সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে মানুষকে হলুদ-সবুজ কতগুলো বর্গাকার বক্সের ছবি এবং কিছু স্কোর শেয়ার করতে দেখছেন? এগুলো মূলত সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া নতুন একটি অনলাইন ওয়ার্ড গেমের স্কোর।
শব্দ ধাঁধা বা ওয়ার্ড গেম তো নতুন কিছু না। পত্রপত্রিকায় তো বটেই, ইন্টারনেটেও এগুলোর শত শত সংস্করণ আছে। কিন্তু তারপরেও এই বিশেষ গেমটির বৈশিষ্ট্য কী, যার কারণে এটি হঠাৎ করে এত আলোড়ন সৃষ্টি করল? চলুন জেনে নিই ওয়ার্ডল (Wordle) নামের এই গেমের আদ্যোপান্ত- এর উৎপত্তি, জনপ্রিয়তার রহস্য এবং ভবিষ্যত।
কী এই ওয়ার্ডল (Wordle) গেম?
ওয়ার্ডল মূলত একধরনের ওয়েবভিত্তিক শব্দ ধাঁধা। এর মূল আইডিয়া পত্রিকার শব্দধাঁধার মতোই। গেমটির ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রতিদিন মাত্র একটি করে শব্দ মেলাতে হয়। এবং প্রতিদিন বিশ্বের সবার জন্য এর একটিই সমাধান থাকে। প্রতি ২৪ ঘণ্টা পর পর নতুন শব্দ এসে হাজির হয়।
ওয়ার্ডল গেমটি তৈরি করেছেন ব্রিটিশ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জশ ওয়ার্ডল। জশের তৈরি এটাই প্রথম ওয়েবভিত্তিক গেম না। এর আগেও রেডইট সাইটে চাকরি করার সময় তিনি দুটি ওয়েব অ্যাপ বানান, যা মোটামুটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু এবারের ওয়ার্ডল গেমটি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
ওয়ার্ডল গেমটির প্রথম সংস্করণ জশ তৈরি করেন আরও আট বছর আগে, ২০১৩ সালে। কিন্তু সেসময় আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া না পাওয়ায় সেটার যাত্রা সেখানেই থমকে যায়। কিন্তু এরপর গত বছর মহামারীর মধ্যে জশ এবং তার সঙ্গিনী মিস পলক শাহ যখন সময় কাটানোর জন্য ঘরে বসে নিউ ইয়র্ক টাইমসের শব্দ ধাঁধা Spelling Bee এবং daily crossword puzzle সমাধান করতে শুরু করেন, তখন এগুলো তাদের নেশার মতো পেয়ে বসে।
সে সময় মূলত সঙ্গীনির সাথে খেলার জন্যই জশ তার সেই পুরনো ওয়ার্ড গেমটি নতুন করে তৈরি করেন। করোনার প্রভাবেই হোক, অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক, এবার তার তৈরি গেমটি বেশ ভালো সাড়া ফেলে। আত্মীয়-স্বজনদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গেমটি নিয়ে মতামাতি লক্ষ্য করে ২০২১ সালের অক্টোবরে জশ গেমটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। নিজের নামের (Wardle) বানান একটু পরিবর্তন করে তিনি গেমটির নাম দেন Wordle।
এবার মাত্র দু’মাসের মধ্যেই গেমটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। যে গেম তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে সময় কাটানোর জন্য, সেই গেম অর্জন করে নেয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা।
কীভাবে খেলতে হয় এই ওয়ার্ডল?
ওয়ার্ডল গেমে আপনাকে ছয়বারের চেষ্টায় পাঁচ অক্ষরের একটি ইংরেজি শব্দ মেলাতে হবে। এর জন্য ছয় সারিতে পাঁচটি করে বর্গাকার বাক্স দেওয়া আছে। কোনো রকম সূত্র ছাড়াই আপনাকে প্রথম সারিতে পাঁচ অক্ষরের একটি শব্দ অনুমান করে লিখতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রথম চেষ্টাতেই আপনি সঠিক শব্দটি অনুমান করতে পারবেন না। কিন্তু আপনার লেখা শব্দটির যে অক্ষরগুলো সঠিক শব্দটিতে আছে, সেগুলো হলুদ বর্ণ এবং যে অক্ষরগুলো সঠিক শব্দটিতে নেই, সেগুলো ধূসর বর্ণ ধারণ করবে। আর কোনো অক্ষরের অবস্থান যদি সঠিক শব্দটিতে থাকা ঐ অক্ষরের অবস্থানের সাথে মিলে যায়, তাহলে সেটি সবুজ বর্ণ ধারণ করবে।
যেমন ধরুন, কোনো একদিনের ধাঁধার সঠিক উত্তরটি হচ্ছে RIGHT। কিন্তু আপনি তো সেটা জানেন না। আপনি প্রথম চেষ্টায় অনুমান করে লিখলেন COURT। এখন আপনার প্রথম তিনটি অক্ষর C, O, U যেহেতু সঠিক উত্তরে নেই, তাই এগুলোর রং হয়ে যাবে ধূসর। অন্যদিকে চতুর্থ অক্ষর R যেহেতু আছে, কিন্তু ভুল অবস্থানে, তাই এর রং হবে হলুদ। আর শেষ অক্ষর T যেহেতু সঠিক অবস্থানেই আছে, তাই এর রং হবে সবুজ।
এবার এই সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় সারিতে, সেখান থেকে পাওয়া সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় সারিতে আরও ভালো অনুমান করতে পারবেন। এভাবে ছয়বারের মধ্যেই আপনাকে সঠিক শব্দটি অনুমান করতে হবে।
গেম শেষ হওয়ার পর আপনাকে কিছু স্কোর দেখানো হবে, যা আপনি কপি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে পারবেন। স্কোরটি হতে পারে এরকম: 202 4/6। এখানে 202 তথা প্রথম অংশটি হচ্ছে গেমের সিরিয়াল নাম্বার, আর 4/6 তথা দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে আপনি ছয়বারের মধ্যে কতবারের চেষ্টায় সমাধান করতে পেরেছেন, তার নির্দেশক।
ওয়ার্ডলের জনপ্রিয়তার রহস্য
জশ ওয়ার্ডল তার গেমটি ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করেছিলেন অক্টোবর মাসে। তখনও তার আত্মীয়-স্বজনের বাইরে বেশি কেউ গেমটি সম্পর্কে জানত না। নভেম্বরের ১ তারিখে মাত্র ৯০ জন ব্যবহারকারী গেমটি খেলেছিল। অথচ এর মাত্র দুই মাস পরে, জানুয়ারির ২ তারিখে গেমটি খেলে ৩ লাখ মানুষ! তার এক সপ্তাহ পরেই গেমটি খেলে ২০ লাখ মানুষ! জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে শুধুমাত্র টুইটারে গেমটির স্কোর শেয়ার করে ১২ লাখ মানুষ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এরকম গেম তো ইন্টারনেটে আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার আছে? তাহলে ওয়ার্ডলের এই জনপ্রিয়তার রহস্য কী? এর একটা ব্যাখ্যা জশ ওয়ার্ডল নিজেই দিয়েছেন। তার মতে, দিনে মাত্র একটা গেম খেলতে পারার ব্যাপারটা ব্যবহারকারীদের মধ্যে যোগানের স্বল্পতার অনুভূতির জন্ম দেয়, ফলে গেমটির প্রতি তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যদি দিনে যত খুশি ততবার খেলা যেত, তাহলে হয়তো ব্যবহারকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলত।
তবে এটাই ওয়ার্ডলের জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ না। কোনো অ্যাপ ইনস্টল না করতে হওয়া, পেজের ডিজাইন খুবই সিম্পল হওয়া, খুব বেশি কন্ট্রোল না থাকা, পেজে কোনো বিজ্ঞাপন না থাকা, রেজিস্ট্রেশন করার ঝামেলা না থাকা- এরকম অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার একত্রে গেমটি ব্যবহারকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
তবে গেমটি ভাইরাল হওয়ার পেছনে এককভাবে সবচেয়ে দায়ী যে ফিচারটি, সেটি হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় এর স্কোর শেয়ার করতে পারার ফিচার। শুরুতে ওয়ার্ডলে এই ফিচার ছিল না। কিন্তু নভেম্বরের শেষের দিকে নিউজিল্যান্ডের কিছু ব্যবহারকারী ইমোজি ব্যবহার করে তাদের স্কোর শেয়ার করার পর তা জশের নজরে আসে এবং তিনি ফিচারটি যুক্ত করেন। এর পরপরই মূলত গেমটি ভাইরাল হতে শুরু করে।
অধিকাংশ ওয়ার্ড গেমেই ফলাফল শেয়ার করলে মানুষ মূল উত্তরটাই জেনে যায়, এবং এর ফলে গেমের মজাটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওয়ার্ডলের স্কোর এমনভাবে শেয়ার যায়, যার ফলে সবাই বুঝবে সমাধানকারী কোন গেমটি ঠিক কত ধাপে, কী পদ্ধতিতে সমাধান করেছে, কিন্তু তারপরেও মূল উত্তরটি কেউই অনুমান করতে পারবে না। ফলে একইসাথে শেয়ার করার আনন্দ এবং রহস্য- দুটোই বজায় থাকে।
তাছাড়া হলুদ-সবুজ কতগুলো বর্গাকার বাক্স মানুষের মধ্যে আগ্রহেরও সৃষ্টি করে। যারা জানে না, তারাও কৌতূহলী হয়ে ওঠে- বিষয়টা কী? সবাই এই বাক্সগুলো কেন শেয়ার করছে? এগুলোর মানে কী? এই কৌতূহলও গেমটি জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছে।
ওয়ার্ডল-ম্যানিয়ার মধ্য দিয়ে অবশ্য শুধু গেমটি একাই ভাইরাল হয়নি। একই নামের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অ্যাপও এর মধ্য দিয়ে ভাইরাল হয়ে গেছে। শুধুমাত্র জানুয়ারির ৫ তারিখ থেকে ১২ তারিখের মধ্যেই অ্যাপটি ২ লক্ষবারের বেশি ডাউনলোড হয়েছে।
কী হবে ওয়ার্ডলের ভবিষ্যত?
ওয়ার্ডলের বিপুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস সাত অঙ্কের অর্থ দিয়ে গেমটি কিনে নেয়। গেমটি তারা নিজেদের অ্যাপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে অ্যাপটিকে আরও আকর্ষণীয় করতে চায়, যেন এর সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস অ্যাপটি কেনার পর ব্যবহারকারীদের মধ্যে ওয়ার্ডলের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিভিন্ন ফিচার ব্যবহার করার জন্য টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়। টাইমস কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে গেমটি সকলের জন্য ফ্রি থাকবে। কিন্তু এই “প্রাথমিকভাবে” শব্দটির ব্যবহারই ইঙ্গিত দেয়, ভবিষ্যতে হয়তো এটি আর ফ্রি থাকবে না।
অবশ্য ওয়ার্ডল যদি ফ্রি না-ও থাকে, তাহলেও খুব বেশি কিছু আসবে-যাবে না। প্রযুক্তিবিদ অ্যারন রাইকি তার এক টুইটে ব্যাখ্যা করেন, গেমটি মূলত ক্লায়েন্ট সাইড সার্ভার থেকে চলে। অর্থাৎ গেমটির সবগুলো ওয়ার্ডের তালিকা সম্পূর্ণ কোড ওয়েব পেজের সাথেই দিয়ে দেওয়া আছে, যা যেকোনো ব্যবহারকারী যেকোনো সময় দেখতে পারবে। এবং যে কেউ চাইলে ওয়েব পেজটি সেভ করে অফলাইনে বসেও খেলতে পারবে।
কাজেই নিউ ইয়র্ক টাইমস যদি গেমটিও সরিয়েও ফেলে, তবুও যারা পেজটি আগে থেকে নিজেদের কম্পিউটারে সেভ করে রাখবে, তারা ঠিক আগের মতোই প্রতিদিন একটি করে গেম খেলে যেতে পারবে এবং শেয়ার বাটনে ক্লিক করে সোশ্যাল মিডিয়াতে স্কোর শেয়ার করতে পারবে। আর গেমটিতে যেহেতু ইংরেজি পাঁচ অক্ষরের ২,৩১৫টি ওয়ার্ড দেওয়া আছে, তাই আগামী পাঁচ-ছয় বছরের জন্য গেমটির কোনো বিকল্প না খুঁজলেও চলবে।
তারপরেও অবশ্য মানুষ থেমে নেই। ইতোমধ্যেই আরবি, হিব্রু, টার্কিশ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ওয়ার্ডলের মতো গেম তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া ইংরেজিতেও অন্তত কয়েক ডজন হুবহু ওয়ার্ডলের মতো, কিংবা এর একটু পরিবর্তিত এবং বিকল্প সংস্করণের গেম জনপ্রিয় হয়েছে। মূল ওয়ার্ডল ফ্রি থাকুক বা না থাকুক, এই বিকল্প গেমগুলোও হতে পারে আগ্রহী পাঠকদের সৃজনশীল পদ্ধতিতে সময় কাটানোর বড় একটি মাধ্যম।
ওয়ার্ডলের এরকম আরও কয়েকটি বিকল্প গেম সম্পর্কে জানতে পড়ুন আমাদের আরেকটি আর্টিকেল – ভাইরাল গেম ওয়ার্ডলের যত বিকল্প!