আয়ারল্যান্ড সফরের আগের দিন। মাশরাফি বিন মুর্তজা শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলন করলেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্টেডিয়ামের আঙিনায় চিরচেনা আড্ডায় মুখরিত হলেন। কথার ফাঁকে তার বুকচেরা আফসোসটা বের হয়ে এলো হুহু করে,
‘ইশ! যা আছে, তার সাথে যদি একটা তেছরা বোলার (লেগস্পিনার) থাকতো! তাহলে দেখতেন।’
আক্ষেপটা বুক ভরে অক্সিজেন নিতে দেয় না। বারবার পোড়ায়। আক্ষেপটা যে বহু পুরনো! ২০১৫ এর পর শুরু হয়েছে ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বলা হচ্ছে, নিজেদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে এবার ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে গেছেন মাশরাফিরা। অভিজ্ঞতা, পারফরম্যান্স, সক্ষমতা – সব কিছু মিলিয়ে নিঃসন্দেহে এই দলই ইতিহাসের সেরা দল, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। প্রত্যাশার বাড়তি চাপও তাই অনেক বেশি। তার মধ্যে ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ে এমনিতেই আত্মবিশ্বাসের পারদ বেড়েছে বহুগুণ।
কিন্তু একজন লেগস্পিনারের অভাবটা যেন বারবার দলের বুকে মোচড় দিয়ে তুলছে। কারণ, দলে স্রেফ একটা পরিপূর্ণ লেগস্পিনার থাকলে দুইটি কাজ হয়। প্রথমত, দলের ব্যাটসম্যানরা কব্জির মোচড় ঘুরে আসা ঘূর্ণিপাক থেকে নিজেদের বাঁচাতে শিখে যান। দ্বিতীয়ত, ম্যাচে বোলার রান যতই খরচ করুক না কেন, ঠিকঠাক বড় উইকেটগুলো ঝোলায় বন্দী করে বসেন।
প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে যুযুবেন্দ্র চাহাল লেগস্পিনার হিসেবে সেটি করে দেখিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে রান খরচ করেও সেট ব্যাটসম্যানকে বিপাকে ফেলতে হয়। কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে আনতে হয়। অন্যদিকে, ব্যাট হাতে অফস্পিনার কিংবা পেস বোলিংয়ে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিলেও অসহায় হয়ে থেকেছে লেগস্পিনারের সামনে। তাই তো, মাশরাফির সেই আক্ষেপ ফিরে আসে আরও একবার।
নিজের দলে লেগস্পিনার না থাকার সমস্যা মাশরাফি কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি সাকিব-মিরাজদের অফস্পিন দিয়ে। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচেই বুঝে গেছেন, উপমহাদেশের ‘স্লো এন্ড লো’ উইকেটের মতো এখানে খুব সুবিধা অফস্পিনে পাওয়া যাবে না।
মাশরাফি বলেছিলেন,
‘ইংল্যান্ড কিংবা নিউ জিল্যান্ডে দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলোতে আমরা জানতাম যে, ব্যাটিং করা কঠিন। কিন্তু এখন দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলোতে প্রচুর রান হয়। আর বিশ্বকাপে আইসিসির চাওয়া থাকে ফ্ল্যাট উইকেট এবং প্রচুর রানের। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্বকাপে অনেক রানের ম্যাচ হবে। আর এমনিতেও বছরের এই সময়ে ইংল্যান্ডে অনেক রান হয়, সব দলের বোলারদের জন্যই চ্যালেঞ্জ। আমাদের কোনো লেগ স্পিনার নেই, এটা আমাদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য দলে যাদের আছে, তারা ব্রেক থ্রু দিয়ে দেয় মাঝখানে। রান করার সামর্থ্য যে আমাদের নেই, তা বলবো না। অতীতে হয়তো এরকম রেকর্ড খুব একটা নেই।’
প্রস্তুতি ম্যাচে চাহাল একাই তিন উইকেট নিয়েছেন। ফিরিয়েছেন ৭৩ রানের ইনিংস খেলা ওপেনার লিটন কুমার দাসকে, শূন্য রানে ফিরিয়েছেন মোহাম্মদ মিঠুনকে এবং ১৮ রানে থাকা সাইফউদ্দিনকে। অর্থাৎ, প্রয়োজনের সময় চাইলেই একজন লেগস্পিনার উইকেট এনে দিতে পারেন, মাশরাফির এই কথার হাতেনাতে প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছে ভারত।
পাকিস্তানের শাদাব খান, ভারতের চাহাল, ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, আফগানিস্তানের রশিদ; প্রত্যেকেই বিশ্বকাপে নিজ নিজ দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাদের সবাই লেগস্পিনার। তবে বাংলাদেশের এমন অবস্থায় ডানহাতি স্পিন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ দলকে সাহায্য করতে পারবেন বলে মন্তব্য করেছেন।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটা শক্তিশালী দল হিসেবে কেবল লেগস্পিনার বাদে সব আছে বাংলাদেশের। তাই তো পেসারদের সহায়ক হিসেবে নিজের কাজটা ঠিকঠাক করতে চান মিরাজ। নিজের অফস্পিন দিয়েই ভোলাতে চান লেগস্পিনের সমস্যা। মিরাজের ভাষায়,
‘একজন স্পিনার হিসেবে আমি মনে করি, ব্যাটসম্যানকে যেকোনো সময় আটকে ফেলা এবং পেসারদের সাহায্য করাটা এই কন্ডিশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি রানের গতি কমিয়ে দিতে পারি, তাহলে অন্যপাশ থেকে কোনো বোলারের পক্ষে উইকেট তুলে নিতে সহজ হবে। তো, বিশ্বকাপে একজন অফস্পিনার হিসেবে আমার লক্ষ্যই থাকবে ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখা।’
পরিকল্পনামতোই বিশ্বকাপে ইংল্যন্ডের উইকেটগুলো ফ্ল্যাট হচ্ছে। তাছাড়া, এখানকার স্টেডিয়ামগুলোও ছোট। মূল কথা, আইসিসি চেয়েছে যেন বেশি রান হয়। সেভাবেই হচ্ছে সবকিছু। এমন পরিস্থিতিতে একাধিক বৈচিত্র্যের কারণে অফস্পিনের চেয়ে লেগস্পিনে সুবিধা পাওয়া যায় বেশি। সেক্ষেত্রে লেগস্পিনার না হয়েও বোলিংয়ে বৈচিত্র্য কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উইকেট তুলে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চান মিরাজ।
এ প্রসঙ্গে তার ভাবনা,
‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবসময়ই চাপ থাকেই। আর আমি এবারের বিশ্বকাপকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমি দেখতে চাই, এই ধরণের কন্ডিশনে আমি কতটা ভালো করতে পারি। টিম ম্যানেজমেন্ট আমার উপর ভরসা করেছে, আমিও তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে চাই। যেহেতু দলে কোনো লেগস্পিনার নেই, আমি চেষ্টা করবো নিজের সেরাটা দিয়ে সেই অভাব পূরণের।’
মিরাজের এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার লড়াইয়ের শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি। ভারতের বিপক্ষে প্রস্ততি ম্যাচে ৫ ওভার বোলিংয়ে ছিলেন খরুচে। ইংলিশ কন্ডিশনে তার ঘূর্ণিবল ধার দেখাতে পারেনি। উপরন্তু খরচ করেছেন ৪০ রান! উইকেটশূন্যতাও ছিল না পাওয়ার অন্যতম সূচক। শুধু মিরাজ নন, বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান দু’টি উইকেট তুলে নিলেও রান দেওয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন উদার। ৬ ওভার বল করে তিনি দিয়েছেন ৫৮ রান।
সবকিছুই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে একজন লেগস্পিনারের অভাব টের পাওয়াচ্ছে। এমন নয় যে, বাংলাদেশে লেগস্পিনার নেই। কিন্তু লেগস্পিনার থাকার চেয়ে তাকে ‘রাখার’ প্রয়োজনটা খুব দেরিতে বুঝেছে বাংলাদেশ। লেগস্পিনের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো মার খাওয়া। সেই খরুচে স্বভাব মেনে নিয়ে যারা দলে লেগস্পিনার রাখতে পেরেছে, তারাই একটা সময়ে ফল পেয়েছে। কিন্তু ওই যে, খরুচে! অর্থাৎ, লেগস্পিনারকে বলা যায় একটা দলের সাদা হাতি, যার কেবলই পরিচর্যা প্রয়োজন। ফল কখন আসবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কালেভাদ্রে লেগস্পিনার পেয়ে যায়। যেমনটা পেয়েছিল জুবায়ের হোসেন লিখনকে। মূলত তৎকালীন কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে নিজ উদ্যোগে দলে একজন লেগির গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন। যেমনটা চাইতেন, তেমন মেধাও দেখেছিলেন লিখনের মাঝে। অন্যদিকে, ৬ টেস্টে ১৬ উইকেট, ৩ ওয়ানডেতে ৪ উইকেট আর একটি টি-টোয়েন্টিতে ২ উইকেট নিয়ে আস্থার প্রতিদানও দিচ্ছিলেন ক্রমশ। কিন্তু দল লিখনের মূল্য বুঝলেও বোঝেননি লিখন নিজে। খ্যাতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর খামখেয়ালিতে ২৩ বছর বয়সী ক্রিকেটার হারিয়ে ফেললেন নিজের পারফরম্যান্স, হারিয়ে ফেললেন নিজের ফিটনেস। অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত এমন হলো যে, ঘরোয়াতেও দল পাওয়া হয় না তার। লিখন অবশ্য শুধরেছেন, বদলেছে তার ফিটনেস, বদলেছে তার মানসিকতা। লিখন এখন অপেক্ষা করেন, কীভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া যায়। তাহলেই তিনি খুশি। অথচ, সবকিছু ঠিক থাকলে আজ সেই লিখনই হতে পারতেন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশের তুরুপের তাস।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে আশা দেখছে প্রায় সব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলের চোখে, বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম অভিজ্ঞ দল, সবচেয়ে ‘ইমোশনাল’ দল। হয়তো এই আবেগের জোরেই মাশরাফিরা পৌঁছে যেতে পারেন অনেকদূর। কিন্তু একটা বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে এলেও, টুর্নামেন্টজুড়ে একজন লেগস্পিনারের অভাব প্রতি ম্যাচেই পোড়াবে, তা নিশ্চিত।