যাকে জাগতিক অর্থে অর্জন বলে, সামান্য একটা জয় পাওয়া ছাড়া এসব দিনে আর কিছুই পাওয়ার থাকে না। সিরিজ জয়ের প্রশ্নটাও অবান্তর। তবে এসব দিনেই নাকি শুঁয়োপোকা থেকে কেউ কেউ প্রজাপতি হয়ে ওঠে, অনেক কাল ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকার পরে সে ম্যাচেই নাকি কয়েকজন লোকে ক্রিকেটার হয়ে ওঠে।
আফিফ হোসেন ধ্রুবও কি তাই হলেন? ক্যারিয়ারের গতিপথটা নতুন বাঁক নিল হারারের একটা ইনিংসেই?
না, মোটেই বিশাল কিছু করেননি, ৮১ বলে ৮৫ রানের একটা ইনিংসই খেলেছেন। তবে চাহিদামতো মঞ্চ পেলে যে বিশাল কিছু করে ফেলতে পারেন, এই ভরসাও তো যোগালেন। অবশ্য তার ক্যারিয়ার যারা গোড়া থেকে অনুসরণ করছেন, তারা এখানটায় এসে একটু আপত্তি জানাবেন। ভরসা যোগানোর কাজ তো বহুদিন থেকেই করছেন।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা সবে ১৯ ম্যাচ হলো। তবে এই কয় ম্যাচেই ৯২.৩২ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৪৩ গড়ে। কমপক্ষে ৫০০ বল মোকাবেলা করেছেন, এমন বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট পাওয়া যাচ্ছে মাত্র একজনের, সৌম্য সরকার। আর এর সঙ্গে গড়কে জুড়ে দিলে পেছনে পড়ে যাচ্ছেন সৌম্যও। সংখ্যাগুলো আরও বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে, কারণ নিজের পছন্দমতো পজিশনে তিনি নাকি খেলার সুযোগই পাননি।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ হওয়ার পরে আফিফ নিজেই বলেছেন, উইকেটে ব্যস্ত থাকতে, স্ট্রাইক বদল করে খেলতে পছন্দ করেন। কিন্তু তামিম ইকবালের দল তাকে যেখানে সুযোগ করে দিচ্ছে, সেখানে নেমে এই প্রান্তবদলের ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাওয়ার কথা সীমিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্যাম্পল সাইজটা এমনিতেই ছোট, তাতে ওপরে খেলার সুযোগ পেয়েছেন আরও কমসংখ্যক ম্যাচে। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ব্যাট হাতে নামা ১৬ ইনিংসের নয়টিতেই নামতে হয়েছে সাত নম্বরে। ক্যারিয়ারের তিন ফিফটির দু’টিই ওই পজিশনে ব্যাট করে, সংখ্যারেখায় বসালে গড়টাও ৫১-এর ডানদিকে।
তবে এই পরিসংখ্যানেই যদি বাংলাদেশ দলের সাত নম্বর জায়গাটা পরবর্তী বছরের জন্য লিখে দেওয়া হয় তার নামে, সেখানটায় ঘোরতর আপত্তি তোলা যাবে। কেননা, সাত নম্বরে কেউ ব্যাট করতে নামলে তার কাছে মুখ্য চাহিদা কী? ইনিংসের শেষ পর্যায়, পাঁচজন ফিল্ডার সীমানাদড়িতে দাঁড়ানো, সুতরাং গায়ের জোরে ছক্কা মারতে পারতে হবে। লিকলিকে গড়নের আফিফকে দেখলেই তো বোঝা যায়, শেষের ওভারগুলোতে মায়ের দিব্যি খেয়ে ব্যাট চালানোর সামর্থ্য ওই শরীরে নেই। সরল পরিসংখ্যানে তাকালেও এই দাবির সত্যতা মেলে। ১৯ ম্যাচের ক্যারিয়ারে চার মেরেছেন ৪৪টি, বিপরীতে ছক্কা মাত্র ৭টি।
আরেকটু তলিয়ে দেখতে গেলে পাওয়া যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে আফিফকে নামতে হয়েছে ৪০ ওভারের পরে। এবং, ওই ম্যাচগুলোতে আফিফের দেওয়া প্রতিদানের সংখ্যাগুলো এমন: ৭ (৪), ২৬ (১৭), ২৭ (২২), ১৩* (১২), ১৭ (১৩)। অর্থাৎ, শেষে গিয়ে এক ওভারে খেলা বদলে দেওয়াটা আফিফের সহজাত নয়।
সম্পূরক হিসেবে চলে আসছে এই প্রশ্নটাও, আফিফের জন্য তাহলে সহজাত কোনটা? উত্তরটা পাওয়া যাবে আফিফের দুটো শটেই। গতদিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪৬.২ ওভারে যেমন লেগ স্টাম্পেরও আধহাত বাইরের বল রিভার্স স্কুপে পাঠিয়ে দিলেন থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে। শর্ট থার্ডম্যানে দাঁড়ানো ফিল্ডারের বলটা সীমানার বাইরে থেকে কুড়িয়ে আনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
কিংবা এরপরের ৪৭.৬ ওভারের শটটা। ফাইন লেগ এবং স্কয়ার লেগের ফিল্ডার দুজনই বৃত্তের ভেতরে, বোলার অফ স্টাম্পের বাইরে বল করবেন বলে সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু আফিফ এই যুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। প্রায় অষ্টম স্টাম্পের বলটাকে কব্জির মোচড়ে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ বাউন্ডারিতে। চার।
পেশি শক্তি নয়, বরং ফিল্ড সেটআপকে নড়াচড়া করানোর এই খেলাটাই আফিফের জন্য সহজাত। ব্যাপারটা আরও গভীরে ঢুকে বুঝতে চাইলে পরিসংখ্যানেও ডুব দেওয়া যায়। যে ম্যাচগুলোতে আফিফ ৩৬তম ওভারের আগে নামতে সুযোগ পেয়েছেন, সেই ম্যাচগুলোতে তার গড় হয়ে যাচ্ছে ৪৮.২৫। যদিও এই ম্যাচগুলোতে স্ট্রাইকরেট গোটা ক্যারিয়ারের চাইতে ৬ কমেছে, তবে কাঁধে দায়িত্ব বর্তালে তিনি যে তা সুচারুভাবে পালন করতে পারবেন, সেটাও এই কয়েক ম্যাচেই বোঝা গেছে। খাদের কিনার থেকে বাংলাদেশ তো দুই ম্যাচে জামিনও পেল তার কারণে।
সামান্য যা সংশয়, সেটা স্পিনের বিপক্ষে তিনি কতটা কার্যকর হতে পারবেন, তা নিয়ে। মিডল-অর্ডারে ব্যাট করতে গেলে স্পিনের বিপক্ষেই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা দিতে হয় ব্যাটারদের। ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের কৌশল হিসেবে যেমন সবচেয়ে ভালো স্পিন খেলা ব্যাটারদের নিয়েই মিডল-অর্ডার সাজিয়েছিল ইংল্যান্ড, উইকেট না দিয়েও যারা ১১-৩৫ ওভারে স্পিনের বিপক্ষে রান করতে পারতেন প্রায় ৯০ স্ট্রাইক রেটে।
স্পিনের বিপক্ষে ১৩ ইনিংস ব্যাট করে আফিফ উইকেট হারিয়েছেন ৬ বার, বল-বাই-বল ডেটা পাওয়া যায় এমন ম্যাচগুলোতে ধীরগতির বোলারদের বিপক্ষে তার স্ট্রাইকরেট মোটে ৬৫.৩৮। কেবলমাত্র মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনের বিপক্ষে পরিসংখ্যানটাও বেশ মলিন, ওভারপ্রতি রান তুলেছেন ৩.৮৫ করে।
অফ স্পিনেই সবচেয়ে বেশি চারবার আউট হলেও এই প্রকারের বোলারদের বিপক্ষেই সবচেয়ে আক্রমণাত্মক দেখা গেছে তাকে। এবং, এই সংখ্যাটাও ওভারপ্রতি মাত্র ৪.২২ রান।
তবে আগেই বলা হয়েছে, আফিফের ক্যারিয়ারটা হাঁটি হাঁটি পা পা। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ ম্যাচেই খেলতে হয়েছে নিচু-মন্থরগতির উইকেটে, স্পিনারদেরই যেখানে রাজত্ব করবার কথা। এবং কিছুদিন এমন অবস্থাতেই ব্যাট করতে নামতে হয়েছে যে, তখন সম্মানজনক স্কোর গড়াই বড় চ্যালেঞ্জ। ঘরোয়া ক্রিকেটে তার রেকর্ড দেখাটাই তাই এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিচার করতে পারে, আক্ষরিক অর্থেই ব্যাটিং-অর্ডারে মাঝের কাণ্ডারি হবার সুযোগ সেখানেই তো পেয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে, সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ১২ ম্যাচে যে ৩৯০ বল খেলেছেন, তার ৭৩.৫ শতাংশই মাঝের ওভারে। এবং, ইনিংসের এই পর্যায়টায় তার স্ট্রাইকরেট ছিল ৮৯ ছাড়ানো। যদিও বেশি বল খেলেছেন বলে সবচেয়ে বেশি ছয়বার আউটও হয়েছেন ১১-৪০ ওভারের মাঝেই, গড় ছিল তাই ৪৩-এর মতো।
মিডল-অর্ডারে খেলেছেন বলে স্পিন বলই খেলতে হয়েছে বেশি। তবে, স্পিনের বিপক্ষের ভয়টা ডিপিএলের পরিসংখ্যানেও থেকে যাচ্ছে। লেগ-স্পিনারের আকাল বাংলাদেশে, পুরো মৌসুমে একটা বলও খেলতে পারেননি ওই ধরনের বোলারদের। আর ডানহাতি অফ স্পিনারের বলেই আউট হয়েছেন সবচেয়ে বেশি, পাঁচবার। এই জাতের বোলারদের বিপক্ষে মাঝের ওভারে গড়ও তাই সবচেয়ে কম, ২১-২২ এর মাঝামাঝি।
আফিফের খেলার একটা সুনির্দিষ্ট ধারা লক্ষ্য করা যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও, রান-বলের ব্যবধানটা খুব বেশি বাড়তে দেন না কখনোই। কিছুটা চাপে পড়লেই চার-ছক্কা মেরে চেষ্টা করেন বোলারকে উল্টো স্নায়ুচাপে ফেলতে। অফ স্পিনারদের বিপক্ষে বেশিবার আউট হওয়ার কারণটাও এই ধারাতেই বোধ হয় লুকিয়ে। মাঝের ওভারে অফ স্পিনারের বলে চারবার ক্যাচ দিয়েছেন বাউন্ডারি লাইনে, বল সরাসরি সীমানাদড়ির ওপারে ফেলতে চাইছিলেন কি না।
পরিসংখ্যানে যদি বিশ্বাস রাখেন, তো অফ স্পিনারদের বিপক্ষে ছক্কা মারার জুয়াতে আফিফের না যাওয়াটাই উচিত হবে আপাতত। তবে সমস্ত পরিসংখ্যান মেনে টিম ম্যানেজমেন্টকেও তো আফিফকে ওপরে ওঠানোর ঝুঁকি নিয়ে দেখতে হবে এর আগে। সাকিব আল হাসান ওপর থেকে আরও ওপরে উঠে যাওয়াতে বাংলাদেশের মিডল-অর্ডার এখন পুরোটাই ডানহাতি-সর্বস্ব। এবং এদের একজন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, পার করছেন দুঃস্বপ্নের মতো এক অধ্যায়। স্পিনারদের লাইন-লেংথে গুবলেট পাকাতে এই বাঁহাতি তাই হতে পারেন ব্রহ্মাস্ত্র।
কিন্তু, এতক্ষণ যে স্পিনের বিপক্ষে তার পরিসংখ্যানটা কেবল শঙ্কাই জাগাল? রাশিদ খান-মুজিবদের স্পিনজালই অবলীলায় এড়াতে পেরেছেন যিনি, পরিসংখ্যান নতুন করে লেখাটা তার জন্যে আর এমন কী!