১০ কি.মির আশেপাশে, ১২০ কি.মির দিকটায় বলই করেন না তেমন। আর ফাস্ট বলগুলোতে গতি বেড়ে পৌঁছোয় ১৩০ কি.মির কাছে। বাকি যে তিনজনের কথা বলা হলো, তাদের লেখচিত্রটাও মোটামুটিরকম এমনই।
এবার মোস্তাফিজের গ্রাফটায় নজর দিন। ২০১৬ সালে যে মোস্তাফিজ এসেছিলেন, তিনি বলতে গেলে ১২০-১৪০ কি.মির মাঝে যেকোনো গতিতেই বল ছুড়তে পারতেন। অর্থাৎ, এই ২০ কি.মি সীমার মাঝে যেকোনো গতিতেই কাটার করার ক্ষমতা মোস্তাফিজ তখন রাখতেন। গ্রিপ দেখে কাটার বোঝাটাই কঠিন, সঙ্গে যদি যোগ হয় ‘কেমন গতিতে কাটার আসছে’ প্রশ্ন, সেটা ওই সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে ধরাটা কঠিন তো বটেই, মাঝেমধ্যে অসম্ভবও।
কিন্তু ২০২১ আইপিএলে এসে দেখা যাচ্ছে, মোস্তাফিজ যেন হয়ে গেছেন বাকিদের মতোই। স্লোয়ার আর ফাস্ট বলগুলোর মধ্যে ফাঁরাক স্পষ্ট। মাঝে আরও যে দুই আইপিএল খেলেছেন, সেখানেও অবস্থাটা মোটাদাগে এমনই ছিল। গ্রাফ থেকে বোঝা যাচ্ছে আরেকটা জিনিসও, এই ক’বছরে মোস্তাফিজ গতিও হারিয়েছেন বেশ কয়েক কি.মি।
গতি হারিয়েছেন নাকি ইচ্ছে করেই কম গতিতে বল করছেন, সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তোলা যায়। চোট সারিয়ে ফেরার পর মোস্তাফিজ তার কাঁধকে ব্যবহার করছেন না আর আগের মতো। তার দ্রুতগতির বলগুলোও তাই আর উইকেট থেকে ডেভিয়েশনও পাচ্ছে না আগের মতো। গতির সঙ্গে আপোষে গিয়ে উইকেটের সাহায্যটাই বেশি পেতে চাইছেন মোস্তাফিজ। তার ইকোনমি রেট জানার পরে কারণটা বুঝতে পারবেন আপনিও।
ওই মোস্তাফিজ আর নেই, কথাটা মুখ ফসকে কেউ বলে ফেললেও তাকে ঠিক ভুল বলা যাবে না। তবে আপনি তো এখন জানেনই, যে মোস্তাফিজে আমরা বাস করছি, সেই মোস্তাফিজ এলিয়েন না হলেও অতিমানবের চেয়ে কম কিছু না।
তাকেও খেলা যায় না।
*(সমস্ত পরিসংখ্যান ২০২১ আইপিএলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত)